গ্রামীণ নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি হোক মূল লক্ষ্য by মো: আবুল হাসান ও খন রঞ্জন রায়
১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বরে বেইজিংয়ে
অনুষ্ঠিত নারী সম্মেলনে প্রদত্ত ঘোষণা অনুযায়ী প্রতি বছর ১৫ অক্টোবর পালিত
হয় বিশ্ব গ্রামীণ নারী দিবস। গ্রামীণ নারীদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন ও
তাদের অসামান্য ভূমিকার স্বীকৃতি হিসেবেই ঘোষিত হয় এ দিবস। দিবসটি পালনের
উদ্দেশ্য হচ্ছে-
১. গ্রামীণ নারীর অবস্থাকে তুলে ধরা, ২. গ্রামীণ নারীদের প্রচ্ছন্ন ভূমিকার প্রতি সরকার ও জনগণের অনুভূতি জাগ্রত করা, ৩. গ্রামীণ নারী কার্যক্রমে সমর্থন জোগানো, ৪. কৃষি, পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষায় গ্রামীণ নারীর ভূমিকাকে উন্নত করা এবং তাদের অধিকার বাস্তবায়ন ও ক্ষমতায়নের জন্য সচেতনতা সৃষ্টি করা। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন, ‘কোন কালে একা হয়নিক জয়ী পুরুষের তরবারী/শক্তি দিয়েছে, প্রেরণা দিয়েছে, বিজয় লক্ষ্মী নারী।’ লক্ষ্মী নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় শত বছরেরও বেশি সময় ধরে যে নারী আন্দোলন চলেছে নানা রূপে, নানা ছন্দে তার অন্যতম ফল হিসেবে ‘নারী’ শব্দটি আজ চলে এসেছে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। নারীর জীবন, নারীর জীবিকা, নারীর ভাবনা, নারীর কর্ম ইত্যাদি নানা বিষয়ে গবেষণা, নীতি, কর্মপরিকল্পনা পেয়েছে গুরুত্ব। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ‘নারী’ একটি আলোচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। একজন গ্রামীণ নারী প্রতিদিন যে গার্হস্থ্য কার্য সম্পাদন করেন; তার মতো ভোরবেলা শয্যাত্যাগ, হাতমুখ ধোয়া, ধর্মীয় উপাসনা, হাঁস-মুরগি বের করা ও খাবার দেয়া, গরু-ছাগল বের করা, উঠোন ঝাড়– দেয়া, গরুকে খাবার দেয়া, থালাবাসন, হাঁড়িপাতিল মাজা-ঘষা, নাশতা তৈরি করা, পরিবারের সদস্যদের নাশতা খাওয়ানো, কোলের সন্তানকে দুধদান করা, পানি আনা, ঘরদোর পরিষ্কার করা, জ্বালানি লাকড়ি-খড়ি সংগ্রহ ও রান্না করা, কাপড়চোপড় ধৌত করা, ছেলেমেয়েদের গোসল করানো ও নিজে করা। স্বামী ও আত্মীয়পরিজনের সেবাশুশ্রƒষায় নারীকে হতে হয় সুনিপুণ।
দেশে শত নারী দিবস পার করলেও এখনো শ্রমের স্বীকৃতি মেলেনি গ্রামীণ নারীদের। ঘরে-বাইরে নানা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন তারা। সংসারে তো বটেই, বাইরে পরিশ্রম করেও নারী বলে হতে হচ্ছে অবমূল্যায়িত। সারা দিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেও ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন গ্রামীণ নারী, কৃষি শ্রমিকেরা। দেশের গার্মেন্ট শিল্প থেকে সব শিল্পের ক্ষেত্রে নারীর অবস্থা থথৈবচ। অথচ দেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ, অর্থাৎ আড়াই কোটি নারীই দীর্ঘস্থায়ী অপুষ্টির শিকার। এ ছাড়া আয়োডিন ঘাটতিতে ৩৪ শতাংশ এবং রক্তস্বল্পতার ভুগছেন ৪২ শতাংশ নারী। এই নারীদের ওপরই নির্ভর করছে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম।
পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সে দেশই তত বেশি উন্নত যে দেশের নারীরা যত বেশি সচেতন ও কর্মঠ। দেশের সার্বিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে গ্রামীণ নারীসমাজই রাখতে পারেন অনবদ্য অবদান। গ্রামীণ নারীসমাজের কার্যক্রমের বাস্তবতাকে সমুন্নত রাখতে হবে। করতে হবে সুসংহত, যার হাত ধরে সম্ভব হবে নারীর ক্ষমতায়ন।
দেশে চলমান ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচির বদৌলতে অর্থনীতিতে গ্রামীণ নারীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে; কিন্তু ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের অবসান ঘটেনি; ঘটেনি সমাজে ও পরিবারে নারীর ক্ষমতায়ন। সংখ্যাগরিষ্ঠ গ্রমীণ নারীর শিক্ষায় মাধ্যমিক পর্যায়ে এসে ছেদ পড়ে। ডিপ্লোমা শিক্ষার বিস্তার ছাড়া নারীর অগ্রগতি ও ক্ষমতায়ন সম্ভব নয়। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে ছেলে ও মেয়েশিশুদের বিদ্যালয়ে ভর্তির হার প্রায় সমান, ক্রমেই ওপরের দিকে মেয়েদের ঝরে পড়ার হার বেশি। এ জন্য সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে নারীদের কর্মকেন্দ্রিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে। আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিতে নারীর ভূমিকা হতে হবে অগ্রণী। কারণ যার ুধা তাকেই ভাবতে হবে। নারীকে সমাজে তার ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে হলে তাকে অবশ্যই আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করে নিতে হবে।
নারীর আত্মকর্মসংস্থান সুযোগ সৃষ্টির ও উন্নয়ন টার্গেট আমাদের নির্ধারণ করতে হবে। নারী উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়ন, নারীর জন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার বিষয়গুলো যেন কাগুজে বিষয়ে রূপান্তরিত না হয়, সে জন্য তাকে প্রযুক্তিগত কর্মমুখী শিক্ষার ওপর নির্ভরশীল হতে হবে। বাংলাদেশের গ্রামীণ নারীর আত্মপরিচয় ও আত্মমর্যাদায় শক্তিশালী হয়ে আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ কাজে লাগানোর জন্য প্রয়োজন ডিপ্লোমা শিক্ষা। গ্রামীণ নারীর ভাগ্যোন্নয়ন ও মর্যাদাশীলতা প্রতিষ্ঠায় নারীর জন্য কর্মসংস্থানমুখী শিক্ষার ক্ষেত্রে উন্মোচন হোক গ্রামীণ নারী দিবস পালনের মূল লক্ষ্য।
No comments