যুক্তি তর্ক গল্প- ছকে বাঁধা রাজনীতির ঘুরপাক by আবুল মোমেন
মন্ত্রিপরিষদ সম্প্রসারণ নিয়ে যে নাটক হলো এবং এখনো কিছুটা চলছে, তা ক্ষমতার রাজনীতির অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তারই বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু এতে দেশে যে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা চলছে, তা কাটবে না।
যেসব বড় কেলেঙ্কারি, ব্যর্থতার কারণে যেকোনো গণতান্ত্রিক সরকার অত্যন্ত চাপে থাকার কথা, তা বিরোধী দল কতটা কাজে লাগাতে পারছে—সেটা নির্বাচনের ফলাফলের আগে বোঝা যাবে না। কিন্তু নির্বাচন নিয়েই অনিশ্চয়তা রয়েছে।
তবে এ রকম অনিশ্চয়তা বাংলাদেশের জন্য নতুন কিছু নয়। মুশকিল হলো এ থেকে ভালো কিছুর আশা নেই। ক্ষমতার লড়াই বড় দুই দলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এ থেকে জনগণের সরাসরি পাওয়ার কিছু নেই। তবে এই যেহেতু বাস্তব, তাই এর গতি-প্রকৃতি ও এ থেকে কী ঘটতে পারে, তার সন্ধান করা যায়।
প্রতিটি সরকারই পুনর্নির্বাচিত হতে চায়। কিন্তু তার জন্য তারা যেসব কৌশল প্রয়োগ করে, তাতে ক্ষমতার অপপ্রয়োগ কিংবা জবরদস্তির ব্যাপার ঘটে। সেটা বিএনপির আমলে বিচারপতিদের চাকরির বয়স দুই বছর বাড়িয়ে দেওয়ার মধ্যে যেমন ছিল, তেমনি এবারে আওয়ামী লীগের আমলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার তুলে দেওয়ার মধ্যেও রয়েছে।
এযাবৎ আওয়ামী লীগ আন্দোলন করেই দাবি আদায় করেছে—সেটা যেমন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা, তেমনি বিচারপতি কে এম হাসানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হওয়ার পথ বন্ধ করার ক্ষেত্রে ঘটেছে।
এবার বিএনপির সামনে পরীক্ষা, তারা দাবি অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকার আদায় করতে পারছে কি না। বিএনপি বড় দল হলেও তাদের এককভাবে মাঠপর্যায়ের আন্দোলনের অভিজ্ঞতা নেই বললেই চলে। আশির দশকের এরশাদবিরোধী আন্দোলন এবং নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনে বরাবরের মতোই মাঠে মূল ভূমিকা পালন করেছে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের কর্মীরাই। তবে তখন বিএনপির ছাত্রসংগঠন ছাত্রদল যথেষ্ট সাহসী ও সক্রিয় ভূমিকা পালন করে মাঠে বিএনপির উপস্থিতি জানান দিয়ে রেখেছিল। নব্বইয়ের পর থেকে সামগ্রিকভাবে দেশের গৌরবময় ছাত্ররাজনীতির ঐতিহ্যে ভাটা শুরু হয়। ছাত্রদল তার ব্যতিক্রম নয়, বরং ছাত্রলীগের মতো তাদেরও ভালো রকম অবক্ষয় ঘটেছে। আর জামায়াতের ছাত্রসংগঠন ছাত্রশিবিরেরও রাজনীতির শুরুটাই অবক্ষয় দিয়ে। এখন এ পর্যায়ে বিএনপি আন্দোলনকে মাঠপর্যায়ে চাঙা করতে চাইলে সহযোগী শক্তির সাহায্য না নিয়ে পারবে না। তা ছাড়া, বর্তমান সময়ের তীব্র প্রতিকূলতার মধ্যে তাদের জোটভুক্ত জামায়াতও তো মাঠে নেমে আন্দোলনকে জঙ্গি রূপ দেওয়ার সুযোগের অপেক্ষায় আছে। তারা এ সুযোগ হাতছাড়া করবে না।
যুদ্ধাপরাধ ও দলের শীর্ষস্থানীয় পদের যুদ্ধাপরাধীদের ভাবমূর্তির সংকটের বোঝা বহন করে জামায়াত বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের ভোটারদের ব্যাপক হারে টানতে পারবে না। তবে অভিজ্ঞ নাগরিকদের অনেকেরই ধারণা, আদর্শিক অস্পষ্টতা এবং সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে আওয়ামী লীগবিরোধী রাজনীতিতে বড় দল হলেও কার্যকারিতা ও প্রভাবের দিক থেকে অধিকতর স্পষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শের দল জামায়াত বিএনপিকে ছাড়িয়ে যাবে। স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, উন্নয়ন ইত্যাদি নানা দিক থেকে বিবেচনা করে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী এটাকে দেশের জন্য কাম্য পরিণতি বলে গণ্য করবে না।
দেশের রাজনীতিতে আদর্শের দ্বন্দ্বের কথা সবাই জানি। এর একদিকে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ও অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধ—বহুকাল এভাবেই চলছিল। কিন্তু কালের প্রভাবে এবং আওয়ামী লীগের সচেতন চেষ্টায় তাতে কিছু পরিবর্তন এসেছে। আওয়ামী লীগ ও ধর্মীয় রাজনীতির মধ্যে বৈপরীত্য সৃষ্টির ফায়দা রাজনীতিতে বহুকাল মিললেও পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে এখন। এটা ঘটেছে মূলত ধর্ম তথা ইসলাম সম্পর্কে সাধারণভাবে মানুষের জানার পরিধি আগের চেয়ে বাড়ার ফলে। অন্যদিকে ব্যবসা-বাণিজ্য তথা আয়-উপার্জনের সুযোগ বাড়ায় মানুষ জাগতিক জীবনে আগ্রহী ও মনোযোগী হচ্ছে। ফলে জীবনে আচার-অনুষ্ঠানের বাইরে করণীয় আরও অনেক বিষয় তার আগ্রহের ও চর্চার আওতায় আসছে। জীবনে সচ্ছলতার নানা শোভন-অশোভন প্রকাশও ঘটছে। মানুষ ধর্মের আলোচনায় নীতি-নৈতিকতার বিষয়কে টানছে এবং এভাবে তার আলোচনা বা বিবেচনার গণ্ডি সংকীর্ণ ধর্মচর্চা ছাড়িয়ে ধর্ম ও নৈতিকতার বৃহত্তর পরিসরে চলে যাচ্ছে। তাতে ধর্মীয় বিষয়ে অতীতে নির্দিষ্ট কিছু মানুষের যে একচ্ছত্র অধিকার ও প্রভাব ছিল, তা ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছে। এর একটা সুদূরপ্রসারী ফল হচ্ছে ভয়ভীতি ও প্রলোভন দেখিয়ে ধর্মীয় নসিহতের যে ধারা বহুকাল ধরে চলে আসছিল, তার পাশাপাশি ধর্মের সহিষ্ণু ও উদার মানবিক একটি আলোচনা ও চর্চার ধারাও গড়ে উঠছে। দেখা যাচ্ছে, ধর্মীয় উগ্রবাদীদের চেয়ে এই উদার মনোভাবের মানুষের প্রতি সমাজের আগ্রহ ও শ্রদ্ধা বাড়ছে।
সংকীর্ণতা ও চিন্তার স্থবিরতা কাটতে থাকায় ইসলাম ও গণতান্ত্রিক রাজনীতি এখন আর পরস্পর বিরোধী নয়। এ পরিবেশে এখন পর্যন্ত সাধারণ মানুষের দল আওয়ামী লীগের পক্ষে রাজনীতিতে ধর্মীয় সংস্কৃতি অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া সহজ হয়েছে। এটাকে আলাদা রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে তাদের নিতে হয়নি।
এ বাস্তবতায় রাজনৈতিকভাবে দুটি দিক থেকে আওয়ামী লীগ সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। প্রথমত, মুক্তিযুদ্ধের অর্জনগুলো ধারণ করার জন্য তার সমকক্ষ প্রতিপক্ষ এখনো নেই মাঠে। দ্বিতীয়ত, তার বিরুদ্ধে ইসলাম বিপন্ন করার অভিযোগ; যা আমিনী প্রমুখ এখনো চালিয়ে যাচ্ছেন, বৃহত্তর সমাজে তেমনটা আর গৃহীত হবে না।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যেকোনো সরকারের জন্য স্টক মার্কেট, হলমার্ক ও ডেসটিনি কেলেঙ্কারি আর পদ্মা সেতু নিয়ে দোলাচল ও অর্থায়নের টানাহেঁচড়া নির্বাচনে বিপদে পড়ার কারণ হতে পারে। এসব ঘটেছে দুর্নীতি ও অদক্ষতার ফলে। এর দায় সরকার ফেলতে পারবে না।
কিন্তু এসব হলো একটি সরকারের কার্যক্রমের মূল্যায়ন ও সমালোচনা। আমাদের দেশে এ রকম ইস্যু নিয়ে মাঠ গরম করা আন্দোলন জমানো মুশকিল। কারণ, অপর বড় দল বিএনপিও দুর্নীতিগ্রস্ত ও অদক্ষ। ফলে এসব ইস্যু ভোটের রাজনীতিতে প্রচারণায় কাজে লাগলেও আন্দোলনকে রাজপথে নিয়ে আসতে হলে প্রয়োজন দেশ, রাষ্ট্র, সংবিধানভিত্তিক মৌলিক ইস্যু। তাই বিএনপি ভোটের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগকে ঘায়েল করার মোক্ষম সব ইস্যু থাকতেও তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুটাকেই প্রধান করে ধরতে চাইছে। তবে অধিকাংশ বিশ্লেষক মনে করেন, আজকাল নির্বাচনে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক নজরদারি যে পর্যায়ে থাকে তাতে জনগণের রায় উল্টে দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ, নির্বাচনে কোনো পক্ষ জবরদস্তি কিছু করলে তা ধরা পড়বেই। কিন্তু এ ভাবনা নিয়ে এগোতে ভরসা পাবে না বিএনপি। কারণ, আওয়ামী লীগ জবরদস্তি কিছু ঘটিয়ে ফেললে তারা পরে আন্দোলন করে তা রহিত বা বাতিল করতে পারবে কি না, সে বিষয়ে নিজেরা আত্মবিশ্বাসী নয়। ফলে বিএনপির সাম্প্রতিক বাগাড়ম্বরের তুলনায় কার্যকলাপে দোলাচল, বিভ্রান্তির ছাপই বেশি।
বিএনপি নেতৃত্ব মনে হয় আপাতত মনোযোগ দিয়েছে বাংলাদেশে ক্ষমতার ক্ষেত্রে প্রভাবশালী বলে পরিচিত ভারত, সৌদি আরব, যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দাতা দেশের আস্থা অর্জন এবং তাদের মাধ্যমে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির দিকে। ফলে এখন তারা মাঠের আন্দোলন চাঙা করতে চায় না। কারণ, তাতে জামায়াতের সক্রিয় ভূমিকা প্রকট হয়ে ওঠার আশঙ্কাই বেশি। তারা চাইছে দাতা দেশ ও ভারতের এবং সুশীল সমাজের মাধ্যমে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য সরকারের ওপর চাপ বাড়াতে। আর এর জন্য দুই বড় দলের মধ্যে আপস বৈঠকের কথাই স্বভাবত বলা হবে বেশি।
চাপ কাটিয়ে ওঠার জন্য আওয়ামী লীগের হাতে একেবারেই যে কোনো অস্ত্র নেই, তা নয়। বস্তুত অত্যন্ত জোরালো অস্ত্র আছে। পঁচাত্তরের বঙ্গবন্ধু হত্যার সুবিধাভোগী বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের ভূমিকা যেমন প্রশ্নবিদ্ধ থেকে গেল, তেমনি ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টাতে তৎকালীন সরকার ও তারেকের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ থেকে যাচ্ছে।
এ দুটি প্রশ্নের অবসান হতে পারত— প্রথমত, বিস্তারিত নিরপেক্ষ বিশ্বাসযোগ্য তদন্তের মাধ্যমে ঘটনা উদ্ঘাটন করে প্রমাণ করা যে অভিযোগ ও সন্দেহ অমূলক। সেটা সম্ভব না হলে দ্বিতীয় উপায়টি হাতে থাকে—তা হলো এ অভিযোগ থেকে যদি আওয়ামী লীগ বিএনপিকে মুক্তি দেয়, যেমন করে নেলসন ম্যান্ডেলা ও তাঁর দল এএনসি দেশের পূর্ববর্তী বর্ণবৈষম্যবাদী নির্যাতক সরকারগুলোর কর্মকাণ্ডকে বিচারের আওতায় না এনে সমঝোতা-সৌহার্দ্যের বাতাবরণ তৈরি করেছে।
তবে বুঝতে হবে দুই দেশের পরিস্থিতি এক নয়। দক্ষিণ আফ্রিকায় এএনসির বিজয়ের মাধ্যমে যে বাস্তবতার সূচনা হয়েছে, তাতে সংখ্যালঘু শ্বেতাঙ্গদের নেতৃত্বাধীন কোনো দলের পক্ষে এএনসির রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই আর থাকেনি। বিপরীতে জন্মলগ্ন থেকে ২০০৪-এর গ্রেনেড হামলা পর্যন্ত বিএনপির রাজনীতিতে এমন অনেক ষড়যন্ত্র ও অস্পষ্টতার গ্রন্থি আছে, যার সরাসরি ভুক্তভোগী আওয়ামী লীগ। তা ছাড়া, সমকক্ষ প্রতিদ্বন্দ্বী দল হওয়ায় আওয়ামী লীগ এই ঔদার্য দেখাতে যাবে না। তাতে রাজনৈতিকভাবে লাভের চেয়ে ঝুঁকি থাকবে বেশি।
বাংলাদেশ যে বারবার রাজনৈতিক হোঁচট খাচ্ছে, তা এড়াতে হলে প্রথমে বড় দুই দলকে রাজনৈতিক লক্ষ্য, আদর্শ ও ইতিহাস নিয়ে কার্যকর সমঝোতায় আসতে হবে। সে ক্ষেত্রে যে রাজনৈতিক প্রত্যয় অগ্রাধিকার পাবে তা হলো, পাকিস্তানি ভাবাদর্শকে প্রত্যাখ্যান করে একটি গণতান্ত্রিক বিকাশের পথে রাজনীতিকে পরিচালিত করতে চেয়েছিল এ দেশের মানুষ। এ প্রত্যয়ে দুটি বড় দলকেই, অন্তত আদর্শিকভাবে, আস্থাশীল হতে হবে। নতুবা নানা দোষ, দুর্বলতা, ব্যর্থতা সত্ত্বেও সমাজের একটা বড় অংশ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে এখানেই পার্থক্যটা টানবে। আর যে আদর্শের জন্য মানুষ একদিন সব ফেলে জান বাজি রেখে যুদ্ধ করেছিল, তা রক্ষায় সে বারবার রাজপথ কাঁপানো আন্দোলনে নেমে যাবে। মানুষের এই ভাবাবেগের রাজনৈতিক সুবিধা আওয়ামী লীগই পাবে।
আওয়ামী লীগ যেমন কালের বিবর্তনে ধর্মভিত্তিক রাজনীতিতে ভাগ বসাতে পেরেছে, তেমনি বিএনপিকে তাদের রাজনীতিতে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে ধারণ করার পরিসর সত্যি সত্যি তৈরি করতে হবে। সেটা জামায়াতকে পাশে রেখে বা চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে থেকে অর্জন করা সম্ভব নয়।
ফলে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতি থেকে বৈরিতা-সংঘাতের উপাদান কাটবে কি না, তা অনেকাংশে নির্ভর করছে কিন্তু বিএনপির ওপর। দেশের বাস্তবতা, ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় দুই বড় দলে মৌলিক কিছু বিষয়ে সমঝোতা হলেই প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাজনীতির ধারা তৈরি হতে পারবে। তখনই সরকারের বিভিন্ন ব্যর্থতা নিয়ে রাজনীতি ফলপ্রসূ হবে, সরকার পরিবর্তনের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া কার্যকর ভূমিকা নেবে। আর তারা যদি দলীয় রাজনীতির বিবর্তন-উত্তরণের কথা না ভেবে কেবল ক্ষমতার কথাই ভাবতে থাকে, তা হলে এ দেশে রাজনৈতিক হানাহানি, অস্থিরতা চলবেই এবং তথাকথিত বিদেশি মুরব্বিদের হস্তক্ষেপের প্রবণতাও অব্যাহত থাকবে।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
তবে এ রকম অনিশ্চয়তা বাংলাদেশের জন্য নতুন কিছু নয়। মুশকিল হলো এ থেকে ভালো কিছুর আশা নেই। ক্ষমতার লড়াই বড় দুই দলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এ থেকে জনগণের সরাসরি পাওয়ার কিছু নেই। তবে এই যেহেতু বাস্তব, তাই এর গতি-প্রকৃতি ও এ থেকে কী ঘটতে পারে, তার সন্ধান করা যায়।
প্রতিটি সরকারই পুনর্নির্বাচিত হতে চায়। কিন্তু তার জন্য তারা যেসব কৌশল প্রয়োগ করে, তাতে ক্ষমতার অপপ্রয়োগ কিংবা জবরদস্তির ব্যাপার ঘটে। সেটা বিএনপির আমলে বিচারপতিদের চাকরির বয়স দুই বছর বাড়িয়ে দেওয়ার মধ্যে যেমন ছিল, তেমনি এবারে আওয়ামী লীগের আমলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার তুলে দেওয়ার মধ্যেও রয়েছে।
এযাবৎ আওয়ামী লীগ আন্দোলন করেই দাবি আদায় করেছে—সেটা যেমন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা, তেমনি বিচারপতি কে এম হাসানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হওয়ার পথ বন্ধ করার ক্ষেত্রে ঘটেছে।
এবার বিএনপির সামনে পরীক্ষা, তারা দাবি অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকার আদায় করতে পারছে কি না। বিএনপি বড় দল হলেও তাদের এককভাবে মাঠপর্যায়ের আন্দোলনের অভিজ্ঞতা নেই বললেই চলে। আশির দশকের এরশাদবিরোধী আন্দোলন এবং নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনে বরাবরের মতোই মাঠে মূল ভূমিকা পালন করেছে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের কর্মীরাই। তবে তখন বিএনপির ছাত্রসংগঠন ছাত্রদল যথেষ্ট সাহসী ও সক্রিয় ভূমিকা পালন করে মাঠে বিএনপির উপস্থিতি জানান দিয়ে রেখেছিল। নব্বইয়ের পর থেকে সামগ্রিকভাবে দেশের গৌরবময় ছাত্ররাজনীতির ঐতিহ্যে ভাটা শুরু হয়। ছাত্রদল তার ব্যতিক্রম নয়, বরং ছাত্রলীগের মতো তাদেরও ভালো রকম অবক্ষয় ঘটেছে। আর জামায়াতের ছাত্রসংগঠন ছাত্রশিবিরেরও রাজনীতির শুরুটাই অবক্ষয় দিয়ে। এখন এ পর্যায়ে বিএনপি আন্দোলনকে মাঠপর্যায়ে চাঙা করতে চাইলে সহযোগী শক্তির সাহায্য না নিয়ে পারবে না। তা ছাড়া, বর্তমান সময়ের তীব্র প্রতিকূলতার মধ্যে তাদের জোটভুক্ত জামায়াতও তো মাঠে নেমে আন্দোলনকে জঙ্গি রূপ দেওয়ার সুযোগের অপেক্ষায় আছে। তারা এ সুযোগ হাতছাড়া করবে না।
যুদ্ধাপরাধ ও দলের শীর্ষস্থানীয় পদের যুদ্ধাপরাধীদের ভাবমূর্তির সংকটের বোঝা বহন করে জামায়াত বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের ভোটারদের ব্যাপক হারে টানতে পারবে না। তবে অভিজ্ঞ নাগরিকদের অনেকেরই ধারণা, আদর্শিক অস্পষ্টতা এবং সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে আওয়ামী লীগবিরোধী রাজনীতিতে বড় দল হলেও কার্যকারিতা ও প্রভাবের দিক থেকে অধিকতর স্পষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শের দল জামায়াত বিএনপিকে ছাড়িয়ে যাবে। স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, উন্নয়ন ইত্যাদি নানা দিক থেকে বিবেচনা করে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী এটাকে দেশের জন্য কাম্য পরিণতি বলে গণ্য করবে না।
দেশের রাজনীতিতে আদর্শের দ্বন্দ্বের কথা সবাই জানি। এর একদিকে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ও অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধ—বহুকাল এভাবেই চলছিল। কিন্তু কালের প্রভাবে এবং আওয়ামী লীগের সচেতন চেষ্টায় তাতে কিছু পরিবর্তন এসেছে। আওয়ামী লীগ ও ধর্মীয় রাজনীতির মধ্যে বৈপরীত্য সৃষ্টির ফায়দা রাজনীতিতে বহুকাল মিললেও পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে এখন। এটা ঘটেছে মূলত ধর্ম তথা ইসলাম সম্পর্কে সাধারণভাবে মানুষের জানার পরিধি আগের চেয়ে বাড়ার ফলে। অন্যদিকে ব্যবসা-বাণিজ্য তথা আয়-উপার্জনের সুযোগ বাড়ায় মানুষ জাগতিক জীবনে আগ্রহী ও মনোযোগী হচ্ছে। ফলে জীবনে আচার-অনুষ্ঠানের বাইরে করণীয় আরও অনেক বিষয় তার আগ্রহের ও চর্চার আওতায় আসছে। জীবনে সচ্ছলতার নানা শোভন-অশোভন প্রকাশও ঘটছে। মানুষ ধর্মের আলোচনায় নীতি-নৈতিকতার বিষয়কে টানছে এবং এভাবে তার আলোচনা বা বিবেচনার গণ্ডি সংকীর্ণ ধর্মচর্চা ছাড়িয়ে ধর্ম ও নৈতিকতার বৃহত্তর পরিসরে চলে যাচ্ছে। তাতে ধর্মীয় বিষয়ে অতীতে নির্দিষ্ট কিছু মানুষের যে একচ্ছত্র অধিকার ও প্রভাব ছিল, তা ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছে। এর একটা সুদূরপ্রসারী ফল হচ্ছে ভয়ভীতি ও প্রলোভন দেখিয়ে ধর্মীয় নসিহতের যে ধারা বহুকাল ধরে চলে আসছিল, তার পাশাপাশি ধর্মের সহিষ্ণু ও উদার মানবিক একটি আলোচনা ও চর্চার ধারাও গড়ে উঠছে। দেখা যাচ্ছে, ধর্মীয় উগ্রবাদীদের চেয়ে এই উদার মনোভাবের মানুষের প্রতি সমাজের আগ্রহ ও শ্রদ্ধা বাড়ছে।
সংকীর্ণতা ও চিন্তার স্থবিরতা কাটতে থাকায় ইসলাম ও গণতান্ত্রিক রাজনীতি এখন আর পরস্পর বিরোধী নয়। এ পরিবেশে এখন পর্যন্ত সাধারণ মানুষের দল আওয়ামী লীগের পক্ষে রাজনীতিতে ধর্মীয় সংস্কৃতি অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া সহজ হয়েছে। এটাকে আলাদা রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে তাদের নিতে হয়নি।
এ বাস্তবতায় রাজনৈতিকভাবে দুটি দিক থেকে আওয়ামী লীগ সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। প্রথমত, মুক্তিযুদ্ধের অর্জনগুলো ধারণ করার জন্য তার সমকক্ষ প্রতিপক্ষ এখনো নেই মাঠে। দ্বিতীয়ত, তার বিরুদ্ধে ইসলাম বিপন্ন করার অভিযোগ; যা আমিনী প্রমুখ এখনো চালিয়ে যাচ্ছেন, বৃহত্তর সমাজে তেমনটা আর গৃহীত হবে না।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যেকোনো সরকারের জন্য স্টক মার্কেট, হলমার্ক ও ডেসটিনি কেলেঙ্কারি আর পদ্মা সেতু নিয়ে দোলাচল ও অর্থায়নের টানাহেঁচড়া নির্বাচনে বিপদে পড়ার কারণ হতে পারে। এসব ঘটেছে দুর্নীতি ও অদক্ষতার ফলে। এর দায় সরকার ফেলতে পারবে না।
কিন্তু এসব হলো একটি সরকারের কার্যক্রমের মূল্যায়ন ও সমালোচনা। আমাদের দেশে এ রকম ইস্যু নিয়ে মাঠ গরম করা আন্দোলন জমানো মুশকিল। কারণ, অপর বড় দল বিএনপিও দুর্নীতিগ্রস্ত ও অদক্ষ। ফলে এসব ইস্যু ভোটের রাজনীতিতে প্রচারণায় কাজে লাগলেও আন্দোলনকে রাজপথে নিয়ে আসতে হলে প্রয়োজন দেশ, রাষ্ট্র, সংবিধানভিত্তিক মৌলিক ইস্যু। তাই বিএনপি ভোটের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগকে ঘায়েল করার মোক্ষম সব ইস্যু থাকতেও তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুটাকেই প্রধান করে ধরতে চাইছে। তবে অধিকাংশ বিশ্লেষক মনে করেন, আজকাল নির্বাচনে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক নজরদারি যে পর্যায়ে থাকে তাতে জনগণের রায় উল্টে দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ, নির্বাচনে কোনো পক্ষ জবরদস্তি কিছু করলে তা ধরা পড়বেই। কিন্তু এ ভাবনা নিয়ে এগোতে ভরসা পাবে না বিএনপি। কারণ, আওয়ামী লীগ জবরদস্তি কিছু ঘটিয়ে ফেললে তারা পরে আন্দোলন করে তা রহিত বা বাতিল করতে পারবে কি না, সে বিষয়ে নিজেরা আত্মবিশ্বাসী নয়। ফলে বিএনপির সাম্প্রতিক বাগাড়ম্বরের তুলনায় কার্যকলাপে দোলাচল, বিভ্রান্তির ছাপই বেশি।
বিএনপি নেতৃত্ব মনে হয় আপাতত মনোযোগ দিয়েছে বাংলাদেশে ক্ষমতার ক্ষেত্রে প্রভাবশালী বলে পরিচিত ভারত, সৌদি আরব, যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দাতা দেশের আস্থা অর্জন এবং তাদের মাধ্যমে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির দিকে। ফলে এখন তারা মাঠের আন্দোলন চাঙা করতে চায় না। কারণ, তাতে জামায়াতের সক্রিয় ভূমিকা প্রকট হয়ে ওঠার আশঙ্কাই বেশি। তারা চাইছে দাতা দেশ ও ভারতের এবং সুশীল সমাজের মাধ্যমে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য সরকারের ওপর চাপ বাড়াতে। আর এর জন্য দুই বড় দলের মধ্যে আপস বৈঠকের কথাই স্বভাবত বলা হবে বেশি।
চাপ কাটিয়ে ওঠার জন্য আওয়ামী লীগের হাতে একেবারেই যে কোনো অস্ত্র নেই, তা নয়। বস্তুত অত্যন্ত জোরালো অস্ত্র আছে। পঁচাত্তরের বঙ্গবন্ধু হত্যার সুবিধাভোগী বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের ভূমিকা যেমন প্রশ্নবিদ্ধ থেকে গেল, তেমনি ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টাতে তৎকালীন সরকার ও তারেকের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ থেকে যাচ্ছে।
এ দুটি প্রশ্নের অবসান হতে পারত— প্রথমত, বিস্তারিত নিরপেক্ষ বিশ্বাসযোগ্য তদন্তের মাধ্যমে ঘটনা উদ্ঘাটন করে প্রমাণ করা যে অভিযোগ ও সন্দেহ অমূলক। সেটা সম্ভব না হলে দ্বিতীয় উপায়টি হাতে থাকে—তা হলো এ অভিযোগ থেকে যদি আওয়ামী লীগ বিএনপিকে মুক্তি দেয়, যেমন করে নেলসন ম্যান্ডেলা ও তাঁর দল এএনসি দেশের পূর্ববর্তী বর্ণবৈষম্যবাদী নির্যাতক সরকারগুলোর কর্মকাণ্ডকে বিচারের আওতায় না এনে সমঝোতা-সৌহার্দ্যের বাতাবরণ তৈরি করেছে।
তবে বুঝতে হবে দুই দেশের পরিস্থিতি এক নয়। দক্ষিণ আফ্রিকায় এএনসির বিজয়ের মাধ্যমে যে বাস্তবতার সূচনা হয়েছে, তাতে সংখ্যালঘু শ্বেতাঙ্গদের নেতৃত্বাধীন কোনো দলের পক্ষে এএনসির রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই আর থাকেনি। বিপরীতে জন্মলগ্ন থেকে ২০০৪-এর গ্রেনেড হামলা পর্যন্ত বিএনপির রাজনীতিতে এমন অনেক ষড়যন্ত্র ও অস্পষ্টতার গ্রন্থি আছে, যার সরাসরি ভুক্তভোগী আওয়ামী লীগ। তা ছাড়া, সমকক্ষ প্রতিদ্বন্দ্বী দল হওয়ায় আওয়ামী লীগ এই ঔদার্য দেখাতে যাবে না। তাতে রাজনৈতিকভাবে লাভের চেয়ে ঝুঁকি থাকবে বেশি।
বাংলাদেশ যে বারবার রাজনৈতিক হোঁচট খাচ্ছে, তা এড়াতে হলে প্রথমে বড় দুই দলকে রাজনৈতিক লক্ষ্য, আদর্শ ও ইতিহাস নিয়ে কার্যকর সমঝোতায় আসতে হবে। সে ক্ষেত্রে যে রাজনৈতিক প্রত্যয় অগ্রাধিকার পাবে তা হলো, পাকিস্তানি ভাবাদর্শকে প্রত্যাখ্যান করে একটি গণতান্ত্রিক বিকাশের পথে রাজনীতিকে পরিচালিত করতে চেয়েছিল এ দেশের মানুষ। এ প্রত্যয়ে দুটি বড় দলকেই, অন্তত আদর্শিকভাবে, আস্থাশীল হতে হবে। নতুবা নানা দোষ, দুর্বলতা, ব্যর্থতা সত্ত্বেও সমাজের একটা বড় অংশ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে এখানেই পার্থক্যটা টানবে। আর যে আদর্শের জন্য মানুষ একদিন সব ফেলে জান বাজি রেখে যুদ্ধ করেছিল, তা রক্ষায় সে বারবার রাজপথ কাঁপানো আন্দোলনে নেমে যাবে। মানুষের এই ভাবাবেগের রাজনৈতিক সুবিধা আওয়ামী লীগই পাবে।
আওয়ামী লীগ যেমন কালের বিবর্তনে ধর্মভিত্তিক রাজনীতিতে ভাগ বসাতে পেরেছে, তেমনি বিএনপিকে তাদের রাজনীতিতে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে ধারণ করার পরিসর সত্যি সত্যি তৈরি করতে হবে। সেটা জামায়াতকে পাশে রেখে বা চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে থেকে অর্জন করা সম্ভব নয়।
ফলে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতি থেকে বৈরিতা-সংঘাতের উপাদান কাটবে কি না, তা অনেকাংশে নির্ভর করছে কিন্তু বিএনপির ওপর। দেশের বাস্তবতা, ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় দুই বড় দলে মৌলিক কিছু বিষয়ে সমঝোতা হলেই প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাজনীতির ধারা তৈরি হতে পারবে। তখনই সরকারের বিভিন্ন ব্যর্থতা নিয়ে রাজনীতি ফলপ্রসূ হবে, সরকার পরিবর্তনের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া কার্যকর ভূমিকা নেবে। আর তারা যদি দলীয় রাজনীতির বিবর্তন-উত্তরণের কথা না ভেবে কেবল ক্ষমতার কথাই ভাবতে থাকে, তা হলে এ দেশে রাজনৈতিক হানাহানি, অস্থিরতা চলবেই এবং তথাকথিত বিদেশি মুরব্বিদের হস্তক্ষেপের প্রবণতাও অব্যাহত থাকবে।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
No comments