মুক্তিযোদ্ধার বাঁচার লড়াই -দেশমাতৃকার জন্য যাঁরা যুদ্ধে নেমেছিলেন তাঁদের অনেকেই আজ লড়ছেন দুবেলা দুমুঠো খাবারের জন্য। তাঁদের জীবনচিত্র নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন-চশমাটা ভাঙায় দর্জিগিরি বন্ধ রবিউলের by শামীম খান
ছোট্ট একটি খুপরি ঘর। পলিথিন ও টিনের ছাউনি। পাটকাঠির বেড়া দিয়ে কোনো রকমে ঘেরা। ভেতরে খাট-চৌকি কিছুই নেই। মাটির মেঝেতে তোশক ও কাঁথা বিছিয়ে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে কোনো রকমে জীবন কাটাচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধা রবিউল ইসলাম।
যত দিন দৈহিক সামর্থ্য ছিল, তত দিন ভ্যান চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেছেন তিনি। হার্নিয়ার ব্যথা বেড়ে যাওয়ায় ওই কাজ এখন বন্ধ। মাস ছয়েক ধরে বাড়িতে বসে দর্জিগিরি করে মাসে ৫০০-৬০০ টাকা আয় করছিলেন। চশমার ফ্রেম ভেঙে যাওয়ায় সে কাজটিও এখন করতে পারছেন না ঠিকমতো। বর্তমানে তাঁর একমাত্র ভরসা মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী ভাতা হিসেবে পাওয়া মাসিক দুই হাজার টাকা।
মাগুরা সদর উপজেলার বারাশিয়া গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা রবিউল ইসলাম এলাকায় সুরত আলী নামেও পরিচিত। গত বুধবার তাঁর বাড়িতে গিয়ে জানা যায়, চশমার নতুন ফ্রেম লাগাতে ২০০ টাকা প্রয়োজন, যা এখন তাঁর কাছে নেই। অগত্যা ঝাপসা চোখেই কোনো রকমে দিন কাটানো। অথচ মুক্তিযুদ্ধের সময় এ চোখ দিয়েই নিশানা ঠিক করতেন শত্রুপক্ষের।
মুক্তিযুদ্ধের কথা তুলতেই যেন চকচক করে উঠল রবিউলের ঝাপসা চোখ। বর্তমান অবস্থায় তাঁর অনুভূতি জানতে চাইলে রবিউল বলেন, 'নিজ দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছি। কোনো চাওয়া-পাওয়ার হিসাব করে যুদ্ধে যাইনি। ব্যক্তিগত জীবনযাপন ও প্রাপ্তি নিয়ে কখনো ভাবিনি, এখনো ভাবি না। যুদ্ধ করেছি, ভূখণ্ড পেয়েছি- এটাই মূল কথা। তবে সুদ, ঘুষ, শোষণ, দুঃশাসন থেকে দেশকে রক্ষা করতে যে যুদ্ধ করলাম; তা যেন শেষ হয়নি। উপরন্তু যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছি তাদের কেউ কেউ যখন জাতীয় পতাকার অধিকারী হয় ও প্রভাব খাটায় তখন খুব খারাপ লাগে। মাঝে মধ্যে মনে হয়, আবারও অস্ত্র হাতে নিয়ে রুখে দাঁড়াই।'
মুক্তিযোদ্ধা রবিউল ইসলাম বারাশিয়ার কৃষক মকছেদ মোল্লার আট সন্তানের মধ্যে সবার বড়। ১৯৭১ সালে ২০ বছর বয়সে কমান্ডার এনামুল কবির খোকনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভারতে প্রশিক্ষণ নেন তিনি। তাঁদের গ্রুপটি পরিচিত ছিল আকবর বাহিনী নামে। এ বাহিনীতে থেকেই বিজয়ের আগ পর্যন্ত মাগুরার শ্রীপুর ও সদরের কিছু অংশের বিভিন্ন অভিযানে অংশ নিয়েছেন রবিউল।
অনেক স্মৃতির মধ্যে শ্রীপুরের খামারপাড়া, নাকোল, রাধানগর যুদ্ধের স্মৃতি এখনো রবিউলকে নাড়া দেয়। খামারপাড়ার যুদ্ধে তাঁদের আক্রমণে ৯ পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়েছিল। যুদ্ধের দিনগুলোর মধ্যে একটি ভোররাতের কথা কোনো দিন ভুলবেন না রবিউল ইসলাম। এটি তাঁর জীবনের এক বিয়োগান্তক অধ্যায়। তাঁদের স্থানীয় কমান্ডার এনামুল হক তাঁর এসএমজির নল পরিষ্কার করার সময় যেটি দিয়ে নল পরিষ্কার করতে হয় হঠাৎ তা আটকে যায়। এনামুল হক নল থেকে যন্ত্রটি বের করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। একপর্যায়ে কাজটির দায়িত্ব দেন রবিউল ইসলামের ওপর। তিনি ভোররাতের দিকে নিজ ঘরে বসে নল পরিষ্কার করার চেষ্টা করছিলেন; কিন্তু কিছুতেই সম্ভব হচ্ছিল না। একপর্যায়ে তাঁর মনে হলো, ফাঁকা গুলি ছুড়লে গুলির চাপে এটি বেরিয়ে আসতে পারে। সে অনুযায়ী তিনি বারান্দার দিকে তাক করে এসএমজি থেকে একটি গুলি ছোড়েন। সেখানে আগে থেকেই তাঁর পাঁচ বছর বয়সী ছোট ভাই ইসহাক বসে ছিল, যা খেয়াল করেননি রবিউল। তাঁর ছোড়া গুলিতেই মর্মান্তিক মৃত্যু হলো ইসহাকের। এ দুর্বিষহ স্মৃতি এখনো তাড়িয়ে বেড়ায় রবিউলকে। পরবর্তী জীবনে প্রথম স্ত্রী ও বড় ছেলের অস্বাভাবিক মৃত্যু ঘটে। কিন্তু নিজের হাতে ছোট ভাইয়ের মৃত্যুই এখনো বারবার শোকে কাতর করে তাঁকে।
কথা প্রসঙ্গে রবিউল ইসলামের বর্তমান স্ত্রী রিনা বেগম বলেন, "বিশ বছর হলো তাঁর সাথে ঘর করছি। কোনোদিন কারো কাছে হাত পাততে দেখিনি। খুব নিভৃত জীবনযাপন করেন তিনি। সাহায্য-সহায়তার জন্য কারো কাছে যেতে চান না। তাঁর একটাই কথা, 'যুদ্ধ বেচে কিছু নেব না। কোনো কিছু পাওয়ার জন্য যুদ্ধ করিনি।' এ কারণে প্রথমে ভ্যান চালিয়ে এবং পরে দর্জিগিরি করে জীবনযাপন করেছেন।" রিনা বেগম আরো বলেন, 'আমাদের নিজেদের কোনো জমি নাই। শ্বশুরের আদি বাড়ি অনেক আগেই বিক্রি হয়ে গেছে। মাঝে কিছু দিন পাশের গ্রাম বরুনাতৈলে ছিলাম। বছর কয়েক হলো আমার স্বামীর ছোট ভাই মাজেদ মোল্লার কাছ থেকে নবগঙ্গার চরের সামান্য জমি নিয়ে কোনো রকমে মাথা গুঁজে আছি। তিন ছেলেমেয়ের মধ্যে একজন মারা গেছে। মেয়ে রানীর বিয়ে দিয়েছি। এখন সংসারে আছে একমাত্র ছোট ছেলে রকিবুল। শহরের মেন্টর নামের একটি স্কুলে নার্সারিতে পড়ে। অর্থ কষ্টের সংসারে তার স্কুলের খরচ চালানো সম্ভব হচ্ছে না। বাড়িতে যে ঘরটি দেখছেন আগে এর ছাউনি ছিল শুধুই পলিথিন ও পাটকাঠির। ফারুক হোসেন নামের এক মুক্তিযোদ্ধা কিছু টিন কিনে দিয়ে ছাউনি দিয়ে দিয়েছেন। তবে এসব নিয়ে আমার কোনো অভিযোগ নেই। বরং গর্ব অনুভব করি।'
স্ত্রীর কথায় সায় দিয়ে রবিউল ইসলামও বললেন, 'যত দিন বেঁচে থাকব এ পতাকার গৌরব নিয়েই থাকতে চাই। দেশের মানুষ ভালো থাক, তাতেই আমাদের সব প্রাপ্তি।'
মাগুরা সদর উপজেলার বারাশিয়া গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা রবিউল ইসলাম এলাকায় সুরত আলী নামেও পরিচিত। গত বুধবার তাঁর বাড়িতে গিয়ে জানা যায়, চশমার নতুন ফ্রেম লাগাতে ২০০ টাকা প্রয়োজন, যা এখন তাঁর কাছে নেই। অগত্যা ঝাপসা চোখেই কোনো রকমে দিন কাটানো। অথচ মুক্তিযুদ্ধের সময় এ চোখ দিয়েই নিশানা ঠিক করতেন শত্রুপক্ষের।
মুক্তিযুদ্ধের কথা তুলতেই যেন চকচক করে উঠল রবিউলের ঝাপসা চোখ। বর্তমান অবস্থায় তাঁর অনুভূতি জানতে চাইলে রবিউল বলেন, 'নিজ দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছি। কোনো চাওয়া-পাওয়ার হিসাব করে যুদ্ধে যাইনি। ব্যক্তিগত জীবনযাপন ও প্রাপ্তি নিয়ে কখনো ভাবিনি, এখনো ভাবি না। যুদ্ধ করেছি, ভূখণ্ড পেয়েছি- এটাই মূল কথা। তবে সুদ, ঘুষ, শোষণ, দুঃশাসন থেকে দেশকে রক্ষা করতে যে যুদ্ধ করলাম; তা যেন শেষ হয়নি। উপরন্তু যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছি তাদের কেউ কেউ যখন জাতীয় পতাকার অধিকারী হয় ও প্রভাব খাটায় তখন খুব খারাপ লাগে। মাঝে মধ্যে মনে হয়, আবারও অস্ত্র হাতে নিয়ে রুখে দাঁড়াই।'
মুক্তিযোদ্ধা রবিউল ইসলাম বারাশিয়ার কৃষক মকছেদ মোল্লার আট সন্তানের মধ্যে সবার বড়। ১৯৭১ সালে ২০ বছর বয়সে কমান্ডার এনামুল কবির খোকনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভারতে প্রশিক্ষণ নেন তিনি। তাঁদের গ্রুপটি পরিচিত ছিল আকবর বাহিনী নামে। এ বাহিনীতে থেকেই বিজয়ের আগ পর্যন্ত মাগুরার শ্রীপুর ও সদরের কিছু অংশের বিভিন্ন অভিযানে অংশ নিয়েছেন রবিউল।
অনেক স্মৃতির মধ্যে শ্রীপুরের খামারপাড়া, নাকোল, রাধানগর যুদ্ধের স্মৃতি এখনো রবিউলকে নাড়া দেয়। খামারপাড়ার যুদ্ধে তাঁদের আক্রমণে ৯ পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়েছিল। যুদ্ধের দিনগুলোর মধ্যে একটি ভোররাতের কথা কোনো দিন ভুলবেন না রবিউল ইসলাম। এটি তাঁর জীবনের এক বিয়োগান্তক অধ্যায়। তাঁদের স্থানীয় কমান্ডার এনামুল হক তাঁর এসএমজির নল পরিষ্কার করার সময় যেটি দিয়ে নল পরিষ্কার করতে হয় হঠাৎ তা আটকে যায়। এনামুল হক নল থেকে যন্ত্রটি বের করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। একপর্যায়ে কাজটির দায়িত্ব দেন রবিউল ইসলামের ওপর। তিনি ভোররাতের দিকে নিজ ঘরে বসে নল পরিষ্কার করার চেষ্টা করছিলেন; কিন্তু কিছুতেই সম্ভব হচ্ছিল না। একপর্যায়ে তাঁর মনে হলো, ফাঁকা গুলি ছুড়লে গুলির চাপে এটি বেরিয়ে আসতে পারে। সে অনুযায়ী তিনি বারান্দার দিকে তাক করে এসএমজি থেকে একটি গুলি ছোড়েন। সেখানে আগে থেকেই তাঁর পাঁচ বছর বয়সী ছোট ভাই ইসহাক বসে ছিল, যা খেয়াল করেননি রবিউল। তাঁর ছোড়া গুলিতেই মর্মান্তিক মৃত্যু হলো ইসহাকের। এ দুর্বিষহ স্মৃতি এখনো তাড়িয়ে বেড়ায় রবিউলকে। পরবর্তী জীবনে প্রথম স্ত্রী ও বড় ছেলের অস্বাভাবিক মৃত্যু ঘটে। কিন্তু নিজের হাতে ছোট ভাইয়ের মৃত্যুই এখনো বারবার শোকে কাতর করে তাঁকে।
কথা প্রসঙ্গে রবিউল ইসলামের বর্তমান স্ত্রী রিনা বেগম বলেন, "বিশ বছর হলো তাঁর সাথে ঘর করছি। কোনোদিন কারো কাছে হাত পাততে দেখিনি। খুব নিভৃত জীবনযাপন করেন তিনি। সাহায্য-সহায়তার জন্য কারো কাছে যেতে চান না। তাঁর একটাই কথা, 'যুদ্ধ বেচে কিছু নেব না। কোনো কিছু পাওয়ার জন্য যুদ্ধ করিনি।' এ কারণে প্রথমে ভ্যান চালিয়ে এবং পরে দর্জিগিরি করে জীবনযাপন করেছেন।" রিনা বেগম আরো বলেন, 'আমাদের নিজেদের কোনো জমি নাই। শ্বশুরের আদি বাড়ি অনেক আগেই বিক্রি হয়ে গেছে। মাঝে কিছু দিন পাশের গ্রাম বরুনাতৈলে ছিলাম। বছর কয়েক হলো আমার স্বামীর ছোট ভাই মাজেদ মোল্লার কাছ থেকে নবগঙ্গার চরের সামান্য জমি নিয়ে কোনো রকমে মাথা গুঁজে আছি। তিন ছেলেমেয়ের মধ্যে একজন মারা গেছে। মেয়ে রানীর বিয়ে দিয়েছি। এখন সংসারে আছে একমাত্র ছোট ছেলে রকিবুল। শহরের মেন্টর নামের একটি স্কুলে নার্সারিতে পড়ে। অর্থ কষ্টের সংসারে তার স্কুলের খরচ চালানো সম্ভব হচ্ছে না। বাড়িতে যে ঘরটি দেখছেন আগে এর ছাউনি ছিল শুধুই পলিথিন ও পাটকাঠির। ফারুক হোসেন নামের এক মুক্তিযোদ্ধা কিছু টিন কিনে দিয়ে ছাউনি দিয়ে দিয়েছেন। তবে এসব নিয়ে আমার কোনো অভিযোগ নেই। বরং গর্ব অনুভব করি।'
স্ত্রীর কথায় সায় দিয়ে রবিউল ইসলামও বললেন, 'যত দিন বেঁচে থাকব এ পতাকার গৌরব নিয়েই থাকতে চাই। দেশের মানুষ ভালো থাক, তাতেই আমাদের সব প্রাপ্তি।'
No comments