আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের সাত অভিযোগ, ট্রাইব্যুনালের রায় বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে প্রথম ফাঁসি by কুন্তল রায় ও মোছাব্বের হোসেন
স্বাধীনতার ৪২ বছর পর বুদ্ধিজীবী হত্যার
প্রথম বিচার হলো। একাত্তরে বুদ্ধিজীবী নিধনের পরিকল্পনা ও সহযোগিতা করার
দায়ে গতকাল বুধবার আলবদর বাহিনীর নেতা আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদকে
ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ
ট্রাইব্যুনাল-২।
বর্তমানে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি
জেনারেল মুজাহিদ ২০০৭ সালের ২৫ অক্টোবর নির্বাচন কমিশনে বিভিন্ন রাজনৈতিক
দলের সঙ্গে সংলাপে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশে কোনো যুদ্ধাপরাধী নেই। অতীতেও কোনো
যুদ্ধাপরাধী ছিল না।’ কিন্তু গতকাল ট্রাইব্যুনালের রায়ে তিনি নিজেই
একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী হিসেবে দণ্ডপ্রাপ্ত হলেন।
মুজাহিদের বিরুদ্ধে গঠন করা সাতটি অভিযোগের মধ্যে পাঁচটি প্রমাণ করতে পেরেছে রাষ্ট্রপক্ষ। এর মধ্যে ষষ্ঠ অভিযোগ বুদ্ধিজীবী নিধনে সহযোগিতা ও পরিকল্পনা এবং সপ্তম অভিযোগ হিন্দু হত্যা ও নিপীড়নের দায়ে তাঁকে কারাদণ্ডাদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। পঞ্চম অভিযোগ মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে হত্যায় সহযোগিতার দায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও তৃতীয় অভিযোগ মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে আটকে রেখে নির্যাতনের দায়ে তাঁকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। দ্বিতীয় অভিযোগ ও চতুর্থ অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় এ দুটি থেকে তাঁকে খালাস দেওয়া হয়।
মুজাহিদের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণার মধ্য দিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের ষষ্ঠ মামলার রায় ঘোষিত হলো। এর মধ্যে পাঁচটি মামলার আসামিই ছিলেন জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতা, একজন সাবেক সদস্য। গত সোমবার জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমকে ৯০ বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল-১।
গতকাল রায়ের দিন সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে এজলাসে আসামির কাঠগড়ায় হাজির করা হয় সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরা ৬৫ বছরের মুজাহিদকে। ১০ মিনিট পর আসন নেন ট্রাইব্যুনাল-২-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান এবং দুই সদস্য বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও মো. শাহিনুর ইসলাম। ট্রাইব্যুনাল বলেন, পূর্ণাঙ্গ রায় ২০৯ পৃষ্ঠা, এজলাসে ৩৭ পৃষ্ঠার সংক্ষিপ্ত রায় পড়ে শোনানো হবে। বেলা ১১টায় এই ট্রাইব্যুনালের চতুর্থ রায় ঘোষণা শুরু হয়।
রায়ে আসামির পরিচিতিতে ট্রাইব্যুনাল বলেন, এই মামলার আসামি আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে ছাত্রাবস্থায় ইসলামী ছাত্র সংঘে (জামায়াতের তৎকালীন ছাত্র সংগঠন) যোগ দেন। ১৯৬৮-৭০ সালে তিনি ফরিদপুর জেলা ছাত্র সংঘের সভাপতি ছিলেন। ১৯৭০ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন। ওই বছরই তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র সংঘের সেক্রেটারি হন। একাত্তরের অক্টোবরে তিনি ছাত্র সংঘের সভাপতি ও আল-বদর বাহিনীর প্রধান হন বলে দাবি করা হয়। আসামি ১৯৮৬, ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে চারবারই পরাজিত হন। ২০০১-২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে তিনি সমাজকল্যাণ মন্ত্রী ছিলেন।
রায়ের পরবর্তী অংশে ট্রাইব্যুনাল মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগী বাহিনী হিসেবে সশস্ত্র আধাসামরিক বাহিনী আলবদরের কর্মকাণ্ড তুলে ধরেন। আলবদর বাহিনীতে মুজাহিদের অবস্থান প্রসঙ্গে ট্রাইব্যুনাল বলেন, একাত্তরে ছাত্র সংঘের সদস্যরা আলবদর বাহিনীতে রূপান্তরিত হয়। যেহেতু মুজাহিদ ছাত্র সংঘের ঊর্ধ্বতন নেতা ছিলেন, এ জন্য আলবদর ও ছাত্র সংঘ—দুটি সংগঠনের ওপরই তাঁর কর্তৃত্ব ছিল। মুজাহিদ একাত্তরে রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে ক্ষমতাধারী ছিলেন, আর এ ক্ষমতার জন্যই তিনি আলবদর বাহিনীকে দিক-নির্দেশনা দিতে পারতেন। তবে তিনিই এ বাহিনীর একমাত্র নেতা ছিলেন না।
ট্রাইব্যুনাল বলেন, এ জন্য আলবদরের কোনো আনুষ্ঠানিক নথিতে মুজাহিদের নাম থাকা জরুরি নয়। সব ধরনের নথি ও সাক্ষ্য মূল্যায়ন করে বোঝা যায়, মুজাহিদ আলবদর বাহিনীর সব ধরনের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা রাখতেন। অবস্থানগত কারণেই আলবদর গঠন থেকে শুরু করে হত্যা-নিধনযজ্ঞের শেষ পর্যন্ত এ বাহিনীর ওপর তাঁর কর্তৃত্ব ছিল। সেলিম মনসুর খালেদের আলবদর বই অনুসারে, একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর মুজাহিদ আলবদর বাহিনীর উদ্দেশে ‘শেষ ভাষণ’ দেন। মুক্তিযুদ্ধকালে আসামির সঙ্গে আলবদর বাহিনীর অনানুষ্ঠানিক ঊর্ধ্বতন-অধস্তন সম্পর্ক রাষ্ট্রপক্ষ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে পেরেছে। আলবদর সদস্যদের ওপর মুজাহিদের কার্যকর নিয়ন্ত্রণ ছিল এবং আলবদরের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে তিনি সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল ছিলেন।
এরপর মুজাহিদের বিরুদ্ধে গঠন করা মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার সাতটি অভিযোগের মূল্যায়ন তুলে ধরেন ট্রাইব্যুনাল।
সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন হত্যা ও বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড: মুজাহিদের বিরুদ্ধে প্রথম অভিযোগ শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনকে হত্যায় সহযোগিতা করা। একাত্তরের ১০ ডিসেম্বর গভীর রাতে আলবদর সদস্যরা সিরাজুদ্দীন হোসেনকে অপহরণ করে নিয়ে যায়, তাঁর লাশও পরে আর পাওয়া যায়নি। ষষ্ঠ অভিযোগে বলা হয়েছে, মোহাম্মদপুরের শারীরিক শিক্ষা কলেজে পাকিস্তানি সেনা, রাজাকার ও আলবদর ক্যাম্পে মুজাহিদ বাঙালি নিধনের পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র করতেন। ওই ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতায় ১০ ডিসেম্বর থেকে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড শুরু হয়।
প্রথম অভিযোগের মূল্যায়নে ট্রাইব্যুনাল বলেন, প্রখ্যাত সাংবাদিক ও ইত্তেফাক পত্রিকার তৎকালীন কার্যনির্বাহী সম্পাদক সিরাজুদ্দীন হোসেনকে অপহরণ করে আলবদর সদস্যরা, যারা ছিল পাকিস্তানি সেনাদের ‘ডেথ স্কোয়াড’ ও জামায়াতের ‘অ্যাকশন সেকশন’। একাত্তরের সেপ্টেম্বরে তিনি ‘ঠগ বাছতে গাঁ উজাড়’ শীর্ষক একটি নিবন্ধে মূলত পাকিস্তানি সেনা ও তাদের সমর্থকদের সমালোচনা করেন। একাত্তরের ১৬ সেপ্টেম্বর জামায়াতের মুখপত্র সংগ্রাম পত্রিকায় ‘অতএব ঠগ বাছিও না’ শীর্ষক পাল্টা নিবন্ধ ছাপা হয়। ওই নিবন্ধে সিরাজুদ্দীন হোসেনকে ‘ভারতের দালাল’, ‘ব্রাহ্মণ্যবাদের দালাল’ বলে উল্লেখ করা হয়। স্পষ্টতই সিরাজুদ্দীনের লেখনীতে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ প্রতিফলিত হওয়ায় তিনি ঘাতক আলবদর বাহিনীর লক্ষ্যে পরিণত হন। একাত্তরের ২৪ নভেম্বর সংগ্রাম পত্রিকায় আসামির একটি যৌথ বিবৃতি ছাপা হয়, যাতে আসামি ভারতের দালালদের নিশ্চিহ্ন করার আহ্বান জানান। পরবর্তী সময়ে নারকীয় বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড শুরু হয়।
আদালত আরও বলেন, ২০১০ সালের ১৪ ডিসেম্বর একটি দৈনিক পত্রিকায় ছাপা হওয়া ‘কান্ট্রি কুড নট কেয়ারলেস’ শীর্ষক প্রতিবেদন (আসামিপক্ষের নথি) খুঁটিয়ে পড়লে দেখা যায়, যে সশস্ত্র দলটি সিরাজুদ্দীন হোসেনকে অপহরণ করেছিল তার নেতৃত্বে ছিলেন মুজাহিদ। ‘নেতৃত্বে থাকা’ মানে সবসময় এটা দেখানোর দরকার নেই যে ঘটনাস্থলে শারীরিকভাবে উপস্থিত থাকতে হবে। যে ব্যক্তি কর্তৃত্ববাদী অবস্থানে থাকেন, তাঁর নির্দেশনা, আদেশ, উসকানি বা প্ররোচনাও নেতৃত্ব দেওয়ার মধ্যে পড়ে।
ষষ্ঠ অভিযোগের মূল্যায়নে বলা হয়, আলবদর বাহিনীর নীতিনির্ধারণী অংশে আসামি মুজাহিদের অবস্থান ও আলবদরের কার্যক্রমের সঙ্গে তাঁর সংশ্লিষ্টতা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত। রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, মুজাহিদ নিয়মিত মোহাম্মদপুরের শারীরিক শিক্ষা কলেজে আলবদরের ক্যাম্পে যেতেন। বিশেষত একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর ওই আলবদর ক্যাম্পে চরম হতাশা ও কষ্ট নিয়ে দেওয়া তাঁর শেষ ভাষণে তিনি ছাত্র সংঘের সদস্যদের আলবদরে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানান এবং তথাকথিত ‘দুষ্কৃতকারী’, ‘ভারতের দালাল’ ‘ইসলামের শত্রু’দের নিশ্চিহ্ন করতে বলেন। এতে আলবদর বাহিনীতে মুজাহিদের নেতৃত্বস্থানীয় অবস্থান এবং ব্যাপক মাত্রার নিয়ন্ত্রণ ছিল বলে প্রমাণিত হয়।
রায়ে বলা হয়, নাৎসী যুদ্ধাপরাধী অ্যাডলফ আইকম্যান নিজ হাতে কাউকে হত্যা করেননি। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন নাৎসী নিধনের মূল কারিগর। আইকম্যান নাৎসী সংগঠন স্টর্ম ট্রুপারস (এসএ), সিকিউরিটি সার্ভিস (এসডি) ও গেস্টাপো বাহিনীর সদস্য ছিলেন। এই তিনটি বাহিনী ১৯৪৬ সালে ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালে অপরাধী সংগঠন হিসেবে প্রমাণিত হয়েছিল। গেস্টাপো বাহিনীর প্রধান হিসেবে আইকম্যানের মৃত্যুদণ্ড হয়েছিল। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর ও ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে পত্রিকায় প্রকাশিত অসংখ্য প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, শতাধিক বুদ্ধিজীবীকে অপহরণ করে হত্যা করেছিল কুখ্যাত আলবদর বাহিনী। একাত্তরের ১৯ ডিসেম্বর ইত্তেফাক-এ প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের টিভি ও রেডিওর প্রতিনিধিরা মুক্তিযুদ্ধ শেষে মোহাম্মদপুরের শারীরিক শিক্ষা কলেজের কয়েকটি কক্ষে রক্তের স্রোত ভেসে যেতে দেখেন, সেই সঙ্গে বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডে ব্যবহূত অস্ত্রগুলোও পড়ে থাকতে দেখা যায়। এতে বোঝা যায়, ওই কলেজটি ছিল প্রকৃতপক্ষে একটি হত্যাপুরী। এতে প্রমাণিত হয়, একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর আসামি মুজাহিদ শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পূণ্য রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে আলবদর সদস্যদের উদ্দেশে তাঁর শেষ ভাষণ দিয়েছিলেন। রাষ্ট্রপক্ষ এ অভিযোগে আসামির বিরুদ্ধে একক ও যৌথ অপরাধের দায় এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃত্বের দায়—উভয়ই প্রমাণ করতে পেরেছে।
মুজাহিদের বিরুদ্ধে এ দুটি অভিযোগই সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হলেও ট্রাইব্যুনাল আলাদাভাবে তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করেননি। ট্রাইব্যুনাল বলেন, সিরাজুদ্দীন হোসেন হত্যাকাণ্ড, পরিকল্পিত ও ধারাবাহিকভাবে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের একটি অংশ। বরং পৃথকভাবে সিরাজুদ্দীন হোসেন হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ প্রমাণ হওয়া বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা ও সহযোগিতা করায় আসামির সম্পৃক্ততার যুক্তিকে আরও জোরদার করে।
বাকচরে হিন্দুদের হত্যা ও নিপীড়ন: সপ্তম অভিযোগে বলা হয়, একাত্তরের ১৩ মে মুজাহিদ সহযোগীদের নিয়ে ফরিদপুর সদর থানাধীন হিন্দু অধ্যুষিত বাকচর গ্রামে হামলা চালান। সেখানে কয়েকজন হিন্দুকে হত্যা করা হয়, এক হিন্দুর বাড়ি লুট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এতে ওই হিন্দু পরিবার দেশত্যাগ করে ভারতে চলে যায়।
এ অভিযোগের মূল্যায়নে ট্রাইব্যুনাল বলেন, রাষ্ট্রপক্ষের ১৩তম সাক্ষী শক্তি সাহার সাক্ষ্যে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে আসামি মুজাহিদ অস্ত্র হাতে অপরাধস্থলে উপস্থিত ছিলেন এবং তাঁর ইঙ্গিতেই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। এটা কখনোই দাবি করা হয়নি যে মুজাহিদ সেখানে একা ছিলেন, তাঁর সঙ্গে ফরিদপুরের কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির আহ্বায়ক আফজাল, আলাউদ্দিন খাঁ, কালু বিহারীসহ অন্যরা উপস্থিত ছিল। রাষ্ট্রপক্ষের ১২তম সাক্ষী চিত্তরঞ্জন সাহার সাক্ষ্যে এ বিষয়টি প্রমাণিত। রাষ্ট্রপক্ষের এই দুই সাক্ষীর সাক্ষ্য বিশ্লেষণ করে বোঝা যায়, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের নির্মূল করতেই তাঁরা সেখানে গিয়েছিলেন। আর বিশেষ ধর্মাবলম্বীদের বাড়ি লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে ওই জনগোষ্ঠীর সদস্যদের মূলত বাসভূমি ত্যাগের ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে বা বাধ্য করা হয়েছে। হিন্দুদের দেশান্তর সংঘটিত অপরাধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নয় বরং সেটিই ছিল মূল উদ্দেশ্য। স্পষ্টতই, ওই ঘটনায় দুটি পৃথক অপরাধ ঘটানো হয়েছে। একটি হিন্দুদের হত্যা, অপরটি হিন্দুদের নিপীড়ন। পদাধিকার বলে আসামির অবস্থান একই সঙ্গে তাঁর বিরুদ্ধে ঊর্ধ্বতন কর্তৃত্বের দায় এবং একক ও যৌথ অপরাধের দায় প্রমাণ করে।
নাখালপাড়া সেনাক্যাম্পে আলতাফ মাহমুদ, রুমী, বদি, আজাদ, জুয়েল হত্যাকাণ্ড: পঞ্চম অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ৩০ আগস্ট নাখালপাড়ার পুরাতন এমপি হোস্টেলে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে যান মুজাহিদ। সেখানে বন্দী সুরকার আলতাফ মাহমুদ, জহির উদ্দিন জালাল, বদি, রুমী, জুয়েল, আজাদকে দেখে তাঁরা গালিগালাজ করেন। পরে মুজাহিদের পরামর্শ অনুসারে রাষ্ট্রপতির সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আগে তাঁদের অমানবিক নির্যাতন করে হত্যা করা হয়।
এ অভিযোগের মূল্যায়নে ট্রাইব্যুনাল বলেন, রাষ্ট্রপক্ষের দ্বিতীয় সাক্ষী জহির উদ্দিন জালাল ওই ক্যাম্পে আটক ছিলেন। তিনি শুনেছেন, মুজাহিদ ক্যাপ্টেন কাইয়ুমকে বলছেন, রাষ্ট্রপতির ক্ষমা ঘোষণার আগেই বন্দী রুমী, বদি, জুয়েল ও অন্যদের মেরে ফেলতে হবে। ট্রাইব্যুনাল মনে করেন, একটি নির্ধারিত পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য তিনি এ ধরনের পরামর্শ দিচ্ছেন। সাক্ষ্য বিশ্লেষণে এটাও প্রমাণিত যে বদি, রুমীদের আটক করে আলবদর সদস্যরা থানায় সোপর্দ করে। তাঁদের আটক, নির্যাতন ও হত্যায় আলবদর সদস্যদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। এ জন্য আলবদরের ঊর্ধ্বতন পদাধিকারী মুজাহিদ কোনোভাবেই দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। রুমীদের আটক করার ঘটনা তর্কাতীত, কারণ রুমী স্মারক গ্রন্থ থেকেও তাঁদের ধরে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি সমর্থিত।
ফরিদপুরের রণজিৎ নাথকে আটক রেখে নির্যাতন: মুজাহিদের বিরুদ্ধে তৃতীয় অভিযোগ হলো, একাত্তরের জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে ফরিদপুরের রথখোলা গ্রামের রণজিৎ নাথকে খাবাসপুর মসজিদের কাছ থেকে ধরে পুরাতন সার্কিট হাউসে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে উপস্থিত মুজাহিদের ইঙ্গিতে রণজিৎকে একটি বাড়িতে আটকে রেখে নির্যাতন করে। তবে রাতে রণজিৎ পালিয়ে যান।
এ অভিযোগের মূল্যায়নে ট্রাইব্যুনাল বলেন, সেনাক্যাম্পে মুজাহিদের নিছক উপস্থিতি প্রমাণ করে না যে তিনি অপরাধে সহযোগিতা বা নির্দেশনা দিয়েছিলেন। তবে ক্যাম্পে পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করা এটা প্রমাণ করে যে ওই কর্মকর্তাদের ওপর আসামির কর্তৃত্ব রয়েছে। ক্যাম্পে রণজিৎকে দেখে মুজাহিদ বলেন, ‘ইসকো হটাও’। এটা কোনো নির্দোষ উচ্চারণ নয়, বরং এ উচ্চারণ আদেশ বা নির্দেশনা বোঝায়। যদি এটা নির্দোষ উচ্চারণ হত, তবে রণজিৎকে সেনাক্যাম্প থেকে ছেড়ে দেওয়া হত। বরং এ কথা উচ্চারণের পর তাঁকে নিয়ে অন্য একটি স্থানে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়। রাষ্ট্রপক্ষের সপ্তম সাক্ষী ও ঘটনার শিকার রণজিৎ নাথ নিজে ওই ঘটনার সাক্ষ্য দিয়েছেন, রাষ্ট্রপক্ষের অষ্টম সাক্ষী মীর লুৎফর রহমান ওই সাক্ষ্য সমর্থন করেছেন। রণজিৎকে আটকে রাখার ওই ঘটনা মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে আটকে রেখে নির্যাতনের পর্যায়ে পড়ে।
প্রমাণিত হয়নি দ্বিতীয় ও চতুর্থ অভিযোগ: মুজাহিদের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় অভিযোগ ফরিদপুরের হিন্দু অধ্যুষিত বৈদ্যডাঙ্গি, ভাঙ্গিডাঙ্গি, বালাডাঙ্গি ও মাঝিডাঙ্গি গ্রামে গণহত্যা বা নিপীড়ন এবং চতুর্থ অভিযোগ আবু ইউসুফকে আটকে রেখে নির্যাতন প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ।
দ্বিতীয় অভিযোগের মূল্যায়নে ট্রাইব্যুনাল বলেন, রাষ্ট্রপক্ষের ষষ্ঠ, নবম ও ১১তম সাক্ষীর সাক্ষ্য থেকে এটা প্রমাণিত যে হিন্দু জনগোষ্ঠীকে আংশিকভাবে নির্মূলের উদ্দেশ্যে ওই হামলা চালানো হয়। নবম সাক্ষী বলেছেন, মুজাহিদ হামলাকারীদের সঙ্গী ছিলেন। তদন্ত কর্মকর্তাকে জেরায় এ বক্তব্যে বৈপরীত্য ধরা পড়ে। রাষ্ট্রপক্ষের ১১তম সাক্ষী অপরাধস্থলে আসামিকে দেখার বিষয়ে নিজেই পরস্পরবিরোধী সাক্ষ্য দিয়েছেন। রাষ্ট্রপক্ষের ষষ্ঠ সাক্ষী আসামিকে দেখার বিষয়ে যে শোনা সাক্ষ্য দিয়েছেন, তারও কোনো সূত্র নেই। ট্রাইব্যুনাল মনে করেন, যৌক্তিক বিচারে সাক্ষ্যের এই বৈপরীত্য মুজাহিদের পক্ষে যায় এবং তিনি যে ঘটনাস্থলে ছিলেন তা প্রমাণ হয় না।
রায়ে চতুর্থ অভিযোগের মূল্যায়নে বলা হয়, এ অভিযোগে আসামি কী অপরাধ করেছে—তা প্রমাণ করতে রাষ্ট্রপক্ষ সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে, তিনি অপরাধ সংঘটনের সহযোগিতা করেছেন। আসামির রাজনৈতিক অবস্থান বিবেচনা করে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না যে ফরিদপুরের পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে যত অপরাধ হয়েছে, সবই মুজাহিদের সহযোগিতায় ঘটেছে।
দোষী সাব্যস্তকরণ ও শাস্তি: ট্রাইব্যুনাল বলেন, প্রাপ্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ, দালিলিক নথি ও যুক্তির ভিত্তিতে আসামির বিরুদ্ধে গঠন করা সাতটি অভিযোগের মধ্যে পাঁচটি রাষ্ট্রপক্ষ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে পেরেছে। শাস্তি দেওয়ার বিষয়ে ট্রাইব্যুনাল বলেন, এ ক্ষেত্রে আদালত সম্পূর্ণভাবে সংঘটিত অপরাধের আইনগত প্রকৃতি, অপরাধের মাত্রা, আসামির ভূমিকা ও অবস্থান এবং ঘটনার শিকার হওয়া ব্যক্তি ও পরিবারের সদস্যদের বেদনার মাত্রা বিবেচনা করা হয়েছে। আবার যে অপরাধে শাস্তি দেওয়া হবে, সেই অপরাধের গভীরতা ও এতে আসামির দায়দায়িত্বের মাত্রা বিবেচনা করতে হবে। এসব বিষয় বিবেচনায় তৃতীয় অভিযোগে আসামিকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ও পঞ্চম অভিযোগে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হলো। তবে মানবসভ্যতার বিবেককে বিমূঢ় করা বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের মতো নারকীয় ঘটনা এবং হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের উদ্দেশ্য করে চালানো হত্যাকাণ্ড ও দেশান্তরের মতো গর্হিত অপরাধে আসামির সর্বোচ্চ সাজা প্রাপ্য। এ জন্য ষষ্ঠ ও সপ্তম অভিযোগে আসামি আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদকে ফাঁসির রশিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেওয়া হলো।
ষষ্ঠ অভিযোগের সঙ্গে প্রথম অভিযোগ একীভূত করে ফেলায় এতে আর আলাদা করে শাস্তি ঘোষণা করেননি ট্রাইব্যুনাল। দ্বিতীয় ও চতুর্থ অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় এসব অভিযোগ থেকে আসামিকে খালাস দেওয়া হয়। তবে সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়ায় কারাদণ্ডের শাস্তি একীভূত হয়ে যাবে।
দুপুর পৌনে একটার দিকে রায় ঘোষণা শেষ করে আসন ত্যাগ করেন তিন বিচারক। এ সময় কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে মুজাহিদ বলেন, ‘এটা অবিচার, ইসলামী আন্দোলন করাই আমার অপরাধ। একাত্তরে আমি ফরিদপুরে যাইনি।’ উপস্থিত পুলিশ সদস্যরা তখন তাঁকে নামিয়ে হাজতখানায় নিয়ে যান।
প্রতিক্রিয়া: রায়ের পর রাজধানীর ধানমন্ডিতে নিজের বাসায় আয়োজিত ব্রিফিংয়ে আসামিপক্ষের প্রধান আইনজীবী আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘এই রায়ে আমরা সংক্ষুব্ধ। রায় সম্পূর্ণ ভুল। মাননীয় বিচারপতিদের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখে বলছি, তাঁরা আন্তর্জাতিক আইন অনুধাবন করতে ও এর সঠিক ব্যাখ্যা প্রদানে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেন। তাঁরা যে রায় দিয়েছেন, তা আইনের শাসন ও ন্যায়বিচারের পরিপন্থী।’
রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলিদের সমন্বয়ক এম কে রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ‘রায়ে আমরা সন্তুষ্ট। রাষ্ট্রপক্ষ বেশির ভাগ অভিযোগই প্রমাণ করতে পেরেছে।’ যে দুটি অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি তার বিরুদ্ধে আপিল করা হবে কি না—এ প্রশ্নে তিনি বলেন, রায়ের কপি হাতে পাওয়ার পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
মুজাহিদের বিরুদ্ধে গঠন করা সাতটি অভিযোগের মধ্যে পাঁচটি প্রমাণ করতে পেরেছে রাষ্ট্রপক্ষ। এর মধ্যে ষষ্ঠ অভিযোগ বুদ্ধিজীবী নিধনে সহযোগিতা ও পরিকল্পনা এবং সপ্তম অভিযোগ হিন্দু হত্যা ও নিপীড়নের দায়ে তাঁকে কারাদণ্ডাদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। পঞ্চম অভিযোগ মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে হত্যায় সহযোগিতার দায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও তৃতীয় অভিযোগ মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে আটকে রেখে নির্যাতনের দায়ে তাঁকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। দ্বিতীয় অভিযোগ ও চতুর্থ অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় এ দুটি থেকে তাঁকে খালাস দেওয়া হয়।
মুজাহিদের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণার মধ্য দিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের ষষ্ঠ মামলার রায় ঘোষিত হলো। এর মধ্যে পাঁচটি মামলার আসামিই ছিলেন জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতা, একজন সাবেক সদস্য। গত সোমবার জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমকে ৯০ বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল-১।
গতকাল রায়ের দিন সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে এজলাসে আসামির কাঠগড়ায় হাজির করা হয় সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরা ৬৫ বছরের মুজাহিদকে। ১০ মিনিট পর আসন নেন ট্রাইব্যুনাল-২-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান এবং দুই সদস্য বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও মো. শাহিনুর ইসলাম। ট্রাইব্যুনাল বলেন, পূর্ণাঙ্গ রায় ২০৯ পৃষ্ঠা, এজলাসে ৩৭ পৃষ্ঠার সংক্ষিপ্ত রায় পড়ে শোনানো হবে। বেলা ১১টায় এই ট্রাইব্যুনালের চতুর্থ রায় ঘোষণা শুরু হয়।
রায়ে আসামির পরিচিতিতে ট্রাইব্যুনাল বলেন, এই মামলার আসামি আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে ছাত্রাবস্থায় ইসলামী ছাত্র সংঘে (জামায়াতের তৎকালীন ছাত্র সংগঠন) যোগ দেন। ১৯৬৮-৭০ সালে তিনি ফরিদপুর জেলা ছাত্র সংঘের সভাপতি ছিলেন। ১৯৭০ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন। ওই বছরই তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র সংঘের সেক্রেটারি হন। একাত্তরের অক্টোবরে তিনি ছাত্র সংঘের সভাপতি ও আল-বদর বাহিনীর প্রধান হন বলে দাবি করা হয়। আসামি ১৯৮৬, ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে চারবারই পরাজিত হন। ২০০১-২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে তিনি সমাজকল্যাণ মন্ত্রী ছিলেন।
রায়ের পরবর্তী অংশে ট্রাইব্যুনাল মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগী বাহিনী হিসেবে সশস্ত্র আধাসামরিক বাহিনী আলবদরের কর্মকাণ্ড তুলে ধরেন। আলবদর বাহিনীতে মুজাহিদের অবস্থান প্রসঙ্গে ট্রাইব্যুনাল বলেন, একাত্তরে ছাত্র সংঘের সদস্যরা আলবদর বাহিনীতে রূপান্তরিত হয়। যেহেতু মুজাহিদ ছাত্র সংঘের ঊর্ধ্বতন নেতা ছিলেন, এ জন্য আলবদর ও ছাত্র সংঘ—দুটি সংগঠনের ওপরই তাঁর কর্তৃত্ব ছিল। মুজাহিদ একাত্তরে রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে ক্ষমতাধারী ছিলেন, আর এ ক্ষমতার জন্যই তিনি আলবদর বাহিনীকে দিক-নির্দেশনা দিতে পারতেন। তবে তিনিই এ বাহিনীর একমাত্র নেতা ছিলেন না।
ট্রাইব্যুনাল বলেন, এ জন্য আলবদরের কোনো আনুষ্ঠানিক নথিতে মুজাহিদের নাম থাকা জরুরি নয়। সব ধরনের নথি ও সাক্ষ্য মূল্যায়ন করে বোঝা যায়, মুজাহিদ আলবদর বাহিনীর সব ধরনের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা রাখতেন। অবস্থানগত কারণেই আলবদর গঠন থেকে শুরু করে হত্যা-নিধনযজ্ঞের শেষ পর্যন্ত এ বাহিনীর ওপর তাঁর কর্তৃত্ব ছিল। সেলিম মনসুর খালেদের আলবদর বই অনুসারে, একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর মুজাহিদ আলবদর বাহিনীর উদ্দেশে ‘শেষ ভাষণ’ দেন। মুক্তিযুদ্ধকালে আসামির সঙ্গে আলবদর বাহিনীর অনানুষ্ঠানিক ঊর্ধ্বতন-অধস্তন সম্পর্ক রাষ্ট্রপক্ষ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে পেরেছে। আলবদর সদস্যদের ওপর মুজাহিদের কার্যকর নিয়ন্ত্রণ ছিল এবং আলবদরের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে তিনি সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল ছিলেন।
এরপর মুজাহিদের বিরুদ্ধে গঠন করা মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার সাতটি অভিযোগের মূল্যায়ন তুলে ধরেন ট্রাইব্যুনাল।
সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন হত্যা ও বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড: মুজাহিদের বিরুদ্ধে প্রথম অভিযোগ শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনকে হত্যায় সহযোগিতা করা। একাত্তরের ১০ ডিসেম্বর গভীর রাতে আলবদর সদস্যরা সিরাজুদ্দীন হোসেনকে অপহরণ করে নিয়ে যায়, তাঁর লাশও পরে আর পাওয়া যায়নি। ষষ্ঠ অভিযোগে বলা হয়েছে, মোহাম্মদপুরের শারীরিক শিক্ষা কলেজে পাকিস্তানি সেনা, রাজাকার ও আলবদর ক্যাম্পে মুজাহিদ বাঙালি নিধনের পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র করতেন। ওই ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতায় ১০ ডিসেম্বর থেকে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড শুরু হয়।
প্রথম অভিযোগের মূল্যায়নে ট্রাইব্যুনাল বলেন, প্রখ্যাত সাংবাদিক ও ইত্তেফাক পত্রিকার তৎকালীন কার্যনির্বাহী সম্পাদক সিরাজুদ্দীন হোসেনকে অপহরণ করে আলবদর সদস্যরা, যারা ছিল পাকিস্তানি সেনাদের ‘ডেথ স্কোয়াড’ ও জামায়াতের ‘অ্যাকশন সেকশন’। একাত্তরের সেপ্টেম্বরে তিনি ‘ঠগ বাছতে গাঁ উজাড়’ শীর্ষক একটি নিবন্ধে মূলত পাকিস্তানি সেনা ও তাদের সমর্থকদের সমালোচনা করেন। একাত্তরের ১৬ সেপ্টেম্বর জামায়াতের মুখপত্র সংগ্রাম পত্রিকায় ‘অতএব ঠগ বাছিও না’ শীর্ষক পাল্টা নিবন্ধ ছাপা হয়। ওই নিবন্ধে সিরাজুদ্দীন হোসেনকে ‘ভারতের দালাল’, ‘ব্রাহ্মণ্যবাদের দালাল’ বলে উল্লেখ করা হয়। স্পষ্টতই সিরাজুদ্দীনের লেখনীতে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ প্রতিফলিত হওয়ায় তিনি ঘাতক আলবদর বাহিনীর লক্ষ্যে পরিণত হন। একাত্তরের ২৪ নভেম্বর সংগ্রাম পত্রিকায় আসামির একটি যৌথ বিবৃতি ছাপা হয়, যাতে আসামি ভারতের দালালদের নিশ্চিহ্ন করার আহ্বান জানান। পরবর্তী সময়ে নারকীয় বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড শুরু হয়।
আদালত আরও বলেন, ২০১০ সালের ১৪ ডিসেম্বর একটি দৈনিক পত্রিকায় ছাপা হওয়া ‘কান্ট্রি কুড নট কেয়ারলেস’ শীর্ষক প্রতিবেদন (আসামিপক্ষের নথি) খুঁটিয়ে পড়লে দেখা যায়, যে সশস্ত্র দলটি সিরাজুদ্দীন হোসেনকে অপহরণ করেছিল তার নেতৃত্বে ছিলেন মুজাহিদ। ‘নেতৃত্বে থাকা’ মানে সবসময় এটা দেখানোর দরকার নেই যে ঘটনাস্থলে শারীরিকভাবে উপস্থিত থাকতে হবে। যে ব্যক্তি কর্তৃত্ববাদী অবস্থানে থাকেন, তাঁর নির্দেশনা, আদেশ, উসকানি বা প্ররোচনাও নেতৃত্ব দেওয়ার মধ্যে পড়ে।
ষষ্ঠ অভিযোগের মূল্যায়নে বলা হয়, আলবদর বাহিনীর নীতিনির্ধারণী অংশে আসামি মুজাহিদের অবস্থান ও আলবদরের কার্যক্রমের সঙ্গে তাঁর সংশ্লিষ্টতা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত। রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, মুজাহিদ নিয়মিত মোহাম্মদপুরের শারীরিক শিক্ষা কলেজে আলবদরের ক্যাম্পে যেতেন। বিশেষত একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর ওই আলবদর ক্যাম্পে চরম হতাশা ও কষ্ট নিয়ে দেওয়া তাঁর শেষ ভাষণে তিনি ছাত্র সংঘের সদস্যদের আলবদরে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানান এবং তথাকথিত ‘দুষ্কৃতকারী’, ‘ভারতের দালাল’ ‘ইসলামের শত্রু’দের নিশ্চিহ্ন করতে বলেন। এতে আলবদর বাহিনীতে মুজাহিদের নেতৃত্বস্থানীয় অবস্থান এবং ব্যাপক মাত্রার নিয়ন্ত্রণ ছিল বলে প্রমাণিত হয়।
রায়ে বলা হয়, নাৎসী যুদ্ধাপরাধী অ্যাডলফ আইকম্যান নিজ হাতে কাউকে হত্যা করেননি। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন নাৎসী নিধনের মূল কারিগর। আইকম্যান নাৎসী সংগঠন স্টর্ম ট্রুপারস (এসএ), সিকিউরিটি সার্ভিস (এসডি) ও গেস্টাপো বাহিনীর সদস্য ছিলেন। এই তিনটি বাহিনী ১৯৪৬ সালে ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালে অপরাধী সংগঠন হিসেবে প্রমাণিত হয়েছিল। গেস্টাপো বাহিনীর প্রধান হিসেবে আইকম্যানের মৃত্যুদণ্ড হয়েছিল। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর ও ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে পত্রিকায় প্রকাশিত অসংখ্য প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, শতাধিক বুদ্ধিজীবীকে অপহরণ করে হত্যা করেছিল কুখ্যাত আলবদর বাহিনী। একাত্তরের ১৯ ডিসেম্বর ইত্তেফাক-এ প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের টিভি ও রেডিওর প্রতিনিধিরা মুক্তিযুদ্ধ শেষে মোহাম্মদপুরের শারীরিক শিক্ষা কলেজের কয়েকটি কক্ষে রক্তের স্রোত ভেসে যেতে দেখেন, সেই সঙ্গে বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডে ব্যবহূত অস্ত্রগুলোও পড়ে থাকতে দেখা যায়। এতে বোঝা যায়, ওই কলেজটি ছিল প্রকৃতপক্ষে একটি হত্যাপুরী। এতে প্রমাণিত হয়, একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর আসামি মুজাহিদ শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পূণ্য রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে আলবদর সদস্যদের উদ্দেশে তাঁর শেষ ভাষণ দিয়েছিলেন। রাষ্ট্রপক্ষ এ অভিযোগে আসামির বিরুদ্ধে একক ও যৌথ অপরাধের দায় এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃত্বের দায়—উভয়ই প্রমাণ করতে পেরেছে।
মুজাহিদের বিরুদ্ধে এ দুটি অভিযোগই সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হলেও ট্রাইব্যুনাল আলাদাভাবে তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করেননি। ট্রাইব্যুনাল বলেন, সিরাজুদ্দীন হোসেন হত্যাকাণ্ড, পরিকল্পিত ও ধারাবাহিকভাবে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের একটি অংশ। বরং পৃথকভাবে সিরাজুদ্দীন হোসেন হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ প্রমাণ হওয়া বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা ও সহযোগিতা করায় আসামির সম্পৃক্ততার যুক্তিকে আরও জোরদার করে।
বাকচরে হিন্দুদের হত্যা ও নিপীড়ন: সপ্তম অভিযোগে বলা হয়, একাত্তরের ১৩ মে মুজাহিদ সহযোগীদের নিয়ে ফরিদপুর সদর থানাধীন হিন্দু অধ্যুষিত বাকচর গ্রামে হামলা চালান। সেখানে কয়েকজন হিন্দুকে হত্যা করা হয়, এক হিন্দুর বাড়ি লুট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এতে ওই হিন্দু পরিবার দেশত্যাগ করে ভারতে চলে যায়।
এ অভিযোগের মূল্যায়নে ট্রাইব্যুনাল বলেন, রাষ্ট্রপক্ষের ১৩তম সাক্ষী শক্তি সাহার সাক্ষ্যে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে আসামি মুজাহিদ অস্ত্র হাতে অপরাধস্থলে উপস্থিত ছিলেন এবং তাঁর ইঙ্গিতেই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। এটা কখনোই দাবি করা হয়নি যে মুজাহিদ সেখানে একা ছিলেন, তাঁর সঙ্গে ফরিদপুরের কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির আহ্বায়ক আফজাল, আলাউদ্দিন খাঁ, কালু বিহারীসহ অন্যরা উপস্থিত ছিল। রাষ্ট্রপক্ষের ১২তম সাক্ষী চিত্তরঞ্জন সাহার সাক্ষ্যে এ বিষয়টি প্রমাণিত। রাষ্ট্রপক্ষের এই দুই সাক্ষীর সাক্ষ্য বিশ্লেষণ করে বোঝা যায়, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের নির্মূল করতেই তাঁরা সেখানে গিয়েছিলেন। আর বিশেষ ধর্মাবলম্বীদের বাড়ি লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে ওই জনগোষ্ঠীর সদস্যদের মূলত বাসভূমি ত্যাগের ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে বা বাধ্য করা হয়েছে। হিন্দুদের দেশান্তর সংঘটিত অপরাধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নয় বরং সেটিই ছিল মূল উদ্দেশ্য। স্পষ্টতই, ওই ঘটনায় দুটি পৃথক অপরাধ ঘটানো হয়েছে। একটি হিন্দুদের হত্যা, অপরটি হিন্দুদের নিপীড়ন। পদাধিকার বলে আসামির অবস্থান একই সঙ্গে তাঁর বিরুদ্ধে ঊর্ধ্বতন কর্তৃত্বের দায় এবং একক ও যৌথ অপরাধের দায় প্রমাণ করে।
নাখালপাড়া সেনাক্যাম্পে আলতাফ মাহমুদ, রুমী, বদি, আজাদ, জুয়েল হত্যাকাণ্ড: পঞ্চম অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ৩০ আগস্ট নাখালপাড়ার পুরাতন এমপি হোস্টেলে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে যান মুজাহিদ। সেখানে বন্দী সুরকার আলতাফ মাহমুদ, জহির উদ্দিন জালাল, বদি, রুমী, জুয়েল, আজাদকে দেখে তাঁরা গালিগালাজ করেন। পরে মুজাহিদের পরামর্শ অনুসারে রাষ্ট্রপতির সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আগে তাঁদের অমানবিক নির্যাতন করে হত্যা করা হয়।
এ অভিযোগের মূল্যায়নে ট্রাইব্যুনাল বলেন, রাষ্ট্রপক্ষের দ্বিতীয় সাক্ষী জহির উদ্দিন জালাল ওই ক্যাম্পে আটক ছিলেন। তিনি শুনেছেন, মুজাহিদ ক্যাপ্টেন কাইয়ুমকে বলছেন, রাষ্ট্রপতির ক্ষমা ঘোষণার আগেই বন্দী রুমী, বদি, জুয়েল ও অন্যদের মেরে ফেলতে হবে। ট্রাইব্যুনাল মনে করেন, একটি নির্ধারিত পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য তিনি এ ধরনের পরামর্শ দিচ্ছেন। সাক্ষ্য বিশ্লেষণে এটাও প্রমাণিত যে বদি, রুমীদের আটক করে আলবদর সদস্যরা থানায় সোপর্দ করে। তাঁদের আটক, নির্যাতন ও হত্যায় আলবদর সদস্যদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। এ জন্য আলবদরের ঊর্ধ্বতন পদাধিকারী মুজাহিদ কোনোভাবেই দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। রুমীদের আটক করার ঘটনা তর্কাতীত, কারণ রুমী স্মারক গ্রন্থ থেকেও তাঁদের ধরে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি সমর্থিত।
ফরিদপুরের রণজিৎ নাথকে আটক রেখে নির্যাতন: মুজাহিদের বিরুদ্ধে তৃতীয় অভিযোগ হলো, একাত্তরের জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে ফরিদপুরের রথখোলা গ্রামের রণজিৎ নাথকে খাবাসপুর মসজিদের কাছ থেকে ধরে পুরাতন সার্কিট হাউসে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে উপস্থিত মুজাহিদের ইঙ্গিতে রণজিৎকে একটি বাড়িতে আটকে রেখে নির্যাতন করে। তবে রাতে রণজিৎ পালিয়ে যান।
এ অভিযোগের মূল্যায়নে ট্রাইব্যুনাল বলেন, সেনাক্যাম্পে মুজাহিদের নিছক উপস্থিতি প্রমাণ করে না যে তিনি অপরাধে সহযোগিতা বা নির্দেশনা দিয়েছিলেন। তবে ক্যাম্পে পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করা এটা প্রমাণ করে যে ওই কর্মকর্তাদের ওপর আসামির কর্তৃত্ব রয়েছে। ক্যাম্পে রণজিৎকে দেখে মুজাহিদ বলেন, ‘ইসকো হটাও’। এটা কোনো নির্দোষ উচ্চারণ নয়, বরং এ উচ্চারণ আদেশ বা নির্দেশনা বোঝায়। যদি এটা নির্দোষ উচ্চারণ হত, তবে রণজিৎকে সেনাক্যাম্প থেকে ছেড়ে দেওয়া হত। বরং এ কথা উচ্চারণের পর তাঁকে নিয়ে অন্য একটি স্থানে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়। রাষ্ট্রপক্ষের সপ্তম সাক্ষী ও ঘটনার শিকার রণজিৎ নাথ নিজে ওই ঘটনার সাক্ষ্য দিয়েছেন, রাষ্ট্রপক্ষের অষ্টম সাক্ষী মীর লুৎফর রহমান ওই সাক্ষ্য সমর্থন করেছেন। রণজিৎকে আটকে রাখার ওই ঘটনা মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে আটকে রেখে নির্যাতনের পর্যায়ে পড়ে।
প্রমাণিত হয়নি দ্বিতীয় ও চতুর্থ অভিযোগ: মুজাহিদের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় অভিযোগ ফরিদপুরের হিন্দু অধ্যুষিত বৈদ্যডাঙ্গি, ভাঙ্গিডাঙ্গি, বালাডাঙ্গি ও মাঝিডাঙ্গি গ্রামে গণহত্যা বা নিপীড়ন এবং চতুর্থ অভিযোগ আবু ইউসুফকে আটকে রেখে নির্যাতন প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ।
দ্বিতীয় অভিযোগের মূল্যায়নে ট্রাইব্যুনাল বলেন, রাষ্ট্রপক্ষের ষষ্ঠ, নবম ও ১১তম সাক্ষীর সাক্ষ্য থেকে এটা প্রমাণিত যে হিন্দু জনগোষ্ঠীকে আংশিকভাবে নির্মূলের উদ্দেশ্যে ওই হামলা চালানো হয়। নবম সাক্ষী বলেছেন, মুজাহিদ হামলাকারীদের সঙ্গী ছিলেন। তদন্ত কর্মকর্তাকে জেরায় এ বক্তব্যে বৈপরীত্য ধরা পড়ে। রাষ্ট্রপক্ষের ১১তম সাক্ষী অপরাধস্থলে আসামিকে দেখার বিষয়ে নিজেই পরস্পরবিরোধী সাক্ষ্য দিয়েছেন। রাষ্ট্রপক্ষের ষষ্ঠ সাক্ষী আসামিকে দেখার বিষয়ে যে শোনা সাক্ষ্য দিয়েছেন, তারও কোনো সূত্র নেই। ট্রাইব্যুনাল মনে করেন, যৌক্তিক বিচারে সাক্ষ্যের এই বৈপরীত্য মুজাহিদের পক্ষে যায় এবং তিনি যে ঘটনাস্থলে ছিলেন তা প্রমাণ হয় না।
রায়ে চতুর্থ অভিযোগের মূল্যায়নে বলা হয়, এ অভিযোগে আসামি কী অপরাধ করেছে—তা প্রমাণ করতে রাষ্ট্রপক্ষ সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে, তিনি অপরাধ সংঘটনের সহযোগিতা করেছেন। আসামির রাজনৈতিক অবস্থান বিবেচনা করে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না যে ফরিদপুরের পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে যত অপরাধ হয়েছে, সবই মুজাহিদের সহযোগিতায় ঘটেছে।
দোষী সাব্যস্তকরণ ও শাস্তি: ট্রাইব্যুনাল বলেন, প্রাপ্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ, দালিলিক নথি ও যুক্তির ভিত্তিতে আসামির বিরুদ্ধে গঠন করা সাতটি অভিযোগের মধ্যে পাঁচটি রাষ্ট্রপক্ষ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে পেরেছে। শাস্তি দেওয়ার বিষয়ে ট্রাইব্যুনাল বলেন, এ ক্ষেত্রে আদালত সম্পূর্ণভাবে সংঘটিত অপরাধের আইনগত প্রকৃতি, অপরাধের মাত্রা, আসামির ভূমিকা ও অবস্থান এবং ঘটনার শিকার হওয়া ব্যক্তি ও পরিবারের সদস্যদের বেদনার মাত্রা বিবেচনা করা হয়েছে। আবার যে অপরাধে শাস্তি দেওয়া হবে, সেই অপরাধের গভীরতা ও এতে আসামির দায়দায়িত্বের মাত্রা বিবেচনা করতে হবে। এসব বিষয় বিবেচনায় তৃতীয় অভিযোগে আসামিকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ও পঞ্চম অভিযোগে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হলো। তবে মানবসভ্যতার বিবেককে বিমূঢ় করা বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের মতো নারকীয় ঘটনা এবং হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের উদ্দেশ্য করে চালানো হত্যাকাণ্ড ও দেশান্তরের মতো গর্হিত অপরাধে আসামির সর্বোচ্চ সাজা প্রাপ্য। এ জন্য ষষ্ঠ ও সপ্তম অভিযোগে আসামি আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদকে ফাঁসির রশিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেওয়া হলো।
ষষ্ঠ অভিযোগের সঙ্গে প্রথম অভিযোগ একীভূত করে ফেলায় এতে আর আলাদা করে শাস্তি ঘোষণা করেননি ট্রাইব্যুনাল। দ্বিতীয় ও চতুর্থ অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় এসব অভিযোগ থেকে আসামিকে খালাস দেওয়া হয়। তবে সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়ায় কারাদণ্ডের শাস্তি একীভূত হয়ে যাবে।
দুপুর পৌনে একটার দিকে রায় ঘোষণা শেষ করে আসন ত্যাগ করেন তিন বিচারক। এ সময় কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে মুজাহিদ বলেন, ‘এটা অবিচার, ইসলামী আন্দোলন করাই আমার অপরাধ। একাত্তরে আমি ফরিদপুরে যাইনি।’ উপস্থিত পুলিশ সদস্যরা তখন তাঁকে নামিয়ে হাজতখানায় নিয়ে যান।
প্রতিক্রিয়া: রায়ের পর রাজধানীর ধানমন্ডিতে নিজের বাসায় আয়োজিত ব্রিফিংয়ে আসামিপক্ষের প্রধান আইনজীবী আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘এই রায়ে আমরা সংক্ষুব্ধ। রায় সম্পূর্ণ ভুল। মাননীয় বিচারপতিদের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখে বলছি, তাঁরা আন্তর্জাতিক আইন অনুধাবন করতে ও এর সঠিক ব্যাখ্যা প্রদানে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেন। তাঁরা যে রায় দিয়েছেন, তা আইনের শাসন ও ন্যায়বিচারের পরিপন্থী।’
রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলিদের সমন্বয়ক এম কে রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ‘রায়ে আমরা সন্তুষ্ট। রাষ্ট্রপক্ষ বেশির ভাগ অভিযোগই প্রমাণ করতে পেরেছে।’ যে দুটি অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি তার বিরুদ্ধে আপিল করা হবে কি না—এ প্রশ্নে তিনি বলেন, রায়ের কপি হাতে পাওয়ার পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
No comments