কালের পুরাণ মওদুদ আহমদের চোখে হাসিনা-খালেদা by সোহরাব হাসান
মওদুদ আহমদকে দেশের মানুষ একজন রাজনীতিক
এবং প্রায় সব সরকারের মন্ত্রী হিসেবে জানলেও বাইরের দুনিয়ায় তিনি পরিচিত
রাজনৈতিক বিশ্লেষক বা পণ্ডিত হিসেবে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর বই পাঠ্য।
পাকিস্তান
আমল থেকে শুরু করে বাংলাদেশের রাজনীতির আদ্যোপান্ত উঠে এসেছে তাঁর
গবেষণাধর্মী রচনায়। তিনি মন্ত্রী বা রাজনীতিক হিসেবে যে দলেই থাকুন না কেন,
রাজনৈতিক বিশ্লেষণে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নির্মোহ ও বস্তুনিষ্ঠ থাকার চেষ্টা
করেন; যে কারণে তাঁর প্রতিটি বই-ই নিজ দলের কাছে সমালোচিত এবং প্রতিপক্ষের
কাছে সমাদৃত। দুই সামরিক শাসকের অধীনে দীর্ঘ সময় মন্ত্রিত্ব করলেও মওদুদ
আহমদ তাঁদের কঠোর সমালোচনা করতে দ্বিধা করেননি।
যে প্রশ্নের উত্তর নেই: আমাদের হাতে তাঁর সর্বশেষ যে বইটি এসেছে সেটি অনেকটা ভিন্ন মেজাজের; ঠিক গবেষণা নয়। এতে তাঁর বন্দিজীবনের অভিজ্ঞতা বিবৃত হয়েছে। বইয়ের শিরোনাম কারাগারে কেমন ছিলাম: ২০০৭-২০০৮। সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আরও অনেক রাজনীতিকের মতো মওদুদ আহমদও গ্রেপ্তার হন এবং এক বছর আট মাস কারাভোগ করেন। বইটি সেই কারাজীবনের ডায়েরি হলেও রাজনৈতিক বিশ্লেষণ ও ইতিহাসের বিচার আছে, আছে আত্মসমালোচনাও। বইটি শুরু হয়েছে ১০ এপ্রিল ২০০৭ তাঁর গ্রেপ্তার হওয়ার দিন থেকে এবং শেষ হয়েছে ১ ডিসেম্বর ২০০৮ মুক্তির তারিখে। দুই তারিখের মধ্যে অনেক তারিখ আছে, আছে অনেক ব্যক্তিগত ক্ষোভ-দুঃখ-বেদনার কথা। পারিবারিক ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সঙ্গে তিনি দেশের রাজনীতির গতি-প্রকৃতি মেলাতে চেষ্টা করেছেন। রিমান্ডে নেওয়ার ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন: ‘আমাকে যে জায়গায় নিয়ে আসা হয়েছিল সেটা ছিল মিলিটারি ফিল্ড ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের একটা বন্ধ প্রকোষ্ঠ। এটা চরম রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত দেশি বা বিদেশি শত্রু বা চরদের জন্য এটি ছিল সংরক্ষিত একটি বিশেষ জায়গা।’ (পৃষ্ঠা-২)। জিজ্ঞাসাবাদের নামে চালানো হয়েছে মানসিক নির্যাতন।
একজন নাগরিক হিসেবে মওদুদ আহমদ যে পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন, সে জন্য আমরা মর্মাহত। একই সঙ্গে তাঁর কাছে একটি প্রশ্ন উত্থাপন করাও নিশ্চয়ই অযৌক্তিক হবে না। সেনা-সমর্থিত সরকারের আমলে এই যে ভিন্নমতের কারণে তাঁর প্রতি অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়েছে, সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন করা হয়েছে, অনুরূপ ঘটনা কি তাঁর মন্ত্রিত্বকালে বিরোধী দলের রাজনীতিক এবং ভিন্নমতের লেখক-বুদ্ধিজীবীদের ওপর ঘটেনি? বিনা অপরাধে মুনতাসীর মামুন, শাহরিয়ার কবিরেরা কি জেল-জুলুমের শিকার হননি? যদি হয়ে থাকেন, একজন মন্ত্রী হিসেবে তিনি তার প্রতিবাদ করেছিলেন কি? তিনি বলতে পারেন, প্রতিকারের ক্ষমতা তাঁর ছিল না; গণতান্ত্রিক কিংবা অগণতান্ত্রিক—সব সরকারের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন একজন। কিন্তু তিনি সেই ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বৈরশাসনের প্রতিবাদে সরকার থেকে বেরিয়ে আসার সৎ সাহস দেখাতে পারলেন না কেন?
মওদুদ আহমদ তাঁর বইয়ে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের অনেক সমস্যা চিহ্নিত করলেও এই প্রতিবাদ করতে না পারার সমস্যাটি উল্লেখ করেছেন মনে পড়ে না। এরশাদের আমলে তিনি দুর্নীতির মামলায় জেলে যান, আবার জেল থেকে বেরিয়ে সেই সরকারের উচ্চপদে আসীন হয়েছেন। ১৯৯২ সালে যে দলের মাস্তানদের হামলায় তিনি আহত হন, পরবর্তীকালে সেই দলের সরকারে মন্ত্রিত্ব করেছেন (২০০১-০৬)।
মওদুদ আহমদ বুঝতে না পারলেও দেশের সাধারণ মানুষ বুঝতে পারছে, এটাই বাংলাদেশের গণতন্ত্রের প্রধান সমস্যা। তিনি সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বেআইনি তৎপরতা, বিশেষ করে ভিন্নমতাবলম্বীদের ওপর নির্যাতন সম্পর্কে যেসব বর্ণনা করেছেন, তা যেমন মিথ্যে নয়; তেমনি মিথ্যে নয় তাঁর সরকারের আমলেও মাত্রাভেদে সেগুলো চালু ছিল। হয়তো বর্তমান সরকারের আমলেও আছে। আমাদের দুর্ভাগ্য হলো, বিরোধী দলে থাকতে যে নেতারা সরকারের হাতে নিগৃহীত ও লাঞ্ছিত হন, ক্ষমতায় গিয়ে তাঁরাও বিরোধীদের ওপর একই কাজ করেন।
ডায়েরি ও ইতিহাসের দায়বদ্ধতা: জেলখানায় মওদুদ আহমদ প্রতিদিন ডায়েরি লিখতেন। সেই ডায়েরিতে প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতার বর্ণনার পাশাপাশি রাজনীতি ও ইতিহাসের বিশ্লেষণও আছে। ৭ নভেম্বর ২০০৭-এর ডায়েরিতে তিনি লিখেছেন: ‘এই দিনটির কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে। স্বতঃস্ফূর্ত এক বিপ্লবের মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটিয়ে ঐক্যবদ্ধ স্লোগান মুখরিত করে সেনাবাহিনী ও জনগণ সম্মিলিতভাবে নেমে এসেছিল রাজধানীর রাজপথে। তারা সেদিন জিয়াউর রহমানকে অন্তরীণ অবস্থা থেকে মুক্ত ও ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করে।’ (পৃষ্ঠা-১৮৭)। অন্যত্র তিনি লিখেছেন: ‘বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে উচ্চাভিলাষ বিবর্জিত ও লোভ-লালসা দ্বারা মনে মনে উজ্জীবিত হননি এমন মুক্তিযোদ্ধা প্রায় ছিলেন না বললেই চলে।’ ৭ নভেম্বরের ঘটনাও সেই উচ্চাভিলাষের অংশ কি না, মওদুদ সে সম্পর্কে কিছু বলেননি। তবে আমরা ঘটনাপরম্পরায় লক্ষ করি, মুক্তিযুদ্ধের ১১ জন সেক্টর কমান্ডারের চারজনই একে অপরের হাতে খুন হয়েছেন।
১৫ আগস্ট ২০০৭ তারিখের ডায়েরিতে তিনি লিখেছেন: ‘সারা দেশে উদ্যাপিত হচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকী।’...আমার এ কারণে দুঃখ হয় যে আমার অক্লান্ত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও আমি সরকারের বিরোধিতার কারণে আপিল বিভাগে জমে থাকা সেই জঘন্য হত্যা মামলার শুনানি শুরু করতে পারিনি। আমি এমনও যুক্তি দেখিয়েছি যে মুজিব যখন নিহত হন, তখন বিএনপির জন্মই হয়নি। কাজেই আপিল শুরু না করে বিএনপি এর দায়ভার বহন করতে যাবে কেন? কিন্তু প্রধানমন্ত্রীসহ অন্যদের আমি তা বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছি। এ জন্য ব্যক্তিগতভাবে আমি লজ্জিত এবং নিজেকেই আমার কাছে ছোট বলে মনে হয়।’ (পৃষ্ঠা-১৪১)। পরের বছরে একই দিনের ডায়েরিতে তিনি লিখেছেন: ‘বিতর্কিত একটি জন্মদিন হিসেবে আজ বেগম জিয়ার ৬৩তম জন্মদিন। সঠিক হলেও আমি হলে আমার জন্মদিন বোধ হয় এক দিন আগে বা পরে পালন করতাম ও শেখ মুজিবের হত্যা দিবসের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতাম। এটা একটা রুচিবোধের বিষয়। বেগম জিয়া তা করলে তিনি সকল শ্রেণীর জনগণের কাছ থেকে আরও বেশি শ্রদ্ধা অর্জন করতে পারতেন। তাঁর এই উদারতা তাঁকে আরও বেশি মহান করে তুলত।’ (পৃষ্ঠা ৩২৪-২৫)
২১ আগস্ট ২০০৮ ডায়েরিতে মওদুদ লিখেছেন: ‘আজ সেই কালো দিবস যেদিন ঢাকার আওয়ামী লীগ অফিসের সামনে আয়োজিত জনসভায় শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড হামলা চালানো হয়েছিল। তিনি অলৌকিকভাবে বেঁচে গেলেও জিল্লুর রহমানের স্ত্রী ও আওয়ামী লীগের নারী আন্দোলনের নেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন সেদিনকার ভয়াবহ হামলায় নিহত হন। এ ঘটনায় আমি কতটা মর্মাহত হয়েছি তা প্রকাশ করার কোনো ভাষা আমার নেই। এদের দুজনকেই আমি ভালো করে জানি এবং এদের প্রতি রয়েছে আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা।’ (পৃষ্ঠা-৩২৮)
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সমালোচনা: মওদুদ আহমদ তাঁর বইয়ে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কঠোর সমালোচনা করেছেন। তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে কাজ করেছে বলেও গুরুতর অভিযোগ তাঁর। তিনি লিখেছেন: ‘আমার আশঙ্কা যে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশে নিরবচ্ছিন্ন গণতন্ত্রের তেমন সম্ভাবনা নেই। ত্রাস ভয় সন্ত্রাস; নিরাপত্তাহীনতা ও আশঙ্কা প্রতিনিয়ত দেশের রাজনৈতিক আবহকে নিয়ন্ত্রণ করে চলছে। দেশে এক কার্যকর নির্বাচিত একটি সরকার প্রতিষ্ঠিত হলেও তা হবে দুর্বল সরকার।’ মওদুদ আরও লিখেছেন: ‘বাংলাদেশ আর কখনো আগের অবস্থানে ফিরে যাবে না। অসীম সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও প্রবৃদ্ধির হার অপ্রত্যাশিতভাবে বাড়বে না এবং দেশের বিরাট সংখ্যার জনগোষ্ঠী অবস্থান করবে চরম দারিদ্র্যের মধ্যে।’
সৌভাগ্যবশত তাঁর এই ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হয়নি। জিয়া বা এরশাদের মতো সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। অন্যান্য বিএনপি নেতার মতো মওদুদ আহমদও মনে করেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে বোঝাপড়া করেই এক-এগারোর কুশীলবেরা ক্ষমতার দৃশ্যপট থেকে বিদায় নিয়েছেন।
তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দ্বৈতশাসন সম্পর্কে তাঁর পর্যবেক্ষণ যথার্থ। তিনি লিখেছেন: ‘এ সময়টিতে আমরা লক্ষ করেছি দুটি পৃথক সরকারের অবস্থান। একটি ছিল ড. ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন সাধারণ মানের বেসামরিক সরকার, যাঁরা আমলাতন্ত্রের সম্প্রসারিত অংশ হিসেবে রাষ্ট্রের দৈনন্দিন ক্রিয়াকর্ম সম্পাদন করেছেন, তাঁদের কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল না। অন্যটি ছিল সেনাপ্রধানের নেতৃত্বাধীন অদৃশ্য কিন্তু সর্বত্র বিরাজমান একটি সরকার।’ (পৃষ্ঠা-৩৮৯)
হাসিনা-খালেদার ইতি-নেতি: মওদুদ আহমদ তাঁর বইয়ে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার রাজনীতি মূল্যায়ন করেছেন। সেনা-সমর্থিত সরকারের চাপের কাছে দুই নেত্রী নতিস্বীকার না করায় তাঁদের প্রশংসা করেছেন।
একই সঙ্গে তাঁদের রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন: ‘খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা উভয় নেত্রীই তাঁদের নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে রাজনীতি করেন এবং তাঁদের ব্যক্তিগত স্টাইলভিত্তিক শাসনব্যবস্থা প্রকৃতপক্ষে সুশাসনের অন্তরায় বলে অনেকে মনে করেন। তার পরও এটাও প্রত্যাশা করা অসমীচীন হবে না যে দুই নেত্রী একসময় তাঁদের নিজ নিজ কক্ষপথের বাইরে বের হয়ে আসবেন।’
তাঁর এই আশাবাদ স্থায়ী হয় না। অন্যত্র তিনি লিখেছেন: ‘ভবিষ্যতেও যখন দুই বিবদমান নেত্রী পারস্পরিক রাজনীতি ও অসহিষ্ণুতার মাত্রা ছাড়িয়ে যাবেন ও জনগণ তা আর রাজনৈতিকভাবে ধারণ করতে পারবে না, তখন ওই গোষ্ঠীই আবার ক্রমশ শক্তি সঞ্চয় করতে থাকবে। দুই নেত্রী তাঁদের ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে নিজেদের মধ্যকার দূরত্ব ক্রমশ কমিয়ে আনবেন—এমন সম্ভাবনা কম। তাই সেই একই শক্তির পুনরুত্থানকে একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না।’
বৃহস্পতিবার ৩ মে ২০০৭-এর ডায়েরিতে মওদুদ লিখেছেন: ‘এতে কোনো সন্দেহ নেই যে আমাদের সরকার সুশাসনে অনেকটা ব্যর্থ হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, অনেক ক্ষেত্রে ছিল অব্যবস্থাপনা ও অপশাসনের নমুনা। মন্ত্রী ও নিজেদের দপ্তরকেন্দ্রিক লোকজনের বিভিন্ন রকমের দুর্নীতি প্রধানমন্ত্রী বন্ধ করতে পারেননি। তিনি হয়তো অনেক কিছু জানতেনই না। আজ গোটা জাতিকে তার মাশুল দিতে হচ্ছে।’ (পৃষ্ঠা-৭৮)।
২৭ ফেব্রুয়ারি ২০০৮-এর ডায়েরিতে তিনি লিখেছেন: ‘শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া উভয় নেত্রীই দূরদৃষ্টিরই ক্ষেত্রে একটি সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়ে রাজনীতি করেন। তাঁদের পারস্পরিক রাজনৈতিক ঘৃণাবোধ এবং অসহনীয়তার ফলে জাতিকে প্রচুর খেসারত দিতে হয়েছে।’ (পৃষ্ঠা-২৪৩)
মওদুদ আহমদ এভাবেই দেখেছেন দুই নেত্রীকে। পাঠক, আপনারা কীভাবে দেখেন?
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
যে প্রশ্নের উত্তর নেই: আমাদের হাতে তাঁর সর্বশেষ যে বইটি এসেছে সেটি অনেকটা ভিন্ন মেজাজের; ঠিক গবেষণা নয়। এতে তাঁর বন্দিজীবনের অভিজ্ঞতা বিবৃত হয়েছে। বইয়ের শিরোনাম কারাগারে কেমন ছিলাম: ২০০৭-২০০৮। সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আরও অনেক রাজনীতিকের মতো মওদুদ আহমদও গ্রেপ্তার হন এবং এক বছর আট মাস কারাভোগ করেন। বইটি সেই কারাজীবনের ডায়েরি হলেও রাজনৈতিক বিশ্লেষণ ও ইতিহাসের বিচার আছে, আছে আত্মসমালোচনাও। বইটি শুরু হয়েছে ১০ এপ্রিল ২০০৭ তাঁর গ্রেপ্তার হওয়ার দিন থেকে এবং শেষ হয়েছে ১ ডিসেম্বর ২০০৮ মুক্তির তারিখে। দুই তারিখের মধ্যে অনেক তারিখ আছে, আছে অনেক ব্যক্তিগত ক্ষোভ-দুঃখ-বেদনার কথা। পারিবারিক ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সঙ্গে তিনি দেশের রাজনীতির গতি-প্রকৃতি মেলাতে চেষ্টা করেছেন। রিমান্ডে নেওয়ার ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন: ‘আমাকে যে জায়গায় নিয়ে আসা হয়েছিল সেটা ছিল মিলিটারি ফিল্ড ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের একটা বন্ধ প্রকোষ্ঠ। এটা চরম রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত দেশি বা বিদেশি শত্রু বা চরদের জন্য এটি ছিল সংরক্ষিত একটি বিশেষ জায়গা।’ (পৃষ্ঠা-২)। জিজ্ঞাসাবাদের নামে চালানো হয়েছে মানসিক নির্যাতন।
একজন নাগরিক হিসেবে মওদুদ আহমদ যে পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন, সে জন্য আমরা মর্মাহত। একই সঙ্গে তাঁর কাছে একটি প্রশ্ন উত্থাপন করাও নিশ্চয়ই অযৌক্তিক হবে না। সেনা-সমর্থিত সরকারের আমলে এই যে ভিন্নমতের কারণে তাঁর প্রতি অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়েছে, সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন করা হয়েছে, অনুরূপ ঘটনা কি তাঁর মন্ত্রিত্বকালে বিরোধী দলের রাজনীতিক এবং ভিন্নমতের লেখক-বুদ্ধিজীবীদের ওপর ঘটেনি? বিনা অপরাধে মুনতাসীর মামুন, শাহরিয়ার কবিরেরা কি জেল-জুলুমের শিকার হননি? যদি হয়ে থাকেন, একজন মন্ত্রী হিসেবে তিনি তার প্রতিবাদ করেছিলেন কি? তিনি বলতে পারেন, প্রতিকারের ক্ষমতা তাঁর ছিল না; গণতান্ত্রিক কিংবা অগণতান্ত্রিক—সব সরকারের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন একজন। কিন্তু তিনি সেই ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বৈরশাসনের প্রতিবাদে সরকার থেকে বেরিয়ে আসার সৎ সাহস দেখাতে পারলেন না কেন?
মওদুদ আহমদ তাঁর বইয়ে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের অনেক সমস্যা চিহ্নিত করলেও এই প্রতিবাদ করতে না পারার সমস্যাটি উল্লেখ করেছেন মনে পড়ে না। এরশাদের আমলে তিনি দুর্নীতির মামলায় জেলে যান, আবার জেল থেকে বেরিয়ে সেই সরকারের উচ্চপদে আসীন হয়েছেন। ১৯৯২ সালে যে দলের মাস্তানদের হামলায় তিনি আহত হন, পরবর্তীকালে সেই দলের সরকারে মন্ত্রিত্ব করেছেন (২০০১-০৬)।
মওদুদ আহমদ বুঝতে না পারলেও দেশের সাধারণ মানুষ বুঝতে পারছে, এটাই বাংলাদেশের গণতন্ত্রের প্রধান সমস্যা। তিনি সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বেআইনি তৎপরতা, বিশেষ করে ভিন্নমতাবলম্বীদের ওপর নির্যাতন সম্পর্কে যেসব বর্ণনা করেছেন, তা যেমন মিথ্যে নয়; তেমনি মিথ্যে নয় তাঁর সরকারের আমলেও মাত্রাভেদে সেগুলো চালু ছিল। হয়তো বর্তমান সরকারের আমলেও আছে। আমাদের দুর্ভাগ্য হলো, বিরোধী দলে থাকতে যে নেতারা সরকারের হাতে নিগৃহীত ও লাঞ্ছিত হন, ক্ষমতায় গিয়ে তাঁরাও বিরোধীদের ওপর একই কাজ করেন।
ডায়েরি ও ইতিহাসের দায়বদ্ধতা: জেলখানায় মওদুদ আহমদ প্রতিদিন ডায়েরি লিখতেন। সেই ডায়েরিতে প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতার বর্ণনার পাশাপাশি রাজনীতি ও ইতিহাসের বিশ্লেষণও আছে। ৭ নভেম্বর ২০০৭-এর ডায়েরিতে তিনি লিখেছেন: ‘এই দিনটির কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে। স্বতঃস্ফূর্ত এক বিপ্লবের মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটিয়ে ঐক্যবদ্ধ স্লোগান মুখরিত করে সেনাবাহিনী ও জনগণ সম্মিলিতভাবে নেমে এসেছিল রাজধানীর রাজপথে। তারা সেদিন জিয়াউর রহমানকে অন্তরীণ অবস্থা থেকে মুক্ত ও ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করে।’ (পৃষ্ঠা-১৮৭)। অন্যত্র তিনি লিখেছেন: ‘বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে উচ্চাভিলাষ বিবর্জিত ও লোভ-লালসা দ্বারা মনে মনে উজ্জীবিত হননি এমন মুক্তিযোদ্ধা প্রায় ছিলেন না বললেই চলে।’ ৭ নভেম্বরের ঘটনাও সেই উচ্চাভিলাষের অংশ কি না, মওদুদ সে সম্পর্কে কিছু বলেননি। তবে আমরা ঘটনাপরম্পরায় লক্ষ করি, মুক্তিযুদ্ধের ১১ জন সেক্টর কমান্ডারের চারজনই একে অপরের হাতে খুন হয়েছেন।
১৫ আগস্ট ২০০৭ তারিখের ডায়েরিতে তিনি লিখেছেন: ‘সারা দেশে উদ্যাপিত হচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকী।’...আমার এ কারণে দুঃখ হয় যে আমার অক্লান্ত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও আমি সরকারের বিরোধিতার কারণে আপিল বিভাগে জমে থাকা সেই জঘন্য হত্যা মামলার শুনানি শুরু করতে পারিনি। আমি এমনও যুক্তি দেখিয়েছি যে মুজিব যখন নিহত হন, তখন বিএনপির জন্মই হয়নি। কাজেই আপিল শুরু না করে বিএনপি এর দায়ভার বহন করতে যাবে কেন? কিন্তু প্রধানমন্ত্রীসহ অন্যদের আমি তা বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছি। এ জন্য ব্যক্তিগতভাবে আমি লজ্জিত এবং নিজেকেই আমার কাছে ছোট বলে মনে হয়।’ (পৃষ্ঠা-১৪১)। পরের বছরে একই দিনের ডায়েরিতে তিনি লিখেছেন: ‘বিতর্কিত একটি জন্মদিন হিসেবে আজ বেগম জিয়ার ৬৩তম জন্মদিন। সঠিক হলেও আমি হলে আমার জন্মদিন বোধ হয় এক দিন আগে বা পরে পালন করতাম ও শেখ মুজিবের হত্যা দিবসের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতাম। এটা একটা রুচিবোধের বিষয়। বেগম জিয়া তা করলে তিনি সকল শ্রেণীর জনগণের কাছ থেকে আরও বেশি শ্রদ্ধা অর্জন করতে পারতেন। তাঁর এই উদারতা তাঁকে আরও বেশি মহান করে তুলত।’ (পৃষ্ঠা ৩২৪-২৫)
২১ আগস্ট ২০০৮ ডায়েরিতে মওদুদ লিখেছেন: ‘আজ সেই কালো দিবস যেদিন ঢাকার আওয়ামী লীগ অফিসের সামনে আয়োজিত জনসভায় শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড হামলা চালানো হয়েছিল। তিনি অলৌকিকভাবে বেঁচে গেলেও জিল্লুর রহমানের স্ত্রী ও আওয়ামী লীগের নারী আন্দোলনের নেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন সেদিনকার ভয়াবহ হামলায় নিহত হন। এ ঘটনায় আমি কতটা মর্মাহত হয়েছি তা প্রকাশ করার কোনো ভাষা আমার নেই। এদের দুজনকেই আমি ভালো করে জানি এবং এদের প্রতি রয়েছে আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা।’ (পৃষ্ঠা-৩২৮)
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সমালোচনা: মওদুদ আহমদ তাঁর বইয়ে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কঠোর সমালোচনা করেছেন। তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে কাজ করেছে বলেও গুরুতর অভিযোগ তাঁর। তিনি লিখেছেন: ‘আমার আশঙ্কা যে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশে নিরবচ্ছিন্ন গণতন্ত্রের তেমন সম্ভাবনা নেই। ত্রাস ভয় সন্ত্রাস; নিরাপত্তাহীনতা ও আশঙ্কা প্রতিনিয়ত দেশের রাজনৈতিক আবহকে নিয়ন্ত্রণ করে চলছে। দেশে এক কার্যকর নির্বাচিত একটি সরকার প্রতিষ্ঠিত হলেও তা হবে দুর্বল সরকার।’ মওদুদ আরও লিখেছেন: ‘বাংলাদেশ আর কখনো আগের অবস্থানে ফিরে যাবে না। অসীম সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও প্রবৃদ্ধির হার অপ্রত্যাশিতভাবে বাড়বে না এবং দেশের বিরাট সংখ্যার জনগোষ্ঠী অবস্থান করবে চরম দারিদ্র্যের মধ্যে।’
সৌভাগ্যবশত তাঁর এই ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হয়নি। জিয়া বা এরশাদের মতো সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। অন্যান্য বিএনপি নেতার মতো মওদুদ আহমদও মনে করেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে বোঝাপড়া করেই এক-এগারোর কুশীলবেরা ক্ষমতার দৃশ্যপট থেকে বিদায় নিয়েছেন।
তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দ্বৈতশাসন সম্পর্কে তাঁর পর্যবেক্ষণ যথার্থ। তিনি লিখেছেন: ‘এ সময়টিতে আমরা লক্ষ করেছি দুটি পৃথক সরকারের অবস্থান। একটি ছিল ড. ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন সাধারণ মানের বেসামরিক সরকার, যাঁরা আমলাতন্ত্রের সম্প্রসারিত অংশ হিসেবে রাষ্ট্রের দৈনন্দিন ক্রিয়াকর্ম সম্পাদন করেছেন, তাঁদের কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল না। অন্যটি ছিল সেনাপ্রধানের নেতৃত্বাধীন অদৃশ্য কিন্তু সর্বত্র বিরাজমান একটি সরকার।’ (পৃষ্ঠা-৩৮৯)
হাসিনা-খালেদার ইতি-নেতি: মওদুদ আহমদ তাঁর বইয়ে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার রাজনীতি মূল্যায়ন করেছেন। সেনা-সমর্থিত সরকারের চাপের কাছে দুই নেত্রী নতিস্বীকার না করায় তাঁদের প্রশংসা করেছেন।
একই সঙ্গে তাঁদের রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন: ‘খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা উভয় নেত্রীই তাঁদের নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে রাজনীতি করেন এবং তাঁদের ব্যক্তিগত স্টাইলভিত্তিক শাসনব্যবস্থা প্রকৃতপক্ষে সুশাসনের অন্তরায় বলে অনেকে মনে করেন। তার পরও এটাও প্রত্যাশা করা অসমীচীন হবে না যে দুই নেত্রী একসময় তাঁদের নিজ নিজ কক্ষপথের বাইরে বের হয়ে আসবেন।’
তাঁর এই আশাবাদ স্থায়ী হয় না। অন্যত্র তিনি লিখেছেন: ‘ভবিষ্যতেও যখন দুই বিবদমান নেত্রী পারস্পরিক রাজনীতি ও অসহিষ্ণুতার মাত্রা ছাড়িয়ে যাবেন ও জনগণ তা আর রাজনৈতিকভাবে ধারণ করতে পারবে না, তখন ওই গোষ্ঠীই আবার ক্রমশ শক্তি সঞ্চয় করতে থাকবে। দুই নেত্রী তাঁদের ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে নিজেদের মধ্যকার দূরত্ব ক্রমশ কমিয়ে আনবেন—এমন সম্ভাবনা কম। তাই সেই একই শক্তির পুনরুত্থানকে একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না।’
বৃহস্পতিবার ৩ মে ২০০৭-এর ডায়েরিতে মওদুদ লিখেছেন: ‘এতে কোনো সন্দেহ নেই যে আমাদের সরকার সুশাসনে অনেকটা ব্যর্থ হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, অনেক ক্ষেত্রে ছিল অব্যবস্থাপনা ও অপশাসনের নমুনা। মন্ত্রী ও নিজেদের দপ্তরকেন্দ্রিক লোকজনের বিভিন্ন রকমের দুর্নীতি প্রধানমন্ত্রী বন্ধ করতে পারেননি। তিনি হয়তো অনেক কিছু জানতেনই না। আজ গোটা জাতিকে তার মাশুল দিতে হচ্ছে।’ (পৃষ্ঠা-৭৮)।
২৭ ফেব্রুয়ারি ২০০৮-এর ডায়েরিতে তিনি লিখেছেন: ‘শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া উভয় নেত্রীই দূরদৃষ্টিরই ক্ষেত্রে একটি সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়ে রাজনীতি করেন। তাঁদের পারস্পরিক রাজনৈতিক ঘৃণাবোধ এবং অসহনীয়তার ফলে জাতিকে প্রচুর খেসারত দিতে হয়েছে।’ (পৃষ্ঠা-২৪৩)
মওদুদ আহমদ এভাবেই দেখেছেন দুই নেত্রীকে। পাঠক, আপনারা কীভাবে দেখেন?
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
No comments