আজ-কাল-পরশু- মন্ত্রিসভা গঠনে গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি by মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর
সম্প্রতি মহাজোট সরকারের মন্ত্রিসভায় আওয়ামী লীগের নেতা তোফায়েল আহমেদ ও ওয়ার্কার্স পার্টির প্রধান রাশেদ খান মেননের যোগ না দেওয়ায় রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা আলোচনা ও সমালোচনা হচ্ছে। এই নিবন্ধে সেই আলোচনার পুনরাবৃত্তি করার প্রয়োজন নেই।
পাঠকেরা ইতিমধ্যে নানা মাধ্যমে তার বিস্তারিত জেনেছেন। তবে এই ঘটনার সূত্র ধরে বাংলাদেশে মন্ত্রিসভা গঠনের কিছু প্রক্রিয়াগত দুর্বলতা নিয়ে আলোচনা করার প্রয়োজন মনে করছি।
যদ্দুর মনে পড়ে, অনেক দিন আগে এই বিষয়ে একবার লিখেছিলাম। কিন্তু সেই বক্তব্য পাঠক বা রাজনৈতিক মহলের মনোযোগ আকর্ষণ করেনি। কার্পেটের নিচে ধুলো আড়াল করতে বাংলাদেশে সরকার ও প্রধান দলগুলো খুবই পারঙ্গম। তারই খেসারত আজ দিচ্ছে মহাজোট সরকার।
বাংলাদেশের সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীকে প্রচুর ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। সংবিধান-প্রদত্ত ক্ষমতাবলে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে ‘স্বৈরাচার’ হয়ে ওঠা অসম্ভব কিছু নয়। ‘একনায়ক’ তো হতেই পারেন। বাস্তবে বিভিন্ন আমলে আমাদের প্রধানমন্ত্রীরা কী আচরণ করেছেন ও করছেন, তা পাঠক ভালো জানেন। অন্যান্য দেশে সংসদীয় পদ্ধতির সরকারে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কতটুকু, তার সঙ্গে মিলিয়ে সংবিধানের এই অংশটি পর্যালোচনার দাবি রাখে। বাংলাদেশে এতবার সংবিধান পরিবর্তন করা হয়েছে কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় পরিবর্তন আনা হয়নি। রাজনীতি থেকে শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়া অবসর নিলে এবং তাঁদের পরিবারের সদস্য ক্ষমতায় না থাকলে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতারা বুঝতে পারবেন, প্রধানমন্ত্রীর এই ক্ষমতার যন্ত্রণা কী! এখন নেত্রী-বন্দনায় মশগুল বলে তাঁরা ততটা উপলব্ধি করছেন না।
যখন কোনো দল বা জোট নির্বাচনে জয়লাভের পর সরকার গঠন করার আমন্ত্রণ পায়, তখন কার্যত কোনো একজন ‘নেতা’ আমন্ত্রণ পান না। যদিও আনুষ্ঠানিকতার স্বার্থে ‘সংসদ নেতা’কে সেই আমন্ত্রণ জানানো হয়। সংসদ নেতা সংবিধান-প্রদত্ত ক্ষমতা অনুযায়ী তাঁর ইচ্ছেমতো মন্ত্রিসভা গঠন করতে পারেন। এতে কোনো অন্যায় হয় না। কিন্তু তাঁর মনে রাখা উচিত, দল ছাড়া তাঁর কোনো মূল্য নেই। দল চেয়েছে বলেই তিনি সংসদ নেতা। দল না চাইলে তিনি আর দশজন সাংসদের মতো একজন সাংসদ! কাজেই এ ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য হওয়া উচিত, সংসদ নেতাকে দলের কেন্দ্রীয় হাইকমান্ডের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করে সবার মতামত শুনে মন্ত্রিসভার সদস্য নির্বাচন করা। একটা দল পাঁচ বছর জনমত তৈরি করে, ভোটারদের আস্থা অর্জন করে নির্বাচনে জয়লাভ করে এবং সরকার গঠন করার সুযোগ পায়। সেই সরকার কারা পরিচালনা করবেন, তা দলের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা ইস্যু। কারণ, একটি দক্ষ মন্ত্রিসভাই পাঁচ বছর দলকে নানা সমালোচনা ও ব্যর্থতার হাত থেকে রক্ষা করবে। সরকারের ব্যর্থতার জন্য দেশব্যাপী (টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া) দলের লাখ লাখ কর্মীকে অপদস্থ ও অপমানিত হতে হয়। দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে এটা মনে রাখতে হবে। তাই মন্ত্রিসভা গঠন-প্রক্রিয়া কখনো এক ব্যক্তির চিন্তাপ্রসূত কাজ হওয়া উচিত নয়। সংবিধানে যা-ই লেখা থাকুক, দলের গঠনতন্ত্রে এ ব্যাপারে বিধান থাকা উচিত। মন্ত্রিসভা গঠন, রদবদল ইত্যাদি ব্যাপারে সংসদ নেতাকে দলের হাইকমান্ডের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এই আলোচনা-প্রক্রিয়া সংসদ নেতার মর্জির ওপর যেন নির্ভর না করে। দলের গঠনতন্ত্রে এই আলোচনাকে বাধ্যতামূলক করতে হবে। মনে রাখতে হবে, যিনি সংসদ নেতা, তিনি সাংসদ হয়েছেন দলের কারণে। সাংসদ হয়েছেন বলেই তিনি সংসদ নেতা। দল ছাড়া তাঁর আর কোনো পরিচয় নেই। (‘বঙ্গবন্ধুকন্যা’ বা ‘দেশনেত্রী’ ইত্যাদি পরিচয় অতীত, বর্তমান বা ভবিষ্যতে বেশি পাওয়া যাবে না।) পারিবারিক পরিচয়বহির্ভূত নেতার কথা মনে রেখেই সংবিধান বা দলীয় গঠনতন্ত্র পর্যালোচনা করতে হবে।
‘মন্ত্রিসভা গঠন’ দলের বা অঙ্গসংগঠনের নানা কমিটি গঠনের মতো বিষয় নয়। দল বা অঙ্গসংগঠনের কমিটির দু-একজন ছাড়া কারও নামও অনেকে জানেন না। কার কী কাজ, তা-ও অনেকে জানেন না। পত্রিকায় দেখেছি, আওয়ামী মহিলা লীগের বর্ধিত সভা হয়েছে নয় বছর পর (১৪ সেপ্টেম্বর)। এগুলোই তো আমাদের গণতন্ত্র চর্চার নমুনা। মন্ত্রিসভা গঠনকে দলের এ ধরনের কমিটি গঠনের মতো দেখলে হবে না। মন্ত্রিসভার দক্ষতা ও সততার ওপর সরকার ও দলের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। বিশেষ করে দল পরেরবার নির্বাচনে জয়লাভ করতে পারবে কি না, তা-ও নির্ভর করে মন্ত্রিসভার দক্ষতা ও সততার ওপর।
এই কনভেনশনটা দলের মধ্যে চালু করতে হবে। এটাও গণতন্ত্র চর্চার একটি দিক। রাজনৈতিক দল বা সরকার কারও প্রাইভেট লিমিডেট কোম্পানি নয়। ব্যক্তি যা খুশি, সেভাবে দল বা সরকার চালাতে পারেন না। মন্ত্রী নিয়োগ কোম্পানির ম্যানেজার নিয়োগের মতো বিষয় নয়। ম্যানেজারকে যেমন কোম্পানির ‘হিউম্যান রিসোর্স বিভাগ’ নিয়োগ দেয়, মন্ত্রীকে সে রকমভাবে সরকারের মন্ত্রিপরিষদ সচিব ফোনে ডাকলেই হয় না। দলনেতা বা প্রধানমন্ত্রীকে দলের মধ্যে বা জোটের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে মন্ত্রী পদে নিয়োগ দেওয়াই নিয়ম। এটাই গণতন্ত্র। এটাই শোভন পদ্ধতি। মন্ত্রিপরিষদ সচিবের ফোন নিছক সরকারি আনুষ্ঠানিকতা। আমাদের বড় রাজনৈতিক দলে স্তাবক, আত্মসম্মানহীন ও মেরুদণ্ডহীন নেতার সংখ্যা বেশি হওয়ায় দুই দলের প্রধানই দলকে ‘প্রাইভেট কোম্পানির’ মতো পরিচালনা করার সাহস পেয়েছেন। ভারতে কোনো বুর্জোয়া বা বামপন্থী দলের প্রধান দলের নেতাদের সঙ্গে এ রকম আচরণ করার কথা চিন্তাই করতেন না। ভারতে দলের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র অত্যন্ত শক্ত ও শৃঙ্খলাপূর্ণ। সিপিআইএমের পলিটব্যুরো কমরেড জ্যোতি বসুকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার অনুমোদন দেয়নি। (যদিও পরবর্তীকালে প্রমাণিত হয়েছে, সিদ্ধান্তটি ভুল ছিল।)
সম্প্রতি মন্ত্রিসভা সম্প্রসারণের সময় প্রধানমন্ত্রীর একটি মন্তব্য পর্যালোচনার দাবি রাখে। তিনি বলেছেন: ‘অনেক জেলার মন্ত্রী ছিল না, এই সম্প্রসারণের মাধ্যমে তাদের সন্তুষ্ট করেছি।’
মন্ত্রিসভায় বাংলাদেশের প্রতি জেলা থেকে মন্ত্রী নিতে পারলে খুব ভালো হয়। এতে মন্ত্রিসভা প্রতিনিধিত্বশীল হবে। কিন্তু এই ধারণাকে উৎসাহিত করা উচিত নয়। এটি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে প্রতিটি ধর্মের একজনকে মন্ত্রী করা, মুক্তিযোদ্ধা কোটা, তাঁদের সন্তানদের কোটা, আদিবাসী কোটা ইত্যাদি নানা দাবি আসতে থাকবে। এগুলো কোনোটাই সুস্থ দাবি নয়। কোটা প্রথার জন্য আমাদের পাবলিক সার্ভিস কমিশন এখন খাবি খাচ্ছে। মন্ত্রিসভা রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান ফোরাম। দলীয় সংসদ সদস্য ও দলের মধ্যে যাঁরা সবচেয়ে প্রতিভাবান, মেধাবী, দক্ষ, সম্ভাবনাময়, যাঁদের সততা প্রশ্নহীন, ক্ষেত্রবিশেষে অভিজ্ঞ, সৃজনশীল, অতীতে নানা বড় মাপের কাজে নেতৃত্ব দিয়েছেন, দলের প্রতি অনুগত, দলের জন্য ত্যাগ স্বীকার করেছেন ইত্যাদি বহু সূচক দেখে সংসদ নেতা তাঁর মন্ত্রিসভার নাম দলের হাইকমান্ডের বিবেচনার জন্য পেশ করবেন। এ ক্ষেত্রে আপস করার সুযোগ নেই। দলের একজন নেতা বা কর্মীও যেন বলতে না পারেন, ‘হায়! আমাদের অমুককে মূল্যায়ন করা হয়নি।’
আন্দোলন, সংগ্রাম ও দলের কাজে যাঁরা ত্যাগ স্বীকার করেছেন, তাঁদের মূল্যায়ন করা দলের কর্তব্য। কিন্তু তাই বলে তাঁদের মন্ত্রী করতে হবে, এমন দাবি করা উচিত নয়। তাঁদের ভিন্নভাবে মূল্যায়ন করতে হবে। ‘মন্ত্রিত্ব’ অনেক বড় একটি পদ। বাংলাদেশে সামরিক শাসকেরা এবং কয়েকটি রাজনৈতিক দল মন্ত্রিত্বকে ‘ছেলেখেলা’ বানিয়ে ফেলেছে। একটি মুদির দোকানও যিনি জীবনে চালাননি, তাঁকেও একটি মন্ত্রণালয় পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ফলে এসব মন্ত্রী আমলাদের ক্রীড়নকে পরিণত হয়েছেন। কাজ কিছু হয়নি।
সম্প্রতি তোফায়েল আহমেদ ও রাশেদ খান মেননের মন্ত্রিত্ব প্রত্যাখ্যানে আমাদের ক্ষমতার রাজনীতিতে যদি আত্মসম্মান বোধ ফিরে আসে এবং দলের ভেতরে আলোচনার চর্চা প্রতিষ্ঠিত হয়, তা হলে সেটাই হবে একটা বড় অর্জন। আশা করি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া এ ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবেন। ভুল থেকেই মানুষ শেখে। শেখ হাসিনা নিশ্চয় গণমাধ্যমে দেখেছেন, সর্বস্তরের রাজনীতিক ও রাজনীতিমনস্ক ব্যক্তিরা তোফায়েল ও মেননকে কীভাবে অভিনন্দিত করেছেন। এই অভিনন্দন ও শ্রদ্ধা তাঁদের প্রাপ্য ছিল।
আরও একটি বিষয় এখানে খুব সংক্ষেপে আলোচনা করতে চাই। কোনো সরকারের প্রধানমন্ত্রী ভবিষ্যৎদ্রষ্টা নন যে তাঁর মন্ত্রীরা কী রকম কাজ করবেন, তা আগাম জানবেন। তাই মন্ত্রিসভা গঠনের সময় একটা অলিখিত শর্ত থাকতে পারে যে, আড়াই বছর পর প্রত্যেকের কাজের মূল্যায়ন হবে। যাঁরা দক্ষতা দেখাতে পারেননি, যাঁদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে, তাঁদের বাদ দিতে হবে। তাঁদের অদক্ষতা বা দুর্নীতির দায় পুরো সরকার নিতে পারে না। সরকারপ্রধান তাঁর বিশেষ কমিটির (ব্যক্তিগত নয়) মূল্যায়নের ভিত্তিতে আড়াই বছর পর কিছু মন্ত্রীকে বাদ দেবেন এবং কিছু মন্ত্রীকে নতুন নিয়োগ দেবেন। বলা বাহুল্য, বাদ দেওয়া ও নিয়োগ দেওয়া—সবই দলের হাইকমান্ডের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে চূড়ান্ত করতে হবে। দল বা সরকার প্রধানমন্ত্রীর (সব সরকারের) প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি নয়, এটা সব সময় মনে রাখতে হবে। মন্ত্রিসভার নতুন সদস্যদের অন্তত আড়াই বছর কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। নইলে তাঁরা তাঁদের দক্ষতা প্রমাণের বা সরকারকে সহযোগিতা করার সুযোগ পাবেন না। ফুটবল ম্যাচের বদলি খেলোয়াড়ের সঙ্গে এটা তুলনীয় নয়। যদিও ফুটবল খেলার সঙ্গে সরকার পরিচালনার কোনো তুলনা হয় না।
তোফায়েল ও মেনন একটি ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাঁদের এই সিদ্ধান্ত আমাদের গণতন্ত্র চর্চায় ও রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তনে সামান্য ভূমিকাও যদি রাখে, তা হলে তাঁদের এই ত্যাগ সার্থক হবে।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ও উন্নয়নকর্মী।
যদ্দুর মনে পড়ে, অনেক দিন আগে এই বিষয়ে একবার লিখেছিলাম। কিন্তু সেই বক্তব্য পাঠক বা রাজনৈতিক মহলের মনোযোগ আকর্ষণ করেনি। কার্পেটের নিচে ধুলো আড়াল করতে বাংলাদেশে সরকার ও প্রধান দলগুলো খুবই পারঙ্গম। তারই খেসারত আজ দিচ্ছে মহাজোট সরকার।
বাংলাদেশের সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীকে প্রচুর ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। সংবিধান-প্রদত্ত ক্ষমতাবলে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে ‘স্বৈরাচার’ হয়ে ওঠা অসম্ভব কিছু নয়। ‘একনায়ক’ তো হতেই পারেন। বাস্তবে বিভিন্ন আমলে আমাদের প্রধানমন্ত্রীরা কী আচরণ করেছেন ও করছেন, তা পাঠক ভালো জানেন। অন্যান্য দেশে সংসদীয় পদ্ধতির সরকারে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কতটুকু, তার সঙ্গে মিলিয়ে সংবিধানের এই অংশটি পর্যালোচনার দাবি রাখে। বাংলাদেশে এতবার সংবিধান পরিবর্তন করা হয়েছে কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় পরিবর্তন আনা হয়নি। রাজনীতি থেকে শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়া অবসর নিলে এবং তাঁদের পরিবারের সদস্য ক্ষমতায় না থাকলে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতারা বুঝতে পারবেন, প্রধানমন্ত্রীর এই ক্ষমতার যন্ত্রণা কী! এখন নেত্রী-বন্দনায় মশগুল বলে তাঁরা ততটা উপলব্ধি করছেন না।
যখন কোনো দল বা জোট নির্বাচনে জয়লাভের পর সরকার গঠন করার আমন্ত্রণ পায়, তখন কার্যত কোনো একজন ‘নেতা’ আমন্ত্রণ পান না। যদিও আনুষ্ঠানিকতার স্বার্থে ‘সংসদ নেতা’কে সেই আমন্ত্রণ জানানো হয়। সংসদ নেতা সংবিধান-প্রদত্ত ক্ষমতা অনুযায়ী তাঁর ইচ্ছেমতো মন্ত্রিসভা গঠন করতে পারেন। এতে কোনো অন্যায় হয় না। কিন্তু তাঁর মনে রাখা উচিত, দল ছাড়া তাঁর কোনো মূল্য নেই। দল চেয়েছে বলেই তিনি সংসদ নেতা। দল না চাইলে তিনি আর দশজন সাংসদের মতো একজন সাংসদ! কাজেই এ ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য হওয়া উচিত, সংসদ নেতাকে দলের কেন্দ্রীয় হাইকমান্ডের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করে সবার মতামত শুনে মন্ত্রিসভার সদস্য নির্বাচন করা। একটা দল পাঁচ বছর জনমত তৈরি করে, ভোটারদের আস্থা অর্জন করে নির্বাচনে জয়লাভ করে এবং সরকার গঠন করার সুযোগ পায়। সেই সরকার কারা পরিচালনা করবেন, তা দলের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা ইস্যু। কারণ, একটি দক্ষ মন্ত্রিসভাই পাঁচ বছর দলকে নানা সমালোচনা ও ব্যর্থতার হাত থেকে রক্ষা করবে। সরকারের ব্যর্থতার জন্য দেশব্যাপী (টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া) দলের লাখ লাখ কর্মীকে অপদস্থ ও অপমানিত হতে হয়। দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে এটা মনে রাখতে হবে। তাই মন্ত্রিসভা গঠন-প্রক্রিয়া কখনো এক ব্যক্তির চিন্তাপ্রসূত কাজ হওয়া উচিত নয়। সংবিধানে যা-ই লেখা থাকুক, দলের গঠনতন্ত্রে এ ব্যাপারে বিধান থাকা উচিত। মন্ত্রিসভা গঠন, রদবদল ইত্যাদি ব্যাপারে সংসদ নেতাকে দলের হাইকমান্ডের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এই আলোচনা-প্রক্রিয়া সংসদ নেতার মর্জির ওপর যেন নির্ভর না করে। দলের গঠনতন্ত্রে এই আলোচনাকে বাধ্যতামূলক করতে হবে। মনে রাখতে হবে, যিনি সংসদ নেতা, তিনি সাংসদ হয়েছেন দলের কারণে। সাংসদ হয়েছেন বলেই তিনি সংসদ নেতা। দল ছাড়া তাঁর আর কোনো পরিচয় নেই। (‘বঙ্গবন্ধুকন্যা’ বা ‘দেশনেত্রী’ ইত্যাদি পরিচয় অতীত, বর্তমান বা ভবিষ্যতে বেশি পাওয়া যাবে না।) পারিবারিক পরিচয়বহির্ভূত নেতার কথা মনে রেখেই সংবিধান বা দলীয় গঠনতন্ত্র পর্যালোচনা করতে হবে।
‘মন্ত্রিসভা গঠন’ দলের বা অঙ্গসংগঠনের নানা কমিটি গঠনের মতো বিষয় নয়। দল বা অঙ্গসংগঠনের কমিটির দু-একজন ছাড়া কারও নামও অনেকে জানেন না। কার কী কাজ, তা-ও অনেকে জানেন না। পত্রিকায় দেখেছি, আওয়ামী মহিলা লীগের বর্ধিত সভা হয়েছে নয় বছর পর (১৪ সেপ্টেম্বর)। এগুলোই তো আমাদের গণতন্ত্র চর্চার নমুনা। মন্ত্রিসভা গঠনকে দলের এ ধরনের কমিটি গঠনের মতো দেখলে হবে না। মন্ত্রিসভার দক্ষতা ও সততার ওপর সরকার ও দলের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। বিশেষ করে দল পরেরবার নির্বাচনে জয়লাভ করতে পারবে কি না, তা-ও নির্ভর করে মন্ত্রিসভার দক্ষতা ও সততার ওপর।
এই কনভেনশনটা দলের মধ্যে চালু করতে হবে। এটাও গণতন্ত্র চর্চার একটি দিক। রাজনৈতিক দল বা সরকার কারও প্রাইভেট লিমিডেট কোম্পানি নয়। ব্যক্তি যা খুশি, সেভাবে দল বা সরকার চালাতে পারেন না। মন্ত্রী নিয়োগ কোম্পানির ম্যানেজার নিয়োগের মতো বিষয় নয়। ম্যানেজারকে যেমন কোম্পানির ‘হিউম্যান রিসোর্স বিভাগ’ নিয়োগ দেয়, মন্ত্রীকে সে রকমভাবে সরকারের মন্ত্রিপরিষদ সচিব ফোনে ডাকলেই হয় না। দলনেতা বা প্রধানমন্ত্রীকে দলের মধ্যে বা জোটের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে মন্ত্রী পদে নিয়োগ দেওয়াই নিয়ম। এটাই গণতন্ত্র। এটাই শোভন পদ্ধতি। মন্ত্রিপরিষদ সচিবের ফোন নিছক সরকারি আনুষ্ঠানিকতা। আমাদের বড় রাজনৈতিক দলে স্তাবক, আত্মসম্মানহীন ও মেরুদণ্ডহীন নেতার সংখ্যা বেশি হওয়ায় দুই দলের প্রধানই দলকে ‘প্রাইভেট কোম্পানির’ মতো পরিচালনা করার সাহস পেয়েছেন। ভারতে কোনো বুর্জোয়া বা বামপন্থী দলের প্রধান দলের নেতাদের সঙ্গে এ রকম আচরণ করার কথা চিন্তাই করতেন না। ভারতে দলের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র অত্যন্ত শক্ত ও শৃঙ্খলাপূর্ণ। সিপিআইএমের পলিটব্যুরো কমরেড জ্যোতি বসুকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার অনুমোদন দেয়নি। (যদিও পরবর্তীকালে প্রমাণিত হয়েছে, সিদ্ধান্তটি ভুল ছিল।)
সম্প্রতি মন্ত্রিসভা সম্প্রসারণের সময় প্রধানমন্ত্রীর একটি মন্তব্য পর্যালোচনার দাবি রাখে। তিনি বলেছেন: ‘অনেক জেলার মন্ত্রী ছিল না, এই সম্প্রসারণের মাধ্যমে তাদের সন্তুষ্ট করেছি।’
মন্ত্রিসভায় বাংলাদেশের প্রতি জেলা থেকে মন্ত্রী নিতে পারলে খুব ভালো হয়। এতে মন্ত্রিসভা প্রতিনিধিত্বশীল হবে। কিন্তু এই ধারণাকে উৎসাহিত করা উচিত নয়। এটি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে প্রতিটি ধর্মের একজনকে মন্ত্রী করা, মুক্তিযোদ্ধা কোটা, তাঁদের সন্তানদের কোটা, আদিবাসী কোটা ইত্যাদি নানা দাবি আসতে থাকবে। এগুলো কোনোটাই সুস্থ দাবি নয়। কোটা প্রথার জন্য আমাদের পাবলিক সার্ভিস কমিশন এখন খাবি খাচ্ছে। মন্ত্রিসভা রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান ফোরাম। দলীয় সংসদ সদস্য ও দলের মধ্যে যাঁরা সবচেয়ে প্রতিভাবান, মেধাবী, দক্ষ, সম্ভাবনাময়, যাঁদের সততা প্রশ্নহীন, ক্ষেত্রবিশেষে অভিজ্ঞ, সৃজনশীল, অতীতে নানা বড় মাপের কাজে নেতৃত্ব দিয়েছেন, দলের প্রতি অনুগত, দলের জন্য ত্যাগ স্বীকার করেছেন ইত্যাদি বহু সূচক দেখে সংসদ নেতা তাঁর মন্ত্রিসভার নাম দলের হাইকমান্ডের বিবেচনার জন্য পেশ করবেন। এ ক্ষেত্রে আপস করার সুযোগ নেই। দলের একজন নেতা বা কর্মীও যেন বলতে না পারেন, ‘হায়! আমাদের অমুককে মূল্যায়ন করা হয়নি।’
আন্দোলন, সংগ্রাম ও দলের কাজে যাঁরা ত্যাগ স্বীকার করেছেন, তাঁদের মূল্যায়ন করা দলের কর্তব্য। কিন্তু তাই বলে তাঁদের মন্ত্রী করতে হবে, এমন দাবি করা উচিত নয়। তাঁদের ভিন্নভাবে মূল্যায়ন করতে হবে। ‘মন্ত্রিত্ব’ অনেক বড় একটি পদ। বাংলাদেশে সামরিক শাসকেরা এবং কয়েকটি রাজনৈতিক দল মন্ত্রিত্বকে ‘ছেলেখেলা’ বানিয়ে ফেলেছে। একটি মুদির দোকানও যিনি জীবনে চালাননি, তাঁকেও একটি মন্ত্রণালয় পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ফলে এসব মন্ত্রী আমলাদের ক্রীড়নকে পরিণত হয়েছেন। কাজ কিছু হয়নি।
সম্প্রতি তোফায়েল আহমেদ ও রাশেদ খান মেননের মন্ত্রিত্ব প্রত্যাখ্যানে আমাদের ক্ষমতার রাজনীতিতে যদি আত্মসম্মান বোধ ফিরে আসে এবং দলের ভেতরে আলোচনার চর্চা প্রতিষ্ঠিত হয়, তা হলে সেটাই হবে একটা বড় অর্জন। আশা করি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া এ ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবেন। ভুল থেকেই মানুষ শেখে। শেখ হাসিনা নিশ্চয় গণমাধ্যমে দেখেছেন, সর্বস্তরের রাজনীতিক ও রাজনীতিমনস্ক ব্যক্তিরা তোফায়েল ও মেননকে কীভাবে অভিনন্দিত করেছেন। এই অভিনন্দন ও শ্রদ্ধা তাঁদের প্রাপ্য ছিল।
আরও একটি বিষয় এখানে খুব সংক্ষেপে আলোচনা করতে চাই। কোনো সরকারের প্রধানমন্ত্রী ভবিষ্যৎদ্রষ্টা নন যে তাঁর মন্ত্রীরা কী রকম কাজ করবেন, তা আগাম জানবেন। তাই মন্ত্রিসভা গঠনের সময় একটা অলিখিত শর্ত থাকতে পারে যে, আড়াই বছর পর প্রত্যেকের কাজের মূল্যায়ন হবে। যাঁরা দক্ষতা দেখাতে পারেননি, যাঁদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে, তাঁদের বাদ দিতে হবে। তাঁদের অদক্ষতা বা দুর্নীতির দায় পুরো সরকার নিতে পারে না। সরকারপ্রধান তাঁর বিশেষ কমিটির (ব্যক্তিগত নয়) মূল্যায়নের ভিত্তিতে আড়াই বছর পর কিছু মন্ত্রীকে বাদ দেবেন এবং কিছু মন্ত্রীকে নতুন নিয়োগ দেবেন। বলা বাহুল্য, বাদ দেওয়া ও নিয়োগ দেওয়া—সবই দলের হাইকমান্ডের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে চূড়ান্ত করতে হবে। দল বা সরকার প্রধানমন্ত্রীর (সব সরকারের) প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি নয়, এটা সব সময় মনে রাখতে হবে। মন্ত্রিসভার নতুন সদস্যদের অন্তত আড়াই বছর কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। নইলে তাঁরা তাঁদের দক্ষতা প্রমাণের বা সরকারকে সহযোগিতা করার সুযোগ পাবেন না। ফুটবল ম্যাচের বদলি খেলোয়াড়ের সঙ্গে এটা তুলনীয় নয়। যদিও ফুটবল খেলার সঙ্গে সরকার পরিচালনার কোনো তুলনা হয় না।
তোফায়েল ও মেনন একটি ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাঁদের এই সিদ্ধান্ত আমাদের গণতন্ত্র চর্চায় ও রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তনে সামান্য ভূমিকাও যদি রাখে, তা হলে তাঁদের এই ত্যাগ সার্থক হবে।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ও উন্নয়নকর্মী।
No comments