শ নি বা রে র বিশেষ প্রতিবেদন প্রতিবন্ধীদের বন্ধু আলী দাদু
চাঁদমুখো মেয়েটির লম্বা চুল। সে চুল
বারবার চোখের ওপরে এসে পড়ে। এক হাতে যখন সরিয়ে নেন, তখন চোখ দুটো পিটপিট
করে। বোঝা যায়, সেই চোখে আলো নেই। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মেয়েটির নাম রোজিনা
খাতুন। বয়স ১৮ বছর।
জন্মান্ধ রোজিনা যখন ছোট শিশু, তখন
তাঁকে ও মা রহিমাকে ফেলে পালিয়ে যান বাবা কাজল। এর কয়েক মাস পর মা-ও বিয়ে
করে চলে যান অন্য ঘরে। রোজিনার ঠাঁই হয় নানির কাছে। বয়স যখন সবে চার, নানিও
চলে গেলেন না-ফেরার দেশে। এরপর মামার পরিবারে এসে অথই সাগরে পড়েন রোজিনা।
এক দিন রোজিনার সন্ধান পেয়ে নিজের কাছে নিয়ে আসেন হাওলাদার মো. আক্কেল আলী (এম এ আলী), সবাই যাঁকে ডাকেন আলী দাদু বলে। তিনি রোজিনাকে ভর্তি করেন নিজ হাতে গড়া ‘এম এ আলী প্রতিবন্ধী স্কুল ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে’। এম এ আলীর যত্নে সেই রোজিনা এখন দাঁড়িয়েছেন নিজের পায়ে।
রোজিনার মতো এই স্কুলের সবারই রয়েছে নিজস্ব গল্প। তা শুনলে চোখ ভিজে যায়। একসময় যাঁরা ছিলেন পরিবার ও সমাজের বোঝা, তাঁরাই এখন দেখিয়ে দিচ্ছেন, একটু সহায়তা পেলে তাঁরাও রাখতে পারেন সমাজের জন্য ভূমিকা।
এম এ আলী: এম এ আলীর জন্ম ঝালকাঠি সদর উপজেলার দপদপিয়া গ্রামে। শিশুকালেই হারান মা-বাবাকে। ১৯৬২ সালে গ্রামবাসীর সহায়তায় ভর্তি হন বরিশাল সরকারি শিশু পরিবারে (এতিমখানা)। সেখানে থাকার সময় পড়াশোনার সুযোগ পান বরিশাল আলেকান্দা নূরিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। কিশোর বয়সেই তিনি ছিলেন তুখোড় ফুটবলার ও শরীরচর্চাবিদ; বহু পুরস্কারও পেয়েছেন।
১৯৭০ সাল। দশম শ্রেণীতে পড়েন আলী। সে বছরের ১২ নভেম্বর ভোলাসহ উপকূলীয় এলাকায় ঘটে যায় প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস। লন্ডভন্ড হয়ে যায় সবকিছু। শুধু ভোলাতেই মারা যায় প্রায় দেড় লাখ মানুষ।
মানুষের দুর্গতি দেখে কেঁদে ওঠে কিশোর আলীর মন। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সহায়তার জন্য তিনি ‘সুইডিশ ফ্রি মিশনে’র সঙ্গে বরিশাল থেকে যান ভোলায়। ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করতে গিয়ে দেখলেন, হাত-পা ভাঙা দেড় শতাধিক এতিম শিশু মৃত্যুপথযাত্রী। তাদের মা-বাবা ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে মারা গেছে।
সুইডিশ ফ্রি মিশন বর্তমান সদর উপজেলার মধ্যচরনোয়াবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৈরি করেছিল একটি অস্থায়ী এতিমখানা। এতিম শিশুরা সেখানে সারা দিন মা-বাবার জন্য কান্নাকাটি করত। আর কিশোর আলী আদর-ভালোবাসা দিয়ে শিশুদের কষ্ট ভোলানোর চেষ্টা করতেন।
প্রতিবন্ধী স্কুল: ওই বছরই লিওয়াল হগেন, বারবারা আকসেলসেনসহ সুইডেনের একটি প্রতিনিধিদল স্থানীয় সমাজসেবা অধিদপ্তরের সহায়তা নিয়ে খেয়াঘাট সড়কের পাশে মধ্যচরনোয়াবাদে এতিম শিশুদের জন্য একটি স্থায়ী এতিমখানা তৈরি করে। পরে সেখানেই আলীর চাকরি পাকাপাকি হয়।
১৯৭৩ সালে এসএসসি পাস করেন আলী। বিদেশিদের সঙ্গে থাকতে থাকতে ইংরেজিতে দক্ষ হয়ে ওঠেন তিনি। আলী জানান, সুইডিশ ফ্রি মিশনই তাঁকে বিদেশে নিয়ে গিয়ে প্রতিবন্ধীদের সামাজিক পুনর্বাসন, শব্দ না করে ঠোঁটে কথা বলা (লিপ রিডিং), ইশারা ভাষা (সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ), প্রতিবন্ধীদের সহায়ক উপকরণ তৈরি, ফিজিওথেরাপি ও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের চলনের ওপর নানা প্রশিক্ষণ গ্রহণের সুযোগ করে দিয়েছে। মিশনের সঙ্গে থেকে বাংলাদেশের আনাচকানাচে ঘুরে তিনি টানা ২৪ বছর (১৯৮০-২০০৪) প্রতিবন্ধীদের সেবা দিয়ে পুনর্বাসিত করার চেষ্টা করেছেন।
কিন্তু সুইডিশরা এ দেশ ছেড়ে চলে গেলে বিপাকে পড়েন আলী। কী করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। শেষ পর্যন্ত পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে পরামর্শ করে জীবনের সব সঞ্চয় দিয়ে ভোলায় গিয়ে ২০০৪ সালে খুললেন এম এ আলী প্রতিবন্ধী স্কুল ও পুনর্বাসন কেন্দ্র।
আলী বলেন, ‘সুইডিশ ফ্রি মিশনে কাজ করার সময় বিদেশি অনেক বন্ধু জুটে যায়। তাঁদের কাছে কখনোই টাকা চাইনি। তাঁরা মাঝেমধ্যে স্বেচ্ছায় টাকা পাঠান। আবার স্থানীয় অনেকেই সহায়তা করেন।’
বর্তমানে একসঙ্গে ১২০-১২৫ জন প্রতিবন্ধীর থাকার ব্যবস্থা আছে আলীর স্কুলে। বিভিন্নভাবে আসা সহায়তা দিয়েই খরচ চলে যায়। আলীর ভাষায়, ‘আল্লাহই সব ব্যবস্থা করে দেন। আমি অছিলামাত্র।’
এম এ আলীর স্কুল: আলী জানালেন, তাঁর স্কুলে রুটিন মেপে শেখানো হয় সবকিছু। কারণ, শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনই সুখ আনে। তাঁর স্কুলের সবাই ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে ওঠে। প্রাতঃকার্য সেরে সবাই নামাজ পড়ে। তারপর কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি শেষে নাশতা তৈরির কাজ শুরু হয়। নাশতা তৈরি, তরকারি কাটা, চুলা ধরানো, রুটি বানানো—সবই প্রতিবন্ধীদের প্রশিক্ষণের অংশ।
নাশতা সেরে সবাই স্কুলের জন্য তৈরি হয়। বাকপ্রতিবন্ধীরা ইশারা ভাষায়, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা ব্রেইল এবং অন্যরা ঠোঁটের নড়াচড়ায় পড়া শেখে। আছে গান ও নাচের ক্লাসও। বিকেল চারটার পর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত স্কুলের মাঠে শরীরচর্চা হয় নানা রকম খেলার মাধ্যমে। সন্ধ্যার পরে আবার শিখতে বসা। রাত সাড়ে আটটায় খাবার খেয়ে সবাই টেলিভিশন দেখতে বসে; সাড়ে নয়টায় ঘুম।
আলী স্কুলের সব শিশুকে পুষ্টিকর ও ভেজালমুক্ত খাবার দেওয়ার চেষ্টা করেন। তিনি তিনটি পুকুরে মাছের চাষ করেন। কিছু জমি কিনেছেন, যেখানে তিনি নিয়মিত ধান, নানা রকম ফল ও সবজির চাষ করেন। এম এ আলীর ভাষ্য, সঠিক পুষ্টি পেলে অনেক সময় প্রতিবন্ধিতা কমে যায়।
যত চেষ্টা: আলী দরজির কাজ, কাঠমিস্ত্রির কাজ ও মোমবাতি তৈরির প্রশিক্ষণ দিয়ে এযাবৎ কয়েক শ প্রতিবন্ধীকে পুনর্বাসিত করেছেন। পড়াশোনার পাশাপাশি তাদের শেখাচ্ছেন খোলাধুলা, সাঁতার, শরীরচর্চা এবং গান-নাচও। আলীর ভাষায়, ‘সঠিক চিকিৎসা ও সেবা-যত্নের পাশাপাশি ব্যায়াম করালে অনেকের প্রতিবন্ধিতা কমে আসে।’
আলী ১৫ জন প্রতিবন্ধী ছাত্রীকে পরিণত অবস্থায় চাকরি ও বিয়ের ব্যবস্থা করেছেন। তাঁর পুনর্বাসন কেন্দ্রে বর্তমানে ৫৫ জন ছাত্রছাত্রী ও ২৭ জন শিক্ষক-কর্মচারী রয়েছেন। তাঁর বিশ্বাস, প্রতিবন্ধিতা প্রতিরোধ করতে হলে এসব বিষয়ে মানুষকে আগে সচেতন করা দরকার। তাই তিনি এলাকার স্কুল-কলেজের পাশাপাশি রাস্তার মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে পথচারীদের জমায়েত করেন। তাঁর বিশেষ লক্ষ্য থাকে তরুণসমাজ ও ছাত্রছাত্রী। যেসব কারণে শিশুরা প্রতিবন্ধী হয়ে জন্ম নেয়, সেসব বিষয়ে তিনি তাঁদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির প্রয়াস চালান।
দুশ্চিন্তা: কথায় কথায় একসময় আলীর দুচোখে পানি এসে যায়। তিনি বলেন, ‘আমি চাই না কেউ প্রতিবন্ধী হোক। যদি প্রতিবন্ধী হয়েও যায় সে যেন কারও অবজ্ঞার পাত্র না হয়, সেটাই আমার চাওয়া। কিন্তু আমার মৃত্যুর পরে এ প্রতিষ্ঠানটি কীভাবে চলবে, সেটাই আমার বড় দুশ্চিন্তা।’
এম এ আলী প্রতিবন্ধী স্কুলের পাশে দাঁড়ানোর জন্য আহ্বান জানালেন ভোলার জেলা প্রশাসক খোন্দকার মোস্তাফিজুর রহমান। তাঁর কথায়, ‘সমাজের অবহেলিত অংশ হিসেবে বিবেচিত প্রতিবন্ধীদের পুনর্বাসনের জন্য কাজ করছেন এম এ আলী। এ কাজ দেশকে স্বাবলম্বী করার শামিল। তাঁকে সবাই মিলে সহযোগিতা করা উচিত।’
এক দিন রোজিনার সন্ধান পেয়ে নিজের কাছে নিয়ে আসেন হাওলাদার মো. আক্কেল আলী (এম এ আলী), সবাই যাঁকে ডাকেন আলী দাদু বলে। তিনি রোজিনাকে ভর্তি করেন নিজ হাতে গড়া ‘এম এ আলী প্রতিবন্ধী স্কুল ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে’। এম এ আলীর যত্নে সেই রোজিনা এখন দাঁড়িয়েছেন নিজের পায়ে।
রোজিনার মতো এই স্কুলের সবারই রয়েছে নিজস্ব গল্প। তা শুনলে চোখ ভিজে যায়। একসময় যাঁরা ছিলেন পরিবার ও সমাজের বোঝা, তাঁরাই এখন দেখিয়ে দিচ্ছেন, একটু সহায়তা পেলে তাঁরাও রাখতে পারেন সমাজের জন্য ভূমিকা।
এম এ আলী: এম এ আলীর জন্ম ঝালকাঠি সদর উপজেলার দপদপিয়া গ্রামে। শিশুকালেই হারান মা-বাবাকে। ১৯৬২ সালে গ্রামবাসীর সহায়তায় ভর্তি হন বরিশাল সরকারি শিশু পরিবারে (এতিমখানা)। সেখানে থাকার সময় পড়াশোনার সুযোগ পান বরিশাল আলেকান্দা নূরিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। কিশোর বয়সেই তিনি ছিলেন তুখোড় ফুটবলার ও শরীরচর্চাবিদ; বহু পুরস্কারও পেয়েছেন।
১৯৭০ সাল। দশম শ্রেণীতে পড়েন আলী। সে বছরের ১২ নভেম্বর ভোলাসহ উপকূলীয় এলাকায় ঘটে যায় প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস। লন্ডভন্ড হয়ে যায় সবকিছু। শুধু ভোলাতেই মারা যায় প্রায় দেড় লাখ মানুষ।
মানুষের দুর্গতি দেখে কেঁদে ওঠে কিশোর আলীর মন। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সহায়তার জন্য তিনি ‘সুইডিশ ফ্রি মিশনে’র সঙ্গে বরিশাল থেকে যান ভোলায়। ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করতে গিয়ে দেখলেন, হাত-পা ভাঙা দেড় শতাধিক এতিম শিশু মৃত্যুপথযাত্রী। তাদের মা-বাবা ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে মারা গেছে।
সুইডিশ ফ্রি মিশন বর্তমান সদর উপজেলার মধ্যচরনোয়াবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৈরি করেছিল একটি অস্থায়ী এতিমখানা। এতিম শিশুরা সেখানে সারা দিন মা-বাবার জন্য কান্নাকাটি করত। আর কিশোর আলী আদর-ভালোবাসা দিয়ে শিশুদের কষ্ট ভোলানোর চেষ্টা করতেন।
প্রতিবন্ধী স্কুল: ওই বছরই লিওয়াল হগেন, বারবারা আকসেলসেনসহ সুইডেনের একটি প্রতিনিধিদল স্থানীয় সমাজসেবা অধিদপ্তরের সহায়তা নিয়ে খেয়াঘাট সড়কের পাশে মধ্যচরনোয়াবাদে এতিম শিশুদের জন্য একটি স্থায়ী এতিমখানা তৈরি করে। পরে সেখানেই আলীর চাকরি পাকাপাকি হয়।
১৯৭৩ সালে এসএসসি পাস করেন আলী। বিদেশিদের সঙ্গে থাকতে থাকতে ইংরেজিতে দক্ষ হয়ে ওঠেন তিনি। আলী জানান, সুইডিশ ফ্রি মিশনই তাঁকে বিদেশে নিয়ে গিয়ে প্রতিবন্ধীদের সামাজিক পুনর্বাসন, শব্দ না করে ঠোঁটে কথা বলা (লিপ রিডিং), ইশারা ভাষা (সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ), প্রতিবন্ধীদের সহায়ক উপকরণ তৈরি, ফিজিওথেরাপি ও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের চলনের ওপর নানা প্রশিক্ষণ গ্রহণের সুযোগ করে দিয়েছে। মিশনের সঙ্গে থেকে বাংলাদেশের আনাচকানাচে ঘুরে তিনি টানা ২৪ বছর (১৯৮০-২০০৪) প্রতিবন্ধীদের সেবা দিয়ে পুনর্বাসিত করার চেষ্টা করেছেন।
কিন্তু সুইডিশরা এ দেশ ছেড়ে চলে গেলে বিপাকে পড়েন আলী। কী করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। শেষ পর্যন্ত পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে পরামর্শ করে জীবনের সব সঞ্চয় দিয়ে ভোলায় গিয়ে ২০০৪ সালে খুললেন এম এ আলী প্রতিবন্ধী স্কুল ও পুনর্বাসন কেন্দ্র।
আলী বলেন, ‘সুইডিশ ফ্রি মিশনে কাজ করার সময় বিদেশি অনেক বন্ধু জুটে যায়। তাঁদের কাছে কখনোই টাকা চাইনি। তাঁরা মাঝেমধ্যে স্বেচ্ছায় টাকা পাঠান। আবার স্থানীয় অনেকেই সহায়তা করেন।’
বর্তমানে একসঙ্গে ১২০-১২৫ জন প্রতিবন্ধীর থাকার ব্যবস্থা আছে আলীর স্কুলে। বিভিন্নভাবে আসা সহায়তা দিয়েই খরচ চলে যায়। আলীর ভাষায়, ‘আল্লাহই সব ব্যবস্থা করে দেন। আমি অছিলামাত্র।’
এম এ আলীর স্কুল: আলী জানালেন, তাঁর স্কুলে রুটিন মেপে শেখানো হয় সবকিছু। কারণ, শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনই সুখ আনে। তাঁর স্কুলের সবাই ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে ওঠে। প্রাতঃকার্য সেরে সবাই নামাজ পড়ে। তারপর কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি শেষে নাশতা তৈরির কাজ শুরু হয়। নাশতা তৈরি, তরকারি কাটা, চুলা ধরানো, রুটি বানানো—সবই প্রতিবন্ধীদের প্রশিক্ষণের অংশ।
নাশতা সেরে সবাই স্কুলের জন্য তৈরি হয়। বাকপ্রতিবন্ধীরা ইশারা ভাষায়, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা ব্রেইল এবং অন্যরা ঠোঁটের নড়াচড়ায় পড়া শেখে। আছে গান ও নাচের ক্লাসও। বিকেল চারটার পর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত স্কুলের মাঠে শরীরচর্চা হয় নানা রকম খেলার মাধ্যমে। সন্ধ্যার পরে আবার শিখতে বসা। রাত সাড়ে আটটায় খাবার খেয়ে সবাই টেলিভিশন দেখতে বসে; সাড়ে নয়টায় ঘুম।
আলী স্কুলের সব শিশুকে পুষ্টিকর ও ভেজালমুক্ত খাবার দেওয়ার চেষ্টা করেন। তিনি তিনটি পুকুরে মাছের চাষ করেন। কিছু জমি কিনেছেন, যেখানে তিনি নিয়মিত ধান, নানা রকম ফল ও সবজির চাষ করেন। এম এ আলীর ভাষ্য, সঠিক পুষ্টি পেলে অনেক সময় প্রতিবন্ধিতা কমে যায়।
যত চেষ্টা: আলী দরজির কাজ, কাঠমিস্ত্রির কাজ ও মোমবাতি তৈরির প্রশিক্ষণ দিয়ে এযাবৎ কয়েক শ প্রতিবন্ধীকে পুনর্বাসিত করেছেন। পড়াশোনার পাশাপাশি তাদের শেখাচ্ছেন খোলাধুলা, সাঁতার, শরীরচর্চা এবং গান-নাচও। আলীর ভাষায়, ‘সঠিক চিকিৎসা ও সেবা-যত্নের পাশাপাশি ব্যায়াম করালে অনেকের প্রতিবন্ধিতা কমে আসে।’
আলী ১৫ জন প্রতিবন্ধী ছাত্রীকে পরিণত অবস্থায় চাকরি ও বিয়ের ব্যবস্থা করেছেন। তাঁর পুনর্বাসন কেন্দ্রে বর্তমানে ৫৫ জন ছাত্রছাত্রী ও ২৭ জন শিক্ষক-কর্মচারী রয়েছেন। তাঁর বিশ্বাস, প্রতিবন্ধিতা প্রতিরোধ করতে হলে এসব বিষয়ে মানুষকে আগে সচেতন করা দরকার। তাই তিনি এলাকার স্কুল-কলেজের পাশাপাশি রাস্তার মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে পথচারীদের জমায়েত করেন। তাঁর বিশেষ লক্ষ্য থাকে তরুণসমাজ ও ছাত্রছাত্রী। যেসব কারণে শিশুরা প্রতিবন্ধী হয়ে জন্ম নেয়, সেসব বিষয়ে তিনি তাঁদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির প্রয়াস চালান।
দুশ্চিন্তা: কথায় কথায় একসময় আলীর দুচোখে পানি এসে যায়। তিনি বলেন, ‘আমি চাই না কেউ প্রতিবন্ধী হোক। যদি প্রতিবন্ধী হয়েও যায় সে যেন কারও অবজ্ঞার পাত্র না হয়, সেটাই আমার চাওয়া। কিন্তু আমার মৃত্যুর পরে এ প্রতিষ্ঠানটি কীভাবে চলবে, সেটাই আমার বড় দুশ্চিন্তা।’
এম এ আলী প্রতিবন্ধী স্কুলের পাশে দাঁড়ানোর জন্য আহ্বান জানালেন ভোলার জেলা প্রশাসক খোন্দকার মোস্তাফিজুর রহমান। তাঁর কথায়, ‘সমাজের অবহেলিত অংশ হিসেবে বিবেচিত প্রতিবন্ধীদের পুনর্বাসনের জন্য কাজ করছেন এম এ আলী। এ কাজ দেশকে স্বাবলম্বী করার শামিল। তাঁকে সবাই মিলে সহযোগিতা করা উচিত।’
No comments