সদরে অন্দরে'আমিই আজ প্রতিটি ধর্ষিতার আর্তনাদ' by মোস্তফা হোসেইন
সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত আমার ভাতিজি রিমির মতো
মুখ প্রীতি নামের মেয়েটির। প্রথম আলাপেই তুমি সম্বোধন। কথায় কথায় জানা
হলো, কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক এবং কবি আসাদ মান্নানের স্নেহধন্যাই
শুধু নয়, অনেক আগে থেকে আমিও তাকে চিনি তার লেখার মাধ্যমে।
রাজশাহীর মেয়ে, ওখানকারই এক কলেজের ছাত্রী। যাকে আমি প্রীতি, রিমি কিংবা
হিমি বলে ডাকি। সেই মেয়েটিই বারুদের মতো বিস্ফোরিত হয়ে উঠল। টুকটুকে একটি
শিশু, মাত্র তো বয়স ১১। সেও কি পুরুষের লালসার শিকার হতে পারে? টানা ৫৫ দিন
পালাক্রমে ধর্ষণ করেই ওরা ক্ষান্ত হয়নি। ধর্মকেও ওরা বর্ম হিসেবে ব্যবহার
করেছে অপরাধকে জায়েজ করার জন্য। অথচ ধর্ষকরা শুধু ধর্ষকই নয়, মাদক
ব্যবসায়ীও। প্রীতির এই অভিব্যক্তি যেকোনো মানুষের ভিত নাড়িয়ে দিতে পারে।
লেখক বন্ধু আকাশ লীনা, কলকাতার মেয়ে। চমৎকার গল্প রচনা করে প্রতিনিয়ত। মাঝেমধ্যে মনে হয়, হুমায়ূন-সুনীলের জগৎজ্যোতি ছড়াতেই যেন ফেসবুকে প্রীতি-লীনার মতো বেশ কিছু মানুষের আগমন। যখন দেখি ওদের মতো সৃজনশীল মানুষগুলোর চিন্তার প্রতিপক্ষরা সবাই পুরুষ, তখন আঁতকে উঠি। চেষ্টা করতেই হয়, তাদের দাবি অনুযায়ী জেগে উঠতে। আর জেগে উঠতেই চোখে পড়ে অনেক মুখ। ইমদাদুল হক মিলনের উপন্যাস 'নূরজাহান'-এর নূরজাহান কিংবা তারই উত্তরসূরি পূর্ণিমা, দিনাজপুরের ইয়াসমিন, নাটোরের গৃহবধূ রিতা, রাজশাহীর শিরাফিনা মারডি, ঢাকার দক্ষিণখানের ডাক্তার ইভা, ফরিদপুরের চম্পা, সাভারের চাঁদনীর মতো অনেক। মৌলভীবাজারের নূরজাহান কিংবা দিনাজপুরের ইয়াসমিন বেশ জোরে চপেটাঘাত করেছিল সমাজকে। সাহিত্যের উপকরণ, সংবাদের শিরোনাম হয়েছে এমন দু-একটি ঘটনাও। কিন্তু তাতে কী হয়েছে! আকাশ লীনার কথায়ই আবার আসতে হয়, আমি আমার কন্যাটিকে কোলে বসিয়ে কার্টুন ছবি দেখছি, কিংবা শিশুপার্কে রাইডারে চড়িয়ে তাকে আনন্দ দেওয়ার চেষ্টা করছি। ওদিকে গাজীপুরের সেই ছোট মেয়েটি কক্সবাজারে মাদক ব্যবসায়ী চক্রের হাতে দিনের পর দিন ধর্ষিত হচ্ছে।
চাঁদনীর মতো কুলবধূকে বাসের যাত্রী হয়ে বাসায় ফিরতে গিয়ে ধর্ষকের হাত থেকে রক্ষা পেতে পরপারে যেতে হয়েছে। শিরাফিনা মারডি লিখে যাচ্ছে, 'সারাক্ষণ মানসিক যন্ত্রণায় পুড়ছিলাম। তাই শরীরটাকে পুড়িয়ে আমি দুনিয়া থেকে চলে যাচ্ছি।' কিংবা গাজীপুরের ১১ বছর বয়সের মেধাবী ছাত্রীকে কক্সবাজারে দুর্বৃত্তদের কাছ থেকে কলেমা পড়ে মুসলমান হয়ে ধর্ষকদের হাতে আত্মসমর্পণ করতে হচ্ছে। কী দুর্বিষহ! মাদক ব্যবসায়ীচক্রও ধর্মের কথা ভাবে! ওরাও ধর্মকে ব্যবহার করে। ধর্ষণকে জায়েজ করার জন্য শিশুমেয়েটিকে মুসলমান বানায়। সিনেমায় দেখা সেই খুনের দৃশ্য যেন। খুন করার আগে কলেমা পড়িয়ে নেওয়ার মতো।
খুব জানতে ইচ্ছা করে, আমরা যারা ইসলামের মৌলিক শিক্ষাকে জীবনের জন্য অপরিহার্য চিন্তা করি, ধর্মের ওপর আঘাত হানা যাবে না এমন বিশ্বাসকে ধারণ করি, তারা কি একবারও এমন ধর্মবিরোধীদের ব্যাপারে প্রতিবাদী ভূমিকা পালন করেছি? সংবিধানে আল্লাহর নাম থাকল কি থাকল না এ নিয়ে যারা জেহাদি হওয়ার চিন্তা করে তাদেরও প্রশ্ন করা যায়, আপনারা কি একটিবারও এই ধর্মবিরোধী কাজকে ঘৃণা করে একটা বিবৃতি দিয়েছেন? কিংবা জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হতে পারে জানার পরও আপনারা যেভাবে রাস্তাঘাট বন্ধ করে দিয়ে প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন তার কাছাকাছিও কোনো প্রতিবাদ কি করেছেন? জবাব সবার জানা, সবাই চুপ করে আছেন। কিন্তু কেন?
ধর্মের বিষয়ে আমাদের কথা বলার সময় ১০ বার ভাবতে হয়। আমি মুসলমান হলেও ধর্মের বিষয়ে যেন আমার কথা বলার অধিকার নেই। এমনকি আমার বিশ্বাসের ওপর যারা আঘাত হানছে সে ব্যাপারেও আমার কিছু যেন বলার নেই। মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি প্রতিটি মুসলমানকে কক্সবাজারের সেই ধর্ষকদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া উচিত। বিশ্বাস আছে, প্রতিটি ধর্মপ্রাণ মানুষ ধর্ষকদের বিচার চায়। শুধু কক্সবাজারের সেই বর্বরদের নয়, যারা ২০১২ সালে এই দেশে ৭৭১টি ধর্ষণের সঙ্গে জড়িত, যারা এতগুলো ধর্ষণের ঘটনায় সহযোগিতা করেছে প্রত্যেকের বিচার হওয়া জরুরি। এটা কি বিশ্বাস করা যায়, শুধু ওই সময়ই ধর্ষণের পর ১০৬ জন মানুষকে খুন করেছে মানুষরূপী ওই পশুরা? পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা একাত্তরে গণধর্ষণের মতো অপরাধ করেছে। সেই অপরাধের বিচার চাই আমরা। একটি স্বাধীন দেশে এমনটা প্রত্যাশিত না হলেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে শুধু ২০১২ সালেই ১৫৭টি গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশে। এই চিত্রও কি ফুঁসে ওঠার জন্য যথেষ্ট নয়?
একটি সিনেমার কথা শুনেছিলাম। সম্ভবত নামটা 'টিথ'। প্রেমিকার অনিচ্ছায় কামাতুর প্রেমিক তাকে ভোগ করতে প্রবৃত্ত হয়। প্রেমিকার শারীরিক প্রতিরোধ ক্ষমতা জেগে ওঠে। অস্বাভাবিক মনে হতে পারে। কল্পনায় হলেও নারীকে আত্মরক্ষায় উৎসাহী করতে পারে প্রেমিকা তরুণীর প্রতিক্রিয়া। তেমনি প্রতিক্রিয়া কিন্তু সামাজিকভাবে ক্ষীণ ধারায় হলেও দেখা যাচ্ছে। আমরা প্রত্যাশা করব, ওই প্রতিক্রিয়ায় শুধু নারী নয়, প্রত্যেক মানুষই একসূত্রে আবদ্ধ হবে।
দিল্লিতে ধর্ষণের শিকার এক নারীর পাশে দাঁড়িয়েছিল সারা বিশ্বের বিবেকবান মানুষ। আমাদের মৌলভীবাজারের নূরজাহানের মৃত্যু গোটা বাংলাদেশকে ঝাঁকুনি দিয়েছিল, দিনাজপুরের ইয়াসমিন নৃশংসতার উদাহরণ হয়ে থাকবে দীর্ঘদিন। কিন্তু রাজনীতির বিষ সেখানে প্রবেশ করে পূর্ণিমা কিংবা ইয়াসমিনদের সমাজ থেকে খণ্ডিত করে দেয়। ইয়াসমিন আর পূর্ণিমারা তখন এই পক্ষ আর ওই পক্ষের হয়ে যায়। যদি আমরা মানুষ হই তাহলে কোনো ইয়াসমিনই আর একা থাকবে না। যদি আমরা ভাই, পিতা কিংবা সন্তানের মতো মানসিকতা পোষণ করতে পারি তাহলে নিশ্চিত করে বলা যায়- ধর্ষকের ভিত কেঁপে উঠবেই। আকাশ লীনার ভাষ্যে- 'আমিই আজ প্রতিটি ধর্ষিতার আর্তনাদ'।
লেখক : সাংবাদিক
mhussain_71@yahoo.com
লেখক বন্ধু আকাশ লীনা, কলকাতার মেয়ে। চমৎকার গল্প রচনা করে প্রতিনিয়ত। মাঝেমধ্যে মনে হয়, হুমায়ূন-সুনীলের জগৎজ্যোতি ছড়াতেই যেন ফেসবুকে প্রীতি-লীনার মতো বেশ কিছু মানুষের আগমন। যখন দেখি ওদের মতো সৃজনশীল মানুষগুলোর চিন্তার প্রতিপক্ষরা সবাই পুরুষ, তখন আঁতকে উঠি। চেষ্টা করতেই হয়, তাদের দাবি অনুযায়ী জেগে উঠতে। আর জেগে উঠতেই চোখে পড়ে অনেক মুখ। ইমদাদুল হক মিলনের উপন্যাস 'নূরজাহান'-এর নূরজাহান কিংবা তারই উত্তরসূরি পূর্ণিমা, দিনাজপুরের ইয়াসমিন, নাটোরের গৃহবধূ রিতা, রাজশাহীর শিরাফিনা মারডি, ঢাকার দক্ষিণখানের ডাক্তার ইভা, ফরিদপুরের চম্পা, সাভারের চাঁদনীর মতো অনেক। মৌলভীবাজারের নূরজাহান কিংবা দিনাজপুরের ইয়াসমিন বেশ জোরে চপেটাঘাত করেছিল সমাজকে। সাহিত্যের উপকরণ, সংবাদের শিরোনাম হয়েছে এমন দু-একটি ঘটনাও। কিন্তু তাতে কী হয়েছে! আকাশ লীনার কথায়ই আবার আসতে হয়, আমি আমার কন্যাটিকে কোলে বসিয়ে কার্টুন ছবি দেখছি, কিংবা শিশুপার্কে রাইডারে চড়িয়ে তাকে আনন্দ দেওয়ার চেষ্টা করছি। ওদিকে গাজীপুরের সেই ছোট মেয়েটি কক্সবাজারে মাদক ব্যবসায়ী চক্রের হাতে দিনের পর দিন ধর্ষিত হচ্ছে।
চাঁদনীর মতো কুলবধূকে বাসের যাত্রী হয়ে বাসায় ফিরতে গিয়ে ধর্ষকের হাত থেকে রক্ষা পেতে পরপারে যেতে হয়েছে। শিরাফিনা মারডি লিখে যাচ্ছে, 'সারাক্ষণ মানসিক যন্ত্রণায় পুড়ছিলাম। তাই শরীরটাকে পুড়িয়ে আমি দুনিয়া থেকে চলে যাচ্ছি।' কিংবা গাজীপুরের ১১ বছর বয়সের মেধাবী ছাত্রীকে কক্সবাজারে দুর্বৃত্তদের কাছ থেকে কলেমা পড়ে মুসলমান হয়ে ধর্ষকদের হাতে আত্মসমর্পণ করতে হচ্ছে। কী দুর্বিষহ! মাদক ব্যবসায়ীচক্রও ধর্মের কথা ভাবে! ওরাও ধর্মকে ব্যবহার করে। ধর্ষণকে জায়েজ করার জন্য শিশুমেয়েটিকে মুসলমান বানায়। সিনেমায় দেখা সেই খুনের দৃশ্য যেন। খুন করার আগে কলেমা পড়িয়ে নেওয়ার মতো।
খুব জানতে ইচ্ছা করে, আমরা যারা ইসলামের মৌলিক শিক্ষাকে জীবনের জন্য অপরিহার্য চিন্তা করি, ধর্মের ওপর আঘাত হানা যাবে না এমন বিশ্বাসকে ধারণ করি, তারা কি একবারও এমন ধর্মবিরোধীদের ব্যাপারে প্রতিবাদী ভূমিকা পালন করেছি? সংবিধানে আল্লাহর নাম থাকল কি থাকল না এ নিয়ে যারা জেহাদি হওয়ার চিন্তা করে তাদেরও প্রশ্ন করা যায়, আপনারা কি একটিবারও এই ধর্মবিরোধী কাজকে ঘৃণা করে একটা বিবৃতি দিয়েছেন? কিংবা জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হতে পারে জানার পরও আপনারা যেভাবে রাস্তাঘাট বন্ধ করে দিয়ে প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন তার কাছাকাছিও কোনো প্রতিবাদ কি করেছেন? জবাব সবার জানা, সবাই চুপ করে আছেন। কিন্তু কেন?
ধর্মের বিষয়ে আমাদের কথা বলার সময় ১০ বার ভাবতে হয়। আমি মুসলমান হলেও ধর্মের বিষয়ে যেন আমার কথা বলার অধিকার নেই। এমনকি আমার বিশ্বাসের ওপর যারা আঘাত হানছে সে ব্যাপারেও আমার কিছু যেন বলার নেই। মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি প্রতিটি মুসলমানকে কক্সবাজারের সেই ধর্ষকদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া উচিত। বিশ্বাস আছে, প্রতিটি ধর্মপ্রাণ মানুষ ধর্ষকদের বিচার চায়। শুধু কক্সবাজারের সেই বর্বরদের নয়, যারা ২০১২ সালে এই দেশে ৭৭১টি ধর্ষণের সঙ্গে জড়িত, যারা এতগুলো ধর্ষণের ঘটনায় সহযোগিতা করেছে প্রত্যেকের বিচার হওয়া জরুরি। এটা কি বিশ্বাস করা যায়, শুধু ওই সময়ই ধর্ষণের পর ১০৬ জন মানুষকে খুন করেছে মানুষরূপী ওই পশুরা? পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা একাত্তরে গণধর্ষণের মতো অপরাধ করেছে। সেই অপরাধের বিচার চাই আমরা। একটি স্বাধীন দেশে এমনটা প্রত্যাশিত না হলেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে শুধু ২০১২ সালেই ১৫৭টি গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশে। এই চিত্রও কি ফুঁসে ওঠার জন্য যথেষ্ট নয়?
একটি সিনেমার কথা শুনেছিলাম। সম্ভবত নামটা 'টিথ'। প্রেমিকার অনিচ্ছায় কামাতুর প্রেমিক তাকে ভোগ করতে প্রবৃত্ত হয়। প্রেমিকার শারীরিক প্রতিরোধ ক্ষমতা জেগে ওঠে। অস্বাভাবিক মনে হতে পারে। কল্পনায় হলেও নারীকে আত্মরক্ষায় উৎসাহী করতে পারে প্রেমিকা তরুণীর প্রতিক্রিয়া। তেমনি প্রতিক্রিয়া কিন্তু সামাজিকভাবে ক্ষীণ ধারায় হলেও দেখা যাচ্ছে। আমরা প্রত্যাশা করব, ওই প্রতিক্রিয়ায় শুধু নারী নয়, প্রত্যেক মানুষই একসূত্রে আবদ্ধ হবে।
দিল্লিতে ধর্ষণের শিকার এক নারীর পাশে দাঁড়িয়েছিল সারা বিশ্বের বিবেকবান মানুষ। আমাদের মৌলভীবাজারের নূরজাহানের মৃত্যু গোটা বাংলাদেশকে ঝাঁকুনি দিয়েছিল, দিনাজপুরের ইয়াসমিন নৃশংসতার উদাহরণ হয়ে থাকবে দীর্ঘদিন। কিন্তু রাজনীতির বিষ সেখানে প্রবেশ করে পূর্ণিমা কিংবা ইয়াসমিনদের সমাজ থেকে খণ্ডিত করে দেয়। ইয়াসমিন আর পূর্ণিমারা তখন এই পক্ষ আর ওই পক্ষের হয়ে যায়। যদি আমরা মানুষ হই তাহলে কোনো ইয়াসমিনই আর একা থাকবে না। যদি আমরা ভাই, পিতা কিংবা সন্তানের মতো মানসিকতা পোষণ করতে পারি তাহলে নিশ্চিত করে বলা যায়- ধর্ষকের ভিত কেঁপে উঠবেই। আকাশ লীনার ভাষ্যে- 'আমিই আজ প্রতিটি ধর্ষিতার আর্তনাদ'।
লেখক : সাংবাদিক
mhussain_71@yahoo.com
No comments