নবজাগ্রত প্রাণ
‘বৈষম্য’ বা ‘বিভেদ’ কথাটির মাধ্যমে যে
অর্থ প্রকাশ পায়, পৃথিবীতে এর চেয়ে ঘৃণ্য কোনো কিছু বোধ হয় নেই। বিশ্বে যত
অশান্তি, অনাচার, অনৈতিকতা- সবকিছুর মূলে রয়েছে বিভেদ। বিভেদ মানে কেবলই
অর্থনৈতিক বৈষম্য নয়; জাতিতে জাতিতে বৈষম্য, ধর্মে ধর্মে বৈষম্য, ভাষাগত
বৈষম্য, গাত্রবর্ণের ভিত্তিতে বৈষম্য, নারী-পুরুষের অধিকারের ক্ষেত্রে
বৈষম্য- এককথায় মানুষে মানুষে বৈষম্য। এ বৈষম্যেরই এক চরম রূপ আমরা দেখেছি
দক্ষিণ আফ্রিকায়। বিস্ময় জাগে, এই সেদিনও সভ্য জগতের একটি দেশ এমন অন্ধকারে
নিমজ্জিত ছিল। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে দক্ষিণ আফ্রিকার এই চরম বর্ণবাদী
শাসনের অবসান ঘটে। সেই বর্ণবাদের কথা আমরা শুনেছি। এ সম্পর্কে পত্রপত্রিকায়
পড়েছি। কিন্তু কেমন ছিল সে বর্ণবাদের চেহারা, তা জানা যায় দক্ষিণ আফ্রিকার
জনগণের অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার আত্মজীবনী গ্রন্থ ‘লং ওয়াক টু
ফ্রিডম’ থেকে। শ্বেতাঙ্গরা জনসংখ্যার মাত্র ১৩ শতাংশ হয়েও তিন শতাব্দীরও
বেশি শাসন করেছে দক্ষিণ আফ্রিকা। এই তো সেদিনের কথা। বর্ণবাদের ভিত গড়তে
কতই না আইন করেছিল তারা। ১৯১৩ সালের ভূমি আইনের মাধ্যমে দেশের ৮৭ ভাগ
ভূখণ্ড থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছিল কৃষ্ণাঙ্গদের। ১৯২৩ সালের নগর এলাকা আইনের
মাধ্যমে কালোদের জন্য শহরতলীতে গড়ে তোলা হয় অসংখ্য বস্তি। উদ্দেশ্য সাদাদের
শিল্প-কারখানার জন্য সস্তায় শ্রমিক সরবরাহ। শহরের কেন্দ্রে বসবাসের অধিকার
ছিল না তাদের। নিজ দেশে চলাফেরায় ছিল না স্বাধীনতা। ছিল না স্বাধীনভাবে
ব্যবসা করার অধিকার।
ম্যান্ডেলা লিখেছেন : ‘একজন আফ্রিকান শিশুর জন্ম হয় শুধু আফ্রিকানদের জন্য নির্দিষ্ট করে দেয়া হাসপাতালে। তাকে বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয় শুধু আফ্রিকানদের বাসে করে। সে বসবাস করে শুধু আফ্রিকানদের এলাকায় এবং পড়াশোনা করে কেবল আফ্রিকানদের স্কুলেÑ যদি আদৌ সে স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পায়। যখন বড় হয়, তখন আফ্রিকানদের জন্য নির্দিষ্ট চাকরিটিই কেবল সে করতে পারে। বাড়িভাড়া নেয় শুধু আফ্রিকানদের জন্য নির্ধারিত শহরতলীতে। চড়ে কেবল আফ্রিকানদের নির্দিষ্ট ট্রেনে। দিনে বা রাতের যে কোনো সময় তাকে পথিমধ্যে পাস দেখানোর নির্দেশ দেয়া হতে পারে। কেউ দেখাতে ব্যর্থ হলে তাকে গ্রেফতার করে জেলে নিক্ষেপ করা হয়। বর্ণবাদী আইন ও নিয়ম-কানুন দ্বারা তার জীবন হয়ে পড়ে নিয়ন্ত্রিত, যা তাকে বেড়ে ওঠার পথে পঙ্গু করে দেয়। তার সম্ভাবনাগুলো ঝাপসা করে ফেলে এবং তার জীবনের বিকাশকে করে দেয় রুদ্ধ।’
দক্ষিণ আফ্রিকার এই চরম বর্ণবাদী নীতিই ছিল কৃষ্ণাঙ্গদের দারিদ্র্যের প্রধান কারণ। ম্যান্ডেলা যখন জোহানেসবার্গে ল’ ফার্মে কেরানির কাজ করার পাশাপাশি পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন তাকে প্রায়ই বাসের ভাড়া বাঁচাতে ১২ মাইল পথ হেঁটে যাওয়া-আসা করতে হতো। বহুদিন তাকে পর্যাপ্ত খাবার ছাড়াই দিন কাটাতে হয়েছে। বদলে পরার মতো বাড়তি পোশাকও ছিল না তার। বর্ণবাদী শাসনের বিরুদ্ধে ম্যান্ডেলাসহ অধিকাংশ রাজনীতিক প্রথমে গান্ধীবাদী অহিংস আন্দোলন করেছেন। কিন্তু এ অহিংস আন্দোলনের ওপরও শুরু হয় দমনপীড়ন। সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটে ১৯৬০ সালের ২১ মার্চ। কয়েকটি নতুন বর্ণবাদী আইনের বিরুদ্ধে ট্রান্সভাল প্রদেশের শার্পভিলে শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভরত জনতার ওপর পুলিশ গুলিবর্ষণ করলে ৬৯ জন নিহত হয়, যাদের অনেকেই ছিল স্কুলের ছাত্রছাত্রী। প্রকৃতপক্ষে এটা ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার ইতিহাসে একটি মোড় ফেরানো ঘটনা। কারণ এ বর্বরোচিত হামলার পর অনেকের মতো ম্যান্ডেলাও সশস্ত্র সংগ্রামের পথ বেছে নেন, যার পরিণতিতে তাকে দীর্ঘ ২৭ বছর কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়।
পরবর্তী সময়ে বন্ধুদের কাছে স্মৃতিচারণকালে ম্যান্ডেলা প্রায়ই একটি ঘটনার উল্লেখ করতেন। উইটওয়াটারস্ট্যান্ড ইউনিভার্সিটিতে আইন পড়ার সময় ক্লাসে তার পাশে যে শ্বেতাঙ্গ সহপাঠীটি বসত, সে ঘনঘন আসন বদল করত। কালোদের এমনই ঘৃণা করত শ্বেতাঙ্গরা। ১৯৯৯ সালে ম্যান্ডেলা যখন দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট, তখন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০তম পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে সেই শ্বেতাঙ্গ সহপাঠীকে আমন্ত্রণ জানানোর ইচ্ছা ছিল তার। কিন্তু তার আগেই ওই সহপাঠীর মৃত্যু হয়েছিল। ম্যান্ডেলা বন্ধুদের কাছে বলেছেন, যদি তার সঙ্গে একটিবার সাক্ষাতের সুযোগ পেতেন তিনি তাহলে তাকে বলতেন, ‘তোমার কি মনে আছে ঘটনাটি? প্লিজ
ঘাবড়িও না। আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিয়েছি।’
ম্যান্ডেলার মহত্ত্ব কোন ক্ষেত্রে বেশি- বর্ণবাদের বিরুদ্ধে আজীবন সংগ্রামের জন্য নাকি তার ক্ষমাশীলতার কারণে, তা নিরূপণ করা কঠিন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলে ২৭ বছর কারারুদ্ধ থাকার নজির আর কারও নেই। যারা তার ওপর নির্যাতন চালিয়েছিল, যারা তাকে রেখেছিল বন্দি করে, মুক্তির পর তাদের ক্ষমা করে দেয়ার মতো ঘটনাও ইতিহাসে বিরল। ম্যান্ডেলার মহানুভবতা ও বিচক্ষণতার কারণেই দক্ষিণ আফ্রিকায় শান্তিপূর্ণভাবে অবসান ঘটে বর্ণবাদী শাসনের। যে শ্বেতাঙ্গরা শতাব্দীর পর শতাব্দী শোষণ ও নির্যাতন চালিয়েছে কালোদের ওপর, তাদের সঙ্গে সমঝোতা বা ঐক্য গড়ে তোলা আর কারও পক্ষেই হয়তো সম্ভব ছিল না। ম্যান্ডেলার সে উদারতা কালোরা মেনে নিয়েছিল, কারণ তিনি ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার সবচেয়ে নির্যাতিত বর্ণবাদবিরোধী নেতা।
মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ম্যান্ডেলা ছিলেন দেশকে ঐক্যবদ্ধ রাখার সবচেয়ে বড় শক্তি। তার মৃত্যুর পর কী ঘটবে, টিকে থাকবে কি-না এ ঐক্য, তা নিয়ে চিন্তিত দেশটির সুশীল সমাজ। কয়েক বছর আগে জোহানেসবার্গের দ্য সানডে টাইমস পত্রিকার প্রধান সম্পাদক মন্দলি মাখানিয়া বলেছিলেন, ‘যে আঠা দক্ষিণ আফ্রিকাকে একত্রে বেঁধে রেখেছে, তা নেলসন ম্যান্ডেলার আদর্শ। তার বয়স যত বাড়ছে, ততই দুর্বল হয়ে পড়ছেন তিনি। কঠিন সত্যটি ঘনিয়ে আসছে দ্রুত। আমরা সবাই সে মুহূর্তটির কথা ভেবে উদ্বিগ্ন। এর কারণ, সবাই
তাকে ভালোবাসে। তবে উদ্বেগের কারণ রয়েছে এ প্রশ্নের মাঝেও- তার মৃত্যুর পর কে ঐক্যবদ্ধ রাখবে আমাদের?’
এটা ঠিক, বর্ণবাদী শাসন অবসানের পরও দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি এখনও শ্বেতাঙ্গদের নিয়ন্ত্রণে। কলকারখানা, স্বর্ণ ও হীরার খনিগুলোর সিংহভাগ মালিকানা তাদের। তবে কৃষ্ণাঙ্গরা ফিরে পেয়েছে রাজনৈতিক অধিকার। বর্ণবাদী আইনও হয়েছে বিলুপ্ত। এ পথ ধরেই একদিন অবসান ঘটতে পারে অর্থনৈতিক বৈষম্যের- যদি জনগণ থাকে ঐক্যবদ্ধ। যদি ফিরে না আসে বর্ণবাদ এবং গোষ্ঠী ও জাতিগত সংঘাত। নিজেদের মধ্যে হানাহানি একটি দেশকে কীভাবে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে, পিছিয়ে দেয় নানা ক্ষেত্রে, দক্ষিণ আফ্রিকা তার বড় উদাহরণ। বর্ণবাদের অবসানে সে দেশটি আজ মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে। বর্তমানে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় ম্যান্ডেলা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। গত তিন-চার বছর ধরেই তার স্বাস্থ্য নিয়ে চলছে জল্পনা-কল্পনা। এ সময় তাকে খুব কমই জনসমক্ষে দেখা গেছে। বস্তুত জীবনের একটি বড় অংশ তিনি কারারুদ্ধ থাকায় পৃথিবীর খোলা আলো-বাতাস থেকে বঞ্চিত থেকেছেন। আমরা চাই, মুক্ত জীবনে আরও বহুদিন বেঁচে থাকুন তিনি। পৃথিবীতে নেলসন ম্যান্ডেলার মতো মানুষের জন্ম বিরল ঘটনা। এমন মানুষের জন্ম হয় কালেভদ্রে, হাজার বছরে একবার। আজ সেই মানুষটির ৯৫তম জন্মদিন উদ্ভাসিত হোক বিশ্বজুড়ে অগণিত মানুষের শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায়।
আসিফ রশীদ : সাংবাদিক ও লেখক
ম্যান্ডেলা লিখেছেন : ‘একজন আফ্রিকান শিশুর জন্ম হয় শুধু আফ্রিকানদের জন্য নির্দিষ্ট করে দেয়া হাসপাতালে। তাকে বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয় শুধু আফ্রিকানদের বাসে করে। সে বসবাস করে শুধু আফ্রিকানদের এলাকায় এবং পড়াশোনা করে কেবল আফ্রিকানদের স্কুলেÑ যদি আদৌ সে স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পায়। যখন বড় হয়, তখন আফ্রিকানদের জন্য নির্দিষ্ট চাকরিটিই কেবল সে করতে পারে। বাড়িভাড়া নেয় শুধু আফ্রিকানদের জন্য নির্ধারিত শহরতলীতে। চড়ে কেবল আফ্রিকানদের নির্দিষ্ট ট্রেনে। দিনে বা রাতের যে কোনো সময় তাকে পথিমধ্যে পাস দেখানোর নির্দেশ দেয়া হতে পারে। কেউ দেখাতে ব্যর্থ হলে তাকে গ্রেফতার করে জেলে নিক্ষেপ করা হয়। বর্ণবাদী আইন ও নিয়ম-কানুন দ্বারা তার জীবন হয়ে পড়ে নিয়ন্ত্রিত, যা তাকে বেড়ে ওঠার পথে পঙ্গু করে দেয়। তার সম্ভাবনাগুলো ঝাপসা করে ফেলে এবং তার জীবনের বিকাশকে করে দেয় রুদ্ধ।’
দক্ষিণ আফ্রিকার এই চরম বর্ণবাদী নীতিই ছিল কৃষ্ণাঙ্গদের দারিদ্র্যের প্রধান কারণ। ম্যান্ডেলা যখন জোহানেসবার্গে ল’ ফার্মে কেরানির কাজ করার পাশাপাশি পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন তাকে প্রায়ই বাসের ভাড়া বাঁচাতে ১২ মাইল পথ হেঁটে যাওয়া-আসা করতে হতো। বহুদিন তাকে পর্যাপ্ত খাবার ছাড়াই দিন কাটাতে হয়েছে। বদলে পরার মতো বাড়তি পোশাকও ছিল না তার। বর্ণবাদী শাসনের বিরুদ্ধে ম্যান্ডেলাসহ অধিকাংশ রাজনীতিক প্রথমে গান্ধীবাদী অহিংস আন্দোলন করেছেন। কিন্তু এ অহিংস আন্দোলনের ওপরও শুরু হয় দমনপীড়ন। সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটে ১৯৬০ সালের ২১ মার্চ। কয়েকটি নতুন বর্ণবাদী আইনের বিরুদ্ধে ট্রান্সভাল প্রদেশের শার্পভিলে শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভরত জনতার ওপর পুলিশ গুলিবর্ষণ করলে ৬৯ জন নিহত হয়, যাদের অনেকেই ছিল স্কুলের ছাত্রছাত্রী। প্রকৃতপক্ষে এটা ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার ইতিহাসে একটি মোড় ফেরানো ঘটনা। কারণ এ বর্বরোচিত হামলার পর অনেকের মতো ম্যান্ডেলাও সশস্ত্র সংগ্রামের পথ বেছে নেন, যার পরিণতিতে তাকে দীর্ঘ ২৭ বছর কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়।
পরবর্তী সময়ে বন্ধুদের কাছে স্মৃতিচারণকালে ম্যান্ডেলা প্রায়ই একটি ঘটনার উল্লেখ করতেন। উইটওয়াটারস্ট্যান্ড ইউনিভার্সিটিতে আইন পড়ার সময় ক্লাসে তার পাশে যে শ্বেতাঙ্গ সহপাঠীটি বসত, সে ঘনঘন আসন বদল করত। কালোদের এমনই ঘৃণা করত শ্বেতাঙ্গরা। ১৯৯৯ সালে ম্যান্ডেলা যখন দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট, তখন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০তম পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে সেই শ্বেতাঙ্গ সহপাঠীকে আমন্ত্রণ জানানোর ইচ্ছা ছিল তার। কিন্তু তার আগেই ওই সহপাঠীর মৃত্যু হয়েছিল। ম্যান্ডেলা বন্ধুদের কাছে বলেছেন, যদি তার সঙ্গে একটিবার সাক্ষাতের সুযোগ পেতেন তিনি তাহলে তাকে বলতেন, ‘তোমার কি মনে আছে ঘটনাটি? প্লিজ
ঘাবড়িও না। আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিয়েছি।’
ম্যান্ডেলার মহত্ত্ব কোন ক্ষেত্রে বেশি- বর্ণবাদের বিরুদ্ধে আজীবন সংগ্রামের জন্য নাকি তার ক্ষমাশীলতার কারণে, তা নিরূপণ করা কঠিন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলে ২৭ বছর কারারুদ্ধ থাকার নজির আর কারও নেই। যারা তার ওপর নির্যাতন চালিয়েছিল, যারা তাকে রেখেছিল বন্দি করে, মুক্তির পর তাদের ক্ষমা করে দেয়ার মতো ঘটনাও ইতিহাসে বিরল। ম্যান্ডেলার মহানুভবতা ও বিচক্ষণতার কারণেই দক্ষিণ আফ্রিকায় শান্তিপূর্ণভাবে অবসান ঘটে বর্ণবাদী শাসনের। যে শ্বেতাঙ্গরা শতাব্দীর পর শতাব্দী শোষণ ও নির্যাতন চালিয়েছে কালোদের ওপর, তাদের সঙ্গে সমঝোতা বা ঐক্য গড়ে তোলা আর কারও পক্ষেই হয়তো সম্ভব ছিল না। ম্যান্ডেলার সে উদারতা কালোরা মেনে নিয়েছিল, কারণ তিনি ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার সবচেয়ে নির্যাতিত বর্ণবাদবিরোধী নেতা।
মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ম্যান্ডেলা ছিলেন দেশকে ঐক্যবদ্ধ রাখার সবচেয়ে বড় শক্তি। তার মৃত্যুর পর কী ঘটবে, টিকে থাকবে কি-না এ ঐক্য, তা নিয়ে চিন্তিত দেশটির সুশীল সমাজ। কয়েক বছর আগে জোহানেসবার্গের দ্য সানডে টাইমস পত্রিকার প্রধান সম্পাদক মন্দলি মাখানিয়া বলেছিলেন, ‘যে আঠা দক্ষিণ আফ্রিকাকে একত্রে বেঁধে রেখেছে, তা নেলসন ম্যান্ডেলার আদর্শ। তার বয়স যত বাড়ছে, ততই দুর্বল হয়ে পড়ছেন তিনি। কঠিন সত্যটি ঘনিয়ে আসছে দ্রুত। আমরা সবাই সে মুহূর্তটির কথা ভেবে উদ্বিগ্ন। এর কারণ, সবাই
তাকে ভালোবাসে। তবে উদ্বেগের কারণ রয়েছে এ প্রশ্নের মাঝেও- তার মৃত্যুর পর কে ঐক্যবদ্ধ রাখবে আমাদের?’
এটা ঠিক, বর্ণবাদী শাসন অবসানের পরও দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি এখনও শ্বেতাঙ্গদের নিয়ন্ত্রণে। কলকারখানা, স্বর্ণ ও হীরার খনিগুলোর সিংহভাগ মালিকানা তাদের। তবে কৃষ্ণাঙ্গরা ফিরে পেয়েছে রাজনৈতিক অধিকার। বর্ণবাদী আইনও হয়েছে বিলুপ্ত। এ পথ ধরেই একদিন অবসান ঘটতে পারে অর্থনৈতিক বৈষম্যের- যদি জনগণ থাকে ঐক্যবদ্ধ। যদি ফিরে না আসে বর্ণবাদ এবং গোষ্ঠী ও জাতিগত সংঘাত। নিজেদের মধ্যে হানাহানি একটি দেশকে কীভাবে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে, পিছিয়ে দেয় নানা ক্ষেত্রে, দক্ষিণ আফ্রিকা তার বড় উদাহরণ। বর্ণবাদের অবসানে সে দেশটি আজ মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে। বর্তমানে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় ম্যান্ডেলা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। গত তিন-চার বছর ধরেই তার স্বাস্থ্য নিয়ে চলছে জল্পনা-কল্পনা। এ সময় তাকে খুব কমই জনসমক্ষে দেখা গেছে। বস্তুত জীবনের একটি বড় অংশ তিনি কারারুদ্ধ থাকায় পৃথিবীর খোলা আলো-বাতাস থেকে বঞ্চিত থেকেছেন। আমরা চাই, মুক্ত জীবনে আরও বহুদিন বেঁচে থাকুন তিনি। পৃথিবীতে নেলসন ম্যান্ডেলার মতো মানুষের জন্ম বিরল ঘটনা। এমন মানুষের জন্ম হয় কালেভদ্রে, হাজার বছরে একবার। আজ সেই মানুষটির ৯৫তম জন্মদিন উদ্ভাসিত হোক বিশ্বজুড়ে অগণিত মানুষের শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায়।
আসিফ রশীদ : সাংবাদিক ও লেখক
No comments