সরল গরল ন্যায়বিচারের পথে প্রধানমন্ত্রীরাই যখন বাধা by মিজানুর রহমান খান
আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম সময় টিভিকে
গতকাল বলেছেন, কোনো সরকারই আর দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের বের করতে পারবে না।
তাঁর কথা একেবারে অমূলক নয়। রাজনৈতিক কবর খুঁড়েই তবে বিএনপি বা পরবর্তী
যেকোনো সরকারকে এবারের দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের বের করার ঝুঁকি নিতে হবে।
১৯৭৫ আর ২০১৩ সাল এক নয়। এখন আমাদের শাহবাগ হয়েছে। কিন্তু আইন প্রতিমন্ত্রীর বাণী কি রাজনৈতিক না আইনগতভাবে সত্য?
বঙ্গবন্ধুর খুনি বজলুল হুদা বহু বছর কনডেম সেলে ছিলেন। বেগম খালেদা জিয়া আপিল বিভাগে বিচারক নিয়োগ না দিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা আটকে দিয়েছিলেন। পরে এই আমলে আপিল শুরু হলে হুদা যুক্তি দিলেন, রাষ্ট্র যথাসময়ে বিচার করেনি। বিলম্বিত বিচারে তাঁর দায় নেই। সুতরাং তাঁর মৃত্যুদণ্ড হ্রাস করাই ন্যায়বিচারের দাবি। এই যুক্তি অগ্রাহ্য করতে আপিল বিভাগ অপরাধের ব্যাপকতা, নিষ্পাপ রাসেলকে হত্যার নিষ্ঠুরতা বিবেচনায় নিয়েছিলেন। গোলাম আযম নিজে তাঁর বয়স ও অসুস্থতা বিবেচনা করতে বলেননি। তাই এই বিচারিক করুণা নজিরবিহীন।
যাঁরা সংবিধানের ক্ষমাসংক্রান্ত ৪৯ অনুচ্ছেদের একটি উপযুক্ত সংশোধনী আনতে দাবি তুলেছিলেন, তাঁরা এখন নীরব কেন? প্রাথমিক পর্যায়ের এই রায়গুলো বর্তমান সরকারের মেয়াদের গোড়ায় কিংবা আরও আগে হলেও না-হয় ভরসা ছিল। বিচার-প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আমরা সন্তুষ্ট। কিন্তু তিনি কী করে বলতে পারেন যে, বর্তমান মেয়াদে কিছু রায় কার্যকর হবে। সবচেয়ে এগিয়ে থাকা কাদের মোল্লার আপিলটিও ঝুলে আছে। শাহবাগের ফুটন্ত কড়াইয়ে গরম গরম ৬০ দিন ভেজে নেওয়া হলো। বাহবা কুড়াল সরকার। এরপর আমরা দেখলাম, ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ ও ব্যারিস্টার রাজ্জাক উভয়ে একমত, ৬০ দিনের মধ্যে আপিল নিষ্পত্তি করা আপিল বিভাগের জন্য খাটে না।
আমাদের সর্বোচ্চ আদালত প্রমাণ করে দিলেন, তাঁরা সংবিধানের ৪৭ অনুচ্ছেদের চেতনা রক্ষায় আন্তরিক নন। এই অনুচ্ছেদ যুদ্ধাপরাধবিষয়ক আইন ও বিচারব্যবস্থাকে ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েছে। কিন্তু আমরা দেখলাম, তাঁরা কখনো রাষ্ট্রের প্রশ্রয়ে অন্য দশটা অপরাধের বিচার যেভাবে ঝোলান, সেভাবে তাঁরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকেও একই পাল্লায় মাপেন।
অন্যদিকে বর্তমান জাতীয় নেতৃত্ব এতটাই দেউলে হয়ে পড়েছে যে রিকনসিলিয়েশন নিয়ে কোনো আলোচনার পরিবেশ নেই। এ দেশের তল্পিবাহক নাগরিক সমাজ তাদের রাজনৈতিক প্রভুদের সঙ্গেই কোরাস ধরেন। যদি ধরেও নিই, বর্তমান বিচার-প্রক্রিয়া জাতীয় শাপমোচনের দিকে এগিয়ে নিচ্ছে। কিন্তু অনেক মৌলিক প্রশ্ন অমীমাংসিত থাকছে। জামায়াত দোষ স্বীকার করছে না। তাকে তা স্বীকার করানোর জন্য দরকার অপ্রতিহিংসাপরায়ণ উঁচু মাপের রাজনৈতিক নেতৃত্ব, সেটা আমাদের নেই। পঁচাত্তর-পূর্বকালের প্রায় সাড়ে সাত শ দণ্ডিত যুদ্ধাপরাধী সমাজজীবনে কী প্রভাব ফেলেছিল, তা বিশ্লেষণ করতে আমরা রাজি নই।
বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রীরাই প্রধান বিচারপতি। কারণ, যেকোনো মামলা রায়ের আগে বা পরে, ফাঁসিসহ যেকোনো শাস্তি এই প্রজাতন্ত্রে তাদের ইচ্ছা না থাকলে কার্যকর হতে পারে না। এই অবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করতে বিচারপতি ইনায়েতুর রহিম একটি রায় দিয়ে বসে আছেন। তিনি তো এই আমলেই নিয়োগপ্রাপ্ত। এর সারকথা হলো, ৪৯ অনুচ্ছেদের অপব্যবহার রোধ করতে হবে। কে কাকে শোনে। ওই রায় হাতে শাহবাগের তরুণেরা নিনাদ তুললে সন্তুষ্ট হতাম। কিন্তু তা দেখি না। এমনকি কেউ কেউ অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিতের মতো আচরণ করে। গলা চড়িয়ে রায় প্রত্যাখ্যান করার ফুটানি দেখানো সহজ। কাজের কাজে অশ্বডিম্ব। আর নদীগুলো তো সাগরপানে ছোটে। রাজনৈতিক উত্তাপ ছড়ানো প্রতিটি স্রোত এ দেশে সঙ্গোপনে কিংবা শোরগোল তুলে ভোটসাগরে মিশে যায়। আমরা কোথাও কোনো সীমারেখা টানতে শিখিনি। যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য ভোট চাওয়ার প্রকাশ্য আকুতি আর রায়ের প্রতি প্রতিক্রিয়া না দেখাতে পারার অপারগতার চালিকাশক্তি হলো গদি। এবং সেই অবস্থা সমাজে নেই যে দণ্ডিত ব্যক্তিদের বিষয়ে বিএনপির নীরবতা ভাঙতে কেউ তাকে বাধ্য করতে পারে। সুশাসন না দিতে পারার কারণে আওয়ামী লীগকে এখন আমরা উচিত শিক্ষা দিতে সংকল্পবদ্ধ হয়েছি। তাতে নিজের নাক কাটা পড়লেও দেব। বাংলাদেশে এটা একটা মৌসুমি সত্য, উভয়ের ক্ষেত্রে খাটে। এর মূল কারণ চূড়ান্ত বিচারে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে থাকা বর্তমানের অযোগ্য ও ব্যর্থ নেতৃত্বের পালাক্রমিক হাতবদলসর্বস্ব গণতন্ত্রের চর্চা। বেহায়া সামরিকতন্ত্র ও কঠিন পরিবারতন্ত্র আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে অভিশপ্ত করে রেখেছে। এই সমাজের সুরুচি ও অনুভূতি ক্রমেই আরও ভালো দিকে যাওয়ার কথা। ক্রমান্বয়ে পরিশীলিত হওয়ার কথা। কারণ, সভ্যতা অনুশীলন ও দেখে শেখার বিষয়। সংসদে অশালীন চর্চা। শফীর অশালীন উক্তির মধ্যে তফাত বিরাট। কিন্তু এটা ধারাবাহিক অশালীনতা।
ফাঁসি ফাঁসি ফাঁসি চাই, এই স্লোগান সুফিবাদী সমাজের এভাবে ধারণ করার কথা নয়। তত্ত্বাবধায়ক কোন গণতন্ত্রে আছে, এই প্রশ্ন যে সমাজে সচল, সেই সমাজেই এই প্রশ্ন অচল, তথাকথিত পাইকারি রাজনৈতিক মিথ্যা মামলা দায়ের ও প্রত্যাহার, ঝিন্টু কিংবা আওয়ামী লীগের নেতা তাহেরের
ছেলের মতো ফাঁসির আসামির মার্জনা কোন গণতন্ত্রে আছে? এ রকম কার্যকর রাজনৈতিক প্রধান বিচারপতির বিচার কে কবে কোথায় দেখে?
তাই ৯০ বছর সাজা দিলেও এর কানাকড়ি মূল্য প্রতীয়মান নাও হতে পারে ভুক্তভোগী ও সাধারণ মানুষের কাছে। আদালত বলেন ৯০ বছর। তারা হয়তো দেখে ৯০ দিন। দোষটা জনতার নয়। হাজারবার তাদের ক্ষোভে ফেটে পড়া উচিত। আমরা বলতে চাই, সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদ কোনো ৯০ বছর আর ফাঁসি মানে না। যে কাউকে যখন-তখন ফাঁসির দড়িটা খুলে ফুলের মালা পরাতে পারে। এটা পরিহাস যে একটা সোজা কথা, সোজা করে বলা চলে না। রায় তো কখনো শেষ কথা নয়। শেষ হাসি হাসেন এক ব্যক্তি। নাম তাঁর প্রধানমন্ত্রী, এ লেখায় যার নাম দিয়েছি প্রধান বিচারপতি কিংবা বিচারের প্রধান পতি। মানুষের কাছে প্রকৃত সত্য লুকাতে সংবিধানে তারা একটা ফালতু পর্দা তৈরি করেছে। তাই বেচারা রাষ্ট্রপতি বদনাম কুড়ান।
আগামী দিনের প্রধান বিচারপতি বেগম খালেদা জিয়া কী করবেন? আমরা যাঁরা ফাঁসি হলো না বলে চুল ছিঁড়ছি, তাঁরা কি জানতে চাই যে পঁচাত্তরের আগে দণ্ডিত ৭৫৩ জন কী করে জেল থেকে বেরিয়ে গেল? সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি দ্বিতীয়বার ঘটতেই পারে না, সেটা কেউ হলফ করে বলতে রাজি আছেন কি?
সার্ব যুদ্ধাপরাধী গোরান ৩২ কাউন্ট অপরাধের মধ্যে ৩১টিতেই দোষ স্বীকার করেছিলেন। কেবল গণহত্যার দায় স্বীকার করেননি। তার পরও আদালত তাঁর দোষ স্বীকারকে খুব গুরুত্ব দেননি। কারণ, আদালত বলেছেন, তিনি প্রকৃত অনুশোচনা করেননি। গোলাম আযম আদৌ তওবা করেননি। কেবল নাগরিকত্বের রায় পেয়েই এক জনসভায় অতীতের ভুলের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন মাত্র। সেটা ছিল নিতান্ত কৌশলগত। আদালতে তাঁকে অনুশোচনা করতে দেখা যায়নি।
এই বিষয়কে আমাদের গভীরভাবে ভাবতে হবে। কোনো প্রকৃত অনুশোচনা ও ক্ষমাশীলতা ছাড়া কেবল আদালতের শাস্তি দিয়ে অতীতের দায় শোধ কিংবা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা যাবে কি না। লাইবেরিয়ার প্রচলিত আইনে মৃত্যুদণ্ড আছে। তবে জাতিসংঘের করে দেওয়া ট্রাইব্যুনাল বলেছেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য কাউকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যাবে না। লাইবেরিয়ার মানুষ তাতেও বিচার পাচ্ছে। সন্তুষ্ট থাকছে। গত এক দশকে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালগুলোতে সব যুদ্ধাপরাধী নানা মেয়াদে শাস্তি পেয়েছে। মৃত্যুদণ্ড পায়নি। এটা আমাদের মনে রাখতে হবে। আর ভাবতে হবে, কেন আমরা ফুঁসে উঠছি। কেন ফাঁসি চাইছি। এককথায় এর উত্তর—শাসকগোষ্ঠীকে বিশ্বাস করাতে না পারা। আমরা ভাবি, ফাঁসি কার্যকর করাই আমাদের সান্ত্বনার একমাত্র উপায়। আমরা কি ভাবব না, এটাই একমাত্র পথ নয়?
৪৯ অনুচ্ছেদের সংশোধন চাই। ‘বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী’ করে যদিও তারা আংশিক নাম বদলেছে। তবু জামায়াতকে অপরাধী সংগঠন হিসেবে নির্বাচনী আইনে অযোগ্য করার বিধান চাই। দালাল আইনে ব্যক্তি নির্বাচনে অযোগ্য করা আছে। সংগঠন নেই। এটা বেশি দরকার ওই সংগঠনের সেই সব নেতা-কর্মীর জন্য, যাঁরা স্বাধীন বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছেন। তাঁরা যাতে কলঙ্কমুক্ত সংগঠনে থেকে দেশ গঠনে ভূমিকা রাখতে পারেন। ‘তারা’ এবং ‘আমরা’র বিভেদ ঘোচাতে হবে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
বঙ্গবন্ধুর খুনি বজলুল হুদা বহু বছর কনডেম সেলে ছিলেন। বেগম খালেদা জিয়া আপিল বিভাগে বিচারক নিয়োগ না দিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা আটকে দিয়েছিলেন। পরে এই আমলে আপিল শুরু হলে হুদা যুক্তি দিলেন, রাষ্ট্র যথাসময়ে বিচার করেনি। বিলম্বিত বিচারে তাঁর দায় নেই। সুতরাং তাঁর মৃত্যুদণ্ড হ্রাস করাই ন্যায়বিচারের দাবি। এই যুক্তি অগ্রাহ্য করতে আপিল বিভাগ অপরাধের ব্যাপকতা, নিষ্পাপ রাসেলকে হত্যার নিষ্ঠুরতা বিবেচনায় নিয়েছিলেন। গোলাম আযম নিজে তাঁর বয়স ও অসুস্থতা বিবেচনা করতে বলেননি। তাই এই বিচারিক করুণা নজিরবিহীন।
যাঁরা সংবিধানের ক্ষমাসংক্রান্ত ৪৯ অনুচ্ছেদের একটি উপযুক্ত সংশোধনী আনতে দাবি তুলেছিলেন, তাঁরা এখন নীরব কেন? প্রাথমিক পর্যায়ের এই রায়গুলো বর্তমান সরকারের মেয়াদের গোড়ায় কিংবা আরও আগে হলেও না-হয় ভরসা ছিল। বিচার-প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আমরা সন্তুষ্ট। কিন্তু তিনি কী করে বলতে পারেন যে, বর্তমান মেয়াদে কিছু রায় কার্যকর হবে। সবচেয়ে এগিয়ে থাকা কাদের মোল্লার আপিলটিও ঝুলে আছে। শাহবাগের ফুটন্ত কড়াইয়ে গরম গরম ৬০ দিন ভেজে নেওয়া হলো। বাহবা কুড়াল সরকার। এরপর আমরা দেখলাম, ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ ও ব্যারিস্টার রাজ্জাক উভয়ে একমত, ৬০ দিনের মধ্যে আপিল নিষ্পত্তি করা আপিল বিভাগের জন্য খাটে না।
আমাদের সর্বোচ্চ আদালত প্রমাণ করে দিলেন, তাঁরা সংবিধানের ৪৭ অনুচ্ছেদের চেতনা রক্ষায় আন্তরিক নন। এই অনুচ্ছেদ যুদ্ধাপরাধবিষয়ক আইন ও বিচারব্যবস্থাকে ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েছে। কিন্তু আমরা দেখলাম, তাঁরা কখনো রাষ্ট্রের প্রশ্রয়ে অন্য দশটা অপরাধের বিচার যেভাবে ঝোলান, সেভাবে তাঁরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকেও একই পাল্লায় মাপেন।
অন্যদিকে বর্তমান জাতীয় নেতৃত্ব এতটাই দেউলে হয়ে পড়েছে যে রিকনসিলিয়েশন নিয়ে কোনো আলোচনার পরিবেশ নেই। এ দেশের তল্পিবাহক নাগরিক সমাজ তাদের রাজনৈতিক প্রভুদের সঙ্গেই কোরাস ধরেন। যদি ধরেও নিই, বর্তমান বিচার-প্রক্রিয়া জাতীয় শাপমোচনের দিকে এগিয়ে নিচ্ছে। কিন্তু অনেক মৌলিক প্রশ্ন অমীমাংসিত থাকছে। জামায়াত দোষ স্বীকার করছে না। তাকে তা স্বীকার করানোর জন্য দরকার অপ্রতিহিংসাপরায়ণ উঁচু মাপের রাজনৈতিক নেতৃত্ব, সেটা আমাদের নেই। পঁচাত্তর-পূর্বকালের প্রায় সাড়ে সাত শ দণ্ডিত যুদ্ধাপরাধী সমাজজীবনে কী প্রভাব ফেলেছিল, তা বিশ্লেষণ করতে আমরা রাজি নই।
বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রীরাই প্রধান বিচারপতি। কারণ, যেকোনো মামলা রায়ের আগে বা পরে, ফাঁসিসহ যেকোনো শাস্তি এই প্রজাতন্ত্রে তাদের ইচ্ছা না থাকলে কার্যকর হতে পারে না। এই অবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করতে বিচারপতি ইনায়েতুর রহিম একটি রায় দিয়ে বসে আছেন। তিনি তো এই আমলেই নিয়োগপ্রাপ্ত। এর সারকথা হলো, ৪৯ অনুচ্ছেদের অপব্যবহার রোধ করতে হবে। কে কাকে শোনে। ওই রায় হাতে শাহবাগের তরুণেরা নিনাদ তুললে সন্তুষ্ট হতাম। কিন্তু তা দেখি না। এমনকি কেউ কেউ অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিতের মতো আচরণ করে। গলা চড়িয়ে রায় প্রত্যাখ্যান করার ফুটানি দেখানো সহজ। কাজের কাজে অশ্বডিম্ব। আর নদীগুলো তো সাগরপানে ছোটে। রাজনৈতিক উত্তাপ ছড়ানো প্রতিটি স্রোত এ দেশে সঙ্গোপনে কিংবা শোরগোল তুলে ভোটসাগরে মিশে যায়। আমরা কোথাও কোনো সীমারেখা টানতে শিখিনি। যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য ভোট চাওয়ার প্রকাশ্য আকুতি আর রায়ের প্রতি প্রতিক্রিয়া না দেখাতে পারার অপারগতার চালিকাশক্তি হলো গদি। এবং সেই অবস্থা সমাজে নেই যে দণ্ডিত ব্যক্তিদের বিষয়ে বিএনপির নীরবতা ভাঙতে কেউ তাকে বাধ্য করতে পারে। সুশাসন না দিতে পারার কারণে আওয়ামী লীগকে এখন আমরা উচিত শিক্ষা দিতে সংকল্পবদ্ধ হয়েছি। তাতে নিজের নাক কাটা পড়লেও দেব। বাংলাদেশে এটা একটা মৌসুমি সত্য, উভয়ের ক্ষেত্রে খাটে। এর মূল কারণ চূড়ান্ত বিচারে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে থাকা বর্তমানের অযোগ্য ও ব্যর্থ নেতৃত্বের পালাক্রমিক হাতবদলসর্বস্ব গণতন্ত্রের চর্চা। বেহায়া সামরিকতন্ত্র ও কঠিন পরিবারতন্ত্র আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে অভিশপ্ত করে রেখেছে। এই সমাজের সুরুচি ও অনুভূতি ক্রমেই আরও ভালো দিকে যাওয়ার কথা। ক্রমান্বয়ে পরিশীলিত হওয়ার কথা। কারণ, সভ্যতা অনুশীলন ও দেখে শেখার বিষয়। সংসদে অশালীন চর্চা। শফীর অশালীন উক্তির মধ্যে তফাত বিরাট। কিন্তু এটা ধারাবাহিক অশালীনতা।
ফাঁসি ফাঁসি ফাঁসি চাই, এই স্লোগান সুফিবাদী সমাজের এভাবে ধারণ করার কথা নয়। তত্ত্বাবধায়ক কোন গণতন্ত্রে আছে, এই প্রশ্ন যে সমাজে সচল, সেই সমাজেই এই প্রশ্ন অচল, তথাকথিত পাইকারি রাজনৈতিক মিথ্যা মামলা দায়ের ও প্রত্যাহার, ঝিন্টু কিংবা আওয়ামী লীগের নেতা তাহেরের
ছেলের মতো ফাঁসির আসামির মার্জনা কোন গণতন্ত্রে আছে? এ রকম কার্যকর রাজনৈতিক প্রধান বিচারপতির বিচার কে কবে কোথায় দেখে?
তাই ৯০ বছর সাজা দিলেও এর কানাকড়ি মূল্য প্রতীয়মান নাও হতে পারে ভুক্তভোগী ও সাধারণ মানুষের কাছে। আদালত বলেন ৯০ বছর। তারা হয়তো দেখে ৯০ দিন। দোষটা জনতার নয়। হাজারবার তাদের ক্ষোভে ফেটে পড়া উচিত। আমরা বলতে চাই, সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদ কোনো ৯০ বছর আর ফাঁসি মানে না। যে কাউকে যখন-তখন ফাঁসির দড়িটা খুলে ফুলের মালা পরাতে পারে। এটা পরিহাস যে একটা সোজা কথা, সোজা করে বলা চলে না। রায় তো কখনো শেষ কথা নয়। শেষ হাসি হাসেন এক ব্যক্তি। নাম তাঁর প্রধানমন্ত্রী, এ লেখায় যার নাম দিয়েছি প্রধান বিচারপতি কিংবা বিচারের প্রধান পতি। মানুষের কাছে প্রকৃত সত্য লুকাতে সংবিধানে তারা একটা ফালতু পর্দা তৈরি করেছে। তাই বেচারা রাষ্ট্রপতি বদনাম কুড়ান।
আগামী দিনের প্রধান বিচারপতি বেগম খালেদা জিয়া কী করবেন? আমরা যাঁরা ফাঁসি হলো না বলে চুল ছিঁড়ছি, তাঁরা কি জানতে চাই যে পঁচাত্তরের আগে দণ্ডিত ৭৫৩ জন কী করে জেল থেকে বেরিয়ে গেল? সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি দ্বিতীয়বার ঘটতেই পারে না, সেটা কেউ হলফ করে বলতে রাজি আছেন কি?
সার্ব যুদ্ধাপরাধী গোরান ৩২ কাউন্ট অপরাধের মধ্যে ৩১টিতেই দোষ স্বীকার করেছিলেন। কেবল গণহত্যার দায় স্বীকার করেননি। তার পরও আদালত তাঁর দোষ স্বীকারকে খুব গুরুত্ব দেননি। কারণ, আদালত বলেছেন, তিনি প্রকৃত অনুশোচনা করেননি। গোলাম আযম আদৌ তওবা করেননি। কেবল নাগরিকত্বের রায় পেয়েই এক জনসভায় অতীতের ভুলের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন মাত্র। সেটা ছিল নিতান্ত কৌশলগত। আদালতে তাঁকে অনুশোচনা করতে দেখা যায়নি।
এই বিষয়কে আমাদের গভীরভাবে ভাবতে হবে। কোনো প্রকৃত অনুশোচনা ও ক্ষমাশীলতা ছাড়া কেবল আদালতের শাস্তি দিয়ে অতীতের দায় শোধ কিংবা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা যাবে কি না। লাইবেরিয়ার প্রচলিত আইনে মৃত্যুদণ্ড আছে। তবে জাতিসংঘের করে দেওয়া ট্রাইব্যুনাল বলেছেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য কাউকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যাবে না। লাইবেরিয়ার মানুষ তাতেও বিচার পাচ্ছে। সন্তুষ্ট থাকছে। গত এক দশকে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালগুলোতে সব যুদ্ধাপরাধী নানা মেয়াদে শাস্তি পেয়েছে। মৃত্যুদণ্ড পায়নি। এটা আমাদের মনে রাখতে হবে। আর ভাবতে হবে, কেন আমরা ফুঁসে উঠছি। কেন ফাঁসি চাইছি। এককথায় এর উত্তর—শাসকগোষ্ঠীকে বিশ্বাস করাতে না পারা। আমরা ভাবি, ফাঁসি কার্যকর করাই আমাদের সান্ত্বনার একমাত্র উপায়। আমরা কি ভাবব না, এটাই একমাত্র পথ নয়?
৪৯ অনুচ্ছেদের সংশোধন চাই। ‘বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী’ করে যদিও তারা আংশিক নাম বদলেছে। তবু জামায়াতকে অপরাধী সংগঠন হিসেবে নির্বাচনী আইনে অযোগ্য করার বিধান চাই। দালাল আইনে ব্যক্তি নির্বাচনে অযোগ্য করা আছে। সংগঠন নেই। এটা বেশি দরকার ওই সংগঠনের সেই সব নেতা-কর্মীর জন্য, যাঁরা স্বাধীন বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছেন। তাঁরা যাতে কলঙ্কমুক্ত সংগঠনে থেকে দেশ গঠনে ভূমিকা রাখতে পারেন। ‘তারা’ এবং ‘আমরা’র বিভেদ ঘোচাতে হবে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
No comments