বহে কাল নিরবধি-পরিহাসের আইন by এম আবদুল হাফিজ
সম্প্রতি সন্ত্রাসবিরোধী আইন সংশোধিত হয়ে
সংসদে পাস হয়েছে। এটা জনগণের জীবন ও সম্পদ রক্ষার্থে বিধায় জনগণের কল্যাণে
করা হয়েছে বলে সরকারপক্ষ আইনটির সাফাই গেয়েছে; কালো আইন আখ্যা দিয়ে
বিরোধিতা করে বিরোধী দল আইনটি কণ্ঠভোটে গৃহীত হওয়ার সময় ওয়াকআউট করেছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ আইনটির উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে
বলেছেন যে বিরোধী দলকে আরো দমন-পীড়ন করার জন্যই আইনটি প্রণীত হলো।
এ দেশে আইনের কদাচিৎ কোনো অভাব আছে? বিশেষ করে সরকারপক্ষ সংসদে আকসার আইন প্রণয়ন করে থাকে, যার বেশির ভাগেরই প্রয়োগ নেই। বিশেষ করে সন্ত্রাসবিরোধী আইন প্রণয়নে শুধু এখন নয়, অতীতেও সরকারগুলোর প্রবণতা ছিল। অনেক ক্ষেত্রে এ কারণে সংবিধানও সংশোধন করা হয়েছে। স্বাধীনতার অব্যবহিত পর শেখ মুজিবুর রহমান কার্যত এ দেশের মুকুটহীন রাজা। সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ছিল স্বাধীনতাসংগ্রামের অন্যতম লক্ষ্য। সেই সংসদে ছিল বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগের একচ্ছত্র প্রাধান্য। তবু শেখ মুজিব তাঁর ক্ষমতা নিয়ে আশ্বস্ত হতে পারেননি। জনপ্রিয়তার তুঙ্গে অবস্থান করেও তিনি ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করতে একাধিক আইন প্রণয়ন করেছেন। যখন তাঁর মুখনিসৃত যেকোনো কথাই আইনের মর্যাদা পেত, তিনি দেশে প্রেসিডেনশিয়াল শাসনপদ্ধতির প্রবর্তন করেন।
বলাই বাহুল্য, এই পদ্ধতি আমাদের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ায় পরবর্তীকালে তা বাতিল করতে আওয়ামী লীগসহ বিরোধী দলগুলোকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল। ইত্যবসরে আওয়ামী লীগবিরোধী শক্তিগুলোই এর সুফল ভোগ করেছিল। শুধু এখানেই নয়, আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত অবস্থায় তাদেরই প্রণীত আইনের শিকার হয়েছিল। কিন্তু মনে হয় না যে দলটি তাদের অতীত অভিজ্ঞতা থেকে কোনো শিক্ষা নিয়েছে। নিয়ে থাকলে নিজেরাই ভবিষ্যতে ফাঁদে পড়ার জন্য এসব আইন প্রণয়নে উৎসাহী হতো না।
শেখ হাসিনার প্রথম মেয়াদের সরকারে আওয়ামী লীগ বেশ কিছু সন্ত্রাসবিরোধী এবং মূল নিরাপত্তাসংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করেছিল। বিরোধী দলকে দমনের উদ্দেশ্যেই সেগুলো প্রণীত হলেও আওয়ামী লীগকেই পরবর্তীকালে জোট সরকারের আমলে সেগুলোর প্রতিঘাত মোকাবিলা করতে হয়েছিল। আসলে এমন আইন প্রণেতাদের এটা থেকে ফায়দা উঠাতে হলে সব সময়ই তাদের ক্ষমতায় থাকতে হবে। তার সম্ভাবনা আদৌ বাস্তবসম্মত কি না ক্ষমতার মৌতাতে তাও তাদের ভেবে দেখার ফুরসত হয়নি। সে জন্যই এমন উদ্দেশ্যে এমন আইন প্রণেতাদের বারবার তাঁদের নিজের পাতা ফাঁদে পড়তে হয়েছে। ক্ষমতার পালাবদলে খুব একটা ব্যত্যয় না ঘটলে ক্ষমতা তার খেলাড়িদের মধ্যে বিবর্তিত হতে থাকে।
এই পর্যায়ে আওয়ামী লীগ তার অতীতের ভাগ্য বিপর্যয়ের কথা ভুলে গিয়েছে। আমাদের মতো সে সময়ের আওয়ামী ভক্তদের এখনো মনে আছে যে ক্ষমতা কি নিদারুণভাবে পদ্ম পাতায় শিশির বিন্দুর মতোই অস্থিতিশীল।
আইনের অপপ্রয়োগ করে বা আদালত এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে প্রভাবান্বিত করে প্রতিপক্ষ ঘায়েল করতে পারার মধ্যে কোনো কৃতিত্ব নেই। পাকিস্তানিরাও এসব করত আমাদের ওপর। সে জন্যই তো সেই আইন অপপ্রয়োগের অপরাজনীতি থেকে মুক্তি চেয়েছিলাম আমরা। দুঃখজনক যে সেটা ঘটেনি। বরং ক্ষমতার দণ্ড ধারণকারীরা আরো ক্রূর এবং অমানবিকভাবে অস্তিত্বে এনেছে, যদিও সেই ক্রূররা এবং অমানবিকতা ব্যতিরেকেই রাজনীতি হতে পারে, মানুষে মানুষে মানবিক সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে।
বিয়ালি্লশ বছর আগে আমরা যা ছিলাম বা যেখানে ছিলাম সেখান থেকে সময়ের পরিসরে আমরা অনেক দূর এগিয়ে এসেছি। আমাদের এখন পরিপক্বতা অর্জনের সময়। তবু নির্যাতন, হয়রানি ও প্রতিপক্ষকে পেরেশান করার মধ্যেই ক্ষমতাসীনদের এক প্রকার পাশবিক আনন্দ, যা কাটিয়ে উঠতে না পারলে আমাদের গণতান্ত্রিক স্থাপত্য অবশ্যই স্থায়িত্বও পাবে না।
ত্রাস, ভীতি-শঙ্কা ও নিরাপত্তাহীনতা এক প্রকার মনস্তাত্তি্বক অবস্থা। আইন দিয়ে অন্যকে আইনের ফাঁদে ফেলে তা দূর করা যায় না। সে জন্য চাই নিরাপত্তাহীনতার উৎস সন্ধান। সন্ধান করতে হবে সমাজের অসংখ্য অসংগতি, ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও বৈষম্য, যা সন্ত্রাসকে উসকে দেয় এবং নিরাপত্তাহীনতাকে জিইয়ে রাখে। এ অসংগতিগুলো দূরীকরণ কষ্টসাধ্য, সময়সাপেক্ষ। সেটা করতে গেলে ভাগ্যবানদের অনেক সুবিধা-সুযোগকে কাটছাঁট করতে হবে, যাতে তাদের অনীহা। অন্যের ভালো হওয়াতে তাদের হয়তো কোনো আপত্তি নেই, কিন্তু সে জন্য সামান্যতম ত্যাগ-তিতীক্ষায়ও তাদের মুখ ভারী। শক্তি প্রয়োগ বা প্রতিপক্ষকে বেকায়দায় রেখে সব কিছু সব সময়ের জন্য অর্জিত হয় না। সে জন্য ক্ষমতাকে সব সময়ের জন্য ধরে রাখার শর্তটিও বাস্তবে আয়ত্তে থাকে না। যেকোনো একটি রাজনৈতিক দল প্রতিপক্ষকে কোণঠাসা করে রাখার মানসে কি সব সময় ক্ষমতায় থাকতে পারবে? নাকি তা বাস্তবসম্মত। যদি বাস্তবসম্মত না হয়, তাহলে তো আজকের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ওপরই নেমে আসবে তাদের ঢের অপকৌশলগুলো।
আমরা সবাই সন্ত্রাসমুক্ত নিরাপদ দেশ ও সমাজ চাই। তার জন্য যে পারিপার্শ্বিক, সমাজকাঠামো এবং পারস্পরিক সহমর্মিতা ও সহযোগিতার প্রয়োজন, তার বিনির্মাণে আত্ম নিয়োগ করি। হুমকি-ধমকি, দাম্ভিক আচরণ ও উচ্চারণে এর একটার পর একটা অপকৌশলের জাল রচনায় তিক্ততাই বাড়ে। আমাদের সবারই অন্তর্নিহিত শক্তিরই ক্ষয় হয়, অর্জনের ঝুড়ি থাকে শূন্য। আসুন, আমরা এমন অপপ্রয়াসের গোলকধাঁধা থেকে বেরিয়ে আসি। তা না হলে এমনকি আমাদের আগামী প্রজন্মও আমাদের অবমূল্যায়ন করবে। এতদসত্ত্বেও যে আমরা তাদের জন্য একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের অভ্যুদয় ঘটিয়েছি।
লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, বিআইআইএসএস
এ দেশে আইনের কদাচিৎ কোনো অভাব আছে? বিশেষ করে সরকারপক্ষ সংসদে আকসার আইন প্রণয়ন করে থাকে, যার বেশির ভাগেরই প্রয়োগ নেই। বিশেষ করে সন্ত্রাসবিরোধী আইন প্রণয়নে শুধু এখন নয়, অতীতেও সরকারগুলোর প্রবণতা ছিল। অনেক ক্ষেত্রে এ কারণে সংবিধানও সংশোধন করা হয়েছে। স্বাধীনতার অব্যবহিত পর শেখ মুজিবুর রহমান কার্যত এ দেশের মুকুটহীন রাজা। সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ছিল স্বাধীনতাসংগ্রামের অন্যতম লক্ষ্য। সেই সংসদে ছিল বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগের একচ্ছত্র প্রাধান্য। তবু শেখ মুজিব তাঁর ক্ষমতা নিয়ে আশ্বস্ত হতে পারেননি। জনপ্রিয়তার তুঙ্গে অবস্থান করেও তিনি ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করতে একাধিক আইন প্রণয়ন করেছেন। যখন তাঁর মুখনিসৃত যেকোনো কথাই আইনের মর্যাদা পেত, তিনি দেশে প্রেসিডেনশিয়াল শাসনপদ্ধতির প্রবর্তন করেন।
বলাই বাহুল্য, এই পদ্ধতি আমাদের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ায় পরবর্তীকালে তা বাতিল করতে আওয়ামী লীগসহ বিরোধী দলগুলোকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল। ইত্যবসরে আওয়ামী লীগবিরোধী শক্তিগুলোই এর সুফল ভোগ করেছিল। শুধু এখানেই নয়, আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত অবস্থায় তাদেরই প্রণীত আইনের শিকার হয়েছিল। কিন্তু মনে হয় না যে দলটি তাদের অতীত অভিজ্ঞতা থেকে কোনো শিক্ষা নিয়েছে। নিয়ে থাকলে নিজেরাই ভবিষ্যতে ফাঁদে পড়ার জন্য এসব আইন প্রণয়নে উৎসাহী হতো না।
শেখ হাসিনার প্রথম মেয়াদের সরকারে আওয়ামী লীগ বেশ কিছু সন্ত্রাসবিরোধী এবং মূল নিরাপত্তাসংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করেছিল। বিরোধী দলকে দমনের উদ্দেশ্যেই সেগুলো প্রণীত হলেও আওয়ামী লীগকেই পরবর্তীকালে জোট সরকারের আমলে সেগুলোর প্রতিঘাত মোকাবিলা করতে হয়েছিল। আসলে এমন আইন প্রণেতাদের এটা থেকে ফায়দা উঠাতে হলে সব সময়ই তাদের ক্ষমতায় থাকতে হবে। তার সম্ভাবনা আদৌ বাস্তবসম্মত কি না ক্ষমতার মৌতাতে তাও তাদের ভেবে দেখার ফুরসত হয়নি। সে জন্যই এমন উদ্দেশ্যে এমন আইন প্রণেতাদের বারবার তাঁদের নিজের পাতা ফাঁদে পড়তে হয়েছে। ক্ষমতার পালাবদলে খুব একটা ব্যত্যয় না ঘটলে ক্ষমতা তার খেলাড়িদের মধ্যে বিবর্তিত হতে থাকে।
এই পর্যায়ে আওয়ামী লীগ তার অতীতের ভাগ্য বিপর্যয়ের কথা ভুলে গিয়েছে। আমাদের মতো সে সময়ের আওয়ামী ভক্তদের এখনো মনে আছে যে ক্ষমতা কি নিদারুণভাবে পদ্ম পাতায় শিশির বিন্দুর মতোই অস্থিতিশীল।
আইনের অপপ্রয়োগ করে বা আদালত এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে প্রভাবান্বিত করে প্রতিপক্ষ ঘায়েল করতে পারার মধ্যে কোনো কৃতিত্ব নেই। পাকিস্তানিরাও এসব করত আমাদের ওপর। সে জন্যই তো সেই আইন অপপ্রয়োগের অপরাজনীতি থেকে মুক্তি চেয়েছিলাম আমরা। দুঃখজনক যে সেটা ঘটেনি। বরং ক্ষমতার দণ্ড ধারণকারীরা আরো ক্রূর এবং অমানবিকভাবে অস্তিত্বে এনেছে, যদিও সেই ক্রূররা এবং অমানবিকতা ব্যতিরেকেই রাজনীতি হতে পারে, মানুষে মানুষে মানবিক সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে।
বিয়ালি্লশ বছর আগে আমরা যা ছিলাম বা যেখানে ছিলাম সেখান থেকে সময়ের পরিসরে আমরা অনেক দূর এগিয়ে এসেছি। আমাদের এখন পরিপক্বতা অর্জনের সময়। তবু নির্যাতন, হয়রানি ও প্রতিপক্ষকে পেরেশান করার মধ্যেই ক্ষমতাসীনদের এক প্রকার পাশবিক আনন্দ, যা কাটিয়ে উঠতে না পারলে আমাদের গণতান্ত্রিক স্থাপত্য অবশ্যই স্থায়িত্বও পাবে না।
ত্রাস, ভীতি-শঙ্কা ও নিরাপত্তাহীনতা এক প্রকার মনস্তাত্তি্বক অবস্থা। আইন দিয়ে অন্যকে আইনের ফাঁদে ফেলে তা দূর করা যায় না। সে জন্য চাই নিরাপত্তাহীনতার উৎস সন্ধান। সন্ধান করতে হবে সমাজের অসংখ্য অসংগতি, ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও বৈষম্য, যা সন্ত্রাসকে উসকে দেয় এবং নিরাপত্তাহীনতাকে জিইয়ে রাখে। এ অসংগতিগুলো দূরীকরণ কষ্টসাধ্য, সময়সাপেক্ষ। সেটা করতে গেলে ভাগ্যবানদের অনেক সুবিধা-সুযোগকে কাটছাঁট করতে হবে, যাতে তাদের অনীহা। অন্যের ভালো হওয়াতে তাদের হয়তো কোনো আপত্তি নেই, কিন্তু সে জন্য সামান্যতম ত্যাগ-তিতীক্ষায়ও তাদের মুখ ভারী। শক্তি প্রয়োগ বা প্রতিপক্ষকে বেকায়দায় রেখে সব কিছু সব সময়ের জন্য অর্জিত হয় না। সে জন্য ক্ষমতাকে সব সময়ের জন্য ধরে রাখার শর্তটিও বাস্তবে আয়ত্তে থাকে না। যেকোনো একটি রাজনৈতিক দল প্রতিপক্ষকে কোণঠাসা করে রাখার মানসে কি সব সময় ক্ষমতায় থাকতে পারবে? নাকি তা বাস্তবসম্মত। যদি বাস্তবসম্মত না হয়, তাহলে তো আজকের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ওপরই নেমে আসবে তাদের ঢের অপকৌশলগুলো।
আমরা সবাই সন্ত্রাসমুক্ত নিরাপদ দেশ ও সমাজ চাই। তার জন্য যে পারিপার্শ্বিক, সমাজকাঠামো এবং পারস্পরিক সহমর্মিতা ও সহযোগিতার প্রয়োজন, তার বিনির্মাণে আত্ম নিয়োগ করি। হুমকি-ধমকি, দাম্ভিক আচরণ ও উচ্চারণে এর একটার পর একটা অপকৌশলের জাল রচনায় তিক্ততাই বাড়ে। আমাদের সবারই অন্তর্নিহিত শক্তিরই ক্ষয় হয়, অর্জনের ঝুড়ি থাকে শূন্য। আসুন, আমরা এমন অপপ্রয়াসের গোলকধাঁধা থেকে বেরিয়ে আসি। তা না হলে এমনকি আমাদের আগামী প্রজন্মও আমাদের অবমূল্যায়ন করবে। এতদসত্ত্বেও যে আমরা তাদের জন্য একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের অভ্যুদয় ঘটিয়েছি।
লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, বিআইআইএসএস
No comments