তরুণ সমাজে বিভ্রান্তি মঙ্গলজনক নয় by এম সাখাওয়াত হোসেন
যে দেশে এখনো জাতিসত্তা বিভিন্ন কারণে বিকশিত হতে পারেনি, তার নরম মেরুদণ্ড ভাঙতে বেশি কিছু করতে হয় না। তরুণ সমাজকে বিভক্ত করে বিভ্রান্তির পথে ঠেলে দিলেই হয়। ক্ষমতার স্বাদ ও অর্থের নেশায় বিভ্রান্ত আমাদের তরুণ সমাজের একাংশ। এ অংশ ক্ষুদ্র হলেও সমাজে দারুণভাবে প্রভাব ফেলতে সক্ষম, কারণ এরা রাজনৈতিক দলের মদদপুষ্ট হয়ে নিজেদের প্রভাব বিস্তার ও বলয় সৃষ্টিতে রত। যুবসমাজের মধ্য থেকেই দেশের সর্বক্ষেত্রে নেতৃত্ব গড়ে ওঠার কথা অথচ যে অবস্থানে বর্তমানে আমাদের তরুণ সমাজ রয়েছে, তাতে নেতিবাচক ধারণা জন্মানো স্বাভাবিক।
আমাদের তরুণদের একটি বড় অংশ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের লেজুড় অঙ্গসংগঠনের সঙ্গে জড়িত। এসব অঙ্গসংগঠন রাজনৈতিক দলের তথাকথিত আদর্শ দ্বারা সংগঠিত বলে ওইসব দল থেকে দাবি করা হয়। ছাত্রসংগঠনগুলোকে ব্যবহার করা হয় সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণে। বৃহৎ দলগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত ছাত্রসংগঠনগুলোও রাজনৈতিক অপসংস্কৃতির আবর্তে পড়েছে। বিভাজনের রাজনীতির মধ্যে অন্ধভাবে দলের অনুসরণ করতে গিয়ে নিজেদের স্বকীয়তা হারিয়েছে। হারিয়েছে অতীতের ছাত্ররাজনীতি অথবা যুব রাজনীতির পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি। দলের লেজুড়বৃত্তি করতে করতে বহু জায়গায় নৈতিক স্খলন হয়েছে। অর্থ, ক্ষমতা আর জবরদখল এখন তরুণ দলগুলোর লক্ষ্য। এ লক্ষ্য অর্জনে দলীয় নেতাদের ভাষার প্রতিধ্বনি অহরহ শোনা যাচ্ছে। তরুণ ছাত্ররা স্বকীয়তা হারিয়েছে যার জন্য প্রাথমিকভাবে দায়ী আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো। এর উদাহরণ ছাত্রলীগ আর ছাত্রদলসহ অন্যান্য ছাত্রসংগঠন, সহযোগী সংগঠন এবং যুবদল ও যুবলীগের কর্মকাণ্ড। এসব দল যেভাবে তথাকথিত ছাত্রসহ অন্য অঙ্গসংগঠনগুলো তৈরি ও ব্যবহার করছে, তা বর্তমানে গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশের রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন আইনের পরিপন্থী। এ আইনের প্রয়োগও যেমন দেখছি না, তেমনি আইনের তোয়াক্কাও কোনো দলই করছে না। এসব আইন সংসদ দ্বারা অনুদিত হলেও তার প্রয়োগ নেই। যখন এ আইন সরকারি দলই মানছে না, তখন অন্য দল মানবে এটা কীভাবে আশা করা যায়।
জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে বিএনপির কেন্দ্র থেকে। অন্য ছাত্রসংগঠনগুলোতেও কোনো ধরনের গণতান্ত্রিক চর্চা তো হয় না, এমনকি নেতৃত্ব নির্ধারণও হয় রাজনৈতিক দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা-নেত্রীদের পছন্দ-অপছন্দের ওপরে। ছাত্রদলের অভ্যন্তরে যা হচ্ছে তার দায়দায়িত্ব নেতৃস্থানীয় নেতাদের। এই দলটি সরাসরি বর্তমানে প্রচলিত আইন গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশের ধারা ৯০বি(১)(এ)-এর পরিপন্থী কাজ করেছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মহল একেবারে নিশ্চুপ। এ আইন লঙ্ঘন করে (১) যে ক্ষতি করা হয়েছে, তার উদাহরণ ছাত্রদল। ছাত্রসংগঠনের একতরফাভাবে ছাত্রদলের পরিষদ গঠন করে যে ফলাফল হয়েছে তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। কিছুদিন আগে ছাত্রদলের বিক্ষুব্ধ অংশ বিদ্রোহ ঘোষণা করে যে কর্মকাণ্ড করেছে, তাতেই প্রতীয়মান হয় যে এসব ছাত্রসংগঠন দলের দ্বারা শুধু পরিচালিতই নয়, নিজস্ব উদ্দেশ্য হাসিলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার প্রয়াসেই এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। ছাত্রদল এখন মূল দলকে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করছে। মূল দলের কেন্দ্রীয় নেতা ও অফিসকে আক্রমণ করেছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে মূল দলের কেন্দ্রীয় অফিস ভাঙচুরের ঘটনা ইতিপূর্বে হয়েছে বলে মনে হয় না। এ ধরনের আরও বিভক্তি দেখছি তরুণ সমাজের মধ্যে। এ অস্থিরতার জন্য দায়ী রাজনীতিবিদেরাই।
এখনকার ছাত্র ও যুব সংগঠনগুলোর রাজনীতি কোনো দলের জন্যই সুখকর প্রমাণিত হয়নি। কারণ, বড় দলের মধ্যে যেমন গণতন্ত্রের চর্চা নেই, তেমনি আইনবহির্ভূতভাবে এসব সংগঠনকে নিয়ন্ত্রিত করতে গিয়ে গণতন্ত্রের চর্চার ধারেকাছেও নেই তরুণেরা। এ কারণেই বোধ করি তরুণেরা হয়ে পড়েছে সুবিধাভোগী লেজুড়বৃত্তির হাতিয়ার। তরুণ ও ছাত্রদের সংগঠনগুলো দলের প্রতি আনুগত্যের চেয়ে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির প্রতি অনুগত বেশি, যার প্রমাণ দৃশ্যমান হয়েছিল ২০০৭-০৮ সালের জরুরি অবস্থার সময়। দুই দলের শীর্ষ নেতাদের ওপর নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা, হাজতবাস ইত্যাদির সময় এসব ছাত্র তথা তরুণ সংগঠনকে টুঁ শব্দ করতে শোনা যায়নি। অথচ এখন শুধু দলই নয়, দেশ ও জাতি প্রায় জিম্মি হয়ে পড়েছে এসব ছাত্র ও তরুণ সংগঠনের কাছে। বর্তমানের তরুণ সমাজের রাজনৈতিক নেতৃত্বের দাবিদারেরা নিজস্ব উজ্জ্বল ইতিহাসের প্রতিও যখন মোটেও সচেতন নন, সে ক্ষেত্রে জাতির ইতিহাস নিয়ে সচেতন কতখানি হতে পারে তা অনুমেয়। রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত ছাত্র ও যুব সংগঠনগুলো ছাড়াও বিভিন্ন নামে গড়ে ওঠা যুব সংগঠনগুলোও এখন বিভক্তির রাজনীতিতে এমনভাবে জড়িয়েছে, যেখানে নিজস্ব চিন্তাচেতনার কোনো অবকাশ নেই। হারিয়ে ফেলেছে স্বকীয়তা। মাত্র সপ্তাহ খানেক আগে প্রয়াত ড. পিয়াস করিমের আকস্মিক মৃত্যুর পর তাঁকে শ্রদ্ধা জানানোকে ঘিরে কিছু কিছু যুব সংগঠন যে ধরনের পরিবেশ তৈরি করেছিল, তাতে সমূহ ক্ষতি হয়েছে আমাদের তরুণ প্রজন্মের এবং জাতির ভবিষ্যতের। কারণ, দুঃখজনক হলেও সত্য যে তরুণ সমাজ সেখানে জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হওয়ার কথা, সেখানে আরও বিভাজনের সৃষ্টি করেছে। পা রেখেছে অপসংস্কৃতির পথে।
প্রয়াত পিয়াস করিমের বক্তব্যে বা মতামতের সঙ্গে অনেকের মতো আমিও সব ক্ষেত্রে একমত হতে পারিনি। কিন্তু তার মানে এই নয় যে তাঁর মতকে বিভিন্ন রঙে রাঙানো উচিত। এতে প্রয়াত অধ্যাপকের সম্মান ক্ষুণ্ন হয়নি, বরং যারা না বুঝে এ ফাঁদে পা দিয়েছে তারা নিজেরাই অসম্মানিত হয়েছে। ড. পিয়াস করিম এখন আর কারও সনদের মুখাপেক্ষী নেই। তবে এ ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে কীভাবে তরুণ সমাজকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে বিভ্রান্ত করা হয়েছে। এর আগে তরুণদের উদ্যোগে গঠিত গণজাগরণ মঞ্চকে রাজনৈতিক গ্রাসে পরিণত হতে দেশবাসী দেখেছে। একদা যাদেরকে পুলিশের প্রহরায় সমাবেশ ও চলাফেরা করতে দেখা গেছে, তাদের অনেককেই এখন প্রধান নেতাসহ পুলিশের প্রহার হজম করতে দেখা যায়। এটাই বাস্তবতা, বাংলাদেশের রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার পরিণতি এখন ওই মঞ্চের বেশির ভাগ তরুণকে বলা যায় ‘না ঘরকা না ঘাটকা’ (ঘরেরও না আবার ঘাটেরও না)।
গণজাগরণ মঞ্চের মতো আরও কিছু কিছু স্বঘোষিত তরুণদের সংগঠন গড়ে উঠেছে। এরাও রাজনীতির আবর্তে পড়ে দিশেহারা বিভ্রান্ত। ড. পিয়াস করিমের মৃত্যু এবং শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানানোর প্রস্তাবের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে ক্ষান্ত হয়নি কয়েকটি তরুণ সংগঠন। আরও এক ধাপ এগিয়ে তাদের পিতাসম বয়সতুল্য কয়েকজন বরেণ্য ব্যক্তিকে শহীদ মিনারে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে দেশবাসীকে হতবাক করে দিয়েছে। এদের একটি সংগঠনের নাম পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত ‘সিপি গ্যাং’। অভিনব নাম। ‘গ্যাং’ একটি নেতিবাচক শব্দ, যা এখন ইংরেজিসহ অন্যান্য ভাষায় ব্যবহৃত হয়। এ সংগঠনটি কোনো এক প্রগতিশীল দলের তথাকথিত সহযোগী সংগঠন বলে পত্রিকায় লেখা হয়েছে। এমন নামে কোনো রাজনৈতিক দলের সমর্থক হতে পারে তা জানা ছিল না।
এসব সংগঠনের নাম-পরিচয় যা-ই থাকুক দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, এদের মাধ্যমে দেশের বিদ্যমান বিভাজনে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। এর পেছনে কারা ইন্ধন জোগাচ্ছে তা স্পষ্ট নয়, তবে এ ধরনের নেতিবাচক পরিস্থিতির দায়দায়িত্ব রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্বের ওপরে বর্তায়। এটা সরকারের জন্যও বিব্রতকর, কারণ শহীদ মিনার জাতির গৌরবময় একটি প্রতীক। বিশ্বের কোনো দেশে জাতীয় প্রতীক কারও দখলে থাকে না। সব নাগরিকের জন্য উন্মুক্ত। এ ধরনের নজির ভবিষ্যতের জন্য ভালো নয়। শহীদ মিনার কোনো দলের বা গোষ্ঠীর সম্পদ নয় যে তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছায় পরিচালিত হবে এবং নির্ধারিত হবে ব্যক্তিবিশেষের শহীদ মিনারে গমনের স্বাধীনতা।
আমরা আমাদের যুবসমাজকে ১৯৫২, ১৯৬৯ ও ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্মের মতো দেখতে চাই। রাজনৈতিক ফায়দা আর বৈষয়িক সুবিধাদি প্রাপ্তির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতে দেখতে চাই না। তরুণ সমাজকে জাতীয় ঐক্যের, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সমষ্টিগতভাবে রুখে দাঁড়ানোর প্রত্যয়ী এবং স্বকীয় সত্তা বিকাশের আঙ্গিকে দেখতে চাই। আগামীর বাংলাদেশ কেমন হবে, তা নির্ভর করবে আমাদের তরুণ সমাজের মনমানসিকতা আর নৈতিক মূল্যবোধের ওপর। কারও দ্বারা প্রভাবিত বা ব্যবহৃত হয়ে দিগ্ভ্রষ্ট হলে জাতির ভবিষ্যৎ সংকটময় হবে। সে কারণেই রাজনৈতিক ঘুরপাকে নিমজ্জিত তরুণ সমাজের কাছে অনুরোধ যে তারা যেন লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি বাদ দিয়ে স্বকীয়তা ও নৈতিকতার ভিত্তিতে নিজেদের চলার পথ বেছে নেয়। তা না হলে আমরা যে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছি, তা স্বপ্নই থেকে যাবে। যে তরুণ সমাজ তাদের অগ্রজ সম্মানিত ব্যক্তিদের সম্মান দেখাতে পারে না, একদিন তাদের এ ধরনের অসম্মানের মুখোমুখি হতে হবে।
আমাদের তরুণদের সঠিক পথে পরিচালিত করার দায়িত্ব যে সমাজের রয়েছে তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক দল ও নেতাদের। দেশের রাজনৈতিক অপসংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে মুক্তচিন্তা ও মননের তরুণ সমাজ গড়ে তুলতে না পারলে একটি জাতি বিকশিত হতে পারে না। তরুণেরাই রাষ্ট্রের শক্তি, এদের সঠিক পথে পরিচালিত না করতে পারলে তার খেসারত সমগ্র জাতিকেই দিতে হবে। পরিশেষে দেশের মুক্তচিন্তাশীলদের কাছে অনুরোধ, আমাদের তরুণ প্রজন্মকে তাদের মতো করে বেড়ে উঠতে সহযোগিতা করুন। এটা আমাদের সবার দায়িত্ব। নেতিবাচক ও বিভাজনের রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠতে হবে তরুণ সমাজকে।
এম সাখাওয়াত হোসেন: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও কলাম লেখক৷
hhintlbd@yahoo.com
আমাদের তরুণদের একটি বড় অংশ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের লেজুড় অঙ্গসংগঠনের সঙ্গে জড়িত। এসব অঙ্গসংগঠন রাজনৈতিক দলের তথাকথিত আদর্শ দ্বারা সংগঠিত বলে ওইসব দল থেকে দাবি করা হয়। ছাত্রসংগঠনগুলোকে ব্যবহার করা হয় সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণে। বৃহৎ দলগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত ছাত্রসংগঠনগুলোও রাজনৈতিক অপসংস্কৃতির আবর্তে পড়েছে। বিভাজনের রাজনীতির মধ্যে অন্ধভাবে দলের অনুসরণ করতে গিয়ে নিজেদের স্বকীয়তা হারিয়েছে। হারিয়েছে অতীতের ছাত্ররাজনীতি অথবা যুব রাজনীতির পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি। দলের লেজুড়বৃত্তি করতে করতে বহু জায়গায় নৈতিক স্খলন হয়েছে। অর্থ, ক্ষমতা আর জবরদখল এখন তরুণ দলগুলোর লক্ষ্য। এ লক্ষ্য অর্জনে দলীয় নেতাদের ভাষার প্রতিধ্বনি অহরহ শোনা যাচ্ছে। তরুণ ছাত্ররা স্বকীয়তা হারিয়েছে যার জন্য প্রাথমিকভাবে দায়ী আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো। এর উদাহরণ ছাত্রলীগ আর ছাত্রদলসহ অন্যান্য ছাত্রসংগঠন, সহযোগী সংগঠন এবং যুবদল ও যুবলীগের কর্মকাণ্ড। এসব দল যেভাবে তথাকথিত ছাত্রসহ অন্য অঙ্গসংগঠনগুলো তৈরি ও ব্যবহার করছে, তা বর্তমানে গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশের রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন আইনের পরিপন্থী। এ আইনের প্রয়োগও যেমন দেখছি না, তেমনি আইনের তোয়াক্কাও কোনো দলই করছে না। এসব আইন সংসদ দ্বারা অনুদিত হলেও তার প্রয়োগ নেই। যখন এ আইন সরকারি দলই মানছে না, তখন অন্য দল মানবে এটা কীভাবে আশা করা যায়।
জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে বিএনপির কেন্দ্র থেকে। অন্য ছাত্রসংগঠনগুলোতেও কোনো ধরনের গণতান্ত্রিক চর্চা তো হয় না, এমনকি নেতৃত্ব নির্ধারণও হয় রাজনৈতিক দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা-নেত্রীদের পছন্দ-অপছন্দের ওপরে। ছাত্রদলের অভ্যন্তরে যা হচ্ছে তার দায়দায়িত্ব নেতৃস্থানীয় নেতাদের। এই দলটি সরাসরি বর্তমানে প্রচলিত আইন গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশের ধারা ৯০বি(১)(এ)-এর পরিপন্থী কাজ করেছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মহল একেবারে নিশ্চুপ। এ আইন লঙ্ঘন করে (১) যে ক্ষতি করা হয়েছে, তার উদাহরণ ছাত্রদল। ছাত্রসংগঠনের একতরফাভাবে ছাত্রদলের পরিষদ গঠন করে যে ফলাফল হয়েছে তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। কিছুদিন আগে ছাত্রদলের বিক্ষুব্ধ অংশ বিদ্রোহ ঘোষণা করে যে কর্মকাণ্ড করেছে, তাতেই প্রতীয়মান হয় যে এসব ছাত্রসংগঠন দলের দ্বারা শুধু পরিচালিতই নয়, নিজস্ব উদ্দেশ্য হাসিলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার প্রয়াসেই এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। ছাত্রদল এখন মূল দলকে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করছে। মূল দলের কেন্দ্রীয় নেতা ও অফিসকে আক্রমণ করেছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে মূল দলের কেন্দ্রীয় অফিস ভাঙচুরের ঘটনা ইতিপূর্বে হয়েছে বলে মনে হয় না। এ ধরনের আরও বিভক্তি দেখছি তরুণ সমাজের মধ্যে। এ অস্থিরতার জন্য দায়ী রাজনীতিবিদেরাই।
এখনকার ছাত্র ও যুব সংগঠনগুলোর রাজনীতি কোনো দলের জন্যই সুখকর প্রমাণিত হয়নি। কারণ, বড় দলের মধ্যে যেমন গণতন্ত্রের চর্চা নেই, তেমনি আইনবহির্ভূতভাবে এসব সংগঠনকে নিয়ন্ত্রিত করতে গিয়ে গণতন্ত্রের চর্চার ধারেকাছেও নেই তরুণেরা। এ কারণেই বোধ করি তরুণেরা হয়ে পড়েছে সুবিধাভোগী লেজুড়বৃত্তির হাতিয়ার। তরুণ ও ছাত্রদের সংগঠনগুলো দলের প্রতি আনুগত্যের চেয়ে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির প্রতি অনুগত বেশি, যার প্রমাণ দৃশ্যমান হয়েছিল ২০০৭-০৮ সালের জরুরি অবস্থার সময়। দুই দলের শীর্ষ নেতাদের ওপর নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা, হাজতবাস ইত্যাদির সময় এসব ছাত্র তথা তরুণ সংগঠনকে টুঁ শব্দ করতে শোনা যায়নি। অথচ এখন শুধু দলই নয়, দেশ ও জাতি প্রায় জিম্মি হয়ে পড়েছে এসব ছাত্র ও তরুণ সংগঠনের কাছে। বর্তমানের তরুণ সমাজের রাজনৈতিক নেতৃত্বের দাবিদারেরা নিজস্ব উজ্জ্বল ইতিহাসের প্রতিও যখন মোটেও সচেতন নন, সে ক্ষেত্রে জাতির ইতিহাস নিয়ে সচেতন কতখানি হতে পারে তা অনুমেয়। রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত ছাত্র ও যুব সংগঠনগুলো ছাড়াও বিভিন্ন নামে গড়ে ওঠা যুব সংগঠনগুলোও এখন বিভক্তির রাজনীতিতে এমনভাবে জড়িয়েছে, যেখানে নিজস্ব চিন্তাচেতনার কোনো অবকাশ নেই। হারিয়ে ফেলেছে স্বকীয়তা। মাত্র সপ্তাহ খানেক আগে প্রয়াত ড. পিয়াস করিমের আকস্মিক মৃত্যুর পর তাঁকে শ্রদ্ধা জানানোকে ঘিরে কিছু কিছু যুব সংগঠন যে ধরনের পরিবেশ তৈরি করেছিল, তাতে সমূহ ক্ষতি হয়েছে আমাদের তরুণ প্রজন্মের এবং জাতির ভবিষ্যতের। কারণ, দুঃখজনক হলেও সত্য যে তরুণ সমাজ সেখানে জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হওয়ার কথা, সেখানে আরও বিভাজনের সৃষ্টি করেছে। পা রেখেছে অপসংস্কৃতির পথে।
প্রয়াত পিয়াস করিমের বক্তব্যে বা মতামতের সঙ্গে অনেকের মতো আমিও সব ক্ষেত্রে একমত হতে পারিনি। কিন্তু তার মানে এই নয় যে তাঁর মতকে বিভিন্ন রঙে রাঙানো উচিত। এতে প্রয়াত অধ্যাপকের সম্মান ক্ষুণ্ন হয়নি, বরং যারা না বুঝে এ ফাঁদে পা দিয়েছে তারা নিজেরাই অসম্মানিত হয়েছে। ড. পিয়াস করিম এখন আর কারও সনদের মুখাপেক্ষী নেই। তবে এ ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে কীভাবে তরুণ সমাজকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে বিভ্রান্ত করা হয়েছে। এর আগে তরুণদের উদ্যোগে গঠিত গণজাগরণ মঞ্চকে রাজনৈতিক গ্রাসে পরিণত হতে দেশবাসী দেখেছে। একদা যাদেরকে পুলিশের প্রহরায় সমাবেশ ও চলাফেরা করতে দেখা গেছে, তাদের অনেককেই এখন প্রধান নেতাসহ পুলিশের প্রহার হজম করতে দেখা যায়। এটাই বাস্তবতা, বাংলাদেশের রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার পরিণতি এখন ওই মঞ্চের বেশির ভাগ তরুণকে বলা যায় ‘না ঘরকা না ঘাটকা’ (ঘরেরও না আবার ঘাটেরও না)।
গণজাগরণ মঞ্চের মতো আরও কিছু কিছু স্বঘোষিত তরুণদের সংগঠন গড়ে উঠেছে। এরাও রাজনীতির আবর্তে পড়ে দিশেহারা বিভ্রান্ত। ড. পিয়াস করিমের মৃত্যু এবং শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানানোর প্রস্তাবের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে ক্ষান্ত হয়নি কয়েকটি তরুণ সংগঠন। আরও এক ধাপ এগিয়ে তাদের পিতাসম বয়সতুল্য কয়েকজন বরেণ্য ব্যক্তিকে শহীদ মিনারে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে দেশবাসীকে হতবাক করে দিয়েছে। এদের একটি সংগঠনের নাম পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত ‘সিপি গ্যাং’। অভিনব নাম। ‘গ্যাং’ একটি নেতিবাচক শব্দ, যা এখন ইংরেজিসহ অন্যান্য ভাষায় ব্যবহৃত হয়। এ সংগঠনটি কোনো এক প্রগতিশীল দলের তথাকথিত সহযোগী সংগঠন বলে পত্রিকায় লেখা হয়েছে। এমন নামে কোনো রাজনৈতিক দলের সমর্থক হতে পারে তা জানা ছিল না।
এসব সংগঠনের নাম-পরিচয় যা-ই থাকুক দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, এদের মাধ্যমে দেশের বিদ্যমান বিভাজনে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। এর পেছনে কারা ইন্ধন জোগাচ্ছে তা স্পষ্ট নয়, তবে এ ধরনের নেতিবাচক পরিস্থিতির দায়দায়িত্ব রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্বের ওপরে বর্তায়। এটা সরকারের জন্যও বিব্রতকর, কারণ শহীদ মিনার জাতির গৌরবময় একটি প্রতীক। বিশ্বের কোনো দেশে জাতীয় প্রতীক কারও দখলে থাকে না। সব নাগরিকের জন্য উন্মুক্ত। এ ধরনের নজির ভবিষ্যতের জন্য ভালো নয়। শহীদ মিনার কোনো দলের বা গোষ্ঠীর সম্পদ নয় যে তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছায় পরিচালিত হবে এবং নির্ধারিত হবে ব্যক্তিবিশেষের শহীদ মিনারে গমনের স্বাধীনতা।
আমরা আমাদের যুবসমাজকে ১৯৫২, ১৯৬৯ ও ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্মের মতো দেখতে চাই। রাজনৈতিক ফায়দা আর বৈষয়িক সুবিধাদি প্রাপ্তির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতে দেখতে চাই না। তরুণ সমাজকে জাতীয় ঐক্যের, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সমষ্টিগতভাবে রুখে দাঁড়ানোর প্রত্যয়ী এবং স্বকীয় সত্তা বিকাশের আঙ্গিকে দেখতে চাই। আগামীর বাংলাদেশ কেমন হবে, তা নির্ভর করবে আমাদের তরুণ সমাজের মনমানসিকতা আর নৈতিক মূল্যবোধের ওপর। কারও দ্বারা প্রভাবিত বা ব্যবহৃত হয়ে দিগ্ভ্রষ্ট হলে জাতির ভবিষ্যৎ সংকটময় হবে। সে কারণেই রাজনৈতিক ঘুরপাকে নিমজ্জিত তরুণ সমাজের কাছে অনুরোধ যে তারা যেন লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি বাদ দিয়ে স্বকীয়তা ও নৈতিকতার ভিত্তিতে নিজেদের চলার পথ বেছে নেয়। তা না হলে আমরা যে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছি, তা স্বপ্নই থেকে যাবে। যে তরুণ সমাজ তাদের অগ্রজ সম্মানিত ব্যক্তিদের সম্মান দেখাতে পারে না, একদিন তাদের এ ধরনের অসম্মানের মুখোমুখি হতে হবে।
আমাদের তরুণদের সঠিক পথে পরিচালিত করার দায়িত্ব যে সমাজের রয়েছে তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক দল ও নেতাদের। দেশের রাজনৈতিক অপসংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে মুক্তচিন্তা ও মননের তরুণ সমাজ গড়ে তুলতে না পারলে একটি জাতি বিকশিত হতে পারে না। তরুণেরাই রাষ্ট্রের শক্তি, এদের সঠিক পথে পরিচালিত না করতে পারলে তার খেসারত সমগ্র জাতিকেই দিতে হবে। পরিশেষে দেশের মুক্তচিন্তাশীলদের কাছে অনুরোধ, আমাদের তরুণ প্রজন্মকে তাদের মতো করে বেড়ে উঠতে সহযোগিতা করুন। এটা আমাদের সবার দায়িত্ব। নেতিবাচক ও বিভাজনের রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠতে হবে তরুণ সমাজকে।
এম সাখাওয়াত হোসেন: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও কলাম লেখক৷
hhintlbd@yahoo.com
No comments