আন্তর্জাতিক শরণার্থী দিবস দেশত্যাগী মানুষগুলো কোথায় যাবে? by গোলাম আব্বাস
কোনো এক বিপদের পূর্বাভাস পেয়ে যদি
মুহূর্তের সিদ্ধান্তে নিজ বাসস্থান ত্যাগ করতে হয়, তাহলে কী হবে সেই
একমাত্র বস্তুর, যা আপনি ফেলে রেখে যেতে পারবেন না? আজ আন্তর্জাতিক
শরণার্থী দিবসে এ প্রশ্নই আমরা করতে চাই সবাইকে।
হয়তো সবার ক্ষেত্রে এর উত্তর এক হবে না। আমরা সবাই চাইব আমাদের পরিবার-পরিজনকে পেছনে ফেলে না যেতে।
একজন বাংলাদেশির জন্য পরিবারই তার সামাজিক মূল্যবোধের উৎস। মা-বাবা-ভাইবোন ছাড়া দূরের আত্মীয়স্বজনের সঙ্গেও আমরা নিবিড়ভাবে আবদ্ধ। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে এক কোটিরও অধিক মানুষকে স্বদেশ ত্যাগ করতে হয়েছিল বলে এ দেশের মানুষ বোঝে, পরিবার-পরিজন হারাবার বা তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার সেই অপরিসীম যন্ত্রণা। তা সত্ত্বেও আমাদের সৌভাগ্য ছিল এই যে আমরা বাংলাদেশিরা এত বড় পরিসরের বাস্তুচ্যুত অভিজ্ঞতার শিকার হয়েছিলাম শুধু নয় মাসের জন্য। বাস্তবতা এই যে পৃথিবীর বেশির ভাগ জায়গাতেই এই দুর্ভোগের কাহিনি বয়ে চলে বছরের পর বছর।
গত দুই বছর ছিল জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনারের (ইউএনএইচসিআর) ইতিহাসে অতিমাত্রায় দুঃসাধ্য। শুধু এ দুই বছরেই অনেকগুলো আন্তর্জাতিক সংকট একই সময়ে ঘটে যাওয়ার কারণে আগের সাত বছরের তুলনায় অধিক মানুষকে দেশত্যাগ করে অন্তত একটি আন্তর্জাতিক সীমানা অতিক্রম করতে হয়েছে। ২০১২ সালের শেষাংশে সাড়ে চার কোটি মানুষ যুদ্ধ, সংঘাত কিংবা সহিংসতার কারণে বাস্তুচ্যুত অবস্থায় তাদের জীবন ধারণ করছিল। যদিও আজ সিরিয়া, মালি, দক্ষিণ সুদান ও কঙ্গো প্রজাতন্ত্রের সংকট চরমে অবস্থান করছে, তবু গত বছরের জুন মাসে মিয়ানমারে ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনাগুলো আমাদের ভীষণভাবে মর্মাহত করে চলেছে।
সহিংসতার এক বছর পর এখনো এক লাখ ৪০ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে আছে মিয়ানমারের রাখাইন অঞ্চলে, যার অধিকাংশই রোহিঙ্গা। আরও আছে অন্য কিছু জনগোষ্ঠী, যারা এই সহিংসতায় সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও নিরাপত্তাহীনতার কারণে তাদের জীবিকা হারিয়েছে।
সীমানার ওপার থেকে অনেক নারী, পুরুষ ও শিশুই বাংলাদেশে পার হয়ে আসতে চেষ্টা করেছে সাময়িক নিরাপত্তার খোঁজে; অন্তত মিয়ানমারে অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজমানকালে। এমনও অনেকে আছে, যারা এই গমনের পথে তাদের কাছের মানুষকে হারিয়েছে; পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে।
কয়েক দশকব্যাপী মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীটি প্রচণ্ড বৈষম্য ও দুর্ভোগের ভেতর দিয়ে জীবন কাটাচ্ছে। এমনও শোনা গেছে যে গর্ভবতী মায়েরা পালানোর সময় সমুদ্রপথে চলমান নৌকায় সন্তান প্রসব করেছেন; অথবা কোথাও বয়স্ক মায়েরা আর্তকান্নায় চোরাকারবারিদের হাত থেকে নিজ সন্তানের জীবন ভিক্ষা চাইছেন; আরও আছে অগণিত দুস্থ পরিবার, যারা বর্ষার তুমুল বৃষ্টিতে পাতলা তাঁবুর আশ্রয়ে জীবন অতিবাহিত করছে। না আছে সুযোগ বাড়ি ফেরার, না ভাগ্যকে ঠেকানোর।
রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের এই সংকটের দীর্ঘকালব্যাপী সমাধানের চাবিকাঠি রয়েছে মিয়ানমার সরকারের হাতে। মিয়ানমারের ভূমিকা এখানে মুখ্য এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত মিয়ানমারকে এ বিষয়ে অবিরত সমর্থন করা। এখানে রাতারাতি কোনো সমাধান হয়তো পাওয়া যাবে না, তবে এমতাবস্থায় বিপদগ্রস্ত মানুষগুলোকেও বঙ্গোপসাগরে নৌকায় অসহায়ভাবে ভেসে থাকতে দেওয়া যায় না। উপার্জনক্ষম পুরুষ সদস্যের অবর্তমানে মহিলা, শিশু এবং বয়স্ক জনগোষ্ঠীকে অসহায় ও নিরাপত্তাহীন অবস্থায় একা ফেলে রাখা যায় না। ছোট ছোট শিশুকে শিক্ষার আলোর বাইরে অন্ধকারে অবহেলা করা যায় না।
যত দিন মিয়ানমার এই সমস্যার একটি সুদূরপ্রসারী সমাধান খুঁজছে, তত দিন আশ্রয় প্রদানকারী দেশ হিসেবে কিছু ন্যূনতম আতিথেয়তা চালিয়ে যাওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশের মানুষ এই সংকটাপন্ন রোহিঙ্গাদের প্রতি অসামান্য সংহতি প্রদর্শন করেছে। নিজেদের অসচ্ছলতা এবং জনসংখ্যা সমস্যা সত্ত্বেও রোহিঙ্গাদের ঠাঁই দেওয়ার এই নিদর্শন উদারতার দৃষ্টান্ত। শরণার্থী অধিকার সুরক্ষার পাশাপাশি শরণার্থী-অধ্যুষিত এলাকায় বসবাসরত বাংলাদেশি সম্প্রদায়ের মানুষের প্রয়োজনগুলো চিহ্নিতকরণ এবং উন্নয়ন ঘটানোও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
সর্বসময়ের মতো ইউএনএইচসিআর এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশের সরকার এবং এর নাগরিকদের এ বিষয়ে সমর্থন করতে এগিয়ে আসতে প্রস্তুত।
শরণার্থী দিবস উদ্্যাপনকালে নিজেদের আরেকবার মনে করিয়ে দিতে চাই যে যেসব ব্যক্তি বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশের মাটিতে এসে আশ্রয় নিয়েছে, তারা সবাই মানুষ এবং তারা কারও না কারও মা, বাবা, ভাই বা বোন। এমন একটি পরিবারও যদি সহিংসতার কারণে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, তাহলে আমরা আমাদের দায়িত্ব পালনে বিফল হব।
গোলাম আব্বাস, প্রতিনিধি, ইউএনএইচসিআর রিপ্রেজেন্টেশন অফিস, বাংলাদেশ।
একজন বাংলাদেশির জন্য পরিবারই তার সামাজিক মূল্যবোধের উৎস। মা-বাবা-ভাইবোন ছাড়া দূরের আত্মীয়স্বজনের সঙ্গেও আমরা নিবিড়ভাবে আবদ্ধ। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে এক কোটিরও অধিক মানুষকে স্বদেশ ত্যাগ করতে হয়েছিল বলে এ দেশের মানুষ বোঝে, পরিবার-পরিজন হারাবার বা তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার সেই অপরিসীম যন্ত্রণা। তা সত্ত্বেও আমাদের সৌভাগ্য ছিল এই যে আমরা বাংলাদেশিরা এত বড় পরিসরের বাস্তুচ্যুত অভিজ্ঞতার শিকার হয়েছিলাম শুধু নয় মাসের জন্য। বাস্তবতা এই যে পৃথিবীর বেশির ভাগ জায়গাতেই এই দুর্ভোগের কাহিনি বয়ে চলে বছরের পর বছর।
গত দুই বছর ছিল জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনারের (ইউএনএইচসিআর) ইতিহাসে অতিমাত্রায় দুঃসাধ্য। শুধু এ দুই বছরেই অনেকগুলো আন্তর্জাতিক সংকট একই সময়ে ঘটে যাওয়ার কারণে আগের সাত বছরের তুলনায় অধিক মানুষকে দেশত্যাগ করে অন্তত একটি আন্তর্জাতিক সীমানা অতিক্রম করতে হয়েছে। ২০১২ সালের শেষাংশে সাড়ে চার কোটি মানুষ যুদ্ধ, সংঘাত কিংবা সহিংসতার কারণে বাস্তুচ্যুত অবস্থায় তাদের জীবন ধারণ করছিল। যদিও আজ সিরিয়া, মালি, দক্ষিণ সুদান ও কঙ্গো প্রজাতন্ত্রের সংকট চরমে অবস্থান করছে, তবু গত বছরের জুন মাসে মিয়ানমারে ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনাগুলো আমাদের ভীষণভাবে মর্মাহত করে চলেছে।
সহিংসতার এক বছর পর এখনো এক লাখ ৪০ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে আছে মিয়ানমারের রাখাইন অঞ্চলে, যার অধিকাংশই রোহিঙ্গা। আরও আছে অন্য কিছু জনগোষ্ঠী, যারা এই সহিংসতায় সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও নিরাপত্তাহীনতার কারণে তাদের জীবিকা হারিয়েছে।
সীমানার ওপার থেকে অনেক নারী, পুরুষ ও শিশুই বাংলাদেশে পার হয়ে আসতে চেষ্টা করেছে সাময়িক নিরাপত্তার খোঁজে; অন্তত মিয়ানমারে অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজমানকালে। এমনও অনেকে আছে, যারা এই গমনের পথে তাদের কাছের মানুষকে হারিয়েছে; পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে।
কয়েক দশকব্যাপী মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীটি প্রচণ্ড বৈষম্য ও দুর্ভোগের ভেতর দিয়ে জীবন কাটাচ্ছে। এমনও শোনা গেছে যে গর্ভবতী মায়েরা পালানোর সময় সমুদ্রপথে চলমান নৌকায় সন্তান প্রসব করেছেন; অথবা কোথাও বয়স্ক মায়েরা আর্তকান্নায় চোরাকারবারিদের হাত থেকে নিজ সন্তানের জীবন ভিক্ষা চাইছেন; আরও আছে অগণিত দুস্থ পরিবার, যারা বর্ষার তুমুল বৃষ্টিতে পাতলা তাঁবুর আশ্রয়ে জীবন অতিবাহিত করছে। না আছে সুযোগ বাড়ি ফেরার, না ভাগ্যকে ঠেকানোর।
রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের এই সংকটের দীর্ঘকালব্যাপী সমাধানের চাবিকাঠি রয়েছে মিয়ানমার সরকারের হাতে। মিয়ানমারের ভূমিকা এখানে মুখ্য এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত মিয়ানমারকে এ বিষয়ে অবিরত সমর্থন করা। এখানে রাতারাতি কোনো সমাধান হয়তো পাওয়া যাবে না, তবে এমতাবস্থায় বিপদগ্রস্ত মানুষগুলোকেও বঙ্গোপসাগরে নৌকায় অসহায়ভাবে ভেসে থাকতে দেওয়া যায় না। উপার্জনক্ষম পুরুষ সদস্যের অবর্তমানে মহিলা, শিশু এবং বয়স্ক জনগোষ্ঠীকে অসহায় ও নিরাপত্তাহীন অবস্থায় একা ফেলে রাখা যায় না। ছোট ছোট শিশুকে শিক্ষার আলোর বাইরে অন্ধকারে অবহেলা করা যায় না।
যত দিন মিয়ানমার এই সমস্যার একটি সুদূরপ্রসারী সমাধান খুঁজছে, তত দিন আশ্রয় প্রদানকারী দেশ হিসেবে কিছু ন্যূনতম আতিথেয়তা চালিয়ে যাওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশের মানুষ এই সংকটাপন্ন রোহিঙ্গাদের প্রতি অসামান্য সংহতি প্রদর্শন করেছে। নিজেদের অসচ্ছলতা এবং জনসংখ্যা সমস্যা সত্ত্বেও রোহিঙ্গাদের ঠাঁই দেওয়ার এই নিদর্শন উদারতার দৃষ্টান্ত। শরণার্থী অধিকার সুরক্ষার পাশাপাশি শরণার্থী-অধ্যুষিত এলাকায় বসবাসরত বাংলাদেশি সম্প্রদায়ের মানুষের প্রয়োজনগুলো চিহ্নিতকরণ এবং উন্নয়ন ঘটানোও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
সর্বসময়ের মতো ইউএনএইচসিআর এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশের সরকার এবং এর নাগরিকদের এ বিষয়ে সমর্থন করতে এগিয়ে আসতে প্রস্তুত।
শরণার্থী দিবস উদ্্যাপনকালে নিজেদের আরেকবার মনে করিয়ে দিতে চাই যে যেসব ব্যক্তি বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশের মাটিতে এসে আশ্রয় নিয়েছে, তারা সবাই মানুষ এবং তারা কারও না কারও মা, বাবা, ভাই বা বোন। এমন একটি পরিবারও যদি সহিংসতার কারণে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, তাহলে আমরা আমাদের দায়িত্ব পালনে বিফল হব।
গোলাম আব্বাস, প্রতিনিধি, ইউএনএইচসিআর রিপ্রেজেন্টেশন অফিস, বাংলাদেশ।
No comments