মিসর ৩০ জুন কি ব্রাদারহুড শাসনের শেষ দিন? by কামাল গাবালা
৩০ জুন সামনে রেখে মিসরে উদ্বেগ ও আতঙ্ক
ক্রমেই দানা বাঁধছে। সেদিন প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ অভিমুখে জনতার মিছিল যাবে।
তারা সেখানে গিয়ে প্রেসিডেন্ট মুরসির ওপর থেকে আস্থা ফিরিয়ে নেওয়ার ঘোষণা
দেবে।
দাবি করবে, আশু প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এই আন্দোলনের
নাম দেওয়া হয়েছে তামারোদ বা বিদ্রোহী। পরিস্থিতি দেখে ইসলামি আন্দোলন
বিশেষত, সরকারপন্থী মিলিশিয়াদের মধ্যে ভালোই আতঙ্ক কাজ করছে। পাশাপাশি সেসব
বিপ্লবী গোষ্ঠী এবং প্রধান বিরোধী শক্তি তামারোদে সমর্থন জানিয়ে
মুরসিবিরোধী পিটিশনে লাখ লাখ মানুষের স্বাক্ষর সংগ্রহ করেছে, তারাও
স্বস্তিতে নেই।
এই ভয়ের আবহে দুশ্চিন্তা ও সংশয়ের কারণ অনেকগুলো অমীমাংসিত প্রশ্ন: আসন্ন গণবিক্ষোভ কি ২০১১ সালের অভ্যুত্থানের মতো শান্তিপূর্ণ হবে? নাকি তা হবে আরেকটি অর্থহীন প্রতিবাদের ঢল, যা কেবল দৈনন্দিন জীবনের আরও কটি দিন কেড়ে নিয়ে মিসরকে পিছিয়ে দেবে? নাকি সরকারপন্থী মিলিশিয়া ও সরকারবিরোধীদের মধ্যে সংঘাতে দেশটা রক্তের বন্যায় ডুবে যাবে।
উত্তরহীন আরও কিছু প্রশ্ন এখন জনমন খোঁচাচ্ছে: এত অল্প সময়ের মধ্যে বিরাটসংখ্যক মিসরীয়র মনে কীভাবে মুসলিম ব্রাদারহুড সরকারের বিরুদ্ধে ঘৃণার জন্ম হলো? কেন ঘৃণাটা কেবল ব্রাদারহুডের বিরুদ্ধেই, কেন তাদেরই সহযোগী আরও রক্ষণশীল সালাফিপন্থীদের ছাড় দেওয়া হচ্ছে, আদর্শিকভাবে আন্দোলনকারীরা যাদের অপছন্দ করে? কেন মুসলিম ব্রাদারহুডের সাবেক নেতার প্রতিষ্ঠিত ‘শক্তিশালী মিসর’ দলকেও ছাড় দেওয়া হচ্ছে? কেন অন্যান্য ইসলামপন্থী দল এই ঘৃণার বাইরে রয়ে যাচ্ছে?
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, ৩০ জুন কি মুরসির প্রশাসন ভেঙে পড়বে, নাকি তারা বেসামরিক বিরোধীদের সঙ্গে আপস করে নেবে (যেমন প্রধানমন্ত্রী হিশাম কান্দি সরকারের অপসারণ), শুরা পরিষদ তথা সংসদের উচ্চ পরিষদের কার্যক্রম স্থগিত করা, রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তাকে বরখাস্ত এবং নির্বাচন আইন সংশোধন করে একে ভোটারদের জন্য আরও স্বচ্ছ ও প্রতিনিধিত্বমূলক করা ইত্যাদি।
এরই মধ্যে আতঙ্কজনক গুজব ছড়িয়ে পড়ছে। এর মধ্যে মারাত্মকটি হলো, সেনা ও পুলিশের অনুপস্থিতিতে ভয়ানক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়বে, যা মিসরকে একসময়ের লেবানন অথবা আলজেরিয়ার মতো পরিস্থিতির মধ্যে নিয়ে ফেলবে, অথবা চার্চ ও মসজিদগুলো সরকারের পক্ষে-বিপক্ষে চূড়ান্ত লড়াইয়ের জন্য অস্ত্র সংগ্রহ করছে। কী হবে, খোদাই জানে।
মিসরের আধুনিক ইতিহাসে স্বৈরাচারী শাসকদের উচ্ছেদে সফল গণ-আন্দোলনের দৃষ্টান্ত আছে। প্রথমটি হলো ১৯১৯ সালের বিপ্লব। যার উদ্দেশ্য ছিল সা’দ জাঘলৌদের হাতে নির্বাহী ক্ষমতা নিয়ে আসা বৈধ করা এবং ব্রিটিশ দখলদারদের সঙ্গে একটা বোঝাপড়ায় আসা। এরই পরিণতিতে ১৯২৩ সালের সংবিধান বদলে যায়।
দ্বিতীয় উদাহরণ হলো মোহাম্মদ এল বারাদির নেতৃত্বে গণস্বাক্ষর সংগ্রহ, যার দরুন তিনি পতিত প্রেসিডেন্ট মোবারকের বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পেরেছিলেন। এই আন্দোলনের জনসমর্থন যে পরিবর্তনের আশা জাগিয়েছিল, তা থেকেই জ্বলে ওঠে ২৫ জানুয়ারির বিপ্লব।
তামারোদের লক্ষণীয় দিক হলো, মুরসির প্রতি অনাস্থা ভোটের দাবিতে যে পরিমাণ স্বাক্ষর সংগৃহীত হয়, তা স্পষ্টই বুঝিয়ে দেয় যে ব্রাদারহুডের সরকারের বিরুদ্ধে যত লোক স্বাক্ষর করে তা মোবারকের বিরুদ্ধে স্বাক্ষরকারীদের সংখ্যার চেয়েও বেশি। জনগণের এই প্রত্যাখ্যানের শক্তিটা তাই খাটো করে দেখা যাচ্ছে না।
সাবেক প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী এবং মিসরের প্রধান বিরোধীদলীয় জোট জাতীয় মুক্তি ফ্রন্টের নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তি হামদিন সাবাহি মনে করেন, ব্রাদারহুড সরকার যে বিপ্লবকে পরিত্যাগ করেছে, মিসরের সেই অসম্পূর্ণ বিপ্লবের লক্ষ্য অর্জনে ৩০ জুনের বিক্ষোভই হবে নির্ধারক দিন। তিনি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে জানিয়েছেন যে তাঁর বিশ্বাস, সেদিন লাখ লাখ মিসরীয় প্রতিবাদে যোগ দেবে এবং যারা তাদের হাত থেকে বিপ্লবকে কেড়ে নিয়ে পুরোনো ব্যবস্থায় প্রত্যাবর্তন করেছে, তাদের পরাজিত করা হবে।
মিসরীয় জনগণের বড় অংশই মনে করে, হোসনি মোবারকের পতনের পর ব্রাদারহুড দেশ পরিচালনায় ব্যর্থ হয়েছে। তারাই মিসরীয় গণতান্ত্রিক রূপান্তরের বিলম্বের জন্য দায়ী। বিপ্লবের প্রধান প্রত্যাশা যে রুটি, মুক্তি ও ইনসাফ, ব্রাদারহুড সরকার তা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে।
কার্যত তাদের এই ব্যর্থতার মধ্যে রয়েছে বারবার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা, যে অর্থনৈতিক সংকটে সব মিসরীয় ভুগছে, তা দূর করতে না পারা, ইথিওপিয়ার সঙ্গে উত্তেজনা সৃষ্টি এবং সিনাই উপত্যকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করার ব্যর্থতা। তাহলেও সব কটি উদাহরণ মিলিয়েও পরিষ্কার করা কঠিন যে মুসলিম ব্রাদারহুড মিসরকে কী পরিমাণে দুটি যুধ্যমান শিবিরে বিভক্ত করে ফেলেছে। অথচ এত সব ক্ষতি করা সত্ত্বেও তারা দিব্যি শাসন চালিয়ে যাচ্ছে।
রাজনীতি ও আইনবিশেষজ্ঞ নুর ফারাহাতের ভাষায়: ‘মুরসির সমর্থকেরা তাঁর শাসন চালিয়ে যাওয়ার বৈধতার দোহাই দেন, কিন্তু সেই বৈধতা ধোঁকার মাধ্যমে ক্ষমতা কায়েম করার মাধ্যমে আসে না, তা আসে জনগণের দাবি পূরণের মাধ্যমে এবং তাদের যথার্থ প্রতিনিধিত্বের নিশ্চয়তা দেওয়ার পথে।’
নুর ফারাহাত আরও বলেন, নির্বাচনই বৈধতা দাবির পথ হলেও তার মাধ্যমে নির্বাচিত শাসকের এমন ক্ষমতা জন্মে না, যার দ্বারা তিনি জনগণের ইচ্ছাকে অসম্মান করার চূড়ন্ত কর্তৃপক্ষ হয়ে উঠবেন। কিন্তু তিনি সেটাই হয়ে উঠেছেন কতগুলো কাজের মাধ্যমে: ১. বিকৃত সংবিধান পাস করা—যার পক্ষে ভোট দিয়েছে মাত্র ২০ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক ভোটার এবং যার ফলে দেশ দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে গেছে, ২. মিসরের সীমান্তে পুলিশ ও সেনাসদস্যদের জীবন অহেতুক বিপন্ন করে ফেলা, ৩. সিনাইকে সন্ত্রাসী ও বেআইনি লোকদের হাতে ছেড়ে দেওয়া, ৪. জাতীয় স্বার্থবিরোধী অর্থনৈতিক প্রকল্প গ্রহণ করা, ৫. রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের দলীয়করণ, ৬. সংস্কৃতির ওপর অন্তর্ঘাত চালানো এবং ৭. বিচার বিভাগকে আক্রমণ করে সাংবিধানিক বৈধতাকে হেয় করাসহ আদালতের অপসারণ আদেশ উপেক্ষা করে প্রসিকিউটর জেনারেলকে বহাল রাখা।
অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, মিসরের অর্থনৈতিক অবস্থান যে জায়গায় চলে গেছে, যেখান থেকে আর ফেরার পথ নেই। অনেকেই আশঙ্কায় আছেন, শিগগিরই বাজেট ঘাটতি ও ঋণের ভারে জর্জরিত হয়ে অর্থনীতি ধসে পড়তে পারে।
ব্রাদারহুডের সাবেক নেতা থারওয়াত আল-খারবাওয়ি বলেন, ‘৩০ জুন মিসরে যে বিক্ষোভ শুরু হবে, তার তিন দিনের মাথাতেই মুসলিম ব্রাদারহুড সরকারের পতন ঘটবে। সরকার নিজেকে রক্ষা করতে পারবে না এবং তাদের অপসারণেও খুব বেশি বেগ পেতে হবে না বিপ্লবীদের।’
ওয়াতান সংবাদপত্রে খারবাওয়ি আরও বলেন, কর্মীরা যা-ই বলে বেড়াক, ব্রাদারহুড প্রতিষ্ঠান হিসেবে খুবই দুর্বল। তারা বিক্ষোভ ঠেকাতে পারবে না। কারণ, দেশ পরিচালনার চেয়ে তারা নিজেদের বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেন যে মুসলিম ব্রাদারহুডের জন্য ভালো হবে বিক্ষোভ শুরু হওয়ার আগেই পিছু হটা এবং নিজেদের সব বাহিনীকে প্রত্যাহার করা। নইলে ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে তাদের হয়তো আবার মোবারক আমলের মতো আত্মগোপনের জায়গাগুলোতে ফিরে যেতে হবে, যেখান থেকে তারা উঠে এসেছিল ক্ষমতার শীর্ষে।
প্রথম আলোর জন্য রচিত, ইংরেজি থেকে অনূদিত
কামাল গাবালা: মিসরের আলআহরাম পত্রিকাগোষ্ঠীর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক।
এই ভয়ের আবহে দুশ্চিন্তা ও সংশয়ের কারণ অনেকগুলো অমীমাংসিত প্রশ্ন: আসন্ন গণবিক্ষোভ কি ২০১১ সালের অভ্যুত্থানের মতো শান্তিপূর্ণ হবে? নাকি তা হবে আরেকটি অর্থহীন প্রতিবাদের ঢল, যা কেবল দৈনন্দিন জীবনের আরও কটি দিন কেড়ে নিয়ে মিসরকে পিছিয়ে দেবে? নাকি সরকারপন্থী মিলিশিয়া ও সরকারবিরোধীদের মধ্যে সংঘাতে দেশটা রক্তের বন্যায় ডুবে যাবে।
উত্তরহীন আরও কিছু প্রশ্ন এখন জনমন খোঁচাচ্ছে: এত অল্প সময়ের মধ্যে বিরাটসংখ্যক মিসরীয়র মনে কীভাবে মুসলিম ব্রাদারহুড সরকারের বিরুদ্ধে ঘৃণার জন্ম হলো? কেন ঘৃণাটা কেবল ব্রাদারহুডের বিরুদ্ধেই, কেন তাদেরই সহযোগী আরও রক্ষণশীল সালাফিপন্থীদের ছাড় দেওয়া হচ্ছে, আদর্শিকভাবে আন্দোলনকারীরা যাদের অপছন্দ করে? কেন মুসলিম ব্রাদারহুডের সাবেক নেতার প্রতিষ্ঠিত ‘শক্তিশালী মিসর’ দলকেও ছাড় দেওয়া হচ্ছে? কেন অন্যান্য ইসলামপন্থী দল এই ঘৃণার বাইরে রয়ে যাচ্ছে?
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, ৩০ জুন কি মুরসির প্রশাসন ভেঙে পড়বে, নাকি তারা বেসামরিক বিরোধীদের সঙ্গে আপস করে নেবে (যেমন প্রধানমন্ত্রী হিশাম কান্দি সরকারের অপসারণ), শুরা পরিষদ তথা সংসদের উচ্চ পরিষদের কার্যক্রম স্থগিত করা, রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তাকে বরখাস্ত এবং নির্বাচন আইন সংশোধন করে একে ভোটারদের জন্য আরও স্বচ্ছ ও প্রতিনিধিত্বমূলক করা ইত্যাদি।
এরই মধ্যে আতঙ্কজনক গুজব ছড়িয়ে পড়ছে। এর মধ্যে মারাত্মকটি হলো, সেনা ও পুলিশের অনুপস্থিতিতে ভয়ানক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়বে, যা মিসরকে একসময়ের লেবানন অথবা আলজেরিয়ার মতো পরিস্থিতির মধ্যে নিয়ে ফেলবে, অথবা চার্চ ও মসজিদগুলো সরকারের পক্ষে-বিপক্ষে চূড়ান্ত লড়াইয়ের জন্য অস্ত্র সংগ্রহ করছে। কী হবে, খোদাই জানে।
মিসরের আধুনিক ইতিহাসে স্বৈরাচারী শাসকদের উচ্ছেদে সফল গণ-আন্দোলনের দৃষ্টান্ত আছে। প্রথমটি হলো ১৯১৯ সালের বিপ্লব। যার উদ্দেশ্য ছিল সা’দ জাঘলৌদের হাতে নির্বাহী ক্ষমতা নিয়ে আসা বৈধ করা এবং ব্রিটিশ দখলদারদের সঙ্গে একটা বোঝাপড়ায় আসা। এরই পরিণতিতে ১৯২৩ সালের সংবিধান বদলে যায়।
দ্বিতীয় উদাহরণ হলো মোহাম্মদ এল বারাদির নেতৃত্বে গণস্বাক্ষর সংগ্রহ, যার দরুন তিনি পতিত প্রেসিডেন্ট মোবারকের বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পেরেছিলেন। এই আন্দোলনের জনসমর্থন যে পরিবর্তনের আশা জাগিয়েছিল, তা থেকেই জ্বলে ওঠে ২৫ জানুয়ারির বিপ্লব।
তামারোদের লক্ষণীয় দিক হলো, মুরসির প্রতি অনাস্থা ভোটের দাবিতে যে পরিমাণ স্বাক্ষর সংগৃহীত হয়, তা স্পষ্টই বুঝিয়ে দেয় যে ব্রাদারহুডের সরকারের বিরুদ্ধে যত লোক স্বাক্ষর করে তা মোবারকের বিরুদ্ধে স্বাক্ষরকারীদের সংখ্যার চেয়েও বেশি। জনগণের এই প্রত্যাখ্যানের শক্তিটা তাই খাটো করে দেখা যাচ্ছে না।
সাবেক প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী এবং মিসরের প্রধান বিরোধীদলীয় জোট জাতীয় মুক্তি ফ্রন্টের নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তি হামদিন সাবাহি মনে করেন, ব্রাদারহুড সরকার যে বিপ্লবকে পরিত্যাগ করেছে, মিসরের সেই অসম্পূর্ণ বিপ্লবের লক্ষ্য অর্জনে ৩০ জুনের বিক্ষোভই হবে নির্ধারক দিন। তিনি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে জানিয়েছেন যে তাঁর বিশ্বাস, সেদিন লাখ লাখ মিসরীয় প্রতিবাদে যোগ দেবে এবং যারা তাদের হাত থেকে বিপ্লবকে কেড়ে নিয়ে পুরোনো ব্যবস্থায় প্রত্যাবর্তন করেছে, তাদের পরাজিত করা হবে।
মিসরীয় জনগণের বড় অংশই মনে করে, হোসনি মোবারকের পতনের পর ব্রাদারহুড দেশ পরিচালনায় ব্যর্থ হয়েছে। তারাই মিসরীয় গণতান্ত্রিক রূপান্তরের বিলম্বের জন্য দায়ী। বিপ্লবের প্রধান প্রত্যাশা যে রুটি, মুক্তি ও ইনসাফ, ব্রাদারহুড সরকার তা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে।
কার্যত তাদের এই ব্যর্থতার মধ্যে রয়েছে বারবার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা, যে অর্থনৈতিক সংকটে সব মিসরীয় ভুগছে, তা দূর করতে না পারা, ইথিওপিয়ার সঙ্গে উত্তেজনা সৃষ্টি এবং সিনাই উপত্যকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করার ব্যর্থতা। তাহলেও সব কটি উদাহরণ মিলিয়েও পরিষ্কার করা কঠিন যে মুসলিম ব্রাদারহুড মিসরকে কী পরিমাণে দুটি যুধ্যমান শিবিরে বিভক্ত করে ফেলেছে। অথচ এত সব ক্ষতি করা সত্ত্বেও তারা দিব্যি শাসন চালিয়ে যাচ্ছে।
রাজনীতি ও আইনবিশেষজ্ঞ নুর ফারাহাতের ভাষায়: ‘মুরসির সমর্থকেরা তাঁর শাসন চালিয়ে যাওয়ার বৈধতার দোহাই দেন, কিন্তু সেই বৈধতা ধোঁকার মাধ্যমে ক্ষমতা কায়েম করার মাধ্যমে আসে না, তা আসে জনগণের দাবি পূরণের মাধ্যমে এবং তাদের যথার্থ প্রতিনিধিত্বের নিশ্চয়তা দেওয়ার পথে।’
নুর ফারাহাত আরও বলেন, নির্বাচনই বৈধতা দাবির পথ হলেও তার মাধ্যমে নির্বাচিত শাসকের এমন ক্ষমতা জন্মে না, যার দ্বারা তিনি জনগণের ইচ্ছাকে অসম্মান করার চূড়ন্ত কর্তৃপক্ষ হয়ে উঠবেন। কিন্তু তিনি সেটাই হয়ে উঠেছেন কতগুলো কাজের মাধ্যমে: ১. বিকৃত সংবিধান পাস করা—যার পক্ষে ভোট দিয়েছে মাত্র ২০ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক ভোটার এবং যার ফলে দেশ দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে গেছে, ২. মিসরের সীমান্তে পুলিশ ও সেনাসদস্যদের জীবন অহেতুক বিপন্ন করে ফেলা, ৩. সিনাইকে সন্ত্রাসী ও বেআইনি লোকদের হাতে ছেড়ে দেওয়া, ৪. জাতীয় স্বার্থবিরোধী অর্থনৈতিক প্রকল্প গ্রহণ করা, ৫. রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের দলীয়করণ, ৬. সংস্কৃতির ওপর অন্তর্ঘাত চালানো এবং ৭. বিচার বিভাগকে আক্রমণ করে সাংবিধানিক বৈধতাকে হেয় করাসহ আদালতের অপসারণ আদেশ উপেক্ষা করে প্রসিকিউটর জেনারেলকে বহাল রাখা।
অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, মিসরের অর্থনৈতিক অবস্থান যে জায়গায় চলে গেছে, যেখান থেকে আর ফেরার পথ নেই। অনেকেই আশঙ্কায় আছেন, শিগগিরই বাজেট ঘাটতি ও ঋণের ভারে জর্জরিত হয়ে অর্থনীতি ধসে পড়তে পারে।
ব্রাদারহুডের সাবেক নেতা থারওয়াত আল-খারবাওয়ি বলেন, ‘৩০ জুন মিসরে যে বিক্ষোভ শুরু হবে, তার তিন দিনের মাথাতেই মুসলিম ব্রাদারহুড সরকারের পতন ঘটবে। সরকার নিজেকে রক্ষা করতে পারবে না এবং তাদের অপসারণেও খুব বেশি বেগ পেতে হবে না বিপ্লবীদের।’
ওয়াতান সংবাদপত্রে খারবাওয়ি আরও বলেন, কর্মীরা যা-ই বলে বেড়াক, ব্রাদারহুড প্রতিষ্ঠান হিসেবে খুবই দুর্বল। তারা বিক্ষোভ ঠেকাতে পারবে না। কারণ, দেশ পরিচালনার চেয়ে তারা নিজেদের বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেন যে মুসলিম ব্রাদারহুডের জন্য ভালো হবে বিক্ষোভ শুরু হওয়ার আগেই পিছু হটা এবং নিজেদের সব বাহিনীকে প্রত্যাহার করা। নইলে ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে তাদের হয়তো আবার মোবারক আমলের মতো আত্মগোপনের জায়গাগুলোতে ফিরে যেতে হবে, যেখান থেকে তারা উঠে এসেছিল ক্ষমতার শীর্ষে।
প্রথম আলোর জন্য রচিত, ইংরেজি থেকে অনূদিত
কামাল গাবালা: মিসরের আলআহরাম পত্রিকাগোষ্ঠীর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক।
No comments