সরকারি প্রশাসন মেধাশূন্য করবেন না by ড. সৈয়দ রাশিদল হাসান
সরকারি চাকরিতে কোটা নিয়ে তুলকালাম ঘটনা
ঘটে গেল ঢাকাসহ কয়েকটি জায়গায়। এর আগেও কোটার বিরুদ্ধে অনেক কথাবার্তা
হয়েছে। কিন্তু সেই কোটার কোটারি থেকেই গেছে। এবার আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন
মহাজোট সরকারের শেষদিকে এসে কোটা নিয়ে বেশ একটা বড় ঝাঁকুনি দিয়ে গেল আমাদের
মেধাদীপ্ত তরুণ প্রজন্ম। বাংলাদেশের জনসংখ্যার বড় অংশ হচ্ছে এ তরুণরা। এ
কারণে বলা হয়, আমরা এখন পপুলেশন ডিভিডেন্ট উপভোগ করছি। এটা সম্ভবত ২০৫০ সাল
পর্যন্ত চলবে, তারপর আমাদের জনসংখ্যার কম্পোজিশনে পরিবর্তন আসবে। তখন তরুণ
প্রজর আধিপত্যের পরিবর্তে আসবে বয়স্ক ও শিশুদের আধিপত্য। তাই আমাদের
তরুণদের সঠিক পথে চালাতে তাদের সঠিক দিকনির্দেশনা দিয়ে আমাদের প্রিয়
দেশটাকে এগিয়ে নেয়ার এটাই মোক্ষম সময়।
কোটা সিস্টেম থাকতেই পারে। পৃথিবীর অনেক দেশেই পিছিয়ে পড়া মানুষদের সামনে এগিয়ে নিতে তাদের জন্য কোটা রাখা হয় স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি থেকে শুরু করে সরকারি চাকরিতে নিয়োগ পর্যন্ত। আমাদের সংবিধানেও পাহাড়ি নৃগোষ্ঠীসহ অন্যান্য পিছিয়ে পড়া মানুষদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেয়ার কথা স্বীকৃত। সুতরাং কোটার বিরুদ্ধে কারও কোনো আপত্তি নেই। আপত্তি ওঠে তখনই যখন মেধার লালন না করে কোটার নামে কোটারিপনা শুরু করা হয়। আন্দোলনকারী তরুণরা খুব সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে তারা কোটা পদ্ধতির বিপক্ষে নয়, বরং আনুপাতিক হারের ব্যাপারেই তাদের আপত্তি। তাদের আপত্তি খুবই সঙ্গত। সরকারি চাকরিতে সবচেয়ে বেশি অর্থাৎ ৩০ শতাংশ কোটার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতি-নাতনিদের জন্য। জানা মতে, দেশে এখন প্রায় দুই লাখের মতো সার্টিফিকেটধারী মুক্তিযোদ্ধা আছেন। যুদ্ধে যাওয়ার সময় তাদের বয়স বিবেচনায় নিলে এখন খুব কমসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধার সন্তান চাকরির অপেক্ষায় আছেন। অথচ বর্তমান সরকার এখন মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের সঙ্গে তাদের নাতি-পুতিকেও বিভিন্ন সুযোগ প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অনেক প্রশ্ন জাগে মনের মাঝে। কেন এ নাতি-পুতি? নাতি-পুতি কি ছেলের ঘরের নাকি মেয়ের ঘরের? নাকি উভয়েরই? মেয়ের বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর সে শ্বশুরবাড়ির হয়ে যায়। তাহলে তার ছেলেমেয়েরা কেন এ সুযোগ পাবে? এ প্রশ্নগুলোর পেছনে আমার অজ্ঞতা আছে অনেক। কারণ আমি সরকারি সিদ্ধান্ত নিজে পড়িনি। সেখানে কী লেখা আছে তা জানি না। এ অনীহার কারণ হল, আমি কিংবা আমার বংশধরের কেউই এ সুযোগ পাবে না। অথচ আমরা ১৯৭১ সালে কিভাবে মানবেতর জীবনযাপন করেছিলাম ভারতে। বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন করতাম (মওলানা ভাসানীর সমর্থক) বলে আমাদের ভারতীয় সেনাবাহিনী রায়গঞ্জ রিক্রুটমেন্ট ক্যাম্প থেকে বের করে দেয়। তবু দেশের স্বাধীনতার যুদ্ধে নিজের উদ্যোগেই অংশগ্রহণ করেছিলাম। এই মহান যুদ্ধে আমার নিজের চাচা এবং তার দুই ছেলে শহীদ হন। পরবর্তী সময়ে আমার নিজের ভাই নিখোঁজ হন, যার কোনো খবর আমরা আর পাইনি। যুদ্ধের পর আমরা তো কোনো সার্টিফিকেট নেইনি। দেশের জন্য যুদ্ধ করেছিলাম তার জন্য সার্টিফিকেট নেব? এমন ইচ্ছা লালন করাও আমাদের কাছে মনে হতো অপরাধ। চোখের সামনে দেখেছি মুজিব বাহিনীর সার্টিফিকেট বিক্রি হতে। শোনা কথা, পরবর্তীকালে মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেটও নাকি এভাবে পাওয়া যেত! আত্মীয়তার সূত্রে এবং দলীয় বিবেচনায় নাকি অনেক অমুক্তিযোদ্ধা এ সার্টিফিকেটের অধিকারী হয়ে গেছে! সত্য-মিথ্যা জানি না, তবে এটা তো সত্য যে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার তালিকা নিয়ে দেশে নানা বিতর্ক আছে।
এ দেশে রাজাকাররাও যদি মন্ত্রী হয়ে গাড়িতে পতাকা উড়িয়ে বেড়ানোর সুযোগ পায়, তাহলে সাধারণ একটা সার্টিফিকেট জোগাড় করা তো কোনো বিষয়ই নয়। তাহলে বিষয়টি কী দাঁড়াচ্ছে? মহান মুক্তিযুদ্ধে যারা অংশ নিয়েছিলেন, তাদের ত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে তাদের সন্তানদের সরকারি সুযোগ-সুবিধা দেয়া হচ্ছে। তবে যারা যুদ্ধ না করেও মুক্তিযোদ্ধা, তাদের কেন এ সুবিধা দিতে হবে? আমার নিজের আÍীয়ের কথাই বললাম। আমার বিধবা চাচি তার সন্তানদের নিয়ে স্বাধীনতা উত্তর কী কষ্টেই না জীবন কাটিয়েছেন। কই তখন তো কোনো সরকার তাদের কোনো খবর নেয়নি? এখনও খবরের কাগজে দেখা যায়, দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা কী কষ্ট করে জীবন যাপন করে যাচ্ছেন। কই সরকার তো তাদের সন্তান কিংবা তাদের জন্য পর্যাপ্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়নি? হাস্যকর এক-দুই হাজার টাকার ভাতা দিয়ে তাদের অবদানকে হয়তো আমরা অসম্মানই করছি। পিএসসিকে অনুরোধ করব, বিগত বছরগুলোতে যারা মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি পেয়েছেন, তাদের উৎসে গিয়ে খবর নিন- প্রমাণ হয়ে যাবে কতজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার পোষ্য। অন্তত জনসাধারণের সন্দেহ দূর করার জন্য হলেও এমন একটা জরিপ করার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি।
বর্তমান তরুণ মেধাবীদের দিকে তাকিয়ে কষ্ট পাই। একশ’ ভাগের মধ্যে মাত্র ৪৫ ভাগ মেধা, সিংহভাগই কোটা। দুই লাখ সার্টিফিকেটধারী মুক্তিযোদ্ধার জন্য ৩০ ভাগ কোটা রাখা শুধু অযৌক্তিকই নয়, অন্যায় বলেই মনে হয়। দেশের জনসংখ্যার মাত্র ০.১৩ শতাংশ গোষ্ঠীর জন্য খুব বেশি হলে এক ভাগ কোটা রাখা যেতে পারে, কিন্তু কোনো অবস্থাতেই ৩০ ভাগ নয়। তারপরও যেহেতু তারা দেশের জন্য নিজেদের জীবনবাজি রেখে আমাদের এ মাতৃভূমি স্বাধীন করেছিলেন, তাই তাদের অবদানের প্রতি সম্মান রেখে কোটার পরিমাণ ৫ ভাগ পর্যন্ত বাড়ানো যেতে পারে। সবশেষে বলতে চাই, সরকারি প্রশাসন মেধাশূন্য করবেন না। কোটার নামে অযোগ্যদের সরকারি চাকরিতে ঢুকিয়ে দেশের সর্বনাশ করবেন না। কারণ সরকার আসে সরকার যায়, কিন্তু সরকারি কর্মকর্তারা থেকেই যান। তারাই চালান এ দেশটাকে। অযোগ্যতার কারণে বা ইংরেজি না বোঝার কারণে ভবিষ্যতে কোন দেশের সঙ্গে কী চুক্তি করে তারা তাদের অজান্তেই দেশের কত বড় ক্ষতি করে ফেলবেন, তা কি কেউ বলতে পারে ?
ড. সৈয়দ রাশিদুল হাসান : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক
কোটা সিস্টেম থাকতেই পারে। পৃথিবীর অনেক দেশেই পিছিয়ে পড়া মানুষদের সামনে এগিয়ে নিতে তাদের জন্য কোটা রাখা হয় স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি থেকে শুরু করে সরকারি চাকরিতে নিয়োগ পর্যন্ত। আমাদের সংবিধানেও পাহাড়ি নৃগোষ্ঠীসহ অন্যান্য পিছিয়ে পড়া মানুষদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেয়ার কথা স্বীকৃত। সুতরাং কোটার বিরুদ্ধে কারও কোনো আপত্তি নেই। আপত্তি ওঠে তখনই যখন মেধার লালন না করে কোটার নামে কোটারিপনা শুরু করা হয়। আন্দোলনকারী তরুণরা খুব সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে তারা কোটা পদ্ধতির বিপক্ষে নয়, বরং আনুপাতিক হারের ব্যাপারেই তাদের আপত্তি। তাদের আপত্তি খুবই সঙ্গত। সরকারি চাকরিতে সবচেয়ে বেশি অর্থাৎ ৩০ শতাংশ কোটার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতি-নাতনিদের জন্য। জানা মতে, দেশে এখন প্রায় দুই লাখের মতো সার্টিফিকেটধারী মুক্তিযোদ্ধা আছেন। যুদ্ধে যাওয়ার সময় তাদের বয়স বিবেচনায় নিলে এখন খুব কমসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধার সন্তান চাকরির অপেক্ষায় আছেন। অথচ বর্তমান সরকার এখন মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের সঙ্গে তাদের নাতি-পুতিকেও বিভিন্ন সুযোগ প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অনেক প্রশ্ন জাগে মনের মাঝে। কেন এ নাতি-পুতি? নাতি-পুতি কি ছেলের ঘরের নাকি মেয়ের ঘরের? নাকি উভয়েরই? মেয়ের বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর সে শ্বশুরবাড়ির হয়ে যায়। তাহলে তার ছেলেমেয়েরা কেন এ সুযোগ পাবে? এ প্রশ্নগুলোর পেছনে আমার অজ্ঞতা আছে অনেক। কারণ আমি সরকারি সিদ্ধান্ত নিজে পড়িনি। সেখানে কী লেখা আছে তা জানি না। এ অনীহার কারণ হল, আমি কিংবা আমার বংশধরের কেউই এ সুযোগ পাবে না। অথচ আমরা ১৯৭১ সালে কিভাবে মানবেতর জীবনযাপন করেছিলাম ভারতে। বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন করতাম (মওলানা ভাসানীর সমর্থক) বলে আমাদের ভারতীয় সেনাবাহিনী রায়গঞ্জ রিক্রুটমেন্ট ক্যাম্প থেকে বের করে দেয়। তবু দেশের স্বাধীনতার যুদ্ধে নিজের উদ্যোগেই অংশগ্রহণ করেছিলাম। এই মহান যুদ্ধে আমার নিজের চাচা এবং তার দুই ছেলে শহীদ হন। পরবর্তী সময়ে আমার নিজের ভাই নিখোঁজ হন, যার কোনো খবর আমরা আর পাইনি। যুদ্ধের পর আমরা তো কোনো সার্টিফিকেট নেইনি। দেশের জন্য যুদ্ধ করেছিলাম তার জন্য সার্টিফিকেট নেব? এমন ইচ্ছা লালন করাও আমাদের কাছে মনে হতো অপরাধ। চোখের সামনে দেখেছি মুজিব বাহিনীর সার্টিফিকেট বিক্রি হতে। শোনা কথা, পরবর্তীকালে মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেটও নাকি এভাবে পাওয়া যেত! আত্মীয়তার সূত্রে এবং দলীয় বিবেচনায় নাকি অনেক অমুক্তিযোদ্ধা এ সার্টিফিকেটের অধিকারী হয়ে গেছে! সত্য-মিথ্যা জানি না, তবে এটা তো সত্য যে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার তালিকা নিয়ে দেশে নানা বিতর্ক আছে।
এ দেশে রাজাকাররাও যদি মন্ত্রী হয়ে গাড়িতে পতাকা উড়িয়ে বেড়ানোর সুযোগ পায়, তাহলে সাধারণ একটা সার্টিফিকেট জোগাড় করা তো কোনো বিষয়ই নয়। তাহলে বিষয়টি কী দাঁড়াচ্ছে? মহান মুক্তিযুদ্ধে যারা অংশ নিয়েছিলেন, তাদের ত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে তাদের সন্তানদের সরকারি সুযোগ-সুবিধা দেয়া হচ্ছে। তবে যারা যুদ্ধ না করেও মুক্তিযোদ্ধা, তাদের কেন এ সুবিধা দিতে হবে? আমার নিজের আÍীয়ের কথাই বললাম। আমার বিধবা চাচি তার সন্তানদের নিয়ে স্বাধীনতা উত্তর কী কষ্টেই না জীবন কাটিয়েছেন। কই তখন তো কোনো সরকার তাদের কোনো খবর নেয়নি? এখনও খবরের কাগজে দেখা যায়, দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা কী কষ্ট করে জীবন যাপন করে যাচ্ছেন। কই সরকার তো তাদের সন্তান কিংবা তাদের জন্য পর্যাপ্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়নি? হাস্যকর এক-দুই হাজার টাকার ভাতা দিয়ে তাদের অবদানকে হয়তো আমরা অসম্মানই করছি। পিএসসিকে অনুরোধ করব, বিগত বছরগুলোতে যারা মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি পেয়েছেন, তাদের উৎসে গিয়ে খবর নিন- প্রমাণ হয়ে যাবে কতজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার পোষ্য। অন্তত জনসাধারণের সন্দেহ দূর করার জন্য হলেও এমন একটা জরিপ করার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি।
বর্তমান তরুণ মেধাবীদের দিকে তাকিয়ে কষ্ট পাই। একশ’ ভাগের মধ্যে মাত্র ৪৫ ভাগ মেধা, সিংহভাগই কোটা। দুই লাখ সার্টিফিকেটধারী মুক্তিযোদ্ধার জন্য ৩০ ভাগ কোটা রাখা শুধু অযৌক্তিকই নয়, অন্যায় বলেই মনে হয়। দেশের জনসংখ্যার মাত্র ০.১৩ শতাংশ গোষ্ঠীর জন্য খুব বেশি হলে এক ভাগ কোটা রাখা যেতে পারে, কিন্তু কোনো অবস্থাতেই ৩০ ভাগ নয়। তারপরও যেহেতু তারা দেশের জন্য নিজেদের জীবনবাজি রেখে আমাদের এ মাতৃভূমি স্বাধীন করেছিলেন, তাই তাদের অবদানের প্রতি সম্মান রেখে কোটার পরিমাণ ৫ ভাগ পর্যন্ত বাড়ানো যেতে পারে। সবশেষে বলতে চাই, সরকারি প্রশাসন মেধাশূন্য করবেন না। কোটার নামে অযোগ্যদের সরকারি চাকরিতে ঢুকিয়ে দেশের সর্বনাশ করবেন না। কারণ সরকার আসে সরকার যায়, কিন্তু সরকারি কর্মকর্তারা থেকেই যান। তারাই চালান এ দেশটাকে। অযোগ্যতার কারণে বা ইংরেজি না বোঝার কারণে ভবিষ্যতে কোন দেশের সঙ্গে কী চুক্তি করে তারা তাদের অজান্তেই দেশের কত বড় ক্ষতি করে ফেলবেন, তা কি কেউ বলতে পারে ?
ড. সৈয়দ রাশিদুল হাসান : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক
No comments