সরকারি দলের রাজনীতি by মেজর (অব.) সুধীর সাহা
বাংলাদেশের রাজনীতির বর্তমানকালের সবচেয়ে
আলোড়ন সৃষ্টিকারী অধ্যায় রাজনীতিতে পরাক্রমশালী তিন মহিলার অবস্থান। যে
দেশে মহিলাদের অধিকার হরণের আন্দোলনে সোচ্চার আন্দোলন হয়, সেই দেশে
প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী নেত্রী এবং স্পিকার- তিনজনই মহিলা।
এই
তিন মহিলাই রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকা অবস্থায় হেফাজতে
ইসলাম নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণের বিপক্ষে মাঠ গরম করছে। হেফাজতে ইসলামের ১৩
দফার দুই দফাই সরাসরিভাবে এই তিন ক্ষমতাশালী মহিলার কাজের বিরুদ্ধাচারণ
করছে। তার পরও এই তিন শক্তিধর মহিলা আছেন, আবার হেফাজতে ইসলামের আন্দোলনও
আছে। পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে বর্তমান সময়ে দেশের প্রধান দুই দলের নেত্রী
মহিলা, এমনটা নেই। বাংলাদেশে তা আছে এবং গত কয়েক দশক ধরেই তা চলে আসছে।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপি গত কয়েক দশক ধরেই শুধু নয়, বরং সামনের দিনগুলোতেও শেখ
হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়ার কোনো বিকল্প চিন্তা করার রাজনৈতিক পরিকল্পনায়
নেই। এই দুই দলে দুই মহিলা নেত্রী একচ্ছত্রভাবে ক্ষমতার অধিকারী এবং তাঁদের
বিকল্প কোনো নেতৃত্ব আজ অবধি গড়ে ওঠেনি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে
আওয়ামী লীগের জন্ম হলেও মূলত শেখ হাসিনা দলের নেতৃত্বে আসেন বঙ্গবন্ধুর
মর্মান্তিক মৃত্যুর পর। পিতার মৃত্যুর পর অনেক বছরই শেখ হাসিনা ও শেখ
রেহানা দেশের বাইরে অবস্থান করেন। তখন আওয়ামী লীগকে খুব খারাপ সময় পার করতে
হয়। বিএনপিকে মোকাবিলা করার উদ্দেশ্যে একসময় আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব
বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনে এবং আওয়ামী লীগের
নেতৃত্ব প্রদান করে। তারপর আর শেখ হাসিনাকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। আওয়ামী
লীগ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে তিন-চতুর্থাংশ আসন নিয়ে ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসে।
অন্যদিকে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি ১৯৯১ ও ২০০১ সালের নির্বাচনে
জয়ী হয়।
২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রায় তিন-চতুর্থাংশ আসন নিয়ে সরকার গঠন করে। আওয়ামী লীগ সরকার বেশ কিছু ভালো কাজ করেছে গত চার বছরে। তারা নারীনীতি ও শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছে; প্রাথমিক পর্যায়ে বিনা মূল্যে বই সরবরাহ করার মতো চমৎকার কাজ করেছে; কৃষিক্ষেত্রে বৈপ্লবিক উন্নতি সাধন করেছে, অর্থনীতিতে একটি সুবিধাজনক অবস্থায় দেশকে নিয়ে যেতে পেরেছে।
শুরুতেই সরকার হোঁচট খেয়েছে শেয়ার মার্কেট কেলেঙ্কারিতে। সরকারের কোনো লোককে ছাড় দিতে গিয়ে তারা বিরোধী রাজনীতির লোককেও ছাড় দিতে বাধ্য হয়। লাখ লাখ জামানতকারী যুবককে পথে বসানোর জন্য যারা দায়ী ছিল, অদৃশ্য কারণে সরকার তাদের বিরুদ্ধে কোনো আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থ হয়। এটি ছিল বর্তমান সরকার ও সরকারপ্রধানের প্রথম বড় একটি ব্যর্থতা। মানুষ এই ব্যর্থতাকে ভুলে যাওয়ার আগেই সরকার আরো একটি বড় অর্থ কেলেঙ্কারির দোষে পড়ে যায়। সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেঙ্কারি সরকারকে নিন্দিত করে। হলমার্কের লোকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেও এই অর্থ লোপাটের সঙ্গে সরকারের উচ্চ মহলের কেউ জড়িত কি না সে ব্যাপারে সরকার ও সরকারপ্রধান নীরব ভূমিকা পালন করে। ডেসটিনি কেলেঙ্কারি ছিল সরকারের তৃতীয় হোঁচট। সেখানেও সরকার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের তৎপরতা দেখাতে ব্যর্থ হয়। কুইক রেন্টালে বিদ্যুৎ প্রকল্পটিও বর্তমান সরকারের জন্য এক নাজুক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে কুইক রেন্টাল নিয়ে কোনো আদালতের শরণাপন্ন হওয়া যাবে না- সংসদে এমন একটি আইন পাস হওয়ার কারণে এ নিয়ে প্রশ্ন করার সুযোগ করে দিয়েছে সরকার। এই প্রকল্পে বিদ্যুৎ অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলেও ঠিক ততটা উন্নতি হয়নি, যতটা সরকার আশা করেছিল। বরং উল্টোভাবে কুইক রেন্টালের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের অতিরিক্ত অর্থপ্রাপ্তি ও সরকারি অর্থের অপচয়ের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
সরকার তথা আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে অনেকাংশেই গত চার বছরে। সরকার গত চার বছরে পুরো দেশটাকেই রাজনৈতিক দলীয়করণের আবর্তে নিয়ে এসেছে। মন্ত্রী, মন্ত্রণালয়, সংসদ সদস্য, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী- অনেকের মধ্যেই দুর্নীতির প্রবণতা লক্ষ করা গেছে। সুশাসন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সরকার কোনো কার্যকর ব্যবস্থাই গ্রহণ করতে সমর্থ হয়নি। মন্ত্রিসভায় স্থান পাননি অনেক যোগ্য ও পরীক্ষিত আওয়ামী লীগার। অধিকতর কম যোগ্যতাসম্পন্ন নতুন মুখ ও বাম দল থেকে আগত নব্য আওয়ামী লীগারদের নিয়ে একটি চমকের মন্ত্রিসভা উপহার দিয়েছিলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। ফলে মন্ত্রী ও দল দুটি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হয়েছে এবং এর ফলে আওয়ামী লীগের সফল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতে পারেনি। দলের বহু দিনের অভিজ্ঞ প্রথম ও দ্বিতীয় সারির অনেক নেতাকে নিষ্ক্রিয় রাখার ফলে দলের মধ্যে এক ধরনের রাজনৈতিক স্থবিরতার সৃষ্টি হয়েছে। ফলে ত্যাগী কর্মীর পরিবর্তে সামনে এগিয়ে এসেছে লোভী কর্মীরা।
ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীকে স্পিকার নির্বাচনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর ভুল নির্বাচনের শেষ ধাপটা শেষ করেছেন অধুনা। যেখানে সংসদীয় অভিজ্ঞতা, প্রাজ্ঞতা, দূরদর্শিতা আর সব দলের কাছে গ্রহণযোগ্যতার বিষয়গুলো স্পিকার নির্বাচনের ক্ষেত্রে মূল বিবেচনার বিষয় হওয়া প্রয়োজন ছিল, সেখানে মহিলা সংরক্ষিত আসনের নব্য একজন সংসদ সদস্যকে স্পিকার নির্বাচন করার মধ্যে চমক থাকতে পারে; কিন্তু তাতে রাজনৈতিক সঠিক সিদ্ধান্তের কোনো চিহ্ন নেই।
লেখক : কলামিস্ট
২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রায় তিন-চতুর্থাংশ আসন নিয়ে সরকার গঠন করে। আওয়ামী লীগ সরকার বেশ কিছু ভালো কাজ করেছে গত চার বছরে। তারা নারীনীতি ও শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছে; প্রাথমিক পর্যায়ে বিনা মূল্যে বই সরবরাহ করার মতো চমৎকার কাজ করেছে; কৃষিক্ষেত্রে বৈপ্লবিক উন্নতি সাধন করেছে, অর্থনীতিতে একটি সুবিধাজনক অবস্থায় দেশকে নিয়ে যেতে পেরেছে।
শুরুতেই সরকার হোঁচট খেয়েছে শেয়ার মার্কেট কেলেঙ্কারিতে। সরকারের কোনো লোককে ছাড় দিতে গিয়ে তারা বিরোধী রাজনীতির লোককেও ছাড় দিতে বাধ্য হয়। লাখ লাখ জামানতকারী যুবককে পথে বসানোর জন্য যারা দায়ী ছিল, অদৃশ্য কারণে সরকার তাদের বিরুদ্ধে কোনো আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থ হয়। এটি ছিল বর্তমান সরকার ও সরকারপ্রধানের প্রথম বড় একটি ব্যর্থতা। মানুষ এই ব্যর্থতাকে ভুলে যাওয়ার আগেই সরকার আরো একটি বড় অর্থ কেলেঙ্কারির দোষে পড়ে যায়। সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেঙ্কারি সরকারকে নিন্দিত করে। হলমার্কের লোকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেও এই অর্থ লোপাটের সঙ্গে সরকারের উচ্চ মহলের কেউ জড়িত কি না সে ব্যাপারে সরকার ও সরকারপ্রধান নীরব ভূমিকা পালন করে। ডেসটিনি কেলেঙ্কারি ছিল সরকারের তৃতীয় হোঁচট। সেখানেও সরকার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের তৎপরতা দেখাতে ব্যর্থ হয়। কুইক রেন্টালে বিদ্যুৎ প্রকল্পটিও বর্তমান সরকারের জন্য এক নাজুক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে কুইক রেন্টাল নিয়ে কোনো আদালতের শরণাপন্ন হওয়া যাবে না- সংসদে এমন একটি আইন পাস হওয়ার কারণে এ নিয়ে প্রশ্ন করার সুযোগ করে দিয়েছে সরকার। এই প্রকল্পে বিদ্যুৎ অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলেও ঠিক ততটা উন্নতি হয়নি, যতটা সরকার আশা করেছিল। বরং উল্টোভাবে কুইক রেন্টালের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের অতিরিক্ত অর্থপ্রাপ্তি ও সরকারি অর্থের অপচয়ের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
সরকার তথা আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে অনেকাংশেই গত চার বছরে। সরকার গত চার বছরে পুরো দেশটাকেই রাজনৈতিক দলীয়করণের আবর্তে নিয়ে এসেছে। মন্ত্রী, মন্ত্রণালয়, সংসদ সদস্য, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী- অনেকের মধ্যেই দুর্নীতির প্রবণতা লক্ষ করা গেছে। সুশাসন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সরকার কোনো কার্যকর ব্যবস্থাই গ্রহণ করতে সমর্থ হয়নি। মন্ত্রিসভায় স্থান পাননি অনেক যোগ্য ও পরীক্ষিত আওয়ামী লীগার। অধিকতর কম যোগ্যতাসম্পন্ন নতুন মুখ ও বাম দল থেকে আগত নব্য আওয়ামী লীগারদের নিয়ে একটি চমকের মন্ত্রিসভা উপহার দিয়েছিলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। ফলে মন্ত্রী ও দল দুটি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হয়েছে এবং এর ফলে আওয়ামী লীগের সফল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতে পারেনি। দলের বহু দিনের অভিজ্ঞ প্রথম ও দ্বিতীয় সারির অনেক নেতাকে নিষ্ক্রিয় রাখার ফলে দলের মধ্যে এক ধরনের রাজনৈতিক স্থবিরতার সৃষ্টি হয়েছে। ফলে ত্যাগী কর্মীর পরিবর্তে সামনে এগিয়ে এসেছে লোভী কর্মীরা।
ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীকে স্পিকার নির্বাচনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর ভুল নির্বাচনের শেষ ধাপটা শেষ করেছেন অধুনা। যেখানে সংসদীয় অভিজ্ঞতা, প্রাজ্ঞতা, দূরদর্শিতা আর সব দলের কাছে গ্রহণযোগ্যতার বিষয়গুলো স্পিকার নির্বাচনের ক্ষেত্রে মূল বিবেচনার বিষয় হওয়া প্রয়োজন ছিল, সেখানে মহিলা সংরক্ষিত আসনের নব্য একজন সংসদ সদস্যকে স্পিকার নির্বাচন করার মধ্যে চমক থাকতে পারে; কিন্তু তাতে রাজনৈতিক সঠিক সিদ্ধান্তের কোনো চিহ্ন নেই।
লেখক : কলামিস্ট
No comments