গাজীপুরের নির্বাচন ও প্রবাসীদের ভাবনা by তারেক শামসুর রেহমান
গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচন ঢাকাতে
যেভাবে প্রভাব ফেলেছে, ঠিক তেমনি প্রভাব ফেলেছে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী
বাঙালিদের মধ্যেও। নিউ ইয়র্কে বাস করেন বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি।
জ্যাকসন হাইটস, যা বাঙালিপাড়া হিসেবে পরিচিত, সেখানে বিপুলসংখ্যক মানুষের
মধ্যে এই নির্বাচনের ব্যাপারে আগ্রহ দেখেছি। এখানেও বাঙালিরা রাজনৈতিকভাবে
দুটি বড় দলের মধ্যে বিভক্ত। সে ক্ষেত্রে নির্বাচনের আগের দিন কী হয়, না হয়,
সে ব্যাপারে যথেষ্ট আগ্রহ দেখেছি বাঙালিদের মধ্যে। একটা জিনিস আমাকে খুব
অবাক করেছে, আর তা হচ্ছে এখানে যাঁরা বসবাস করেন, তাঁরা বাংলাদেশের
রাজনীতির বাইরে থাকতে চান না। তাঁরা খুব আগ্রহসহকারেই রাজনীতির গতিবিধি
পর্যবেক্ষণ করেন। অনেকে আমাকে এমন প্রশ্নও করেছেন যে এরপর কী? বিএনপি তথা
১৮ দলীয় জোট কি শেষ পর্যন্ত এ বছরের শেষের দিকে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ
নির্বাচনে অংশ নেবে? অনেকে আমাকে এ প্রশ্নও করেছেন যে যদি বিএনপি সংবিধান
বর্ণিত 'অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের' আওতায় নির্বাচনে অংশ না নেয়, তাহলে
পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?
প্রবাসীদের মধ্যে যাঁরা আওয়ামী লীগের সমর্থক, তাঁদেরও বলতে শুনেছি, গত সাড়ে চার বছরের শাসনামলে আওয়ামী লীগের বড় সমস্যা ছিল সুশাসনের অভাব। পরপর পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের হেরে যাওয়ার পেছনে মূল কারণ ছিল একটাই- সুশাসনের অভাব। দলটিতে যথেষ্ট অভিজ্ঞতাসম্পন্ন রাজনৈতিক নেতা রয়েছেন। কিন্তু অনেকেই ছিলেন নিষ্ক্রিয়। অথবা প্রধানমন্ত্রী তাঁদের 'ব্যবহার' করতে পারেননি। অনেকে আমাকে এমন কথাও বলেছেন যে তোফায়েল আহমেদের মতো লোকদের 'সার্ভিস' থেকে দল বঞ্চিত হয়েছে। তোফায়েলকে যদি আগে থেকে মূল রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় আনা যেত, আওয়ামী লীগ আজকের মতো ইমেজ সংকটে পড়ত না। বিতর্কিত নেতা তথা মন্ত্রীদের মন্ত্রিসভায় রেখে দেওয়া আওয়ামী লীগের 'ইমেজ সংকট'-এ এতটুকু সাহায্য করেনি। বরং দল পরিচালনায় ও মন্ত্রিসভায় যদি যোগ্য ব্যক্তিদের স্থান দেওয়া যেত, তাহলে আজকের পরিস্থিতি এ পর্যায়ে উন্নীত হতো না। অনেকেই মন্ত্রীদের দুর্নীতি, ছাত্রলীগের সন্ত্রাস ও টেন্ডারবাজি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। বলেছেন, একটি সভ্য দেশে এসব অকল্পনীয়। অনেকেই প্রশ্ন করেছেন, প্রধানমন্ত্রী কেন এসব লোকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারলেন না? এদের প্রায় সবারই ধারণা, বাংলাদেশের একটা বিশাল সম্ভাবনা ছিল। আমাদের রাজনীতিবিদরা বাংলাদেশের সেই সম্ভাবনার মৃত্যু ঘটিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রে যাঁরা বাস করেন, তাঁরা সবচেয়ে বেশি আহত হয়েছেন সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের অবনতি হতে দেখে। তাঁদের মতে, এতে করে যেসব বাঙালি যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করেন, তাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এরই মধ্যে বাঙালিদের সম্পর্কে খারাপ একটা ধারণা জন্ম হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। অনেকেই মনে করেন, বাংলাদেশ সরকার ড. ইউনূসের সঙ্গে যে ব্যবহার করেছে, তা করা উচিত হয়নি। ড. ইউনূস বিশ্বব্যাপী পরিচিত ব্যক্তি। তাঁর গ্রামীণ ব্যাংক খোদ যুক্তরাষ্ট্রেও কোনো কোনো স্টেটে মডেল হিসেবে দেখা হচ্ছে। কিন্তু দেশের স্বার্থে তাঁকে ব্যবহার না করে দেশেরই ক্ষতি হয়েছে।
বাংলাদেশের রাজনীতি যেভাবে চলছে, সেভাবে চলতে দেওয়া উচিত না বলেও প্রায় সবার অভিমত। প্রবাসীরা মনে করেন, যেহেতু নির্বাচন সামনে, সেহেতু বিএনপির উচিত হবে নির্বাচনে অংশ নেওয়া। নির্বাচনে অংশ না নিলে বিএনপিরই ক্ষতি- এটিও মনে করেন অনেকে। আর নির্বাচন কোন প্রক্রিয়ায় অনুষ্ঠিত হবে, সেটা নিয়েও সরকারের উচিত বিএনপির সঙ্গে কথাবার্তা বলা। জরুরি একটা সংলাপ হওয়া উচিত। না হলে দেশ আরো গভীর সংকটে পড়বে। রাজনীতিবিদরা আরো 'ম্যাচিওরিটি'র পরিচয় দেবেন, এটাও প্রত্যাশা করেন অনেকে। তবে কোনো অসাংবিধানিক শক্তির ক্ষমতা গ্রহণকেও তাঁরা পছন্দ করছেন না। মুরসির ক্ষমতাচ্যুতির বিষয়টি নিয়েও আলোচনা হয়েছে। মিসর আর বাংলাদেশ এক নয়। মুসলিম ব্রাদারহুডের মতো কট্টর ইসলামপন্থীরা বাংলাদেশে ক্ষমতায় নেই। যারা ক্ষমতায়, তারা অসাম্প্রদায়িক একটি দল। আওয়ামী লীগের অসাম্প্রদায়িক চরিত্র আজকের নয়, বরং অনেক পুরনো। অন্যদিকে বিএনপিকে একটি ইসলামপন্থী দল হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে না। ইসলামকে দলটি ধারণ করে বটে; কিন্তু তারা আদৌ কট্টরপন্থী নয়। সুতরাং বাংলাদেশের সঙ্গে মিসরের পরিস্থিতিকে মেলানো যাবে না। বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিসরের সেনাবাহিনীরও কোনো তুলনা চলবে না। ১৯৫২ সাল থেকেই সেনাবাহিনী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মিসরের ক্ষমতা পরিচালনা করে আসছে। মিসরের অর্থনীতিতে সেখানকার সেনাবাহিনীর বিশাল বিনিয়োগ রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের সেনাবাহিনী এ মুহূর্তে 'টোটালি প্রফেশনাল'। রাজনীতির প্রতি তাদের আদৌ আগ্রহ নেই। তাই মিসরের পরিস্থিতির সঙ্গে বাংলাদেশের পরিস্থিতিকে মেলানো যাবে না।
গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে একটি জাতীয় নির্বাচনের আবহ ফিরে এসেছে। এ নির্বাচন থেকে আওয়ামী লীগ কতটুকু শিখবে, সেটাও একটা বড় প্রশ্ন। নির্বাচনের পর পরই প্রধানমন্ত্রী ব্যক্তিগত সফরে লন্ডন ও পরে বেলারুশ গেছেন। এই নিউ ইয়র্কে অনেককে আক্ষেপ করতে শুনেছি যে এ মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রীর দেশে থাকা উচিত ছিল। গাজীপুর পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে শীর্ষস্থানীয় দলীয় নেতাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ও স্ট্র্যাটেজি গ্রহণ করা উচিত ছিল। তা না করে বেলারুশের সফরকে গুরুত্ব দেওয়ায় অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতিতে বেলারুশ কোনো গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর নয়। এ মুহূর্তে বেলারুশের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধি আমাদের জাতীয় স্বার্থেও কোনো বড় অবদান রাখতে পারবে না। প্রধানমন্ত্রী গাজীপুরের নির্বাচনের ফলকেও খুব বেশি গুরুত্ব দেননি।
এটা সত্য, স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনের সঙ্গে জাতীয় পর্যায়ের নির্বাচনের কোনো তুলনা করা যাবে না। কিন্তু এটা আওয়ামী লীগের জন্য একটা 'ওয়েক-আপ' ফল। সিলেট, রাজশাহী, বরিশাল ও খুলনা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের ফলের ধারাবাহিকতায় গাজীপুরেও একই ফল বয়ে আনল বিএনপির জন্য। এতে করে বিএনপি আরো উৎসাহিত হবে, সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু বিএনপির জন্যও সামনের দিনগুলো খুব সহজ নয়। সংবিধান আওয়ামী লীগকে একটা সুবিধাজনক অবস্থানে এনে দিয়েছে। আওয়ামী লীগ এখন অব্দি তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে এতটুকু ছাড় দিতে রাজি নয়। অন্যদিকে বিএনপির দাবি- তত্ত্বাবধায়ক সরকার দিতে হবে। এখন একদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার, অন্যদিকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার- এই দুইয়ের মধ্যে একটা সমন্বয় প্রয়োজন। এটা কিভাবে সম্ভব- তা নির্ধারণ করতে হবে রাজনীতিবিদদেরই। এখানে অনেকেই আমাকে বলেছেন, শেষ মুহূর্তে হয়তো একটা সমঝোতা হবে। কেননা আওয়ামী লীগ ভালো করেই জানে বিএনপিকে বাদ দিয়ে যে নির্বাচন, সে নির্বাচনের কোনো গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না। আর আওয়ামী লীগ যদি সত্যি সত্যিই বিএনপিকে বাদ দিয়ে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যায়, তাহলে তা দলটির অস্তিত্বকেও একটা হুমকির মুখে ঠেলে দিতে পারে। অনেকেই বিশ্বাস করেন, যাঁরা প্রধানমন্ত্রীকে উপদেশ দিচ্ছেন, তাঁরা তাঁকে সঠিক উপদেশটি দিচ্ছেন না। দলের ভেতরে কট্টরপন্থীদের দ্বারা তিনি বেশি মাত্রায় প্রভাবান্বিত। এক সময় যাঁরা মস্কোপন্থী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তাঁরা বেশি মাত্রায় দলের নীতি-নির্ধারণীতে প্রভাব ফেলেছেন, এমন কথাও অনেকের মুখ থেকে শুনেছি। তাঁদের 'ভুলের' কারণে দলকে আজ এ পরিস্থিতি বরণ করতে হয়েছে।
সর্বশেষ গাজীপুর নির্বাচন সরকারকে একটি 'সিগন্যাল' দিয়েছে- এ থেকে সরকার কতটুকু শিখবে, সেটা ভিন্ন প্রশ্ন। কিন্তু সরকারের কঠোর অবস্থান বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে যে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দেবে, তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। ক্যাপিটল হিলে বাংলাদেশ একটি আলোচিত নাম। বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটা নেতিবাচক ধারণার জন্ম হয়েছে। গার্মেন্টে শ্রমমান, হাজার শ্রমিকের মৃত্যু, সুশাসনের অভাব, র্যাবের মানবতাবিরোধী অপরাধ, শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলাম হত্যাকাণ্ডের বিচার না হওয়া, পদ্মা সেতুতে দুর্নীতি, শেয়ারবাজার, ড. ইউনূস ইত্যাদি কারণে ক্যাপিটল হিলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি খুব উজ্জ্বল নয়। এখন যদি আওয়ামী লীগ এককভাবে নির্বাচন করে, সেটাও দেশটির ভাবমূর্তির জন্য কোনো ভালো সংবাদ বয়ে আনবে না। দাতা সংস্থা ও দেশগুলোর সাহায্য প্রতিশ্রুতিও ঝুঁকির মুখে থাকবে। তাই পরাজয়ের একটা ঝুঁকির মুখে থাকলেও আওয়ামী লীগ তথা সরকারকে 'সব দলের অংশগ্রহণের' একটি নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। এতে বরং আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি আরো উজ্জ্বল হবে। প্রবাসীরা চান, দেশে একটা স্থিতিশীলতা বিরাজ করুক। সুশাসন নিশ্চিত হোক। জনগণ তাদের অধিকার প্রয়োগ করুক। সিলেট থেকে সর্বশেষ গাজীপুর, সাধারণ জনগণ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এমনটিই ঘটুক- এটাই প্রত্যাশা প্রবাসীদের।
নিউ ইয়র্ক, ৮ জুলাই, ২০১৩
লেখক : অধ্যাপক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
প্রবাসীদের মধ্যে যাঁরা আওয়ামী লীগের সমর্থক, তাঁদেরও বলতে শুনেছি, গত সাড়ে চার বছরের শাসনামলে আওয়ামী লীগের বড় সমস্যা ছিল সুশাসনের অভাব। পরপর পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের হেরে যাওয়ার পেছনে মূল কারণ ছিল একটাই- সুশাসনের অভাব। দলটিতে যথেষ্ট অভিজ্ঞতাসম্পন্ন রাজনৈতিক নেতা রয়েছেন। কিন্তু অনেকেই ছিলেন নিষ্ক্রিয়। অথবা প্রধানমন্ত্রী তাঁদের 'ব্যবহার' করতে পারেননি। অনেকে আমাকে এমন কথাও বলেছেন যে তোফায়েল আহমেদের মতো লোকদের 'সার্ভিস' থেকে দল বঞ্চিত হয়েছে। তোফায়েলকে যদি আগে থেকে মূল রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় আনা যেত, আওয়ামী লীগ আজকের মতো ইমেজ সংকটে পড়ত না। বিতর্কিত নেতা তথা মন্ত্রীদের মন্ত্রিসভায় রেখে দেওয়া আওয়ামী লীগের 'ইমেজ সংকট'-এ এতটুকু সাহায্য করেনি। বরং দল পরিচালনায় ও মন্ত্রিসভায় যদি যোগ্য ব্যক্তিদের স্থান দেওয়া যেত, তাহলে আজকের পরিস্থিতি এ পর্যায়ে উন্নীত হতো না। অনেকেই মন্ত্রীদের দুর্নীতি, ছাত্রলীগের সন্ত্রাস ও টেন্ডারবাজি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। বলেছেন, একটি সভ্য দেশে এসব অকল্পনীয়। অনেকেই প্রশ্ন করেছেন, প্রধানমন্ত্রী কেন এসব লোকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারলেন না? এদের প্রায় সবারই ধারণা, বাংলাদেশের একটা বিশাল সম্ভাবনা ছিল। আমাদের রাজনীতিবিদরা বাংলাদেশের সেই সম্ভাবনার মৃত্যু ঘটিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রে যাঁরা বাস করেন, তাঁরা সবচেয়ে বেশি আহত হয়েছেন সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের অবনতি হতে দেখে। তাঁদের মতে, এতে করে যেসব বাঙালি যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করেন, তাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এরই মধ্যে বাঙালিদের সম্পর্কে খারাপ একটা ধারণা জন্ম হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। অনেকেই মনে করেন, বাংলাদেশ সরকার ড. ইউনূসের সঙ্গে যে ব্যবহার করেছে, তা করা উচিত হয়নি। ড. ইউনূস বিশ্বব্যাপী পরিচিত ব্যক্তি। তাঁর গ্রামীণ ব্যাংক খোদ যুক্তরাষ্ট্রেও কোনো কোনো স্টেটে মডেল হিসেবে দেখা হচ্ছে। কিন্তু দেশের স্বার্থে তাঁকে ব্যবহার না করে দেশেরই ক্ষতি হয়েছে।
বাংলাদেশের রাজনীতি যেভাবে চলছে, সেভাবে চলতে দেওয়া উচিত না বলেও প্রায় সবার অভিমত। প্রবাসীরা মনে করেন, যেহেতু নির্বাচন সামনে, সেহেতু বিএনপির উচিত হবে নির্বাচনে অংশ নেওয়া। নির্বাচনে অংশ না নিলে বিএনপিরই ক্ষতি- এটিও মনে করেন অনেকে। আর নির্বাচন কোন প্রক্রিয়ায় অনুষ্ঠিত হবে, সেটা নিয়েও সরকারের উচিত বিএনপির সঙ্গে কথাবার্তা বলা। জরুরি একটা সংলাপ হওয়া উচিত। না হলে দেশ আরো গভীর সংকটে পড়বে। রাজনীতিবিদরা আরো 'ম্যাচিওরিটি'র পরিচয় দেবেন, এটাও প্রত্যাশা করেন অনেকে। তবে কোনো অসাংবিধানিক শক্তির ক্ষমতা গ্রহণকেও তাঁরা পছন্দ করছেন না। মুরসির ক্ষমতাচ্যুতির বিষয়টি নিয়েও আলোচনা হয়েছে। মিসর আর বাংলাদেশ এক নয়। মুসলিম ব্রাদারহুডের মতো কট্টর ইসলামপন্থীরা বাংলাদেশে ক্ষমতায় নেই। যারা ক্ষমতায়, তারা অসাম্প্রদায়িক একটি দল। আওয়ামী লীগের অসাম্প্রদায়িক চরিত্র আজকের নয়, বরং অনেক পুরনো। অন্যদিকে বিএনপিকে একটি ইসলামপন্থী দল হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে না। ইসলামকে দলটি ধারণ করে বটে; কিন্তু তারা আদৌ কট্টরপন্থী নয়। সুতরাং বাংলাদেশের সঙ্গে মিসরের পরিস্থিতিকে মেলানো যাবে না। বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিসরের সেনাবাহিনীরও কোনো তুলনা চলবে না। ১৯৫২ সাল থেকেই সেনাবাহিনী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মিসরের ক্ষমতা পরিচালনা করে আসছে। মিসরের অর্থনীতিতে সেখানকার সেনাবাহিনীর বিশাল বিনিয়োগ রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের সেনাবাহিনী এ মুহূর্তে 'টোটালি প্রফেশনাল'। রাজনীতির প্রতি তাদের আদৌ আগ্রহ নেই। তাই মিসরের পরিস্থিতির সঙ্গে বাংলাদেশের পরিস্থিতিকে মেলানো যাবে না।
গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে একটি জাতীয় নির্বাচনের আবহ ফিরে এসেছে। এ নির্বাচন থেকে আওয়ামী লীগ কতটুকু শিখবে, সেটাও একটা বড় প্রশ্ন। নির্বাচনের পর পরই প্রধানমন্ত্রী ব্যক্তিগত সফরে লন্ডন ও পরে বেলারুশ গেছেন। এই নিউ ইয়র্কে অনেককে আক্ষেপ করতে শুনেছি যে এ মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রীর দেশে থাকা উচিত ছিল। গাজীপুর পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে শীর্ষস্থানীয় দলীয় নেতাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ও স্ট্র্যাটেজি গ্রহণ করা উচিত ছিল। তা না করে বেলারুশের সফরকে গুরুত্ব দেওয়ায় অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতিতে বেলারুশ কোনো গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর নয়। এ মুহূর্তে বেলারুশের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধি আমাদের জাতীয় স্বার্থেও কোনো বড় অবদান রাখতে পারবে না। প্রধানমন্ত্রী গাজীপুরের নির্বাচনের ফলকেও খুব বেশি গুরুত্ব দেননি।
এটা সত্য, স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনের সঙ্গে জাতীয় পর্যায়ের নির্বাচনের কোনো তুলনা করা যাবে না। কিন্তু এটা আওয়ামী লীগের জন্য একটা 'ওয়েক-আপ' ফল। সিলেট, রাজশাহী, বরিশাল ও খুলনা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের ফলের ধারাবাহিকতায় গাজীপুরেও একই ফল বয়ে আনল বিএনপির জন্য। এতে করে বিএনপি আরো উৎসাহিত হবে, সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু বিএনপির জন্যও সামনের দিনগুলো খুব সহজ নয়। সংবিধান আওয়ামী লীগকে একটা সুবিধাজনক অবস্থানে এনে দিয়েছে। আওয়ামী লীগ এখন অব্দি তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে এতটুকু ছাড় দিতে রাজি নয়। অন্যদিকে বিএনপির দাবি- তত্ত্বাবধায়ক সরকার দিতে হবে। এখন একদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার, অন্যদিকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার- এই দুইয়ের মধ্যে একটা সমন্বয় প্রয়োজন। এটা কিভাবে সম্ভব- তা নির্ধারণ করতে হবে রাজনীতিবিদদেরই। এখানে অনেকেই আমাকে বলেছেন, শেষ মুহূর্তে হয়তো একটা সমঝোতা হবে। কেননা আওয়ামী লীগ ভালো করেই জানে বিএনপিকে বাদ দিয়ে যে নির্বাচন, সে নির্বাচনের কোনো গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না। আর আওয়ামী লীগ যদি সত্যি সত্যিই বিএনপিকে বাদ দিয়ে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যায়, তাহলে তা দলটির অস্তিত্বকেও একটা হুমকির মুখে ঠেলে দিতে পারে। অনেকেই বিশ্বাস করেন, যাঁরা প্রধানমন্ত্রীকে উপদেশ দিচ্ছেন, তাঁরা তাঁকে সঠিক উপদেশটি দিচ্ছেন না। দলের ভেতরে কট্টরপন্থীদের দ্বারা তিনি বেশি মাত্রায় প্রভাবান্বিত। এক সময় যাঁরা মস্কোপন্থী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তাঁরা বেশি মাত্রায় দলের নীতি-নির্ধারণীতে প্রভাব ফেলেছেন, এমন কথাও অনেকের মুখ থেকে শুনেছি। তাঁদের 'ভুলের' কারণে দলকে আজ এ পরিস্থিতি বরণ করতে হয়েছে।
সর্বশেষ গাজীপুর নির্বাচন সরকারকে একটি 'সিগন্যাল' দিয়েছে- এ থেকে সরকার কতটুকু শিখবে, সেটা ভিন্ন প্রশ্ন। কিন্তু সরকারের কঠোর অবস্থান বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে যে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দেবে, তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। ক্যাপিটল হিলে বাংলাদেশ একটি আলোচিত নাম। বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটা নেতিবাচক ধারণার জন্ম হয়েছে। গার্মেন্টে শ্রমমান, হাজার শ্রমিকের মৃত্যু, সুশাসনের অভাব, র্যাবের মানবতাবিরোধী অপরাধ, শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলাম হত্যাকাণ্ডের বিচার না হওয়া, পদ্মা সেতুতে দুর্নীতি, শেয়ারবাজার, ড. ইউনূস ইত্যাদি কারণে ক্যাপিটল হিলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি খুব উজ্জ্বল নয়। এখন যদি আওয়ামী লীগ এককভাবে নির্বাচন করে, সেটাও দেশটির ভাবমূর্তির জন্য কোনো ভালো সংবাদ বয়ে আনবে না। দাতা সংস্থা ও দেশগুলোর সাহায্য প্রতিশ্রুতিও ঝুঁকির মুখে থাকবে। তাই পরাজয়ের একটা ঝুঁকির মুখে থাকলেও আওয়ামী লীগ তথা সরকারকে 'সব দলের অংশগ্রহণের' একটি নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। এতে বরং আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি আরো উজ্জ্বল হবে। প্রবাসীরা চান, দেশে একটা স্থিতিশীলতা বিরাজ করুক। সুশাসন নিশ্চিত হোক। জনগণ তাদের অধিকার প্রয়োগ করুক। সিলেট থেকে সর্বশেষ গাজীপুর, সাধারণ জনগণ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এমনটিই ঘটুক- এটাই প্রত্যাশা প্রবাসীদের।
নিউ ইয়র্ক, ৮ জুলাই, ২০১৩
লেখক : অধ্যাপক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
No comments