কালের আয়নায়-এরা কি রাজনীতির মঞ্চে বিদূষক? by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
শেরেবাংলা হক সাহেব একবার বলেছিলেন,
'সার্কাসে যতই বাঘ-ভালুক থাকুক, ক্লাউন না থাকলে সার্কাস জমে না। তেমনি
রাজনীতিতেও কিছু ক্লাউন না থাকলে সে রাজনীতি জমে না।' তিনি তার প্রতিপক্ষের
কয়েকজন রাজনৈতিক নেতাকে ক্লাউন আখ্যা দিয়েছিলেন।
পরবর্তী সময়ে প্রমাণিত হয়েছিল, তারা সত্য সত্যই অবিভক্ত বাংলার রাজনীতিতে একেকজন ক্লাউন বা বিদূষক।
বর্তমান বাংলাদেশের রাজনীতিও একেবারে ভাঁড় বা ক্লাউনমুক্ত নয়। ইদানীং তাদের সংখ্যা বাড়ছে বলে মনে হয়। এই ক্লাউনদের এখন কোনো কোনো রাজনৈতিক সভা, সেমিনার এবং সংবাদপত্রের পৃষ্ঠায় ও টেলিটক শোতেও দেখা যায়। এদের ভাঁড়ামি নিয়ে মাঝে মধ্যে লিখতে হয় এটাই আমার দুঃখ। যদি এদের মুখোশ উন্মোচন না করা হয়, তাহলে দেশের মানুষ এই ভেবে বিভ্রান্ত হতে পারেন যে, এই ভাঁড়ামিই বুঝি দেশের আসল রাজনীতি।
কথায় বলে, 'পুরনো ফকির ভিখ পায় না তো নতুন ফকিরের আবির্ভাব।' হালে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সার্কাসে পুরনো খেলোয়াড়দের খেলা শেষ না হতেই নতুন খেলোয়াড় দেখা যাচ্ছে। এই খেলোয়াড়দের মধ্যে মাহমুদুর রহমান মান্না একজন। তিনি বহু ঘাটের পানি খেয়েছেন। দু'দু'বার নৌকায় চড়েও নির্বাচনের নদী পার হতে পারেননি। ভরাডুবি হয়েছে। রাজনৈতিক সার্কাসে তিনি দড়ির ওপর নাচে ব্যারিস্টার মওদুদকেও হার মানাতে পারেন।
এবারে তার নতুন খেলা 'নাগরিক ঐক্য'। গত বছর যে দু'জন প্রবীণ ব্যক্তিত্বকে সামনে খাড়া করে তিনি এই সংস্থা গড়ে তুলেছিলেন, এবার সংস্থাটির প্রথম বার্ষিকীর সভায় তাদের দু'জনের একজনকেও দেখা যায়নি। এরা হলেন ব্যারিস্টার রফিকুল হক এবং সাংবাদিক এবিএম মূসা। সম্ভবত এই ভাঁড়ামির খেলার আসল রহস্য বুঝতে পেরে তারা সটকে পড়েছেন। ফলে 'নাগরিক ঐক্য' নামটি ভাঁড়ামিতে পরিণত হয়েছে। দু'জন ব্যক্তিত্বকেও যে সংস্থা ধরে রাখতে পারেনি, তারা নাগরিক ঐক্য গড়ে তুলবে কীভাবে?
নাগরিক ঐক্য তাই এখন হারাধনের এক ছেলের সংস্থায় পরিণত হয়েছে। সংস্থার প্রথম প্রতিষ্ঠা দিবসের সাম্প্রতিক সভায় তাই মাহমুদুর রহমান মান্নাকেই সভাপতিত্ব করতে হয়েছে। এই সভায় আমন্ত্রিত হয়ে পুরনো আঁতেলদের কেউ আসেননি। একজন মাত্র জোগাড় করা গেছে। তিনি ড. আকবর আলি খান। আমন্ত্রণ পেলেই নানারকম সভা-সম্মেলনে গিয়ে ইনটেলেকচুয়াল কথা বলেন। গণঐক্যের প্রতিষ্ঠা দিবসের সভাতেও বলেছেন।
তিনি একজন সাবেক আমলা। কেবিনেট সেক্রেটারি, ফিন্যান্স সেক্রেটারি ইত্যাদি বহু উচ্চ পদে ছিলেন। তিনি অর্থ সচিব থাকাকালেই বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে প্রথম ভয়াবহ ধস নেমেছিল। তিনি তা ঠেকাতে পারেননি। কিন্তু পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ শেখ হাসিনার দ্বিতীয় সরকারের আমলে যখন আবার শেয়ারবাজারে ধস নামে, তখন পণ্ডিত সেজে সরকারের ব্যর্থতা সম্পর্কে নানা কটাক্ষ করেছিলেন। তিনি এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার প্রবক্তা সেজেছেন। কিন্তু ইয়াজউদ্দিনের আমলের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একজন উপদেষ্টা হয়েও ওই তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার অপব্যবহার ঠেকাতে পারেননি। তাকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল। এখন তিনি ওই ব্যর্থ ব্যবস্থারই একজন উঁচু গলার সমর্থক। বঙ্কিমচন্দ্র একবার এক পণ্ডিতের কূটতর্ক সম্পর্কে বলেছিলেন, 'ইনি যদি পণ্ডিত হন, তাহলে মূর্খ কে?'
ড. আকবর আলি একবার মার্কসবাদ সম্পর্কেও তার পাণ্ডিত্য প্রদর্শনের জন্য একটা চটি বই লিখে ফেলেছিলেন। উদ্দেশ্য, মার্কসীয় তত্ত্বের ভুলভ্রান্তি দেখানো। বইটি কলকাতায় এক তরুণ মার্কসবাদী অধ্যাপক আমার কাছ থেকে পড়তে নিয়েছিলেন। পড়ার পর বইটি আমাকে ফেরত দিয়ে বলেছিলেন, 'মার্কসবাদ অবশ্যই একেবারে নিখুঁত দর্শন বা তত্ত্ব নয়। কিন্তু মার্কসবাদ সম্পর্কে কিছু না বুঝে যে বই লেখা যায়, এই বইটি তার প্রমাণ।' আমি তাকে বলেছি, আমার যে মার্কসবাদ সম্পর্কে জ্ঞান সামান্যই, তাতেও এই বইটি পড়ে বুঝেছি, এটা একজন পণ্ডিত-মূর্খের লেখা। কলকাতার অধ্যাপক বলেছেন, তাহলে বইটি নিয়ে কিছু লিখছেন না কেন? বলেছি, তাহলে বইটিকে অযথা গুরুত্ব দেওয়া হবে। এই বই সম্পর্কে বাংলাদেশে তেমন কেউ অবহিত আছেন বলে মনে হয় না।
জাতীয় প্রেস ক্লাবে অনুষ্ঠিত নাগরিক ঐক্যের সভায় চারজন অতিথির মধ্যে ড. আকবর আলি খান একজন ছিলেন। বাকি তিনজন হলেন কমিউনিস্ট পার্টির মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, বাসদের খালেকুজ্জামান এবং গণফোরামের মোস্তফা মহসীন মন্টু। এই নাগরিকবিহীন নাগরিক ঐক্যের সভায় মাহমুদুর রহমান মান্নাই ছিলেন তার দলের একমাত্র প্রতিভূ। 'বহু ভঙ্গ বঙ্গ দেশ, তবু রঙ্গে ভরা'_ এই পুরনো কথাটি নাগরিক ঐক্যের সভার খবর পড়ে আবার মনে পড়ল।
সিপিবির মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম এবং বাসদের খালেকুজ্জামান এই নাগরিকবিহীন নাগরিক ঐক্যের সভায় কেন এসেছিলেন তা আমি জানি না। দু'জনেই দুটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের নেতা এবং তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক মতবাদ ও কর্মসূচি রয়েছে। তাদের কি 'গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল' জাতীয় লোকদের বিতর্কিত মঞ্চে ওঠার কোনো দরকার আছে? বরং এই মঞ্চে আওয়ামী লীগ থেকে গুরুতর অভিযোগে বহিষ্কৃত বর্তমানে গণফোরাম নেতা মোস্তফা মহসীন মন্টুর সঙ্গে আরেক সাবেক আওয়ামী লীগের কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের নেতা কাদের সিদ্দিকীকে দেখা গেলে মানাত ভালো। মন্টু ও কাদের সিদ্দিকীর পার্টির এখন একই অবস্থা এবং প্রায় একই অবস্থান।
পরিবেশ অবশ্যই মানুষকে প্রভাবিত করে। তাই সিপিবির মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম একজন বিজ্ঞ মার্কসবাদী এবং প্রবীণ রাজনীতিক হয়েও তথাকথিত নাগরিক ঐক্যের সভায় যেসব কথা বলেছেন, তা তার মুখে মানায় না। সেলিমকে দেশের বাম রাজনীতিতে গুরুত্ব দিই বলেই তাকে সবিনয়ে বলছি, নাগরিক ঐক্যের মতো নামগোত্রহীন মঞ্চে ওঠা বা চটুল কথা বলা তার পক্ষে শোভা পায় না।
ওই সভায় মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেছেন, 'দেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ হচ্ছে আপদ এবং বিএনপি হচ্ছে বিপদ।' আমার প্রশ্ন, একজন মার্কসবাদী বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী নেতার মুখে দেশের দুটি বড় রাজনৈতিক দল সম্পর্কে এই চটুল বিশ্লেষণ কি যথার্থ হলো? এখন তার বক্তব্যের জবাবে কেউ যদি বলেন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি হচ্ছে দেশের রাজনীতিতে আপদ ও বিপদ, কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) হচ্ছে মুসিবত, তাহলে তিনি কী বলবেন?
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে কমরেড মণি সিংহের নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট পার্টির একটা বড় অবদান ছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিআই) কংগ্রেসের লেজুড়বৃত্তি করার মতো বাংলাদেশে কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) আওয়ামী লীগের লেজুড়বৃত্তি করা ছাড়া আর কী ভূমিকা ছিল? সদ্য স্বাধীনতা অর্জিত দেশটিতে অসাম্প্রদায়িকতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের দুর্বল ভিত্তি সুদৃঢ় ও স্থায়ী করার জন্য সিপিবি কি কোনো বাস্তব কর্মসূচি অনুসরণ করেছিল, না লেনিন দিবস পালন, বাংলাদেশের জন্য জুলিও কুরি শান্তি পদক আনা এবং সুযোগ পেলেই চিকিৎসা বা অন্য অজুহাতে মস্কোতে ছুটে গিয়ে 'সমাজতন্ত্রের ঘাঁটি রক্ষায়' ব্যস্ত থাকা ছাড়া স্বদেশে ঘটায়মান প্রতিবিপ্লবী অভ্যুত্থান সম্পর্কে কিছুমাত্র সচেতনতার পরিচয় দেখিয়েছেন?
এই অভ্যুত্থান যখন সংঘটিত হলো, তখন আওয়ামী লীগ না হয় পেটিবুর্জোয়া পার্টি, কোনো তাৎক্ষণিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাপের (মোজাফ্ফর) মিলিত শক্তিশালী বাম শক্তি কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পেরেছিল কি? না, সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের খাল কাটার 'বিপ্লবে' শরিক হতে চেয়েছিল? শরিক হতে চেয়েও তারা পারেননি। জিয়াউর রহমান অতর্কিত শুরু করেছিলেন কমিউনিস্ট নেতাকর্মীদের ব্যাপক ধরপাকড়।
মানুষ এক ভুল থেকে আরেক ভুল সম্পর্কে সতর্ক হয়। কিন্তু সিপিবি অতীতের ভুল থেকে কোনো শিক্ষা না নিয়ে নতুন ভুলে পা দিয়েছে। স্বাধীনতার পর কমিউনিস্ট পার্টি আওয়ামী লীগের কণ্ঠলগ্ন হলেও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিকে ছেড়ে দেওয়া উচিত ছিল সদ্য স্বাধীন দেশে গণতান্ত্রিক বিরোধিতার শূন্যস্থানটি পূর্ণ করার জন্য। সিপিবি তা করেনি। তারা ন্যাপকে জড়িয়ে নিয়ে আওয়ামী লীগের লেজুড়বৃত্তি শুরু করে। ফলে দেশে গণতান্ত্রিক বিরোধিতার শূন্যস্থানটি পূর্ণ করে প্রথমে অ্যাডভেঞ্চারিস্ট জাসদ, যার পরিণতি জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসন। জাসদের বিপর্যয়ের পর জামায়াতসহ '৭১-এর পরাজিত ঘাতক চক্রের পুনরুভ্যুত্থান এবং বিএনপির সহযোগে মূল বিকল্প শক্তি হিসেবে দেশের রাজনীতিতে অবস্থান গ্রহণ।
দেশে এই মৌলিক রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সিপিবি ভুল সংশোধনের নামে আবার যা করল তা আরও বড় ভুল। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে দলটির লেজুড়বৃত্তি করে তারা ভুল করেছেন_ এই উপলব্ধি থেকে তারা আওয়ামী লীগের বিরোধিতা বা আওয়ামী লীগ থেকে দূরে থাকার নীতি গ্রহণ করলেন এমন এক সময়, যখন দেশে গণতন্ত্র নির্বাসিত, সামরিক শাসন ও জঙ্গি মৌলবাদের মিলিত অভ্যুত্থান ঘটেছে এবং আওয়ামী লীগ তার সব পেটিবুর্জোয়াসুলভ ত্রুটি-বিচ্যুতি সত্ত্বেও সেই গণশত্রুদের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত। এ সময় সিপিবি এক ধরনের একলা চলার নীতি গ্রহণ করে অর্থাৎ অতীতের একই ভুল সংশোধনের জন্য বর্তমানের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আরেকটি ভুলে জড়িয়ে গেল।
২০০৮ সালের নির্বাচনের সময়ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত মহাজোটে সিপিবি আসেনি। অথচ এই নির্বাচন ছিল দেশের এক মহাসংকট সন্ধির নির্বাচন। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বা মহাজোট নির্বাচিত হতে না পারলে দেশে নিশ্চিতভাবে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের নেতৃত্বে মধ্যযুগীয় তালেবানি শাসন প্রতিষ্ঠিত হতো। এই মহাআশঙ্কা বিবেচনায় রেখে ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদের (ইনু) মতো এককালের ঘোর আওয়ামী লীগবিরোধী দলও মহাজোটে যোগ দিয়েছে। সিপিবি আসেনি। তারা স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ ও সামরিক ছাউনিতে সামরিক শাসকের দ্বারা গঠিত বিএনপিকে একই ইকোয়েশনে বেঁধে দলের 'তাত্তি্বক সতীত্ব' রক্ষার চেষ্টা করেছেন। বর্তমানে তারা বাসদের সঙ্গে জোট বেঁধেছেন। এটা কি শূন্য যোগ শূন্য ইকোয়ালটু মহাশূন্য নয়? গণতান্ত্রিক রাজনীতির এটা সহায়ক শক্তি না হয়ে শেষ পর্যন্ত কি মুসিবত হয়ে দাঁড়াতে পারে না?
এবার মহাতালেবর ড. আকবর আলি খানের কথায় আসি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় একবার মুখ পুড়িয়ে তার চৈতন্যোদয় হয়নি। তিনি আবার এই ব্যবস্থার পক্ষে ফতোয়া দিচ্ছেন। কিন্তু কেন? নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা যে শেষ পর্যন্ত নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ থাকে না, তার প্রমাণ একবার সাহাবুদ্দীন-লতিফুর রহমান জুটির তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং আরেকবার ইয়াজউদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে কি পাওয়া যায়নি?
প্রশ্নটা তো দলীয় অথবা নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের নয়। প্রশ্ন, নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে কি-না? যদি সারাবিশ্বের দেশগুলোর মতো বাংলাদেশেও দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন হয়, তাহলে আপত্তিটা কোথায়? নব্বইয়ের দশকে বিএনপি সরকারের আমলে নির্বাচনে বারবার কারচুপি হওয়ায় দেশের সব দলই তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চেয়েছিল। বর্তমানে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে কারচুপি ঘটানোর অভিযোগ না ওঠায় দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের পুরনো ও চিরাচরিত ব্যবস্থায় ফিরে যেতে আপত্তি কী?
যদি সন্দেহ করা হয়, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে এখনও কারচুপি হওয়ার আশঙ্কা আছে, তাহলে নির্বাচন কমিশনকে আরও স্বাধীন ও শক্তিশালী করাসহ আরও নানা ধরনের ব্যবস্থা রাজনৈতিক দলগুলো পারস্পরিক আলোচনা দ্বারাই গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু আমরা সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের ওপর জোর না দিয়ে কোন ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচন হবে তার ওপর সব গুরুত্ব দিয়ে সংঘাত ও সন্ত্রাসের পথে দেশকে ঠেলে দিচ্ছি। অতীতে প্রমাণিত হয়েছে, দুই ধরনের সরকার পদ্ধতিতেই নির্বাচনে দুর্নীতি হতে পারে, যদি এই দুর্নীতি বা কারচুপি বন্ধের ব্যবস্থাটি পাকা না হয়। ব্যবস্থাটি পাকা করা যেতে পারে দুই ধরনের সরকার পদ্ধতিতেই। তা না করে কোন পদ্ধতির অধীনে নির্বাচন হবে তা নিয়ে টানাটানি বোকা কুমিরের শিয়াল পণ্ডিতের পা কামড়ে ধরার বদলে তার লাঠি ধরে টানাটানির সমতুল্য নয় কি?
বিএনপি কেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য এত জেদ ধরেছে, তা বুঝতে কষ্ট হয় না। দলনেত্রীর হয়তো আশা, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে তারা সাহাবুদ্দীন ও ইয়াজউদ্দিন আমলের মতো ওই সরকারকে 'ম্যানুপুলেট' করে নিজেদের বৈধ অথবা অবৈধ জয় নিশ্চিত করতে পারবেন। কিন্তু সব জেনেশুনেও ড. আকবর আলি খান, এমনকি 'সংবিধান বিশেষজ্ঞ' বলে পরিচিত ড. কামাল হোসেন এবং আরও অনেক বিজ্ঞ ও বুদ্ধিজীবী বলে পরিচিত ব্যক্তিরা হঠাৎ কোরাসে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি সমর্থনের জন্য কেন উঠেপড়ে লেগেছেন?
একটু পর্যালোচনা করলেই দেখা যাবে, এই বিজ্ঞ ব্যক্তিরা বাইরে যতই নিরপেক্ষতার ভেক দেখান, কিন্তু কার্যকারণে তারা আওয়ামী লীগ ও হাসিনাবিদ্বেষী। বিশাল পাণ্ডিত্য দ্বারা দেশের মানুষের কাছে যে গ্রহণযোগ্যতা তারা অর্জন করতে পারেননি, বিনা পাণ্ডিত্যে কেবল সাহস ও আন্তরিকতা দ্বারা শেখ হাসিনা তা অর্জন করেছেন। এটা তাদের কাছে সহ্যাতীত ব্যাপার। ঈর্ষার ব্যাপারও।
সে জন্যই হয়তো আমরা বিস্ময়করভাবে লক্ষ্য করি, আমাদের সুশীল সমাজের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ আওয়ামী লীগ ও বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে অধিকাংশ সময় সমীকরণ করেন এবং বিএনপি-জামায়াতের দিকে প্রকারান্তরে পক্ষপাত দেখান। তাতে দেশ এবং গণতন্ত্রের ক্ষতি হবে জেনেও তারা আওয়ামী-বিদ্বেষমুক্ত হতে পারেন না। ড. আকবর আলি খান নতুন আঁতেল হওয়া সত্ত্বেও পুরনো আঁতেলদের পন্থানুসরণ ত্যাগ করতে পারেননি। তারা হয়তো ভাবেন, আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনাকে সহজ ও স্বাভাবিক পথে ক্ষমতা থেকে সরানো যাবে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির ম্যানুপুলেশন দ্বারা তা হয়তো সম্ভব হবে। ধন্য আশা কুহকিনী।
নাগরিক ঐক্যের সভায় আকবর আলি খান আরেকটি তথ্য আবিষ্কার করেছেন। তার মতে, 'বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী রাশিয়ার জার, এমনকি মোগল সম্রাটদের চাইতেও অধিক ক্ষমতা ভোগ করেন।' বুঝতে কষ্ট হয় না, কথাটা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে বলা হলেও আসল টার্গেট শেখ হাসিনা। অর্থাৎ হাসিনা একজন গণতান্ত্রিক নেতা নন, তিনি মধ্যযুগীয় রাজা-বাদশার মতো ক্ষমতা ভোগ করেন। কথাটি কি সঠিক, না কোনো উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা? রাশিয়ার জার বা দিলি্লর মোগল বাদশারা ইচ্ছা করলেই একজনের শিরশ্ছেদ করতে পারতেন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একজন মহাশক্তিশালী প্রধানমন্ত্রীও তা পারেন না।
তবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কোনো কোনো সময় মহাব্যক্তিত্বশালী প্রধানমন্ত্রীর আবির্ভাব হয়। যেমন ভারতের ইন্দিরা গান্ধী বা ব্রিটেনের মার্গারেট থ্যাচার। তাদের লৌহমানবী (ওৎড়হ ষধফু) বলা হয়। তারাও জার বা মোগল বাদশাদের মতো ব্যক্তিগত স্বৈরাচার চালাতে পারেননি। আর শেখ হাসিনা তো ইন্দিরা গান্ধী বা থ্যাচারের মতো লৌহমানবীও হতে পারেননি। তিনি অধুনা কঠোর ব্যক্তিত্বের পরিচয় দেখাতে পারেন, কিন্তু ব্যক্তিগত স্বৈরাচারের আশ্রয় কখনও নেননি। বাংলাদেশের বর্তমানে যা অবস্থা, তাতে একজন শক্তিশালী ও ব্যক্তিত্বশালী প্রধানমন্ত্রী অবশ্যই প্রয়োজন। ড. আকবর আলি খান কী চান? একজন ব্যক্তিত্বহীন এবং আমলাদের হাতে জিম্মি একজন প্রধানমন্ত্রী কি?
লন্ডন, ৭ জুন শুক্রবার, ২০১৩
বর্তমান বাংলাদেশের রাজনীতিও একেবারে ভাঁড় বা ক্লাউনমুক্ত নয়। ইদানীং তাদের সংখ্যা বাড়ছে বলে মনে হয়। এই ক্লাউনদের এখন কোনো কোনো রাজনৈতিক সভা, সেমিনার এবং সংবাদপত্রের পৃষ্ঠায় ও টেলিটক শোতেও দেখা যায়। এদের ভাঁড়ামি নিয়ে মাঝে মধ্যে লিখতে হয় এটাই আমার দুঃখ। যদি এদের মুখোশ উন্মোচন না করা হয়, তাহলে দেশের মানুষ এই ভেবে বিভ্রান্ত হতে পারেন যে, এই ভাঁড়ামিই বুঝি দেশের আসল রাজনীতি।
কথায় বলে, 'পুরনো ফকির ভিখ পায় না তো নতুন ফকিরের আবির্ভাব।' হালে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সার্কাসে পুরনো খেলোয়াড়দের খেলা শেষ না হতেই নতুন খেলোয়াড় দেখা যাচ্ছে। এই খেলোয়াড়দের মধ্যে মাহমুদুর রহমান মান্না একজন। তিনি বহু ঘাটের পানি খেয়েছেন। দু'দু'বার নৌকায় চড়েও নির্বাচনের নদী পার হতে পারেননি। ভরাডুবি হয়েছে। রাজনৈতিক সার্কাসে তিনি দড়ির ওপর নাচে ব্যারিস্টার মওদুদকেও হার মানাতে পারেন।
এবারে তার নতুন খেলা 'নাগরিক ঐক্য'। গত বছর যে দু'জন প্রবীণ ব্যক্তিত্বকে সামনে খাড়া করে তিনি এই সংস্থা গড়ে তুলেছিলেন, এবার সংস্থাটির প্রথম বার্ষিকীর সভায় তাদের দু'জনের একজনকেও দেখা যায়নি। এরা হলেন ব্যারিস্টার রফিকুল হক এবং সাংবাদিক এবিএম মূসা। সম্ভবত এই ভাঁড়ামির খেলার আসল রহস্য বুঝতে পেরে তারা সটকে পড়েছেন। ফলে 'নাগরিক ঐক্য' নামটি ভাঁড়ামিতে পরিণত হয়েছে। দু'জন ব্যক্তিত্বকেও যে সংস্থা ধরে রাখতে পারেনি, তারা নাগরিক ঐক্য গড়ে তুলবে কীভাবে?
নাগরিক ঐক্য তাই এখন হারাধনের এক ছেলের সংস্থায় পরিণত হয়েছে। সংস্থার প্রথম প্রতিষ্ঠা দিবসের সাম্প্রতিক সভায় তাই মাহমুদুর রহমান মান্নাকেই সভাপতিত্ব করতে হয়েছে। এই সভায় আমন্ত্রিত হয়ে পুরনো আঁতেলদের কেউ আসেননি। একজন মাত্র জোগাড় করা গেছে। তিনি ড. আকবর আলি খান। আমন্ত্রণ পেলেই নানারকম সভা-সম্মেলনে গিয়ে ইনটেলেকচুয়াল কথা বলেন। গণঐক্যের প্রতিষ্ঠা দিবসের সভাতেও বলেছেন।
তিনি একজন সাবেক আমলা। কেবিনেট সেক্রেটারি, ফিন্যান্স সেক্রেটারি ইত্যাদি বহু উচ্চ পদে ছিলেন। তিনি অর্থ সচিব থাকাকালেই বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে প্রথম ভয়াবহ ধস নেমেছিল। তিনি তা ঠেকাতে পারেননি। কিন্তু পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ শেখ হাসিনার দ্বিতীয় সরকারের আমলে যখন আবার শেয়ারবাজারে ধস নামে, তখন পণ্ডিত সেজে সরকারের ব্যর্থতা সম্পর্কে নানা কটাক্ষ করেছিলেন। তিনি এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার প্রবক্তা সেজেছেন। কিন্তু ইয়াজউদ্দিনের আমলের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একজন উপদেষ্টা হয়েও ওই তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার অপব্যবহার ঠেকাতে পারেননি। তাকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল। এখন তিনি ওই ব্যর্থ ব্যবস্থারই একজন উঁচু গলার সমর্থক। বঙ্কিমচন্দ্র একবার এক পণ্ডিতের কূটতর্ক সম্পর্কে বলেছিলেন, 'ইনি যদি পণ্ডিত হন, তাহলে মূর্খ কে?'
ড. আকবর আলি একবার মার্কসবাদ সম্পর্কেও তার পাণ্ডিত্য প্রদর্শনের জন্য একটা চটি বই লিখে ফেলেছিলেন। উদ্দেশ্য, মার্কসীয় তত্ত্বের ভুলভ্রান্তি দেখানো। বইটি কলকাতায় এক তরুণ মার্কসবাদী অধ্যাপক আমার কাছ থেকে পড়তে নিয়েছিলেন। পড়ার পর বইটি আমাকে ফেরত দিয়ে বলেছিলেন, 'মার্কসবাদ অবশ্যই একেবারে নিখুঁত দর্শন বা তত্ত্ব নয়। কিন্তু মার্কসবাদ সম্পর্কে কিছু না বুঝে যে বই লেখা যায়, এই বইটি তার প্রমাণ।' আমি তাকে বলেছি, আমার যে মার্কসবাদ সম্পর্কে জ্ঞান সামান্যই, তাতেও এই বইটি পড়ে বুঝেছি, এটা একজন পণ্ডিত-মূর্খের লেখা। কলকাতার অধ্যাপক বলেছেন, তাহলে বইটি নিয়ে কিছু লিখছেন না কেন? বলেছি, তাহলে বইটিকে অযথা গুরুত্ব দেওয়া হবে। এই বই সম্পর্কে বাংলাদেশে তেমন কেউ অবহিত আছেন বলে মনে হয় না।
জাতীয় প্রেস ক্লাবে অনুষ্ঠিত নাগরিক ঐক্যের সভায় চারজন অতিথির মধ্যে ড. আকবর আলি খান একজন ছিলেন। বাকি তিনজন হলেন কমিউনিস্ট পার্টির মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, বাসদের খালেকুজ্জামান এবং গণফোরামের মোস্তফা মহসীন মন্টু। এই নাগরিকবিহীন নাগরিক ঐক্যের সভায় মাহমুদুর রহমান মান্নাই ছিলেন তার দলের একমাত্র প্রতিভূ। 'বহু ভঙ্গ বঙ্গ দেশ, তবু রঙ্গে ভরা'_ এই পুরনো কথাটি নাগরিক ঐক্যের সভার খবর পড়ে আবার মনে পড়ল।
সিপিবির মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম এবং বাসদের খালেকুজ্জামান এই নাগরিকবিহীন নাগরিক ঐক্যের সভায় কেন এসেছিলেন তা আমি জানি না। দু'জনেই দুটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের নেতা এবং তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক মতবাদ ও কর্মসূচি রয়েছে। তাদের কি 'গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল' জাতীয় লোকদের বিতর্কিত মঞ্চে ওঠার কোনো দরকার আছে? বরং এই মঞ্চে আওয়ামী লীগ থেকে গুরুতর অভিযোগে বহিষ্কৃত বর্তমানে গণফোরাম নেতা মোস্তফা মহসীন মন্টুর সঙ্গে আরেক সাবেক আওয়ামী লীগের কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের নেতা কাদের সিদ্দিকীকে দেখা গেলে মানাত ভালো। মন্টু ও কাদের সিদ্দিকীর পার্টির এখন একই অবস্থা এবং প্রায় একই অবস্থান।
পরিবেশ অবশ্যই মানুষকে প্রভাবিত করে। তাই সিপিবির মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম একজন বিজ্ঞ মার্কসবাদী এবং প্রবীণ রাজনীতিক হয়েও তথাকথিত নাগরিক ঐক্যের সভায় যেসব কথা বলেছেন, তা তার মুখে মানায় না। সেলিমকে দেশের বাম রাজনীতিতে গুরুত্ব দিই বলেই তাকে সবিনয়ে বলছি, নাগরিক ঐক্যের মতো নামগোত্রহীন মঞ্চে ওঠা বা চটুল কথা বলা তার পক্ষে শোভা পায় না।
ওই সভায় মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেছেন, 'দেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ হচ্ছে আপদ এবং বিএনপি হচ্ছে বিপদ।' আমার প্রশ্ন, একজন মার্কসবাদী বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী নেতার মুখে দেশের দুটি বড় রাজনৈতিক দল সম্পর্কে এই চটুল বিশ্লেষণ কি যথার্থ হলো? এখন তার বক্তব্যের জবাবে কেউ যদি বলেন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি হচ্ছে দেশের রাজনীতিতে আপদ ও বিপদ, কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) হচ্ছে মুসিবত, তাহলে তিনি কী বলবেন?
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে কমরেড মণি সিংহের নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট পার্টির একটা বড় অবদান ছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিআই) কংগ্রেসের লেজুড়বৃত্তি করার মতো বাংলাদেশে কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) আওয়ামী লীগের লেজুড়বৃত্তি করা ছাড়া আর কী ভূমিকা ছিল? সদ্য স্বাধীনতা অর্জিত দেশটিতে অসাম্প্রদায়িকতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের দুর্বল ভিত্তি সুদৃঢ় ও স্থায়ী করার জন্য সিপিবি কি কোনো বাস্তব কর্মসূচি অনুসরণ করেছিল, না লেনিন দিবস পালন, বাংলাদেশের জন্য জুলিও কুরি শান্তি পদক আনা এবং সুযোগ পেলেই চিকিৎসা বা অন্য অজুহাতে মস্কোতে ছুটে গিয়ে 'সমাজতন্ত্রের ঘাঁটি রক্ষায়' ব্যস্ত থাকা ছাড়া স্বদেশে ঘটায়মান প্রতিবিপ্লবী অভ্যুত্থান সম্পর্কে কিছুমাত্র সচেতনতার পরিচয় দেখিয়েছেন?
এই অভ্যুত্থান যখন সংঘটিত হলো, তখন আওয়ামী লীগ না হয় পেটিবুর্জোয়া পার্টি, কোনো তাৎক্ষণিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাপের (মোজাফ্ফর) মিলিত শক্তিশালী বাম শক্তি কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পেরেছিল কি? না, সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের খাল কাটার 'বিপ্লবে' শরিক হতে চেয়েছিল? শরিক হতে চেয়েও তারা পারেননি। জিয়াউর রহমান অতর্কিত শুরু করেছিলেন কমিউনিস্ট নেতাকর্মীদের ব্যাপক ধরপাকড়।
মানুষ এক ভুল থেকে আরেক ভুল সম্পর্কে সতর্ক হয়। কিন্তু সিপিবি অতীতের ভুল থেকে কোনো শিক্ষা না নিয়ে নতুন ভুলে পা দিয়েছে। স্বাধীনতার পর কমিউনিস্ট পার্টি আওয়ামী লীগের কণ্ঠলগ্ন হলেও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিকে ছেড়ে দেওয়া উচিত ছিল সদ্য স্বাধীন দেশে গণতান্ত্রিক বিরোধিতার শূন্যস্থানটি পূর্ণ করার জন্য। সিপিবি তা করেনি। তারা ন্যাপকে জড়িয়ে নিয়ে আওয়ামী লীগের লেজুড়বৃত্তি শুরু করে। ফলে দেশে গণতান্ত্রিক বিরোধিতার শূন্যস্থানটি পূর্ণ করে প্রথমে অ্যাডভেঞ্চারিস্ট জাসদ, যার পরিণতি জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসন। জাসদের বিপর্যয়ের পর জামায়াতসহ '৭১-এর পরাজিত ঘাতক চক্রের পুনরুভ্যুত্থান এবং বিএনপির সহযোগে মূল বিকল্প শক্তি হিসেবে দেশের রাজনীতিতে অবস্থান গ্রহণ।
দেশে এই মৌলিক রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সিপিবি ভুল সংশোধনের নামে আবার যা করল তা আরও বড় ভুল। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে দলটির লেজুড়বৃত্তি করে তারা ভুল করেছেন_ এই উপলব্ধি থেকে তারা আওয়ামী লীগের বিরোধিতা বা আওয়ামী লীগ থেকে দূরে থাকার নীতি গ্রহণ করলেন এমন এক সময়, যখন দেশে গণতন্ত্র নির্বাসিত, সামরিক শাসন ও জঙ্গি মৌলবাদের মিলিত অভ্যুত্থান ঘটেছে এবং আওয়ামী লীগ তার সব পেটিবুর্জোয়াসুলভ ত্রুটি-বিচ্যুতি সত্ত্বেও সেই গণশত্রুদের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত। এ সময় সিপিবি এক ধরনের একলা চলার নীতি গ্রহণ করে অর্থাৎ অতীতের একই ভুল সংশোধনের জন্য বর্তমানের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আরেকটি ভুলে জড়িয়ে গেল।
২০০৮ সালের নির্বাচনের সময়ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত মহাজোটে সিপিবি আসেনি। অথচ এই নির্বাচন ছিল দেশের এক মহাসংকট সন্ধির নির্বাচন। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বা মহাজোট নির্বাচিত হতে না পারলে দেশে নিশ্চিতভাবে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের নেতৃত্বে মধ্যযুগীয় তালেবানি শাসন প্রতিষ্ঠিত হতো। এই মহাআশঙ্কা বিবেচনায় রেখে ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদের (ইনু) মতো এককালের ঘোর আওয়ামী লীগবিরোধী দলও মহাজোটে যোগ দিয়েছে। সিপিবি আসেনি। তারা স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ ও সামরিক ছাউনিতে সামরিক শাসকের দ্বারা গঠিত বিএনপিকে একই ইকোয়েশনে বেঁধে দলের 'তাত্তি্বক সতীত্ব' রক্ষার চেষ্টা করেছেন। বর্তমানে তারা বাসদের সঙ্গে জোট বেঁধেছেন। এটা কি শূন্য যোগ শূন্য ইকোয়ালটু মহাশূন্য নয়? গণতান্ত্রিক রাজনীতির এটা সহায়ক শক্তি না হয়ে শেষ পর্যন্ত কি মুসিবত হয়ে দাঁড়াতে পারে না?
এবার মহাতালেবর ড. আকবর আলি খানের কথায় আসি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় একবার মুখ পুড়িয়ে তার চৈতন্যোদয় হয়নি। তিনি আবার এই ব্যবস্থার পক্ষে ফতোয়া দিচ্ছেন। কিন্তু কেন? নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা যে শেষ পর্যন্ত নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ থাকে না, তার প্রমাণ একবার সাহাবুদ্দীন-লতিফুর রহমান জুটির তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং আরেকবার ইয়াজউদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে কি পাওয়া যায়নি?
প্রশ্নটা তো দলীয় অথবা নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের নয়। প্রশ্ন, নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে কি-না? যদি সারাবিশ্বের দেশগুলোর মতো বাংলাদেশেও দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন হয়, তাহলে আপত্তিটা কোথায়? নব্বইয়ের দশকে বিএনপি সরকারের আমলে নির্বাচনে বারবার কারচুপি হওয়ায় দেশের সব দলই তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চেয়েছিল। বর্তমানে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে কারচুপি ঘটানোর অভিযোগ না ওঠায় দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের পুরনো ও চিরাচরিত ব্যবস্থায় ফিরে যেতে আপত্তি কী?
যদি সন্দেহ করা হয়, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে এখনও কারচুপি হওয়ার আশঙ্কা আছে, তাহলে নির্বাচন কমিশনকে আরও স্বাধীন ও শক্তিশালী করাসহ আরও নানা ধরনের ব্যবস্থা রাজনৈতিক দলগুলো পারস্পরিক আলোচনা দ্বারাই গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু আমরা সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের ওপর জোর না দিয়ে কোন ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচন হবে তার ওপর সব গুরুত্ব দিয়ে সংঘাত ও সন্ত্রাসের পথে দেশকে ঠেলে দিচ্ছি। অতীতে প্রমাণিত হয়েছে, দুই ধরনের সরকার পদ্ধতিতেই নির্বাচনে দুর্নীতি হতে পারে, যদি এই দুর্নীতি বা কারচুপি বন্ধের ব্যবস্থাটি পাকা না হয়। ব্যবস্থাটি পাকা করা যেতে পারে দুই ধরনের সরকার পদ্ধতিতেই। তা না করে কোন পদ্ধতির অধীনে নির্বাচন হবে তা নিয়ে টানাটানি বোকা কুমিরের শিয়াল পণ্ডিতের পা কামড়ে ধরার বদলে তার লাঠি ধরে টানাটানির সমতুল্য নয় কি?
বিএনপি কেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য এত জেদ ধরেছে, তা বুঝতে কষ্ট হয় না। দলনেত্রীর হয়তো আশা, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে তারা সাহাবুদ্দীন ও ইয়াজউদ্দিন আমলের মতো ওই সরকারকে 'ম্যানুপুলেট' করে নিজেদের বৈধ অথবা অবৈধ জয় নিশ্চিত করতে পারবেন। কিন্তু সব জেনেশুনেও ড. আকবর আলি খান, এমনকি 'সংবিধান বিশেষজ্ঞ' বলে পরিচিত ড. কামাল হোসেন এবং আরও অনেক বিজ্ঞ ও বুদ্ধিজীবী বলে পরিচিত ব্যক্তিরা হঠাৎ কোরাসে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি সমর্থনের জন্য কেন উঠেপড়ে লেগেছেন?
একটু পর্যালোচনা করলেই দেখা যাবে, এই বিজ্ঞ ব্যক্তিরা বাইরে যতই নিরপেক্ষতার ভেক দেখান, কিন্তু কার্যকারণে তারা আওয়ামী লীগ ও হাসিনাবিদ্বেষী। বিশাল পাণ্ডিত্য দ্বারা দেশের মানুষের কাছে যে গ্রহণযোগ্যতা তারা অর্জন করতে পারেননি, বিনা পাণ্ডিত্যে কেবল সাহস ও আন্তরিকতা দ্বারা শেখ হাসিনা তা অর্জন করেছেন। এটা তাদের কাছে সহ্যাতীত ব্যাপার। ঈর্ষার ব্যাপারও।
সে জন্যই হয়তো আমরা বিস্ময়করভাবে লক্ষ্য করি, আমাদের সুশীল সমাজের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ আওয়ামী লীগ ও বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে অধিকাংশ সময় সমীকরণ করেন এবং বিএনপি-জামায়াতের দিকে প্রকারান্তরে পক্ষপাত দেখান। তাতে দেশ এবং গণতন্ত্রের ক্ষতি হবে জেনেও তারা আওয়ামী-বিদ্বেষমুক্ত হতে পারেন না। ড. আকবর আলি খান নতুন আঁতেল হওয়া সত্ত্বেও পুরনো আঁতেলদের পন্থানুসরণ ত্যাগ করতে পারেননি। তারা হয়তো ভাবেন, আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনাকে সহজ ও স্বাভাবিক পথে ক্ষমতা থেকে সরানো যাবে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির ম্যানুপুলেশন দ্বারা তা হয়তো সম্ভব হবে। ধন্য আশা কুহকিনী।
নাগরিক ঐক্যের সভায় আকবর আলি খান আরেকটি তথ্য আবিষ্কার করেছেন। তার মতে, 'বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী রাশিয়ার জার, এমনকি মোগল সম্রাটদের চাইতেও অধিক ক্ষমতা ভোগ করেন।' বুঝতে কষ্ট হয় না, কথাটা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে বলা হলেও আসল টার্গেট শেখ হাসিনা। অর্থাৎ হাসিনা একজন গণতান্ত্রিক নেতা নন, তিনি মধ্যযুগীয় রাজা-বাদশার মতো ক্ষমতা ভোগ করেন। কথাটি কি সঠিক, না কোনো উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা? রাশিয়ার জার বা দিলি্লর মোগল বাদশারা ইচ্ছা করলেই একজনের শিরশ্ছেদ করতে পারতেন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একজন মহাশক্তিশালী প্রধানমন্ত্রীও তা পারেন না।
তবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কোনো কোনো সময় মহাব্যক্তিত্বশালী প্রধানমন্ত্রীর আবির্ভাব হয়। যেমন ভারতের ইন্দিরা গান্ধী বা ব্রিটেনের মার্গারেট থ্যাচার। তাদের লৌহমানবী (ওৎড়হ ষধফু) বলা হয়। তারাও জার বা মোগল বাদশাদের মতো ব্যক্তিগত স্বৈরাচার চালাতে পারেননি। আর শেখ হাসিনা তো ইন্দিরা গান্ধী বা থ্যাচারের মতো লৌহমানবীও হতে পারেননি। তিনি অধুনা কঠোর ব্যক্তিত্বের পরিচয় দেখাতে পারেন, কিন্তু ব্যক্তিগত স্বৈরাচারের আশ্রয় কখনও নেননি। বাংলাদেশের বর্তমানে যা অবস্থা, তাতে একজন শক্তিশালী ও ব্যক্তিত্বশালী প্রধানমন্ত্রী অবশ্যই প্রয়োজন। ড. আকবর আলি খান কী চান? একজন ব্যক্তিত্বহীন এবং আমলাদের হাতে জিম্মি একজন প্রধানমন্ত্রী কি?
লন্ডন, ৭ জুন শুক্রবার, ২০১৩
No comments