রাজনীতির সপ্তাহ-আশরাফুল পারলে রাজনীতিকরা কেন নন by চৌধুরী আফতাবুল ইসলাম
ছোট্ট দেশ। তবে বিপুল প্রাণশক্তি বটে।
কর্মকাণ্ড ও ঘটনাপ্রবাহও তাক লাগানো। এই যে এত অশান্তি, অস্থিরতা,
হরতাল-অবরোধের বিপর্যয় যখন-তখন, তবু থেমে থাকার জাতি নয় বাঙালি। দুই দিন
আগে এই নিয়ে আড্ডা হচ্ছিল এক সাংবাদিক বন্ধুর সঙ্গে।
বিষয়- দেশের ভবিষ্যৎ। আলোচনায় সবচেয়ে বড় হয়ে ওঠা প্রশ্নটি ছিল, দেশটা কি
তাহলে স্থবিরতার দিকে এগোচ্ছে? আমার সাংবাদিক বন্ধুর স্পষ্ট জবাবটা ছিল,
'আরে না।' এ জাতি কিছুতেই দমে না। ঘটনা, পরম্পরা, পরিণতি যা-ই হোক, চলতেই
থাকবে, না ভুল হলো- রীতিমতো দৌড়াবে। সামনে-পেছনে, ডানে-বাঁয়ে। আর জন্ম
দিতে থাকবে অতি আলোচিত একটি করে ঘটনা। সাধে কি আর যুক্তরাজ্যের আন্তর্জাতিক
উন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী অ্যালান ডানকান বলেছেন, বিশ্বের নিবিড় পর্যবেক্ষণে
এখন বাংলাদেশ। এ দেশের নেতা-নেত্রীরা কী করেন, না করেন- সব কিছু দেখতে
থাকবে বিশ্ব।
গত কিছুদিনের ঘটনাপ্রবাহ দেখুন- এর বেশির ভাগই ছিল বিশ্বের গণমাধ্যমের শিরোনাম, নয়তো বহুল আলোচিত বিষয়বস্তু। একটি ভবনধসে সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ড এখন বাংলাদেশের। রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে ১৭ দিন পর জীবিত রেশমা উদ্ধার- রূপকথার মতো এ ঘটনাও বিশ্বের শীর্ষ সংবাদ। ২০১৩ সালে প্রতি মাসে গড়ে প্রায় ১০ দিন করে হরতাল- এও রেকর্ড। বর্তমান সংসদের ৯০ শতাংশেরও বেশি অধিবেশনে বিরোধী দল অনুপস্থিত- এটাও সম্ভবত বিশ্ব রেকর্ড। মহাসেনও বড় খবর। এর আগে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের রায়, গণজাগরণ মঞ্চ, সারা দেশে জামায়াত-শিবিরের নারকীয় তাণ্ডব- এর সবই সংবাদ শিরোনাম হয়েছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে।
আর এখন চলছে সংলাপ সংলাপ নাটক। বেশ ক্লাইমেক্স তাতে। এক পক্ষ এগোয় তো অন্য পক্ষ পেছায়। আবার অন্য পক্ষ নরম হয়ে যখন আবেদন-নিবেদন শুরু করে, তো প্রতিপক্ষ তখন ততটাই গরম। এ অবস্থায় দুই পক্ষের মান ভঞ্জনে বা দুই পক্ষকে নরম করতে একের পর এক ছুটে আসতে থাকেন বিশ্ব মোড়লদের প্রতিনিধিরা। এরই মধ্যে আমরা দেখেছি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি ও জাতিসংঘের দূতদের শাটল মিশন। তাঁদের এই ছোটাছুটি দেখে মনে হয়েছে যাবতীয় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার সবটাই যেন ওঁদের। আর যাঁরা সৃষ্টি করেছেন এই সংকট তাঁরাই যেন সবচেয়ে বেশি নির্বিকার, নিরুদ্বেগ এবং যারপরনাই আপসহীন। শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, সেটা দেখার জন্য এখন অতি আশঙ্কায় জাতির অপেক্ষা।
সর্বশেষ বাংলাদেশকে ফের সংবাদ শিরোনামে এনে দিলেন মোহাম্মদ আশরাফুল। দেশের এই ক্রিকেট জিনিয়াস ম্যাচ পাতানোর সম্পৃক্ততার স্বীকারোক্তি দিয়ে যেমন নিজের ক্যারিয়ারের কবর খুঁড়লেন, তেমনই বাংলাদেশের পবিত্র ভূমিকে অপবিত্র করলেন। স্পট ফিক্সিংয়ের মধ্য দিয়ে ম্যাচ গড়াপেটা করে তিনি নিজে অবৈধভাবে টাকা কামিয়েছেন। সেই সঙ্গে অসংখ্য ভক্ত, দেশ ও নিজ ক্রিকেট দলের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। ভাবুন তো, আপনার আবেগ ও ক্রিকেটপ্রেম প্রতারিত হয়েছে আশরাফুলের কারণে। এটা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ, তা তিনি দেশের কয়েকটি জয়ে যত বড় ভূমিকাই রেখে থাকুন না কেন।
নিজের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চেয়ে আশরাফুল জানিয়েছেন, তীব্র অপরাধবোধ থেকেই নাকি তিনি সব কিছু স্বীকার করেছেন। তাঁর বক্তব্য, 'টেস্ট, ওয়ান ডে এবং টি-টোয়েন্টি মিলিয়ে আমার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে আড়াই শর মতো ম্যাচ খেলেছি। এর মধ্যে আমি অল্প কিছু বাজে কাজ করেছি। তা ছাড়া সব সময় সৎ থাকতে চেষ্টা করেছি।' না আশরাফুল, আপনার এই বক্তব্য ঠিক নয়, যৌক্তিকও নয়। একজন মানুষ সৎ তখনই, যখন তিনি শতভাগ সৎ। একজন মানুষ তখনই সত্যবাদী, যখন তিনি শতভাগ সত্যবাদী বলে প্রমাণিত। এখানে ভগ্নাংশ পরিমাণ শঠতা, মিথ্যার জায়গা নেই। সারা জীবনের সুন্দর সব অর্জন নিমেষেই লোপাট হয়ে যায় একটি মাত্র ভুলে, অপরাধে। এমন অজস্র নজির তো আমাদের চোখের সামনেই।
হয়তো নিজেকে রক্ষার আর কোনো সুযোগ নেই জেনে সব কিছু স্বীকার করে নিয়েছেন আশরাফুল কম শাস্তির প্রত্যাশায়। এর পরও তাঁকে অভিনন্দন, ধন্যবাদ। তিনি যে সাহস দেখিয়েছেন এর ছিটেফোঁটাও যদি আমাদের রাজনীতিবিদদের থাকত, তাহলে দেশটার চেহারাই অন্য রকম হয়ে যেত। অপরাধ কবুল করা, দায়িত্ব স্বীকার করার জন্য নৈতিক শক্তির প্রয়োজন। আমাদের রাজনীতিকদের সম্ভবত সে জিনিসটির বড্ড অভাব। এর চর্চাও তাঁরা করেন না। গেল ৪২ বছরেও সেই রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি বাংলাদেশে। অপরাধ, অন্যায়, দুর্নীতির স্বীকারোক্তি তো দূরের কথা, কোনো অনুষ্ঠানে একটা বক্তব্য রেখে চাপে পড়ে গেলেই তা বেমালুম অস্বীকার করে বসেন আমাদের নেতারা। তাঁরা উল্টো তথ্য বিকৃতির অভিযোগ তোলেন গণমাধ্যমের প্রতি। এমনকি অডিও-ভিডিওর মজবুত প্রমাণ থাকার পরও। গেল সপ্তাহেও যেমনটা দেখা গেল মওদুদ আহমদের ক্ষেত্রে। কর্নেল তাহেরের ফাঁসিবিষয়ক রায়ে তাঁর একটি বইয়ের উদ্ধৃতি ও বক্তব্য রেফারেন্স হিসেবে উল্লেখ করেছেন আদালত। একটি সভায় দেওয়া বক্তব্যে তিনি অস্বীকার তো করেছেনই, পারলে নিজের লেখা বইয়ের বক্তব্যও মওদুদ সাহেব উড়িয়ে দিতেন এই বলে যে মুদ্রণ ত্রুটিজনিত কারণে তা হয়ে গেছে। ঠিক এ ক্ষেত্রে স্যালুট জানাতেই হয় আশরাফুলকে।
এ সপ্তাহের আরেকটি অন্যতম বিষয় ছিল বাজেটবিষয়ক জমজমাট আলোচনা আর বিতর্ক। আর বাজেট সপ্তাহ বলে রীতি মেনে বাজারের আঁচটাও ভালোই মালুম করতে পেরেছে সাধারণ মানুষ। সব জিনিসেই বাজেটের প্রভাব। আর এর কারণ মতলবি ব্যবসায়ীদের টুপাইস কামানোর ধান্দা। প্রতিবছরই তাঁরা এই সুযোগ নেন। নির্বাচনের বছর বলে ভোটার ভজানোর একটা ব্যবস্থা সরকার যে করবে, সেটা ছিল পূর্বনির্ধারিত। আর তা অনেকাংশে ঘটেছেও। মানুষকে সাময়িক স্বস্তি দিতে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত দেশের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনাকে খানিকটা অবজ্ঞাও করেছেন। নেই অগ্রাধিকারমূলক কোনো প্রকল্পের ঘোষণা। দেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি কী হবে সে বিষয়ে কোনো দিকনির্দেশনা তিনি দিতে পারেননি, বরং শুনিয়েছেন বিনিয়োগ কমে যাওয়ার শঙ্কা। তাহলে কর্মসংস্থানের কী হবে? শিল্পোৎপাদন বৃদ্ধি ঘটবে কোন জাদুবলে? অথচ দেশজ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি ধরে দেওয়া হয়েছে ৭.২ শতাংশ। সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা, বিভিন্ন খাত ও প্রকল্পে ভর্তুকি ও সুদজনিত ঋণ পরিশোধে বাজেটে যে খরচ ধরা হয়েছে, তা দেশের আর্থিক স্বাস্থ্যের জন্য শুভ নয়। কারণ বাজেটের ৭০ শতাংশ অর্থই বেরিয়ে যাবে এই তিন খাতে। আর নির্বাচনী ওয়াদা থাকায় দুর্নীতিচেষ্টার দায়ে থমকে যাওয়া পদ্মা সেতুর কাজ চলতি বছরই নিজস্ব অর্থে শুরু করার ঘোষণা অবশ্যই রাজনৈতিক। এর নেতিবাচক একটা প্রভাব উন্নয়ন বাজেটে পড়তে বাধ্য। বিভিন্ন পণ্যে শুল্ক রেয়াত আর কর সুবিধার বিস্তৃতির কারণে ঘাটতিকে আতঙ্কের পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে অর্থমন্ত্রী তাঁর বাজেট বক্তৃতাকে মহাজোট সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারের সম্প্রসারিত ডকুমেন্ট করে তুললেন। সংসদে তুমুল হাততালি হলো আর আমাদের বিরোধী দল অধিবেশন কক্ষের বাইরে থেকে যথারীতি বাজেটকে তুলোধুনো করল। প্রতিবছর তাও প্রধান বিরোধী দল একটা ছায়া বাজেট দেয়। কর ব্যবস্থাপনা, উন্নয়ন পরিকল্পনার একটা ছক থাকে তাতে। সরকার গুরুত্ব না দিলেও সমাজের নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ তার থেকে কিছু দিকনির্দেশনা এবং আলোচনার একটা খোরাক পায়। কিন্তু বিরোধী দল এবার সেটা দিতেও ব্যর্থ। তবে সমালোচনা থেমে নেই। বাজেট উচ্চাভিলাষী, বাস্তবায়নের দিকনির্দেশনা নেই, বাজেট একটি সুন্দর বেলুন ইত্যাদি বক্তব্য দিয়ে দেশের প্রধান বিরোধী দলটি তার দায়িত্ব শেষ করেছে। এসব বক্তব্য অন্তঃসারশূন্য এবং রাজনৈতিক। অন্তঃসারশূন্য এই কারণে যে বাজেট কেন দিকনির্দেশনাহীন, কেন উচ্চাভিলাষী, কেন ফাঁপা বেলুন তার সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য-উপাত্ত নেই, প্রতিকারের কোনো পরামর্শ নেই। এসব দেখে দেখে জনগণ ক্লান্ত।
গত কিছুদিনের ঘটনাপ্রবাহ দেখুন- এর বেশির ভাগই ছিল বিশ্বের গণমাধ্যমের শিরোনাম, নয়তো বহুল আলোচিত বিষয়বস্তু। একটি ভবনধসে সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ড এখন বাংলাদেশের। রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে ১৭ দিন পর জীবিত রেশমা উদ্ধার- রূপকথার মতো এ ঘটনাও বিশ্বের শীর্ষ সংবাদ। ২০১৩ সালে প্রতি মাসে গড়ে প্রায় ১০ দিন করে হরতাল- এও রেকর্ড। বর্তমান সংসদের ৯০ শতাংশেরও বেশি অধিবেশনে বিরোধী দল অনুপস্থিত- এটাও সম্ভবত বিশ্ব রেকর্ড। মহাসেনও বড় খবর। এর আগে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের রায়, গণজাগরণ মঞ্চ, সারা দেশে জামায়াত-শিবিরের নারকীয় তাণ্ডব- এর সবই সংবাদ শিরোনাম হয়েছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে।
আর এখন চলছে সংলাপ সংলাপ নাটক। বেশ ক্লাইমেক্স তাতে। এক পক্ষ এগোয় তো অন্য পক্ষ পেছায়। আবার অন্য পক্ষ নরম হয়ে যখন আবেদন-নিবেদন শুরু করে, তো প্রতিপক্ষ তখন ততটাই গরম। এ অবস্থায় দুই পক্ষের মান ভঞ্জনে বা দুই পক্ষকে নরম করতে একের পর এক ছুটে আসতে থাকেন বিশ্ব মোড়লদের প্রতিনিধিরা। এরই মধ্যে আমরা দেখেছি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি ও জাতিসংঘের দূতদের শাটল মিশন। তাঁদের এই ছোটাছুটি দেখে মনে হয়েছে যাবতীয় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার সবটাই যেন ওঁদের। আর যাঁরা সৃষ্টি করেছেন এই সংকট তাঁরাই যেন সবচেয়ে বেশি নির্বিকার, নিরুদ্বেগ এবং যারপরনাই আপসহীন। শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, সেটা দেখার জন্য এখন অতি আশঙ্কায় জাতির অপেক্ষা।
সর্বশেষ বাংলাদেশকে ফের সংবাদ শিরোনামে এনে দিলেন মোহাম্মদ আশরাফুল। দেশের এই ক্রিকেট জিনিয়াস ম্যাচ পাতানোর সম্পৃক্ততার স্বীকারোক্তি দিয়ে যেমন নিজের ক্যারিয়ারের কবর খুঁড়লেন, তেমনই বাংলাদেশের পবিত্র ভূমিকে অপবিত্র করলেন। স্পট ফিক্সিংয়ের মধ্য দিয়ে ম্যাচ গড়াপেটা করে তিনি নিজে অবৈধভাবে টাকা কামিয়েছেন। সেই সঙ্গে অসংখ্য ভক্ত, দেশ ও নিজ ক্রিকেট দলের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। ভাবুন তো, আপনার আবেগ ও ক্রিকেটপ্রেম প্রতারিত হয়েছে আশরাফুলের কারণে। এটা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ, তা তিনি দেশের কয়েকটি জয়ে যত বড় ভূমিকাই রেখে থাকুন না কেন।
নিজের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চেয়ে আশরাফুল জানিয়েছেন, তীব্র অপরাধবোধ থেকেই নাকি তিনি সব কিছু স্বীকার করেছেন। তাঁর বক্তব্য, 'টেস্ট, ওয়ান ডে এবং টি-টোয়েন্টি মিলিয়ে আমার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে আড়াই শর মতো ম্যাচ খেলেছি। এর মধ্যে আমি অল্প কিছু বাজে কাজ করেছি। তা ছাড়া সব সময় সৎ থাকতে চেষ্টা করেছি।' না আশরাফুল, আপনার এই বক্তব্য ঠিক নয়, যৌক্তিকও নয়। একজন মানুষ সৎ তখনই, যখন তিনি শতভাগ সৎ। একজন মানুষ তখনই সত্যবাদী, যখন তিনি শতভাগ সত্যবাদী বলে প্রমাণিত। এখানে ভগ্নাংশ পরিমাণ শঠতা, মিথ্যার জায়গা নেই। সারা জীবনের সুন্দর সব অর্জন নিমেষেই লোপাট হয়ে যায় একটি মাত্র ভুলে, অপরাধে। এমন অজস্র নজির তো আমাদের চোখের সামনেই।
হয়তো নিজেকে রক্ষার আর কোনো সুযোগ নেই জেনে সব কিছু স্বীকার করে নিয়েছেন আশরাফুল কম শাস্তির প্রত্যাশায়। এর পরও তাঁকে অভিনন্দন, ধন্যবাদ। তিনি যে সাহস দেখিয়েছেন এর ছিটেফোঁটাও যদি আমাদের রাজনীতিবিদদের থাকত, তাহলে দেশটার চেহারাই অন্য রকম হয়ে যেত। অপরাধ কবুল করা, দায়িত্ব স্বীকার করার জন্য নৈতিক শক্তির প্রয়োজন। আমাদের রাজনীতিকদের সম্ভবত সে জিনিসটির বড্ড অভাব। এর চর্চাও তাঁরা করেন না। গেল ৪২ বছরেও সেই রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি বাংলাদেশে। অপরাধ, অন্যায়, দুর্নীতির স্বীকারোক্তি তো দূরের কথা, কোনো অনুষ্ঠানে একটা বক্তব্য রেখে চাপে পড়ে গেলেই তা বেমালুম অস্বীকার করে বসেন আমাদের নেতারা। তাঁরা উল্টো তথ্য বিকৃতির অভিযোগ তোলেন গণমাধ্যমের প্রতি। এমনকি অডিও-ভিডিওর মজবুত প্রমাণ থাকার পরও। গেল সপ্তাহেও যেমনটা দেখা গেল মওদুদ আহমদের ক্ষেত্রে। কর্নেল তাহেরের ফাঁসিবিষয়ক রায়ে তাঁর একটি বইয়ের উদ্ধৃতি ও বক্তব্য রেফারেন্স হিসেবে উল্লেখ করেছেন আদালত। একটি সভায় দেওয়া বক্তব্যে তিনি অস্বীকার তো করেছেনই, পারলে নিজের লেখা বইয়ের বক্তব্যও মওদুদ সাহেব উড়িয়ে দিতেন এই বলে যে মুদ্রণ ত্রুটিজনিত কারণে তা হয়ে গেছে। ঠিক এ ক্ষেত্রে স্যালুট জানাতেই হয় আশরাফুলকে।
এ সপ্তাহের আরেকটি অন্যতম বিষয় ছিল বাজেটবিষয়ক জমজমাট আলোচনা আর বিতর্ক। আর বাজেট সপ্তাহ বলে রীতি মেনে বাজারের আঁচটাও ভালোই মালুম করতে পেরেছে সাধারণ মানুষ। সব জিনিসেই বাজেটের প্রভাব। আর এর কারণ মতলবি ব্যবসায়ীদের টুপাইস কামানোর ধান্দা। প্রতিবছরই তাঁরা এই সুযোগ নেন। নির্বাচনের বছর বলে ভোটার ভজানোর একটা ব্যবস্থা সরকার যে করবে, সেটা ছিল পূর্বনির্ধারিত। আর তা অনেকাংশে ঘটেছেও। মানুষকে সাময়িক স্বস্তি দিতে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত দেশের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনাকে খানিকটা অবজ্ঞাও করেছেন। নেই অগ্রাধিকারমূলক কোনো প্রকল্পের ঘোষণা। দেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি কী হবে সে বিষয়ে কোনো দিকনির্দেশনা তিনি দিতে পারেননি, বরং শুনিয়েছেন বিনিয়োগ কমে যাওয়ার শঙ্কা। তাহলে কর্মসংস্থানের কী হবে? শিল্পোৎপাদন বৃদ্ধি ঘটবে কোন জাদুবলে? অথচ দেশজ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি ধরে দেওয়া হয়েছে ৭.২ শতাংশ। সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা, বিভিন্ন খাত ও প্রকল্পে ভর্তুকি ও সুদজনিত ঋণ পরিশোধে বাজেটে যে খরচ ধরা হয়েছে, তা দেশের আর্থিক স্বাস্থ্যের জন্য শুভ নয়। কারণ বাজেটের ৭০ শতাংশ অর্থই বেরিয়ে যাবে এই তিন খাতে। আর নির্বাচনী ওয়াদা থাকায় দুর্নীতিচেষ্টার দায়ে থমকে যাওয়া পদ্মা সেতুর কাজ চলতি বছরই নিজস্ব অর্থে শুরু করার ঘোষণা অবশ্যই রাজনৈতিক। এর নেতিবাচক একটা প্রভাব উন্নয়ন বাজেটে পড়তে বাধ্য। বিভিন্ন পণ্যে শুল্ক রেয়াত আর কর সুবিধার বিস্তৃতির কারণে ঘাটতিকে আতঙ্কের পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে অর্থমন্ত্রী তাঁর বাজেট বক্তৃতাকে মহাজোট সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারের সম্প্রসারিত ডকুমেন্ট করে তুললেন। সংসদে তুমুল হাততালি হলো আর আমাদের বিরোধী দল অধিবেশন কক্ষের বাইরে থেকে যথারীতি বাজেটকে তুলোধুনো করল। প্রতিবছর তাও প্রধান বিরোধী দল একটা ছায়া বাজেট দেয়। কর ব্যবস্থাপনা, উন্নয়ন পরিকল্পনার একটা ছক থাকে তাতে। সরকার গুরুত্ব না দিলেও সমাজের নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ তার থেকে কিছু দিকনির্দেশনা এবং আলোচনার একটা খোরাক পায়। কিন্তু বিরোধী দল এবার সেটা দিতেও ব্যর্থ। তবে সমালোচনা থেমে নেই। বাজেট উচ্চাভিলাষী, বাস্তবায়নের দিকনির্দেশনা নেই, বাজেট একটি সুন্দর বেলুন ইত্যাদি বক্তব্য দিয়ে দেশের প্রধান বিরোধী দলটি তার দায়িত্ব শেষ করেছে। এসব বক্তব্য অন্তঃসারশূন্য এবং রাজনৈতিক। অন্তঃসারশূন্য এই কারণে যে বাজেট কেন দিকনির্দেশনাহীন, কেন উচ্চাভিলাষী, কেন ফাঁপা বেলুন তার সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য-উপাত্ত নেই, প্রতিকারের কোনো পরামর্শ নেই। এসব দেখে দেখে জনগণ ক্লান্ত।
No comments