শিক্ষকের নির্যাতন চোখ হারাতে বসেছে রাব্বী by উৎপল রায়
‘ইচ্ছা ছিল পোলাডারে পড়াশোনা করাইয়া
মানুষের মতো মানুষ করবো। আমি গরিব মানুষ। আমার স্বামী নাই। তাই শত কষ্টেও
ছেলেমেয়েদের মুখে হাসি ফোটানোর লাইগ্যা দিন-রাত কাজ করি। কিন্তু আমার সব
স্বপ্ন এহন শেষ হওয়ার পথে। এই অন্ধ ছেলে নিইয়া আমি এহন কোথায় যাই?’
রাজধানীর আগারগাঁওয়ে জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট হাসপাতালের ৪৩০ নম্বর
ওয়ার্ডের ২ নম্বর বেডে ছেলে গোলাম রাব্বীর সামনে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলছিলেন
বিধবা শাহানা বেগম (৪০)। তার বড় ছেলে রাব্বীর বাঁ চোখে অস্ত্রোপাচার হয়েছে।
শ্রেণীকক্ষে শিক্ষকের ছুড়ে মারা কলমের আঘাতে অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র গোলাম
রাব্বীর বাঁ চোখ চিরতরে নষ্ট হওয়ার পথে। প্রথম দফা অস্ত্রোপচারের পরও সে
চোখে কিছুই দেখছে না। এখন তার বাম চোখে দ্বিতীয় দফা অস্ত্রোপচারের
প্রস্তুতি নিচ্ছেন চিকিৎসকরা। গত ১৯শে অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নিয়াজ
মোহাম্মদ উচ্চ বিদ্যালয়ের একটি শ্রেণীকক্ষে একই বিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা
বিভাগের শিক্ষক সুব্রত সরকারের ছুড়ে মারা কলমের আঘাতে বাম চোখে গুরুতর
আঘাতপ্রাপ্ত হয় পিতৃহীন রাব্বী। ঘটনার পর প্রথমে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতালে। সেখানে চিকিৎসকরা জানান রাব্বীর বাঁ চোখ
গুরুতর জখম হয়েছে। চোখে এধরনের আঘাতের কোন চিকিৎসা সদর হাসপাতালে সম্ভব নয়।
এরপর ওই রাতেই রাব্বীকে নিয়ে আসা হয় রাজধানীর আগারগাঁওয়ের চক্ষু বিজ্ঞান
ইনস্টিটিউট হাসপাতালে। সেখানে সোমবার রাব্বীর চোখে জরুরি অস্ত্রোপচার করেন
সেখানকার চিকিৎসকরা। কিন্তু পরদিন মঙ্গলবার তার চোখের ব্যান্ডেজ খুলে দিলে
সে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না বলে উপস্থিত সবাইকে জানায়। এতে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন
রাব্বীর মা, স্বজন ও চিকিৎসকরা। হাসপাতালের একজন আবাসিক সার্জন বলেন,
ছেলেটির চোখের কর্নিয়া মারাত্মকভাবে কেটে গেছে। প্রথম দফা সফল
অস্ত্রোপচারের পরও সে কিছুই দেখছে না বলে জানিয়েছে। দ্বিতীয় দফা
অস্ত্রোপচারের পরও তার পূর্ণ স্বাভাবিক দৃষ্টিশক্তি হয়তো আর ফিরে না-ও আসতে
পারে। তবে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। হাসপাতালে রাব্বী জানায়,
১৯শে অক্টোবর দুপুরে নিয়াজ মোহাম্মদ উচ্চ বিদ্যালয়ের একটি শ্রেণীকক্ষে
দুষ্টুমি করছিল অষ্টম শ্রেণির দুই শিক্ষার্থী। এ সময় পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা
বিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের শিক্ষক সুব্রত সরকার রাগ করে কলম ছুড়ে
মারেন তাদের দিকে। কলম গিয়ে আঘাত করে পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা রাব্বীর বাঁ চোখে।
আগামী ২রা নভেম্বর রাব্বীর জেএসসি পরীক্ষা। পরীক্ষার মাত্র আর ক’দিন বাকি।
এ সময়ে চোখে এত বড় আঘাত। তাই পড়াশোনা আপাতত বন্ধ। পরীক্ষাও সম্ভবত দেয়া
হবে না তার। রাব্বী জানায়, জেএসসি পরীক্ষার জন্য সে কোন প্রস্তুতি নিতে
পারেনি। বাঁ চোখে আঘাত পাওয়ার পর থেকেই পড়াশোনা বন্ধ। তাই অনেক স্বপ্ন
থাকার পরও জেএসসি পরীক্ষা হয়তো আর দেয়া হবে না। রাব্বী বলে, আমার মা’র
স্বপ্ন ছিল আমাকে নিয়ে। আমিই সংসারের বড় ছেলে। তাই আমিও স্বপ্ন দেখেছিলাম
জীবনে অনেক বড় হয়ে অসহায় মায়ের মুখে হাসি ফোটাবো। কিন্তু চোখে না দেখলে আমি
কিভাবে আমার স্বপ্ন পূরণ করবো? জেএসসি পরীক্ষা দেয়ার খুব ইচ্ছা ছিল আমার।
কিন্তু আমি চোখে কিছুই দেখতে পারছি না। পড়তে পারছি না। এ অবস্থায় পরীক্ষা
কেমন করে দিবো? শাহানা বেগম জানান, তিনি স্থানীয় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে
দপ্তরির কাজ করেন। মাস শেষে যা পান তাই দিয়ে তিন ছেলেমেয়েকে নিয়ে কোনমতে
দিন পার করেন। ছেলে রাব্বীর উন্নত চিকিৎসা করাবেন সে সামর্থ্য তার নেই।
হাসপাতালের আবাসিক সার্জন ডা. তরিকুল ইসলাম বলেন, রাব্বীর বাঁ চোখের কর্নিয়া মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রথম দফায় অস্ত্রোপচারের পরও সে কিছুই দেখছে না। আগের স্বাভাবিক দৃষ্টি ফিরে আসবে কিনা সে বিষয়ে আমরা নিশ্চিত নই। রাব্বীর মামা মো. শাহজাহান মিয়া বলেন, অনেক স্বপ্ন নিয়ে রাব্বীর মা ছেলেকে আগলে রেখেছিলেন। কিন্তু একজন শিক্ষকের মুহূর্তের নির্মমতায় সে এখন চোখ হারাতে বসেছে। আমরা শিক্ষক সুব্রত সরকারের কঠোর শাস্তি চাই। ব্রাহ্মণবাড়িয়া নিয়াজ মোহাম্মদ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. শাহিদুর রহমান মুঠোফোনে বলেন, ঘটনাটি মর্মান্তিক। রাব্বীর চোখের চিকিৎসার যাবতীয় খরচ স্কুল ফান্ড থেকে দেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, অভিযুক্ত ও পলাতক স্কুলশিক্ষককে বরখাস্ত করা হয়েছে। এ বিষয়ে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
No comments