বাজেট-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে সিপিডি বাস্তবায়নের আশা খুবই ক্ষীণ
২০১৩-১৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বড়
ধরনের কয়েকটি ঝুঁকি দেখছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ
(সিপিডি)। এর অন্যতম হচ্ছে, তিনটি সরকারকে এ বাজেট বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে
যেতে হবে।
সঙ্গে আছে সামনের দিনগুলোতে নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতা হওয়ার আশঙ্কাও।
এ অবস্থায় সিপিডি মনে করে, মধ্যবর্তী পর্যায়ে এ বাজেট সংশোধনের প্রয়োজন হতে পারে।
সিপিডির বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘প্রস্তাবিত বাজেটের আকাঙ্ক্ষাগুলো যথেষ্ট উচ্চাকাঙ্ক্ষী। অর্থনীতির এ অবস্থায় উচ্চাকাঙ্ক্ষী বাজেটের খুব বেশি ভিত্তি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।’
প্রস্তাবিত বাজেটে ঘোষিত সরকারি ব্যয় ও আয়—পরিমাণের দিক থেকে দুটিকেই ‘সর্বকালের বড়’ উল্লেখ করে সিপিডি বলেছে, দুটিই যদি শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়ন করা যায়, তবে তা দেশের অর্থনীতির জন্য ভালো হবে।
তবে গবেষণা সংস্থাটি সরকারের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে কি না, সে বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে। রাজস্ব আদায়ের এই পরিকল্পনাকেই প্রস্তাবিত বাজেটের দুর্বলতম দিক মনে করছে সিপিডি।
দেবপ্রিয় বলেন, বাজেটের আর্থিক কাঠামোগুলো দুর্বল। বাস্তবায়নের আশা খুবই ক্ষীণ।
সিপিডি বলছে, বাজেটে আয়-ব্যয়ের বিষয়গুলো এমনভাবেই করা হয়েছে, যা বাস্তবতার নিরিখে সংগতিপূর্ণ নয়। সে কারণে এবারের বাজেটকে পরাবাস্তব বলে মন্তব্য করেছে সংস্থাটি। বিষয়টি ব্যাখ্যা করে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘এবারও পিপিপিতে কোনো বরাদ্দ হবে বলে মনে হয় না। পদ্মা সেতুর জন্যও কোনো ব্যয় হবে বলে মনে করি না। সে কারণে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার মতো ব্যয় হবে না। কিন্তু তা বাজেটে রাখা হয়েছে। আর বলা হচ্ছে, বড় বাজেট। সেটা শুনতেও ভালো লাগে। কিন্তু বাস্তবে বাজেট অত বড় হবে না।’
গতকাল শুক্রবার মহাখালীর ব্র্যাক ইন সেন্টারে সিপিডির সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান, অতিরিক্ত পরিচালক ফাহমিদা খাতুন ও খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, জ্যেষ্ঠ গবেষক তৌফিকুল ইসলাম খান, সংলাপ বিভাগের প্রধান আনিসাতুল ফাতেমা ইউছুফ প্রমুখ।
সংবাদ সম্মেলনে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, এটি বর্তমান সরকারের শেষ বাজেট। তিনটি সরকার এটি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে যাবে। সামনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এরও প্রভাব বাজেটে লক্ষণীয়। তিনি বলেন, প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি, ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ নিম্নমুখী, রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়া, অভ্যন্তরীণ চাহিদা কমে যাওয়া—সব মিলিয়ে দেশের অর্থনীতি উচ্চ পর্যায় থেকে নিম্নগামী হয়েছে। এ অবস্থার মধ্যে প্রস্তাবিত বাজেট দেওয়া হয়েছে।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আরও বলেন, ‘যেসব রাজস্ব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তার সঙ্গে আমরা একমত। সেখানে বিনিয়োগ বাড়ানোর চেষ্টা আছে। দেশি শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা আছে। সমস্যা হচ্ছে আর্থিক কাঠামোতে। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় এবং বাস্তবতার নিরিখে এটি সংগতিপূর্ণ নয়। রানা প্লাজার ধস শেষ পর্যন্ত রপ্তানির পরিস্থিতি কোথায় নিয়ে যাবে, জানি না। হরতালসহ রাজনৈতিক সহিংসতায় বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও বিমুখ রয়েছেন।’
প্রবৃদ্ধি: সিপিডির মতে, প্রস্তাবিত বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ। কিন্তু ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা অনুযায়ী এ হার হওয়া উচিত ছিল ৭ দশমিক ৬ শতাংশ। বিদায়ী অর্থবছরে আরও কয়েকটি ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ায় মধ্যমেয়াদি প্রাক্কলন থেকে অর্থমন্ত্রী পিছিয়ে এসেছেন।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘প্রবৃদ্ধির ধারা যে কমে গেল, তার একটা বড় প্রভাব পড়বে। আমাদের মধ্যম আয়ের দেশে পৌঁছানোর যে রাস্তা বড় হলো, দেরিতে সেখানে পৌঁছাব।’
আবার প্রস্তাবিত বাজেটে জিডিপি, আমদানি ও রপ্তানির যে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, তা অর্জন করা কঠিন হবে বলে মনে করে সংস্থাটি। তারা বলেছে, তিনটি ক্ষেত্রেই বর্তমান বছরে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে পিছিয়ে থেকে হঠাৎ করে কীভাবে গতি বাড়বে, তা বোধগম্য নয়। আবার আগামী বছরে রাজনৈতিক অস্থিরতার আশঙ্কা এর সঙ্গে যোগ হতে পারে।
সরকারি অর্থায়নের কাঠামো: প্রস্তাবিত বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ জিডিপির ৪ দশমিক ৬ শতাংশ। ঘাটতি মোকাবিলায় বড় ধরনের বিদেশি সহায়তা (তিন হাজার ৮০০ কোটি ডলার) পাওয়ার আশা, ব্যাংক ও অব্যাংক খাত থেকে বড় ধরনের ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।
এ কথা উল্লেখ করে দেবপ্রিয় বলেন, ‘দুশ্চিন্তার জায়গা আর্থিক ঘাটতি নয়। কারণ, নির্বাচনী বছরে পরিকল্পনা অনুযায়ী যেমন আয় হয় না, তেমনি ব্যয়ও হয় না। সে কারণে ঘাটতি স্থিতিশীল থাকে।’
দেবপ্রিয় বলেন, প্রত্যক্ষ খাতওয়ারি বিনিয়োগের চেয়ে বেশি ব্যয় হবে সুদজনিত ব্যয়ে। এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। তিনি বলেন, ‘১০০ টাকা যদি নতুন ব্যয় হয়, তাহলে ৪০ টাকাই চলে যাবে সুদের কারণে। এটা আর্থিক খাতের স্বাস্থ্যের লক্ষণ নয়।’
রাজস্ব আদায়: সিপিডি বলেছে, চলতি অর্থবছরেই এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হচ্ছে না। কিন্তু এই রাজস্ব আদায়ের ওপর ভিত্তি করেই আগামী অর্থবছরের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে। এটা কতখানি বাস্তবসম্মত, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে।
দেবপ্রিয় বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ২১ দশমিক ২ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। এটি অর্জিত না হওয়ায় কার্যত আগামী অর্থবছরে প্রায় ২৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে। তিনি বলেন, রাজস্ব আদায়ের প্রায় ৪৬ শতাংশ আসবে আয়কর থেকে। নির্বাচনের বছরে এত বেশি রাজস্ব আদায় করতে পারলে এনবিআর নিঃসন্দেহে ধন্যবাদ পাবে।
করমুক্ত আয়সীমা শিথিল করার উদ্যোগকে সঠিক মনে করলেও বাজেটে আমদানি শুল্কের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে আনার উদ্যোগ যুক্তিযুক্ত হবে কি না, তা দেখা প্রয়োজন বলে মনে করেন দেবপ্রিয়।
এবারের বাজেটে বেশ কিছু খাতে শুল্ক বাড়ানো-কমানো এবং কিছু খাতে প্রত্যাহার করা হয়েছে। সিপিডি মনে করে, এই শুল্ক বাড়ানো-কমানো ও প্রত্যাহারের মধ্যেও যদি আমদানির প্রক্ষেপণ বাড়ে, তাহলে রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ ৪ শতাংশ বাড়বে।
সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, শুল্ক কমিয়ে এনে দেশি শিল্পের প্রতিযোগী সক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এতে রাজস্ব আদায় কমবে না। কারণ, এর মধ্য দিয়ে পুঁজি গঠিত হবে, বিনিয়োগ হবে, নতুন কর্মসংস্থান হবে। এসবের মধ্য দিয়ে রাজস্ব উঠে আসবে।
তবে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার পরও গ্রামীণফোনের করপোরেট কর ৩৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪০ শতাংশ করা হয়েছে। সিপিডি বলছে, শুধু একটি কোম্পানির জন্য নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে এমন পরিবর্তন কাম্য নয়।
কালোটাকা: সিপিডি বলছে, কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া নৈতিকভাবে অগ্রহণযোগ্য এবং এর অর্থনৈতিক সুফল এখনো প্রশ্নবিদ্ধ। গত চার বছরে দেশে মাত্র এক হাজার ৩০৫ কোটি টাকা সাদা হয়েছে। এর বিপরীতে সরকার রাজস্ব পেয়েছে মাত্র ৩৮ কোটি টাকা।
দেবপ্রিয়র মতে, কালোটাকা সাদা করার কারণে যে পরিমাণ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়, সে অনুযায়ী কোনো সুফলই দেখা যায় না। তিনি বলেন, কালোটাকা সাদা করার সুযোগের সঙ্গে পুঁজির গঠন, উন্নয়ন খাত ও শিল্প খাতের কোনো সম্পর্ক নেই। দেশজ আয়ের আধুনিকায়নেও এর কোনো ভূমিকা নেই।
এক প্রশ্নের জবাবে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, সাদা আর কালোর মধ্যে আরেকটি খাত গড়ে উঠেছে। সেটি হলো ধূসর খাত। আইনি কাঠামোর ফাঁকফোকর দিয়েই এটি গড়ে উঠেছে।
জেলা বাজেট: এবার অর্থমন্ত্রী প্রথমবারের মতো একটি জেলার (টাঙ্গাইল) বাজেট ঘোষণা করেছেন। দেবপ্রিয় বলেন, ‘এটাকে আমাদের জেলা বাজেট মনে হয়নি। মনে হয়েছে, টাঙ্গাইল জেলার ব্যয়ের একটি খতিয়ান।’
ভালো দিক: সিপিডির মতে, জেলা সদরের পৌরসভা এলাকার করদাতাদের ন্যূনতম করের পরিমাণ কমিয়ে দুই হাজার এবং এর বাইরের এলাকাতে এক হাজার টাকা ধার্য করার মাধ্যমে প্রান্তিক করদাতার সংখ্যা বাড়বে।
বছরে যাঁদের আয় দুই কোটি থেকে ১০ কোটি টাকা, প্রস্তাবিত বাজেটে তাঁদের ১০ শতাংশ এবং এর বেশি আয়ের মানুষের জন্য ১৫ শতাংশ সারচার্জ আরোপ করা হয়েছে।
মূলধনি যন্ত্রপাতির শুল্ক কমিয়ে ২ শতাংশ করা, কাঁচামালের শুল্ক কমিয়ে ১০ শতাংশ করার কারণে বেসরকারি বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়বে এবং বিনিয়োগ ও চলতি মূলধনের ব্যয় কমবে।
কর অবকাশ-সুবিধা ২০১৫ সাল পর্যন্ত বাড়ানোয় নতুন উদ্যোক্তারা বিনিয়োগে আশাবাদী হবেন। এ ছাড়া স্থানীয় শিল্প সুরক্ষায় বড় সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এসএমই এবং ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পের জন্য যেসব প্রস্তাব করা হয়েছে, সেগুলোও সঠিক বলে মনে করে সিপিডি।
এবার নারী ও শিশুদের জন্য বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। সিপিডির মতে, এটিও একটি ভালো পদক্ষেপ।
এ অবস্থায় সিপিডি মনে করে, মধ্যবর্তী পর্যায়ে এ বাজেট সংশোধনের প্রয়োজন হতে পারে।
সিপিডির বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘প্রস্তাবিত বাজেটের আকাঙ্ক্ষাগুলো যথেষ্ট উচ্চাকাঙ্ক্ষী। অর্থনীতির এ অবস্থায় উচ্চাকাঙ্ক্ষী বাজেটের খুব বেশি ভিত্তি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।’
প্রস্তাবিত বাজেটে ঘোষিত সরকারি ব্যয় ও আয়—পরিমাণের দিক থেকে দুটিকেই ‘সর্বকালের বড়’ উল্লেখ করে সিপিডি বলেছে, দুটিই যদি শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়ন করা যায়, তবে তা দেশের অর্থনীতির জন্য ভালো হবে।
তবে গবেষণা সংস্থাটি সরকারের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে কি না, সে বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে। রাজস্ব আদায়ের এই পরিকল্পনাকেই প্রস্তাবিত বাজেটের দুর্বলতম দিক মনে করছে সিপিডি।
দেবপ্রিয় বলেন, বাজেটের আর্থিক কাঠামোগুলো দুর্বল। বাস্তবায়নের আশা খুবই ক্ষীণ।
সিপিডি বলছে, বাজেটে আয়-ব্যয়ের বিষয়গুলো এমনভাবেই করা হয়েছে, যা বাস্তবতার নিরিখে সংগতিপূর্ণ নয়। সে কারণে এবারের বাজেটকে পরাবাস্তব বলে মন্তব্য করেছে সংস্থাটি। বিষয়টি ব্যাখ্যা করে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘এবারও পিপিপিতে কোনো বরাদ্দ হবে বলে মনে হয় না। পদ্মা সেতুর জন্যও কোনো ব্যয় হবে বলে মনে করি না। সে কারণে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার মতো ব্যয় হবে না। কিন্তু তা বাজেটে রাখা হয়েছে। আর বলা হচ্ছে, বড় বাজেট। সেটা শুনতেও ভালো লাগে। কিন্তু বাস্তবে বাজেট অত বড় হবে না।’
গতকাল শুক্রবার মহাখালীর ব্র্যাক ইন সেন্টারে সিপিডির সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান, অতিরিক্ত পরিচালক ফাহমিদা খাতুন ও খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, জ্যেষ্ঠ গবেষক তৌফিকুল ইসলাম খান, সংলাপ বিভাগের প্রধান আনিসাতুল ফাতেমা ইউছুফ প্রমুখ।
সংবাদ সম্মেলনে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, এটি বর্তমান সরকারের শেষ বাজেট। তিনটি সরকার এটি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে যাবে। সামনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এরও প্রভাব বাজেটে লক্ষণীয়। তিনি বলেন, প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি, ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ নিম্নমুখী, রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়া, অভ্যন্তরীণ চাহিদা কমে যাওয়া—সব মিলিয়ে দেশের অর্থনীতি উচ্চ পর্যায় থেকে নিম্নগামী হয়েছে। এ অবস্থার মধ্যে প্রস্তাবিত বাজেট দেওয়া হয়েছে।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আরও বলেন, ‘যেসব রাজস্ব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তার সঙ্গে আমরা একমত। সেখানে বিনিয়োগ বাড়ানোর চেষ্টা আছে। দেশি শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা আছে। সমস্যা হচ্ছে আর্থিক কাঠামোতে। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় এবং বাস্তবতার নিরিখে এটি সংগতিপূর্ণ নয়। রানা প্লাজার ধস শেষ পর্যন্ত রপ্তানির পরিস্থিতি কোথায় নিয়ে যাবে, জানি না। হরতালসহ রাজনৈতিক সহিংসতায় বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও বিমুখ রয়েছেন।’
প্রবৃদ্ধি: সিপিডির মতে, প্রস্তাবিত বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ। কিন্তু ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা অনুযায়ী এ হার হওয়া উচিত ছিল ৭ দশমিক ৬ শতাংশ। বিদায়ী অর্থবছরে আরও কয়েকটি ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ায় মধ্যমেয়াদি প্রাক্কলন থেকে অর্থমন্ত্রী পিছিয়ে এসেছেন।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘প্রবৃদ্ধির ধারা যে কমে গেল, তার একটা বড় প্রভাব পড়বে। আমাদের মধ্যম আয়ের দেশে পৌঁছানোর যে রাস্তা বড় হলো, দেরিতে সেখানে পৌঁছাব।’
আবার প্রস্তাবিত বাজেটে জিডিপি, আমদানি ও রপ্তানির যে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, তা অর্জন করা কঠিন হবে বলে মনে করে সংস্থাটি। তারা বলেছে, তিনটি ক্ষেত্রেই বর্তমান বছরে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে পিছিয়ে থেকে হঠাৎ করে কীভাবে গতি বাড়বে, তা বোধগম্য নয়। আবার আগামী বছরে রাজনৈতিক অস্থিরতার আশঙ্কা এর সঙ্গে যোগ হতে পারে।
সরকারি অর্থায়নের কাঠামো: প্রস্তাবিত বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ জিডিপির ৪ দশমিক ৬ শতাংশ। ঘাটতি মোকাবিলায় বড় ধরনের বিদেশি সহায়তা (তিন হাজার ৮০০ কোটি ডলার) পাওয়ার আশা, ব্যাংক ও অব্যাংক খাত থেকে বড় ধরনের ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।
এ কথা উল্লেখ করে দেবপ্রিয় বলেন, ‘দুশ্চিন্তার জায়গা আর্থিক ঘাটতি নয়। কারণ, নির্বাচনী বছরে পরিকল্পনা অনুযায়ী যেমন আয় হয় না, তেমনি ব্যয়ও হয় না। সে কারণে ঘাটতি স্থিতিশীল থাকে।’
দেবপ্রিয় বলেন, প্রত্যক্ষ খাতওয়ারি বিনিয়োগের চেয়ে বেশি ব্যয় হবে সুদজনিত ব্যয়ে। এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। তিনি বলেন, ‘১০০ টাকা যদি নতুন ব্যয় হয়, তাহলে ৪০ টাকাই চলে যাবে সুদের কারণে। এটা আর্থিক খাতের স্বাস্থ্যের লক্ষণ নয়।’
রাজস্ব আদায়: সিপিডি বলেছে, চলতি অর্থবছরেই এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হচ্ছে না। কিন্তু এই রাজস্ব আদায়ের ওপর ভিত্তি করেই আগামী অর্থবছরের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে। এটা কতখানি বাস্তবসম্মত, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে।
দেবপ্রিয় বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ২১ দশমিক ২ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। এটি অর্জিত না হওয়ায় কার্যত আগামী অর্থবছরে প্রায় ২৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে। তিনি বলেন, রাজস্ব আদায়ের প্রায় ৪৬ শতাংশ আসবে আয়কর থেকে। নির্বাচনের বছরে এত বেশি রাজস্ব আদায় করতে পারলে এনবিআর নিঃসন্দেহে ধন্যবাদ পাবে।
করমুক্ত আয়সীমা শিথিল করার উদ্যোগকে সঠিক মনে করলেও বাজেটে আমদানি শুল্কের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে আনার উদ্যোগ যুক্তিযুক্ত হবে কি না, তা দেখা প্রয়োজন বলে মনে করেন দেবপ্রিয়।
এবারের বাজেটে বেশ কিছু খাতে শুল্ক বাড়ানো-কমানো এবং কিছু খাতে প্রত্যাহার করা হয়েছে। সিপিডি মনে করে, এই শুল্ক বাড়ানো-কমানো ও প্রত্যাহারের মধ্যেও যদি আমদানির প্রক্ষেপণ বাড়ে, তাহলে রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ ৪ শতাংশ বাড়বে।
সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, শুল্ক কমিয়ে এনে দেশি শিল্পের প্রতিযোগী সক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এতে রাজস্ব আদায় কমবে না। কারণ, এর মধ্য দিয়ে পুঁজি গঠিত হবে, বিনিয়োগ হবে, নতুন কর্মসংস্থান হবে। এসবের মধ্য দিয়ে রাজস্ব উঠে আসবে।
তবে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার পরও গ্রামীণফোনের করপোরেট কর ৩৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪০ শতাংশ করা হয়েছে। সিপিডি বলছে, শুধু একটি কোম্পানির জন্য নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে এমন পরিবর্তন কাম্য নয়।
কালোটাকা: সিপিডি বলছে, কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া নৈতিকভাবে অগ্রহণযোগ্য এবং এর অর্থনৈতিক সুফল এখনো প্রশ্নবিদ্ধ। গত চার বছরে দেশে মাত্র এক হাজার ৩০৫ কোটি টাকা সাদা হয়েছে। এর বিপরীতে সরকার রাজস্ব পেয়েছে মাত্র ৩৮ কোটি টাকা।
দেবপ্রিয়র মতে, কালোটাকা সাদা করার কারণে যে পরিমাণ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়, সে অনুযায়ী কোনো সুফলই দেখা যায় না। তিনি বলেন, কালোটাকা সাদা করার সুযোগের সঙ্গে পুঁজির গঠন, উন্নয়ন খাত ও শিল্প খাতের কোনো সম্পর্ক নেই। দেশজ আয়ের আধুনিকায়নেও এর কোনো ভূমিকা নেই।
এক প্রশ্নের জবাবে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, সাদা আর কালোর মধ্যে আরেকটি খাত গড়ে উঠেছে। সেটি হলো ধূসর খাত। আইনি কাঠামোর ফাঁকফোকর দিয়েই এটি গড়ে উঠেছে।
জেলা বাজেট: এবার অর্থমন্ত্রী প্রথমবারের মতো একটি জেলার (টাঙ্গাইল) বাজেট ঘোষণা করেছেন। দেবপ্রিয় বলেন, ‘এটাকে আমাদের জেলা বাজেট মনে হয়নি। মনে হয়েছে, টাঙ্গাইল জেলার ব্যয়ের একটি খতিয়ান।’
ভালো দিক: সিপিডির মতে, জেলা সদরের পৌরসভা এলাকার করদাতাদের ন্যূনতম করের পরিমাণ কমিয়ে দুই হাজার এবং এর বাইরের এলাকাতে এক হাজার টাকা ধার্য করার মাধ্যমে প্রান্তিক করদাতার সংখ্যা বাড়বে।
বছরে যাঁদের আয় দুই কোটি থেকে ১০ কোটি টাকা, প্রস্তাবিত বাজেটে তাঁদের ১০ শতাংশ এবং এর বেশি আয়ের মানুষের জন্য ১৫ শতাংশ সারচার্জ আরোপ করা হয়েছে।
মূলধনি যন্ত্রপাতির শুল্ক কমিয়ে ২ শতাংশ করা, কাঁচামালের শুল্ক কমিয়ে ১০ শতাংশ করার কারণে বেসরকারি বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়বে এবং বিনিয়োগ ও চলতি মূলধনের ব্যয় কমবে।
কর অবকাশ-সুবিধা ২০১৫ সাল পর্যন্ত বাড়ানোয় নতুন উদ্যোক্তারা বিনিয়োগে আশাবাদী হবেন। এ ছাড়া স্থানীয় শিল্প সুরক্ষায় বড় সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এসএমই এবং ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পের জন্য যেসব প্রস্তাব করা হয়েছে, সেগুলোও সঠিক বলে মনে করে সিপিডি।
এবার নারী ও শিশুদের জন্য বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। সিপিডির মতে, এটিও একটি ভালো পদক্ষেপ।
No comments