সমাজদেহে ঘুণপোকার আক্রমণ by মর্জিনা আফসার রোজী
শত অবক্ষয়ের মতো জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থাও আজ পতনের দিকে এগিয়ে চলেছে। নীতি আদর্শবান শিক্ষক-শিক্ষিকারা হতাশার সাগরে নিমজ্জিত। তাদের বিবেক অনিয়মের বোঝা বইতে বইতে কান্ত-পরিশ্রান্ত। সমাজের সর্বত্রই যেন একটি অদৃশ্য সাইনবোর্ডে এই লেখাটি জ্বলছেÑ ‘দেখার কেউ নেই’। হত্যা, গুম, খুন ও নির্যাতনের জাঁতাকলে অসহায় নাগরিকদের প্রাণ ওষ্ঠাগত। দেশের এমন দৈন্যদশা চিরদিন ছিল না। এক সময় এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থা উন্নতি, সমৃদ্ধি আর পবিত্রতা নিয়ে শির উঁচু করে সগৌরবে অবস্থান করত। দেশী-বিদেশী, স্বজাতি, ভিনজাতি অনেকেই সে সময়ের শিক্ষার আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে বিকশিত হতে চেয়েছে। আজ শুধু দলকে মিথ্যা গৌরবে ভূষিত করার জন্য, কোটি জনতাকে বোকা বানিয়ে প্রতিপক্ষের কাছে মিথ্যা সাফল্য জারি করার নিমিত্তে শিক্ষাব্যবস্থার শক্ত মেরুদণ্ডটি ভেঙে খণ্ড খণ্ড করে দিয়েছে। তাতে যে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম, দুর্বল ভঙ্গুর শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে দেশের জন্য অপাঙক্তেয় হতে চলেছে, সে কথা ভাবার অবকাশ নেই। জাতীয় শিক্ষার অভ্যন্তরে দুর্নীতি প্রবেশ করায় আদর্শবান অভিজ্ঞ শিক্ষকেরা এ অবক্ষয় সহ্য করতে পারছেন না। গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত পাখির মতো ডানা ঝাপ্টাচ্ছে। অভিজ্ঞ বয়োজ্যেষ্ঠ এক শিক্ষক দগ্ধ হৃদয়ে ছলছল নয়নে বলেছিলেন, ‘আর শিক্ষকতা করতে মন চায় না। অনীহা ধরে গেছে এ পেশার ওপর। শিক্ষা নিয়ে এমন নোংরা রাজনীতি জীবনে কোনো দিন দেখিনি। বিবেককে গলা টিপে হত্যা করে অন্যায় করতে পারি না বলে এ বয়সেও কর্তৃপক্ষের কাছে অপমানিত হতে হয়। স্বচক্ষে কোমলমতি শিশুদের অন্ধকারে তলিয়ে যেতে দেখে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। সহ্য করতে পারি না। চরম অনিয়মই আজ নিয়মে পরিণত হয়েছে। নিজ হাতে বোর্ড পরীক্ষার সময় উত্তরে সহায়তা করতে হাত কাঁপে, বিবেক বাধা দেয়। তথাপি জীবন-জীবিকার তাগিদে এসব অন্যায় সওয়া ও করা দুটোই চলেছে। শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বারবার শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ডেকে নির্দেশ দেন, পরীক্ষার খাতা কড়াকড়ি করে দেখা যাবে না। যে পরীক্ষার খাতায় আট পাবে, তাকে দশ বানিয়ে দিতে হবে। কোনো পরীক্ষায় ফেল করানো যাবে না। ন্যূনতম লিখলেই ভালো নম্বর দিতে হবে। নির্ধারিত নম্বরের সবটাই প্রদান করতে হবে। ছাত্রছাত্রী পরীক্ষার খাতায় যা-ই লিখুক না কেন নম্বর দিতেই হবে। পরীক্ষা চলাকালে হলের গার্ড শিথিল দৃষ্টিতে দেখতে হবে। না পারলে শিক্ষার্থীকে বলে দিতে হবে। নকল করলে দেখেও না দেখার ভান করতে হবে। ছাত্রছাত্রীদের প্রয়োজনীয় শাসনও করা যাবে না। মোট কথা হচ্ছে, যা শিখুক না কেন সেটা তার নিজস্ব ব্যাপার; কিন্তু সরকারকে অধিক পাসের হার দেখাতে হবে। বাহবা কুড়াতে হবে। চলতি বছরে নিম্নমেধার ছাত্রছাত্রীরাও জিপিএ ৫ পেয়েছে। লাখের মতো জিপিএ ৫ দিয়ে অ প্লাস-এর সম্মান ভূলুণ্ঠিত করেছে। এবার নির্বাচনী পরীক্ষায় রাজধানীর একটি নামকরা স্কুলে সাধারণ গণিত পরীক্ষার দিন প্রশ্নপত্রে ৪০টি অঙ্কের মধ্যে ১২টি অঙ্কই ভুল ছাপা হয়েছে। কোনোটির + নেই, কোনোটির Ñ নেই, কোনোটির শব্দ ঠিক নেই। এতটাই অবহেলা ভরে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে যে, এর কোনো প্রুফ সংশোধন করা হয়নি। অর্থাৎ অনিয়মের তীব্র স্রোতে শিক্ষকেরাও গা ভাসিয়ে দিয়েছেন। অবশেষে ছাত্রছাত্রীদের প্রতিবাদের মুখে শিক্ষকেরা এ আশ্বাস প্রদান করেছেন যে, ওই ১২টি অঙ্কের পূর্ণ নম্বর সবাইকে প্রদান করা হবে। তাহলে বোর্ড পরীক্ষার আগে মেধা যাচাই হলো কী করে। শিক্ষাব্যবস্থায় এমন দশা বিবেকবান মানুষকে ক্ষতবিক্ষত করে। যেহেতু ঢেলে নম্বর দিতে হবেই, সেখানে আর যাচাই-বাছাই করার কী দরকার। বোর্ডের কর্র্তাব্যক্তিরা শিক্ষকদের ডেকে এনে নাকি শতভাগ পাস করানোর নির্দেশনা দেন। যদি কেউ অপারগতা প্রকাশ করেন তাকে ভর্ৎসনা করা হয়। যে শিক্ষকের বিবেক জাগ্রত হবে তাকে এ পেশা থেকে চলে যেতে হবে। স্কুলে টেস্ট পরীক্ষায় ফেল করেছে অথচ বোর্ডে গিয়ে জিপিএ ৫ পেয়েছে। ছেলেমেয়েরা পরীক্ষার হলে স্বেচ্ছাচারিতার পরিচয় দিলেও শিক্ষক শাসন করতে পারবেন না? তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্ররা পর্যন্ত মোবাইলে পর্নোগ্রাফি তুলে নিয়ে স্কুলে আসে তবুও শিক্ষকদের সংশোধন করার অধিকার নেই। নির্দেশনাটি এমন, অন্যের সন্তান যা করুক আপনাদের কী। সবকিছু দেখার দরকার নেই। আর দৃষ্টি পড়লেও বলার প্রয়োজন নেই। সহপাঠীর লেখা অনুসরণ করলে কিংবা সমাধানপত্র সাথে আনলেও বাধা দেয়া যাবে না। ল্যাপটপে উত্তর তুলে এনে প্রকাশ্যেই পরীক্ষা দেয়া যায়। গার্ডরা কি শুধু অসহায়ের মতো তাকিয়ে দেখবেন? বাধা দেয়ার ক্ষমতা নেই। শেষ পর্যন্ত শিক্ষকদের শাসন করার ক্ষমতাটুকুও হরণ করে নেয়া হচ্ছে। ৫ জানুয়ারি বাংলাদেশের গণতন্ত্রের চরম অমর্যাদা হয়েছে। মানুষ হারিয়েছে ভোট দিয়ে প্রতিনিধি নির্বাচন করার অধিকার। জেল, জুলুম, হত্যা, গুম করে রাজনৈতিক ভিন্নমত প্রকাশ করার অধিকার হরণ করেছে। এমনকি বিচারপতিদের পর্যন্ত সংসদ সদস্যদের কাছে দায়বদ্ধ করার চেষ্টা চলছে। মানুষ আজ নিজ ইচ্ছায় স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করতে পারে না। আর এ সুযোগে খুনি-সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য হয়েছে এ জনপদ। পেশাদার খুনিরা একটার পর একটা দুর্ঘটনা ঘটিয়ে কিছু দিনের জন্য গা ঢাকা দেয়। তারপর কিছুদিন অতিবাহিত হলে যে যার আগের কাজে ফিরে আসে। ভুক্তভোগীরা বিচার পায় না। আসল অপরাধী বরাবরই ধরাছোঁয়ার বাইরে অবস্থান করে। এ কথা ভাবতেও লজ্জা হয়, একজন মৃত মানুষের শেষ ইচ্ছা পূরণের বিপক্ষে কোনো সরকারের অশুভ ইঙ্গিত থাকতে পারে। উদারতা আর পরমতসহিষ্ণুতার শেষ বিন্দুও নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। দেশের আগামী প্রজন্ম সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে রাষ্ট্রীয় কর্ণধার হবে, উজ্জ্বল পথের কাণ্ডারি হয়ে দুঃখিনী বাংলার সোনার ছেলে হবে, সে পথ চিরদিনের জন্য বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। জ্ঞান-বিজ্ঞান অর্জনের বেলায় শিথিলতা আর যৌন শিক্ষার ব্যাপারে চরম উদারতা। এ অসুস্থ মানসিকতার কুপ্রভাবে জনগণ কেন অস্বস্তিতে থাকবে?
লেখক : প্রাবন্ধিক ও সংগঠক
লেখক : প্রাবন্ধিক ও সংগঠক
No comments