এ তো নয় শুধু খেলা by ফখরুজ্জামান চৌধুরী
সম্পূর্ণ অ-ক্রিকেটীয় কারণে একদা নিখাদ
ভদ্রলোকদের খেলা হিসেবে অভিজাত শ্রেণীর মধ্যে বিনোদনের প্রলম্বিত আয়োজন
তুমুল জনপ্রিয়তায় ধন্য ক্রিকেট আজ কাঠগড়ায় অভিযুক্ত জুয়া আর ফটকাবাজির
কারণে।
ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসন উপমহাদেশে দীর্ঘ প্রায় দুই
শতক জগদ্দল পাথরের মতো চেপে থাকার পর বিদায়লগ্নে রেখে যাওয়া দু-একটি ভালো
জিনিসের মধ্যে ছিল ক্রিকেট নামক দীর্ঘ সময় নিয়ে খেলা। সময়ের অপচয়, অভিজাত
শ্রেণীর দখলভুক্ত এই খেলা বহু যৌক্তিক সমালোচনা শেষে বর্তমানে সীমিতসংখ্যক
দেশের মধ্যে বৈশ্বিক খেলা হিসেবে স্বীকৃত।
দুই
ভদ্রলোকের নিপাট খেলা হিসেবে নিরাপদেই চলছিল সীমিতসংখ্যক দেশের মধ্যে দ্বি-দেশীয়, ত্রিদেশীয় ও বিশ্বকাপের প্রতিযোগিতাসহ নানা রকম আয়োজন। অ্যাসেজ, রাবার সিরিজ আর টেস্টের আয়োজনের মধ্যে প্রথম ধাক্কাটি দেন ক্যারি প্যাকার নামক অস্ট্রেলীয় ধনকুবের ও মিডিয়া-মুঘল। কারণ অবশ্যই আর্থিক। তিনি চেয়েছিলেন ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট ম্যাচের প্রচারস্বত্ব তাঁর চ্যানেলের জন্য।
প্রত্যাশিতভাবেই নেতিবাচক জবাব পেলেন তিনি। ফলাফল হলো ক্রিকেটবিশ্বের জন্য ভয়াবহ।
একদল দক্ষ ক্রিকেট খেলোয়াড়কে তিনি উচ্চ অর্থমূল্যে প্রলুব্ধ করে তাদের দেশের ক্রিকেট নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী করে তুললেন। এসব দর্শক-টানা ক্রিকেটারদের মধ্যে কী এক রহস্যময় কারণে ছিলেন না কোনো ভারতীয় খেলোয়াড়।
তাঁরা পরিচিত হলেন 'বিদ্রোহী' হিসেবে এবং তাঁরা প্রতিযোগিতার আয়োজন করলেন সংক্ষিপ্ত আকারের ক্রিকেট ম্যাচের। বৃষ্টিবিঘি্নত এক ক্রিকেট ম্যাচের বদলে আয়োজন করা হলো সীমিত ওভারের খেলা। কেউ বললেন, লিমিটেড ওভার ম্যাচ, কেউ বললেন ক্রিকেট সার্কার্স আর শুদ্ধাচারীরা বললেন, বিরাট মশকরা- গ্রেট ফান।
কিন্তু যে যাই বলুন, দেশে দেশে ক্রিকেট-এস্টাবলিশমেন্ট পড়ল মহা বেকায়দায়। সত্তরের দশকের সেই সময়টায় ছিল ক্রিকেটের মহা আকাল। মুখ থুবড়ে পড়ে ক্রিকেট বোর্ডগুলো। জয়জয়কার ক্যারি প্যাকারের ওয়ার্ল্ড সিরিজের (ডাব্লিউ-এসসি) রঙিন পোশাক পরে, সাদা বল আর কালো স্ক্রিন ব্যবহার করে খেলা রাতের ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ায় এমনই জনপ্রিয় হলো যে ক্লাব আর ক্যাসিনোতে জনসমাগমে ভাটা পড়ল।
বহিষ্কৃত হলেন বিদ্রোহী ক্রিকেটাররা যাঁর যাঁর দেশের ক্রিকেট এস্টাবলিশমেন্টের দ্বারা।
দুই পক্ষের মধ্যে কিছুদিন ধরে চলল উচ্চকণ্ঠ হুমকি-ধমকি, বহিষ্কার-পাল্টা বহিষ্কার।
দুই পক্ষের মধ্যে যখন শুভবুদ্ধির উদয় হলো, যুদ্ধংদেহী মনোভাব পরিহার করে আলাপ-সংলাপের চিরন্তন স্বীকৃত পন্থায় শান্তি স্থাপিত হলো ক্রিকেট পরিমণ্ডলে।
তিন
ক্রিকেটের প্রশান্ত সাগরে বিশাল ঢিলটি ফেলল আইপিএল- ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লীগ। সংক্ষিপ্ত রাত্রিবাসরীয় রঙিন ঝলমলে খেলার আসর। খেলায় সংযুক্ত হলেন বিমান পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান, রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী, মদ প্রস্তুতকারক আর বলিউডের চমকানো পর্দা-তারকারা। মনি আর কাঞ্চনের সমাহারে ক্রিকেটের মহান নীতি পেছনের আসনে বসতে বাধ্য হবে; বলাই বাহুল্য এবং অচিরেই যে 'কাবার্ডের ভেতরকার কুৎসিত কঙ্কালটি' দেখা যাবে, তা বুঝতে কারো দেরি হয়নি।
লোভের যূপকাষ্ঠে বলি হলেন জাঁদরেল ভারতীয় আমলা-কূটনীতিক-রাজনীতিক শশী থারুর। অভিযোগ প্রেমিকাকে অনৈতিকভাবে আইপিএলে দল পেতে সাহায্য করা। দুবাই-সুন্দরী সুনন্দা দল পেয়েছিলেন, প্রেমিককে পেয়েছিলেন স্বামী হিসেবে। কিন্তু দুর্নীতির কেলেঙ্কারির মুকুটও মাথায় পরতে হয়েছিল তাঁকে। আইপিএলের টাকার ঝনঝনানি শুনে আমরা শঙ্কিত হয়ে লিখেছিলাম, দেখেছিলাম বোর্ডের তালিকাভুক্ত খেলোয়াড়রা বোর্ড নির্ধারিত খেলা 'আঘাতের অজুহাতে, অসুস্থতার কারণে' এড়িয়ে গেলেন। অর্থ যে সেরা 'মটিভেশনাল ফোর্স' তা তো স্বীকৃত সত্য। কিন্তু তাই বলে ময়লাযুক্ত, অকুলীন অর্থ?
এখন তদন্ত-অনুসন্ধানে কতিপয় খেলোয়াড় আর কর্তাব্যক্তির ঘুম হারাম, শঙ্কা ক্রিকেট জগৎজুড়ে।
চার
আইপিএলের কেলেঙ্কারির ধাক্কা এর মধ্যে লেগেছে বাংলাদেশ ক্রিকেটের গায়েও। প্রত্যাশার চেয়েও অধিক প্রাপ্তির চাহিদা মেটাতে গিয়ে এমনটা হলো। কী যোগ্যতা আর কী অর্জন, এই সমীকরণ যদি বিবেচনা না করা হয়, তাহলে এমনটাই হয়।
বাংলাদেশের ক্রিকেটের মাঠের অর্জন যেমনই হোক, দুর্নীতির কোনো দায় ছিল না এত দিন।
এবার বুঝি সেই কৌলীন্যটুকুও যায়।
আইপিএলের আদলে বিপিএলের আসর বসিয়ে এই পথটি উন্মুক্ত করে দিল কর্তৃপক্ষ। নানা অব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছিল বিপিএল। আমরা লিখেছিলাম, 'বিপিএল, আনাড়িপনায় পরিপূর্ণ আসর।'
এখন নানা রকম খবর বের হচ্ছে। কোনোটাই সুগন্ধি নয়।
নিত্যনতুন খেলোয়াড়ের নাম উঠে আসে প্রতিদিন, নিত্যনতুন সংযোজন। ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিল-আইসিসির দুর্নীতি দমন ইউনিটের (আকসু) স্ক্যানারের নিচে এখন বাংলাদেশের কতিপয় ক্রিকেটার ও ক্রিকেট সংগঠন ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি।
আগামী কয়েক দিন অস্থিরতা বিরাজ করবে ক্রিকেটবিশ্বে- বিশেষ করে ভারত আর বাংলাদেশে।
প্রত্যাশা করি, দোষী ব্যক্তি আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে যেন পালিয়ে না যায়, যেন কোনো নির্দোষ ব্যক্তি সাজা না পায়। আর এই যে ঝড়ের দমকা হাওয়া বইছে, তাতে 'অর্থশক্তি' আর বিশাল বাণিজ্যিক সুবিধার কারণে উদ্ধত, অহংকারী ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড যেন কিছুটা হলেও 'জমিনমুখী' হয়।
লেখক : অনুবাদক, প্রাবন্ধিক
দুই
ভদ্রলোকের নিপাট খেলা হিসেবে নিরাপদেই চলছিল সীমিতসংখ্যক দেশের মধ্যে দ্বি-দেশীয়, ত্রিদেশীয় ও বিশ্বকাপের প্রতিযোগিতাসহ নানা রকম আয়োজন। অ্যাসেজ, রাবার সিরিজ আর টেস্টের আয়োজনের মধ্যে প্রথম ধাক্কাটি দেন ক্যারি প্যাকার নামক অস্ট্রেলীয় ধনকুবের ও মিডিয়া-মুঘল। কারণ অবশ্যই আর্থিক। তিনি চেয়েছিলেন ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট ম্যাচের প্রচারস্বত্ব তাঁর চ্যানেলের জন্য।
প্রত্যাশিতভাবেই নেতিবাচক জবাব পেলেন তিনি। ফলাফল হলো ক্রিকেটবিশ্বের জন্য ভয়াবহ।
একদল দক্ষ ক্রিকেট খেলোয়াড়কে তিনি উচ্চ অর্থমূল্যে প্রলুব্ধ করে তাদের দেশের ক্রিকেট নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী করে তুললেন। এসব দর্শক-টানা ক্রিকেটারদের মধ্যে কী এক রহস্যময় কারণে ছিলেন না কোনো ভারতীয় খেলোয়াড়।
তাঁরা পরিচিত হলেন 'বিদ্রোহী' হিসেবে এবং তাঁরা প্রতিযোগিতার আয়োজন করলেন সংক্ষিপ্ত আকারের ক্রিকেট ম্যাচের। বৃষ্টিবিঘি্নত এক ক্রিকেট ম্যাচের বদলে আয়োজন করা হলো সীমিত ওভারের খেলা। কেউ বললেন, লিমিটেড ওভার ম্যাচ, কেউ বললেন ক্রিকেট সার্কার্স আর শুদ্ধাচারীরা বললেন, বিরাট মশকরা- গ্রেট ফান।
কিন্তু যে যাই বলুন, দেশে দেশে ক্রিকেট-এস্টাবলিশমেন্ট পড়ল মহা বেকায়দায়। সত্তরের দশকের সেই সময়টায় ছিল ক্রিকেটের মহা আকাল। মুখ থুবড়ে পড়ে ক্রিকেট বোর্ডগুলো। জয়জয়কার ক্যারি প্যাকারের ওয়ার্ল্ড সিরিজের (ডাব্লিউ-এসসি) রঙিন পোশাক পরে, সাদা বল আর কালো স্ক্রিন ব্যবহার করে খেলা রাতের ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ায় এমনই জনপ্রিয় হলো যে ক্লাব আর ক্যাসিনোতে জনসমাগমে ভাটা পড়ল।
বহিষ্কৃত হলেন বিদ্রোহী ক্রিকেটাররা যাঁর যাঁর দেশের ক্রিকেট এস্টাবলিশমেন্টের দ্বারা।
দুই পক্ষের মধ্যে কিছুদিন ধরে চলল উচ্চকণ্ঠ হুমকি-ধমকি, বহিষ্কার-পাল্টা বহিষ্কার।
দুই পক্ষের মধ্যে যখন শুভবুদ্ধির উদয় হলো, যুদ্ধংদেহী মনোভাব পরিহার করে আলাপ-সংলাপের চিরন্তন স্বীকৃত পন্থায় শান্তি স্থাপিত হলো ক্রিকেট পরিমণ্ডলে।
তিন
ক্রিকেটের প্রশান্ত সাগরে বিশাল ঢিলটি ফেলল আইপিএল- ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লীগ। সংক্ষিপ্ত রাত্রিবাসরীয় রঙিন ঝলমলে খেলার আসর। খেলায় সংযুক্ত হলেন বিমান পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান, রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী, মদ প্রস্তুতকারক আর বলিউডের চমকানো পর্দা-তারকারা। মনি আর কাঞ্চনের সমাহারে ক্রিকেটের মহান নীতি পেছনের আসনে বসতে বাধ্য হবে; বলাই বাহুল্য এবং অচিরেই যে 'কাবার্ডের ভেতরকার কুৎসিত কঙ্কালটি' দেখা যাবে, তা বুঝতে কারো দেরি হয়নি।
লোভের যূপকাষ্ঠে বলি হলেন জাঁদরেল ভারতীয় আমলা-কূটনীতিক-রাজনীতিক শশী থারুর। অভিযোগ প্রেমিকাকে অনৈতিকভাবে আইপিএলে দল পেতে সাহায্য করা। দুবাই-সুন্দরী সুনন্দা দল পেয়েছিলেন, প্রেমিককে পেয়েছিলেন স্বামী হিসেবে। কিন্তু দুর্নীতির কেলেঙ্কারির মুকুটও মাথায় পরতে হয়েছিল তাঁকে। আইপিএলের টাকার ঝনঝনানি শুনে আমরা শঙ্কিত হয়ে লিখেছিলাম, দেখেছিলাম বোর্ডের তালিকাভুক্ত খেলোয়াড়রা বোর্ড নির্ধারিত খেলা 'আঘাতের অজুহাতে, অসুস্থতার কারণে' এড়িয়ে গেলেন। অর্থ যে সেরা 'মটিভেশনাল ফোর্স' তা তো স্বীকৃত সত্য। কিন্তু তাই বলে ময়লাযুক্ত, অকুলীন অর্থ?
এখন তদন্ত-অনুসন্ধানে কতিপয় খেলোয়াড় আর কর্তাব্যক্তির ঘুম হারাম, শঙ্কা ক্রিকেট জগৎজুড়ে।
চার
আইপিএলের কেলেঙ্কারির ধাক্কা এর মধ্যে লেগেছে বাংলাদেশ ক্রিকেটের গায়েও। প্রত্যাশার চেয়েও অধিক প্রাপ্তির চাহিদা মেটাতে গিয়ে এমনটা হলো। কী যোগ্যতা আর কী অর্জন, এই সমীকরণ যদি বিবেচনা না করা হয়, তাহলে এমনটাই হয়।
বাংলাদেশের ক্রিকেটের মাঠের অর্জন যেমনই হোক, দুর্নীতির কোনো দায় ছিল না এত দিন।
এবার বুঝি সেই কৌলীন্যটুকুও যায়।
আইপিএলের আদলে বিপিএলের আসর বসিয়ে এই পথটি উন্মুক্ত করে দিল কর্তৃপক্ষ। নানা অব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছিল বিপিএল। আমরা লিখেছিলাম, 'বিপিএল, আনাড়িপনায় পরিপূর্ণ আসর।'
এখন নানা রকম খবর বের হচ্ছে। কোনোটাই সুগন্ধি নয়।
নিত্যনতুন খেলোয়াড়ের নাম উঠে আসে প্রতিদিন, নিত্যনতুন সংযোজন। ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিল-আইসিসির দুর্নীতি দমন ইউনিটের (আকসু) স্ক্যানারের নিচে এখন বাংলাদেশের কতিপয় ক্রিকেটার ও ক্রিকেট সংগঠন ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি।
আগামী কয়েক দিন অস্থিরতা বিরাজ করবে ক্রিকেটবিশ্বে- বিশেষ করে ভারত আর বাংলাদেশে।
প্রত্যাশা করি, দোষী ব্যক্তি আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে যেন পালিয়ে না যায়, যেন কোনো নির্দোষ ব্যক্তি সাজা না পায়। আর এই যে ঝড়ের দমকা হাওয়া বইছে, তাতে 'অর্থশক্তি' আর বিশাল বাণিজ্যিক সুবিধার কারণে উদ্ধত, অহংকারী ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড যেন কিছুটা হলেও 'জমিনমুখী' হয়।
লেখক : অনুবাদক, প্রাবন্ধিক
No comments