সাদাকালো-সিটি নির্বাচন ও জাতীয় রাজনীতি by আহমদ রফিক
চার সিটি করপোরেশনের নির্বাচনী ফলাফল
প্রকাশের পর দেশজুড়ে তুলকালাম- যেন একটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে।
কাগজগুলোতে নানা মাত্রায় জয়-পরাজয়ের খবর, পক্ষ-বিপক্ষের প্রতিক্রিয়া আর সব
খবর ছাপিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছে শুধু ভোটাররাই নন, আমাদের শিক্ষিত শ্রেণীও কেমন
ভোটপাগল।
এর মধ্যে সম্ভাব্য আতঙ্ক পেরিয়ে স্বস্তির কারণ
নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে সহিংসতার প্রকাশ ঘটেনি। এক দিন আগে একটি কলামে
লিখেছিলাম, সুষ্ঠু নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিয়ে পরাজিত প্রার্থী যেন
গণতান্ত্রিক মনোভাবের পরিচয় দেন, আর বিজয়ী যেন উল্লাসে অসংযমের প্রকাশ না
ঘটান। দেখে স্বস্তি বোধ করছি যে বিজয়ী-বিজিত পরস্পরকে আলিঙ্গন করছেন।
রাজনীতির এই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিই তো সবার কাম্য। আশা করব এ ধারার বিস্তার
ঘটুক।
এই সুরে, সৌহার্দ্যের পরিবেশে লেখাটি শেষ করতে পারলে খুশি হতাম। কিন্তু আষাঢ়ের বৃষ্টিহীন গ্রীষ্মসম ভরদুপুরে আমার এক রাজনীতি-মনষ্ক বন্ধু দূরভাষে উত্তেজিত কণ্ঠে বলতে থাকেন 'চার করপোরেশনের ফলাফল তো জাতীয় সাধারণ নির্বাচনের আগাম ঘোষণা দিচ্ছে। আগে ছিল বিএনপি-জামায়াত, এখন সেখানে যুক্ত হয়েছে হেফাজতে ইসলাম- আগামীতে অবস্থা কী দাঁড়াবে অনুমান করতে পারেন? অন্যদিকে গুজরাতি বর্বরতার নায়ক মোদির ভয়ংকর হলুদ ছায়া, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার খায়েশ, পরিস্থিতি প্রচণ্ডভাবে কংগ্রেস জোটবিরোধী- ভাবতে পারছেন, কী হতে যাচ্ছে। তালেবানি পাকিস্তানকে আমি হিসেবেই আনি না- তার পরও বাংলাদেশে পাকি-ভূতের ছায়া! ধর্মীয় রাজনীতির ব্যাপক আবির্ভাব।
তাকে আশ্বস্ত করে দারুণ নিদাঘে মাথা ঠাণ্ডা করে বিশ্রাম নিতে বলি। এতটা না হলেও প্রায় অনুরূপ আশঙ্কা প্রকাশ করেন আরো দুজন মধ্যবয়সী একই দিনে অর্থাৎ আষাঢ়স্য তৃতীয় দিবসে। বলেন, 'কী যে হবে আগামী নির্বাচনে ভেবে কূল-কিনারা পাচ্ছি না।' কাছাকাছি শিরিষ ছায়ার তলে দিবা বিশ্রামে ভগিনীসম কবি ক্ষুব্ধকণ্ঠে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেন : 'এমনই তো হওয়ার কথা।' আত্মপ্রসাদের পরিণাম এমনই হয়। আমরা ভুলেছি একাত্তর, ভুলেছি জামায়াত-বিএনপির গত মেয়াদের সহিংসতা, সংখ্যালঘুর ওপর হামলা! কদিন আগের হেফাজতি কাণ্ড।
প্রতিক্রিয়ার উদ্ধৃতি না বাড়িয়ে শুধু সাংবাদিক গাফ্ফার চৌধুরীর তাৎপর্যপূর্ণ শিরোনামটিই উদ্ধার করি 'এই পরাজয় প্রয়োজন ছিল'। তিনি অবশ্য কথাটা ইতিবাচক অর্থে ব্যবহার করেছেন, তাঁর আলোচনায় যা খুবই স্পষ্ট। তাঁর সঙ্গে একমত হয়েও ভিন্ন ভাষায় বলতে চাই : আত্মবিশ্লেষণের অভাবিত সুযোগ এনে দিয়েছে সিটি করপোরেশনের নির্বাচন, সে সুযোগ কি আওয়ামী লীগ গ্রহণ করবে? তবে আমার জন্য ভাবনা : শুভার্থীদের এই ক্ষোভ, এই আশঙ্কা, পরোক্ষে প্রত্যাশা কি আপাত পরাজিত দলের শীর্ষ নেতৃত্বের চেতনা স্পর্শ করবে? আত্মতুষ্টির ভ্রান্তি থেকে মুক্ত হবেন তাঁরা?
তাঁরা কি আত্মসমালোচনার প্রয়োজন উপলব্ধি করবেন? তৃণমূল স্তর থেকে সত্যিকার 'ফিডব্যাক' নিতে আগ্রহী হবেন? বলছি এ জন্য যে কট্টর আওয়ামী সমর্থক আমাদের এক প্রিয় তরুণ সাংবাদিক এবং আরো অনেকে একটি কথা প্রায়ই বলে থাকেন : 'নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জিতলে আমরা জিতি না; কিন্তু আওয়ামী লীগ হারলে আমরা হারি।' সমমনাদের এই গভীর তাৎপর্যপূর্ণ উক্তি কি শীর্ষ আওয়ামী নেতৃত্বের তরঙ্গ দৈর্ঘ্য স্পর্শ করেছে কখনো?
দলীয় কথাবার্তা থাক। এ নির্বাচনের বড় একটি ইতিবাচক দিক সুষ্ঠু পরিবেশে সেনা উপস্থিতি ছাড়াই একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান সমাপন। এদিক থেকে প্রধানমন্ত্রীর প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ইতিবাচক। তবে প্রশ্ন থাকে, এ বাস্তবতা কি জাতীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিরোধী দল মেনে নেবে? তাদের হাবভাব থেকে তা মনে হয় না। কারণ তারা বিজয় সম্পর্কে নিশ্চিত হতে চায়।
এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সমর্থক শ্রেণীর এমন প্রত্যাশা ছিল অন্তত দুটো আসনে তারা জিতবে। সে আশা পূরণ হয়নি। দলীয় রাজনীতির একটি অলিখিত নিয়ম যেকোনো অভাবিত পরাজয়ের ব্যাপকভিত্তিক কারণ অনুসন্ধান অর্থাৎ পোস্টমর্টেম। এ ক্ষেত্রে পরাজয়ের কারণ বহু আলোচিত, এমনকি কাগজেও তার প্রকাশ দেখা গেছে। প্রধান একটি কারণ দলের অন্তর্দ্বন্দ্ব- এমনকি তৃণমূল স্তরে। আর প্রার্থিতা নিয়ে তো আছেই।
অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণও অজানা নয়। দলীয় সরকার ও সংগঠনের মধ্যে দূরত্ব, বিচ্ছিন্নতা, ক্ষেত্রবিশেষে দ্বন্দ্ব। দ্বন্দ্বের কারণ অন্তত দ্বিবিধ-বৈষয়িক, আদর্শিক। আদর্শিক বলতে দলের অন্ধ অনুরাগী কর্মীদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ যোগাযোগ রক্ষায় উদাসীনতা। অনেক দিন থেকে সংবাদপত্রের খবর- যেমন 'ছাত্রলীগের দুই গ্রুপে সংঘর্ষ' (যুবলীগের পারস্পরিক সংঘাত) শীর্ষ নেতারা কি এ-জাতীয় সমস্যার সমাধানে তৎপর হয়েছেন, নাকি ক্ষমতার অমৃত আস্বাদনে ব্যস্ত থেকেছেন।
এ জাতীয় ঘটনা দু-চারটে নয়, দেশজুড়ে বিভিন্ন জেলা-উপজেলা এমনকি মাঠপর্যায়ে। কিন্তু সাংগঠনিক খাতের নেতাদের এসব বিষয়ে খুব একটা তৎপরতা ছিল কি? থাকলে মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীদের বক্তব্যে এমন কথা উঠে আসত না যে 'বরিশালে হিরনের পরাজয়ের পেছনে আওয়ামী লীগের কোন্দল'। এমনকি অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় এমন তথ্যও প্রকাশ পেয়েছে যে কোথাও কোথাও স্থানীয় পর্যায়ের নেতা দলীয় প্রার্থীর বিপক্ষে প্রচ্ছন্নভাবে তৎপর ছিলেন।
অনেক তথ্য উদ্ধার না করেও সিদ্ধান্তে আসা যায় যে মাঠপর্যায়েও দ্বন্দ্ব-বিরোধিতা ইত্যাদি বিষয়ে কেন্দ্রীয় নেতাদের মনোযোগ আকর্ষণ করেনি। বিবাদ-বিসম্বাদ মেটাতে তাঁদের তৎপর হতে দেখা যায়নি। অর্থাৎ সাংগঠনিক পর্যায়ে বিশৃঙ্খলা। অথচ একসময় আওয়ামী লীগের শক্তিই ছিল প্রান্তিক কর্মীদের বিশ্বস্ততা ও সংহতি। এটা যেকোনো দলের জন্যই সত্য। গ্রাম পর্যায়ের এই সংহতির জোরেই পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট দীর্ঘ সময় রাজ্যের শাসনভার দখলে রেখেছে। ক্রমে এই ব্যবহারিক আদর্শে ভাটা পড়েছে, প্রান্তিক কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ হ্রাস পেয়েছে, কেন্দ্রীয় পর্যায়ে আমলাতন্ত্র জোরদার হয়েছে, সন্ত্রাস ও দুর্নীতি আদর্শের স্থান দখল করেছে। নানা বিচ্যুতির মধ্য দিয়ে ক্ষমতার আসন থেকে বামফ্রন্টের পতন- এগুলো সাধারণ সূত্র। যে মানবে টিকে থাকবে, যে মানবে না তার পতন কেউ ঠেকাতে পারবে না। আমার নয়, অনেক শুভার্থীর বিশ্বাস- এসব দিক থেকে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক উদাসীনতা চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। হতে পারে মূল সংগঠনে এমন আত্মবিশ্বাস কাজ করেছে যে জাতীয় নির্বাচনে বিজয় তাদের অনিবার্য। এর কারণ একাধিক জাতীয় খাতে তাদের সাফল্য। কিন্তু ভোটার মনস্তত্ত্ব বিচিত্র। সেখানে অনেক অদ্ভুত আশা-আকাঙ্ক্ষার ঢেউ কাজ করে, স্থানীয় স্বার্থ জাতীয় স্বার্থ অতিক্রম করে যায়। মানুষের তাৎক্ষণিক প্রয়োজন বড় হয়ে ওঠে। ফাঁকা আদর্শের কথা তখন ধোপে টেকে না। তা ছাড়া মাঠপর্যায়ের ভোটার মনস্তত্ত্ব পাঠ যে কতটা জরুরি বেশ কিছুদিন আগেকার কয়েকটি স্থানীয় নির্বাচন তার প্রমাণ। আশ্চর্য যে নারায়ণগঞ্জ অভিজ্ঞতা তাদের চোখ খুলে দেয়নি। ত্বকি হত্যার সুষ্ঠু বিচারে উদাসীনতা একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। নারায়ণগঞ্জ আবার তাদের এ জাতীয় উদাসীনতার জবাব দিতে পারে। দলীয় বিভাজন যে কী মারাত্মক ফল বয়ে আনতে পারে, উদাহরণ চোখের সামনে থাকা সত্ত্বেও দুর্বোধ্য কারণে কেন্দ্রীয় নেতাদের সেদিকে হুঁশ নেই। এর কারণও কি যুক্তিহীন অতিমাত্রিক আত্মবিশ্বাস, নাকি অন্য কিছু? আওয়ামী লীগের বর্তমান আচরণ অনেকের কাছে দুর্বোধ্য ঠেকছে। কেমন একটা নিশ্চিন্তির ভাব তাদের মধ্যে। তবে করপোরেশন নির্বাচনের ফল সে নিশ্চিন্তি হারাম করে দিয়েছে।
কিন্তু এরশাদ আমলের পর থেকে একটি বিষয় তো স্পষ্ট যে কোনো দলই পরপর দুবার রাজত্ব করতে পারেনি। তা সত্ত্বেও কোনো ক্ষমতাসীন দলই সতর্ক হয়নি। নির্বাচনী ইশতেহারের দিকে ফিরে তাকায়নি। সব প্রতিশ্রুতি পালন বাস্তবে সম্ভব হয় না- এটা যেমন ঠিক, তেমনি চেষ্টা ও আন্তরিকতা মানুষ ঠিকই বুঝতে পারে। যেমন- মধ্যবিত্ত থেকে সাধারণ মানুষের জন্য খুব জরুরি ছিল প্রতিশ্রুত দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ। কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি বৃহৎ ব্যবসায়ী ও সিন্ডিকেটের দাপটে। তারা তাদের মর্জিমতো বাজার নিয়ন্ত্রণ করেছে এবং এখনো করছে। নির্দিষ্ট কিছু পণ্যের দাম অযৌক্তিকভাবে বেড়েছে। ওষুধের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে। কিন্তু ওষুধ নিয়ন্ত্রক সংস্থা নিজ আসনে স্থবির। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ও নিশ্চুপ। বৃহৎ ব্যবসায়ীর এমনই ক্ষমতা যে কোনো রমজানের পণ্যমূল্য বিষয়ক সরকারি আদেশ তারা কানে তোলেনি। এবার প্রথম টার্গেট ছোলা।
এ ধরনের একাধিক ঘটনা যেমন শেয়ারবাজার, ব্যাংক জালিয়াতি ইত্যাদি বিষয়ে দ্রুত যুক্তিসংগত ন্যায্য ব্যবস্থা গ্রহণ মানুষের আস্থা তৈরি করতে পারত। কিন্তু সেগুলো নিয়ে ঢিলেঢালা ব্যবস্থা মানুষের মনে সন্দেহ তৈরি করেছে। এসব সুযোগ দেওয়ার কোনো প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু দেওয়া হয়েছে। সর্বোপরি ভারতের সঙ্গে সমস্যা সমাধানে ব্যর্থতা, যদিও এর দায় প্রায় সবটুকুই ভারতের। কথিত বন্ধু সরকারের প্রতি তাদের অবন্ধুসুলভ আচরণ। তারা সব কটি ক্ষেত্রে কথা দিয়ে কথা রাখেনি। ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশনারের স্বস্তিকর আশ্বাসের পরদিনই সীমান্তে দুই বাংলাদেশির মৃত্যু কী প্রমাণ করে? এসব ছাড়া রয়েছে ঘরের সমস্যা। ব্যক্তি বিশেষের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে শীর্ষ পর্যায়ে উদাসীনতা মানুষ ভালোভাবে নেয়নি।
আমার ধারণা, পররাষ্ট্রনীতির চেয়েও সাধারণ মানুষের কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অভ্যন্তরীণ সমস্যা, সেসব সমাধানের চেষ্টা। সেদিকে মনোযোগ দেওয়া যেমন জরুরি, তেমনি জরুরি সাংগঠনিক নৈরাজ্য মেরামত করার সর্বাত্মক চেষ্টা নেওয়া। তবে এ লেখার শুরুতে যেসব প্রতিক্রিয়ার কথা বলা হয়েছে, সেসব মর্মকথার পেছনে মূল আশঙ্কা জামায়াত-শিবিরের গত কয়েক মাসের তাণ্ডব, সাম্প্রদায়িক হামলা এবং সর্বশেষ তাদের ও বিএনপি এমনকি ১৪ দলীয় জোটের শরিক জাপার মদদে হেফাজতের একদিনকার তুলকালাম অনেকের মনে এমন ধারণার জন্ম দিয়েছে যে এরা ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশটিকে পুরো পাকিস্তান না হোক আধা পাকিস্তান বানিয়ে ছাড়বে। তখন যুক্তিবাদী, নিরপেক্ষ চিন্তার মানুষের পক্ষে স্বদেশ অভিশপ্ত দেশ হয়ে উঠবে। কারণ ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না, নিকট-অতীতকেও সহজেই ভুলে যায়।
লেখক : কবি, গবেষক ও ভাষাসংগ্রামী
এই সুরে, সৌহার্দ্যের পরিবেশে লেখাটি শেষ করতে পারলে খুশি হতাম। কিন্তু আষাঢ়ের বৃষ্টিহীন গ্রীষ্মসম ভরদুপুরে আমার এক রাজনীতি-মনষ্ক বন্ধু দূরভাষে উত্তেজিত কণ্ঠে বলতে থাকেন 'চার করপোরেশনের ফলাফল তো জাতীয় সাধারণ নির্বাচনের আগাম ঘোষণা দিচ্ছে। আগে ছিল বিএনপি-জামায়াত, এখন সেখানে যুক্ত হয়েছে হেফাজতে ইসলাম- আগামীতে অবস্থা কী দাঁড়াবে অনুমান করতে পারেন? অন্যদিকে গুজরাতি বর্বরতার নায়ক মোদির ভয়ংকর হলুদ ছায়া, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার খায়েশ, পরিস্থিতি প্রচণ্ডভাবে কংগ্রেস জোটবিরোধী- ভাবতে পারছেন, কী হতে যাচ্ছে। তালেবানি পাকিস্তানকে আমি হিসেবেই আনি না- তার পরও বাংলাদেশে পাকি-ভূতের ছায়া! ধর্মীয় রাজনীতির ব্যাপক আবির্ভাব।
তাকে আশ্বস্ত করে দারুণ নিদাঘে মাথা ঠাণ্ডা করে বিশ্রাম নিতে বলি। এতটা না হলেও প্রায় অনুরূপ আশঙ্কা প্রকাশ করেন আরো দুজন মধ্যবয়সী একই দিনে অর্থাৎ আষাঢ়স্য তৃতীয় দিবসে। বলেন, 'কী যে হবে আগামী নির্বাচনে ভেবে কূল-কিনারা পাচ্ছি না।' কাছাকাছি শিরিষ ছায়ার তলে দিবা বিশ্রামে ভগিনীসম কবি ক্ষুব্ধকণ্ঠে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেন : 'এমনই তো হওয়ার কথা।' আত্মপ্রসাদের পরিণাম এমনই হয়। আমরা ভুলেছি একাত্তর, ভুলেছি জামায়াত-বিএনপির গত মেয়াদের সহিংসতা, সংখ্যালঘুর ওপর হামলা! কদিন আগের হেফাজতি কাণ্ড।
প্রতিক্রিয়ার উদ্ধৃতি না বাড়িয়ে শুধু সাংবাদিক গাফ্ফার চৌধুরীর তাৎপর্যপূর্ণ শিরোনামটিই উদ্ধার করি 'এই পরাজয় প্রয়োজন ছিল'। তিনি অবশ্য কথাটা ইতিবাচক অর্থে ব্যবহার করেছেন, তাঁর আলোচনায় যা খুবই স্পষ্ট। তাঁর সঙ্গে একমত হয়েও ভিন্ন ভাষায় বলতে চাই : আত্মবিশ্লেষণের অভাবিত সুযোগ এনে দিয়েছে সিটি করপোরেশনের নির্বাচন, সে সুযোগ কি আওয়ামী লীগ গ্রহণ করবে? তবে আমার জন্য ভাবনা : শুভার্থীদের এই ক্ষোভ, এই আশঙ্কা, পরোক্ষে প্রত্যাশা কি আপাত পরাজিত দলের শীর্ষ নেতৃত্বের চেতনা স্পর্শ করবে? আত্মতুষ্টির ভ্রান্তি থেকে মুক্ত হবেন তাঁরা?
তাঁরা কি আত্মসমালোচনার প্রয়োজন উপলব্ধি করবেন? তৃণমূল স্তর থেকে সত্যিকার 'ফিডব্যাক' নিতে আগ্রহী হবেন? বলছি এ জন্য যে কট্টর আওয়ামী সমর্থক আমাদের এক প্রিয় তরুণ সাংবাদিক এবং আরো অনেকে একটি কথা প্রায়ই বলে থাকেন : 'নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জিতলে আমরা জিতি না; কিন্তু আওয়ামী লীগ হারলে আমরা হারি।' সমমনাদের এই গভীর তাৎপর্যপূর্ণ উক্তি কি শীর্ষ আওয়ামী নেতৃত্বের তরঙ্গ দৈর্ঘ্য স্পর্শ করেছে কখনো?
দলীয় কথাবার্তা থাক। এ নির্বাচনের বড় একটি ইতিবাচক দিক সুষ্ঠু পরিবেশে সেনা উপস্থিতি ছাড়াই একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান সমাপন। এদিক থেকে প্রধানমন্ত্রীর প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ইতিবাচক। তবে প্রশ্ন থাকে, এ বাস্তবতা কি জাতীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিরোধী দল মেনে নেবে? তাদের হাবভাব থেকে তা মনে হয় না। কারণ তারা বিজয় সম্পর্কে নিশ্চিত হতে চায়।
এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সমর্থক শ্রেণীর এমন প্রত্যাশা ছিল অন্তত দুটো আসনে তারা জিতবে। সে আশা পূরণ হয়নি। দলীয় রাজনীতির একটি অলিখিত নিয়ম যেকোনো অভাবিত পরাজয়ের ব্যাপকভিত্তিক কারণ অনুসন্ধান অর্থাৎ পোস্টমর্টেম। এ ক্ষেত্রে পরাজয়ের কারণ বহু আলোচিত, এমনকি কাগজেও তার প্রকাশ দেখা গেছে। প্রধান একটি কারণ দলের অন্তর্দ্বন্দ্ব- এমনকি তৃণমূল স্তরে। আর প্রার্থিতা নিয়ে তো আছেই।
অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণও অজানা নয়। দলীয় সরকার ও সংগঠনের মধ্যে দূরত্ব, বিচ্ছিন্নতা, ক্ষেত্রবিশেষে দ্বন্দ্ব। দ্বন্দ্বের কারণ অন্তত দ্বিবিধ-বৈষয়িক, আদর্শিক। আদর্শিক বলতে দলের অন্ধ অনুরাগী কর্মীদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ যোগাযোগ রক্ষায় উদাসীনতা। অনেক দিন থেকে সংবাদপত্রের খবর- যেমন 'ছাত্রলীগের দুই গ্রুপে সংঘর্ষ' (যুবলীগের পারস্পরিক সংঘাত) শীর্ষ নেতারা কি এ-জাতীয় সমস্যার সমাধানে তৎপর হয়েছেন, নাকি ক্ষমতার অমৃত আস্বাদনে ব্যস্ত থেকেছেন।
এ জাতীয় ঘটনা দু-চারটে নয়, দেশজুড়ে বিভিন্ন জেলা-উপজেলা এমনকি মাঠপর্যায়ে। কিন্তু সাংগঠনিক খাতের নেতাদের এসব বিষয়ে খুব একটা তৎপরতা ছিল কি? থাকলে মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীদের বক্তব্যে এমন কথা উঠে আসত না যে 'বরিশালে হিরনের পরাজয়ের পেছনে আওয়ামী লীগের কোন্দল'। এমনকি অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় এমন তথ্যও প্রকাশ পেয়েছে যে কোথাও কোথাও স্থানীয় পর্যায়ের নেতা দলীয় প্রার্থীর বিপক্ষে প্রচ্ছন্নভাবে তৎপর ছিলেন।
অনেক তথ্য উদ্ধার না করেও সিদ্ধান্তে আসা যায় যে মাঠপর্যায়েও দ্বন্দ্ব-বিরোধিতা ইত্যাদি বিষয়ে কেন্দ্রীয় নেতাদের মনোযোগ আকর্ষণ করেনি। বিবাদ-বিসম্বাদ মেটাতে তাঁদের তৎপর হতে দেখা যায়নি। অর্থাৎ সাংগঠনিক পর্যায়ে বিশৃঙ্খলা। অথচ একসময় আওয়ামী লীগের শক্তিই ছিল প্রান্তিক কর্মীদের বিশ্বস্ততা ও সংহতি। এটা যেকোনো দলের জন্যই সত্য। গ্রাম পর্যায়ের এই সংহতির জোরেই পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট দীর্ঘ সময় রাজ্যের শাসনভার দখলে রেখেছে। ক্রমে এই ব্যবহারিক আদর্শে ভাটা পড়েছে, প্রান্তিক কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ হ্রাস পেয়েছে, কেন্দ্রীয় পর্যায়ে আমলাতন্ত্র জোরদার হয়েছে, সন্ত্রাস ও দুর্নীতি আদর্শের স্থান দখল করেছে। নানা বিচ্যুতির মধ্য দিয়ে ক্ষমতার আসন থেকে বামফ্রন্টের পতন- এগুলো সাধারণ সূত্র। যে মানবে টিকে থাকবে, যে মানবে না তার পতন কেউ ঠেকাতে পারবে না। আমার নয়, অনেক শুভার্থীর বিশ্বাস- এসব দিক থেকে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক উদাসীনতা চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। হতে পারে মূল সংগঠনে এমন আত্মবিশ্বাস কাজ করেছে যে জাতীয় নির্বাচনে বিজয় তাদের অনিবার্য। এর কারণ একাধিক জাতীয় খাতে তাদের সাফল্য। কিন্তু ভোটার মনস্তত্ত্ব বিচিত্র। সেখানে অনেক অদ্ভুত আশা-আকাঙ্ক্ষার ঢেউ কাজ করে, স্থানীয় স্বার্থ জাতীয় স্বার্থ অতিক্রম করে যায়। মানুষের তাৎক্ষণিক প্রয়োজন বড় হয়ে ওঠে। ফাঁকা আদর্শের কথা তখন ধোপে টেকে না। তা ছাড়া মাঠপর্যায়ের ভোটার মনস্তত্ত্ব পাঠ যে কতটা জরুরি বেশ কিছুদিন আগেকার কয়েকটি স্থানীয় নির্বাচন তার প্রমাণ। আশ্চর্য যে নারায়ণগঞ্জ অভিজ্ঞতা তাদের চোখ খুলে দেয়নি। ত্বকি হত্যার সুষ্ঠু বিচারে উদাসীনতা একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। নারায়ণগঞ্জ আবার তাদের এ জাতীয় উদাসীনতার জবাব দিতে পারে। দলীয় বিভাজন যে কী মারাত্মক ফল বয়ে আনতে পারে, উদাহরণ চোখের সামনে থাকা সত্ত্বেও দুর্বোধ্য কারণে কেন্দ্রীয় নেতাদের সেদিকে হুঁশ নেই। এর কারণও কি যুক্তিহীন অতিমাত্রিক আত্মবিশ্বাস, নাকি অন্য কিছু? আওয়ামী লীগের বর্তমান আচরণ অনেকের কাছে দুর্বোধ্য ঠেকছে। কেমন একটা নিশ্চিন্তির ভাব তাদের মধ্যে। তবে করপোরেশন নির্বাচনের ফল সে নিশ্চিন্তি হারাম করে দিয়েছে।
কিন্তু এরশাদ আমলের পর থেকে একটি বিষয় তো স্পষ্ট যে কোনো দলই পরপর দুবার রাজত্ব করতে পারেনি। তা সত্ত্বেও কোনো ক্ষমতাসীন দলই সতর্ক হয়নি। নির্বাচনী ইশতেহারের দিকে ফিরে তাকায়নি। সব প্রতিশ্রুতি পালন বাস্তবে সম্ভব হয় না- এটা যেমন ঠিক, তেমনি চেষ্টা ও আন্তরিকতা মানুষ ঠিকই বুঝতে পারে। যেমন- মধ্যবিত্ত থেকে সাধারণ মানুষের জন্য খুব জরুরি ছিল প্রতিশ্রুত দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ। কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি বৃহৎ ব্যবসায়ী ও সিন্ডিকেটের দাপটে। তারা তাদের মর্জিমতো বাজার নিয়ন্ত্রণ করেছে এবং এখনো করছে। নির্দিষ্ট কিছু পণ্যের দাম অযৌক্তিকভাবে বেড়েছে। ওষুধের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে। কিন্তু ওষুধ নিয়ন্ত্রক সংস্থা নিজ আসনে স্থবির। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ও নিশ্চুপ। বৃহৎ ব্যবসায়ীর এমনই ক্ষমতা যে কোনো রমজানের পণ্যমূল্য বিষয়ক সরকারি আদেশ তারা কানে তোলেনি। এবার প্রথম টার্গেট ছোলা।
এ ধরনের একাধিক ঘটনা যেমন শেয়ারবাজার, ব্যাংক জালিয়াতি ইত্যাদি বিষয়ে দ্রুত যুক্তিসংগত ন্যায্য ব্যবস্থা গ্রহণ মানুষের আস্থা তৈরি করতে পারত। কিন্তু সেগুলো নিয়ে ঢিলেঢালা ব্যবস্থা মানুষের মনে সন্দেহ তৈরি করেছে। এসব সুযোগ দেওয়ার কোনো প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু দেওয়া হয়েছে। সর্বোপরি ভারতের সঙ্গে সমস্যা সমাধানে ব্যর্থতা, যদিও এর দায় প্রায় সবটুকুই ভারতের। কথিত বন্ধু সরকারের প্রতি তাদের অবন্ধুসুলভ আচরণ। তারা সব কটি ক্ষেত্রে কথা দিয়ে কথা রাখেনি। ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশনারের স্বস্তিকর আশ্বাসের পরদিনই সীমান্তে দুই বাংলাদেশির মৃত্যু কী প্রমাণ করে? এসব ছাড়া রয়েছে ঘরের সমস্যা। ব্যক্তি বিশেষের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে শীর্ষ পর্যায়ে উদাসীনতা মানুষ ভালোভাবে নেয়নি।
আমার ধারণা, পররাষ্ট্রনীতির চেয়েও সাধারণ মানুষের কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অভ্যন্তরীণ সমস্যা, সেসব সমাধানের চেষ্টা। সেদিকে মনোযোগ দেওয়া যেমন জরুরি, তেমনি জরুরি সাংগঠনিক নৈরাজ্য মেরামত করার সর্বাত্মক চেষ্টা নেওয়া। তবে এ লেখার শুরুতে যেসব প্রতিক্রিয়ার কথা বলা হয়েছে, সেসব মর্মকথার পেছনে মূল আশঙ্কা জামায়াত-শিবিরের গত কয়েক মাসের তাণ্ডব, সাম্প্রদায়িক হামলা এবং সর্বশেষ তাদের ও বিএনপি এমনকি ১৪ দলীয় জোটের শরিক জাপার মদদে হেফাজতের একদিনকার তুলকালাম অনেকের মনে এমন ধারণার জন্ম দিয়েছে যে এরা ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশটিকে পুরো পাকিস্তান না হোক আধা পাকিস্তান বানিয়ে ছাড়বে। তখন যুক্তিবাদী, নিরপেক্ষ চিন্তার মানুষের পক্ষে স্বদেশ অভিশপ্ত দেশ হয়ে উঠবে। কারণ ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না, নিকট-অতীতকেও সহজেই ভুলে যায়।
লেখক : কবি, গবেষক ও ভাষাসংগ্রামী
No comments