বিজয়ের মাস- মুজিবের ভাগ্য নিয়ে উদ্বেগ by মিজানুর রহমান খান
১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাস সামনে রেখে যুদ্ধ আর সংলাপ—দুটোরই প্রস্তুতি নিচ্ছিল ভারত। ইসলামাবাদ ও দিল্লিতে নিযুক্ত পরাশক্তিগুলোর রাষ্ট্রদূতেরা বুঝতে পারছিলেন, পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ আসন্ন।
তবে প্যারিসে ফরাসি প্রধানমন্ত্রী পম্পেন্দু ইন্দিরার কাছে রাজনৈতিক সমঝোতার কথা বললে তিনি তাতে সায় দেন।
কিন্তু ইয়াহিয়া রাজি হননি। ফরাসি রাষ্ট্রদূতের কাছ থেকে চিঠি পেয়ে ইয়াহিয়া চিৎকার করে ওঠেন। বলেন, তিনি ‘দুর্বৃত্তদের’ সঙ্গে সংলাপ করবেন না। বরং রাষ্ট্রদ্রোহী ও বিশ্বাসঘাতকদের বিচার করবেন। ১ ডিসেম্বর দিল্লিতে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে দেখা করে সে কথাই তাঁকে বলেন ভারতে নিযুক্ত ফরাসি রাষ্ট্রদূত লেগার্ড। তাঁর পর্যবেক্ষণ, পাকিস্তান ও ভারত যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে। তবে ইন্দিরা দুই ফ্রন্টে যুদ্ধ চান না।
১৮ নভেম্বরে পম্পেন্দুর চিঠি ইয়াহিয়াকে দেওয়া হয়। ২৭ নভেম্বর ইয়াহিয়ার প্রতিক্রিয়া লেগার্ড ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব ব্যানার্জিকে জানান। জবাবে ব্যানার্জি বলেন, ইয়াহিয়া তো মনস্থির করে ফেলেছেন। ২৯ নভেম্বর পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিংকে লেগার্ড একই কথা বলেন। ১ ডিসেম্বর ১৮৫৬৯ নম্বর তারবার্তায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত কেনেথ কিটিং জানান, লেগার্ডকে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ইয়াহিয়া যদি এখনো রাজনৈতিক আপসের পথ বেছে নেন, তাহলেও পরিস্থিতির উন্নতি ঘটতে পারে।
ভারত কি আট মাস পরে এসে প্রকাশ্যে এটা বলবে যে তারা পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্যেই পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন মানতে প্রস্তুত আছে? শরণ সিং এর সরাসরি উত্তর দেননি। বলেছেন, ‘ইয়াহিয়া প্রয়োজনীয় উদ্যোগ যে নেবেন তার কোনো লক্ষণ নেই।’
২৭ নভেম্বর দিল্লিতে নিযুক্ত সোভিয়েত রাষ্ট্রদূত পেগভের সঙ্গে দেখা করেন লেগার্ড। এ সময় পেগভ তাঁকে বলেন, পাক-ভারত যুদ্ধ নিকটবর্তী। কিটিং লিখেছেন, ‘আজ আমার সঙ্গে পৃথকভাবে সাক্ষাৎ করেন অস্ট্রেলীয় হাইকমিশনার মি. শ। ১০ দিন আগে তিনি পেগভের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। আজ তিনিও বলেন, এই প্রথম তিনি দেখলেন যে, পেগভ প্রচণ্ড বিমর্ষ। লেগার্ডের মতে পেগভ তাঁকে বলেন যে, এখন একটি মাত্র পথ খোলা। সেটা হলো ইয়াহিয়াকে পশ্চিম ফ্রন্ট থেকে সৈন্য প্রত্যাহারে রাজি করানো। এ জন্য আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।’ চীনের মনোভাব সম্পর্কে পেগভ বলেন, তারা বুলি ঝাড়বে। কিন্তু পাকিস্তানের পক্ষে যুদ্ধ করবে না।
বাংলাদেশ সরকারের একজন প্রতিনিধির সঙ্গে নৈশভোজ করেছিলেন লেগার্ড। ওই মুক্তিযোদ্ধা লেগার্ডকে বলেন, ‘১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে আমরা যশোর এবং ১ জানুয়ারির মধ্যে ঢাকায় পৌঁছাব।’
দিল্লি থেকে পররাষ্ট্র দপ্তরে ১ ডিসেম্বর পাঠানো কিটিংয়ের আরেকটি বার্তায় দেখা যায়, রক্তপাত ও হানাহানির মধ্যেও জেনারেল ইয়াহিয়া ইন্দিরা গান্ধীর কাছে ঈদের শুভেচ্ছা পাঠিয়েছিলেন। দিল্লির এক মার্কিন কূটনীতিকের কাছে ঘরোয়া আলোচনায় এ তথ্য প্রকাশ করেছিলেন ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব জে এন দীক্ষিত। তিনি তখন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশবিষয়ক ডেস্কের (প্রটেক্ট ইউনিট) পরিচালক।
৩০ নভেম্বর দীক্ষিত মার্কিন কূটনীতিকের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে খোলামেলা কথা বলেন। এ সময় তিনি বলেন, ইয়াহিয়া প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরার কাছে শুভেচ্ছা পাঠিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী এর উত্তরে মৌখিক বার্তা পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন। সে অনুযায়ী, ভারতের হাইকমিশনার অটল ইয়াহিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বলেন, আপনার শুভেচ্ছার প্রতিদান হিসেবে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী এবং ঈদের উৎসব সামনে রেখে তিনি মুজিবের প্রতি তাঁর অনুকম্পা আশা করছেন। ইন্দিরার বরাত দিয়ে হাইকমিশনার এ সময় আরও বলেন, সংলাপ শুরু করার জন্য তাঁর (প্রধানমন্ত্রী) অভিপ্রায় হলো, আপনি শেখ মুজিবকে মুক্তি দিন। কেনেথ কিটিং লিখেছেন, ইয়াহিয়া এ কথা শোনার পরে কাঁধ ঝাঁকিয়ে তা উড়িয়ে দেন।
কেনেথ কিটিং তাঁর এদিনের তারবার্তার ষষ্ঠ অনুচ্ছেদে বলেন, পাকিস্তানকে ভেঙে কয়েক টুকরা করার পরিকল্পনা ভারতের নেই। তারা পাকিস্তানের সঙ্গে দুই ফ্রন্টে যুদ্ধে জড়াতে চায় না। তবে তারা মুজিবের নিয়তি নিয়ে উদ্বিগ্ন। কারণ, তারা শুনেছে যে, ইরানের পার্সিপোলিস শহরে গিয়ে ইয়াহিয়া শাহকে বলেছেন, মুজিবের স্বাস্থ্য খুব ভালো যাচ্ছে না। দীক্ষিত সাফ বলেছেন, যদি মুজিবের কিছু ঘটে তাহলে ইয়াহিয়া সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাবে। এ সময় এক প্রশ্নের জবাবে দীক্ষিত বলেছেন, ‘যদি আমরা খবর পাই যে, মুজিব মারা গেছেন কিংবা শারীরিকভাবে অসমর্থ হয়ে পড়েছেন, তাহলে ভারত পূর্ব পাকিস্তানে আক্রমণ তীব্র করবে। এবং তখন পাক-ভারত যুদ্ধের আশঙ্কা বাস্তব রূপ নিতে পারে।’
কেনেথ কিটিং ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ২৯ নভেম্বর। নিক্সনের বার্তা ইন্দিরাকে পৌঁছে দিয়েছেন কিটিং। চিঠি পেয়েই দ্রুত তা পাঠ করেছিলেন ইন্দিরা। বলেছিলেন, তিনি শিগগিরই এর উত্তর দেবেন। তবে তাৎক্ষণিকভাবে যা বলার তা বলে দিয়েছিলেন ইন্দিরা। কিটিংয়ের বয়ানই কিসিঞ্জার আজ জানান নিক্সনকে।
ওই সময় নিক্সনকে ইন্দিরা কী বলবেন, সেটা জানতে মার্কিনিদের উদ্বেগ ছিল। সে কারণে ওই মার্কিন কর্মকর্তা ৩০ নভেম্বরও দীক্ষিতের কাছে খোঁজ নিচ্ছিলেন ইন্দিরা কী বলতে পারেন। দীক্ষিত তাঁকে বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ভারত অধিকতর অনুরক্ত হতে পারে, যদি তারা মুজিবকে মুক্ত এবং রাজনৈতিক সংলাপ শুরু করতে ইয়াহিয়াকে রাজি করাতে পারে।
নিক্সন ইন্দিরাকে বলেছিলেন, ইয়াহিয়াকে তিনি অনুরোধ করছেন পশ্চিম পাকিস্তানের সীমান্ত থেকে তাদের সেনা সরাতে। তবে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকেও তিনি তখন অনুরূপ পদক্ষেপ আশা করবেন। অনেক দেশই তো পাকিস্তানের প্রতি সেনা প্রত্যাহারে অনুরোধ করেছে। কিন্তু কোনো সুফল মিলেছি কি?
এই আলোচনা সম্পর্কে কিসিঞ্জার নিক্সনকে জানিয়েছেন, কিটিং কথার ফাঁকে যেই বললেন যে ভারতের সেনাবাহিনী পাকিস্তানি ভূখণ্ডে অনুপ্রবেশ করেছে, তখন ইন্দিরা তাঁকে থামিয়ে দেন এই বলে, ‘আমরা এমন উপদেশ গ্রহণ করতে পারব না, যা আমাদের দুর্বল করে দেয়।’ কিটিং মন্তব্য করেছেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য ছিল স্পষ্ট এবং তাতে তাঁর কঠোরতার ছাপ ছিল স্পষ্ট।
ওদিকে সোভিয়েত নেতা কোসিগিনকে লেখা নিক্সনের চিঠির উত্তর পেতে মস্কোতে একইভাবে উদ্গ্রীব মার্কিন কূটনীতিক বিয়াম। সোভিয়েত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আমেরিকান ডেস্ক প্রধান তখন কোরনিয়েঙ্কো। এক পার্টিতেই বিয়াম তাঁকে জোরাজুরি করেন। তিনি ওয়াশিংটনে পাঠানো এক বার্তায় বলেন, কোরনিয়েঙ্কো আমার কথা শুনেই বলেন, ‘মুজিবের মুক্তিই সংকটের সমাধানসূত্র। আমি বলি, ইয়াহিয়াকে চাপ দেওয়ার অবস্থানে আমরা নেই।’ পশ্চিম ফ্রন্টে ভারতকে সামলাতেই নিক্সন কোসিগিনের কাছে চিঠি লিখেছিলেন। তাই বিয়াম তাঁকে বলেন, ‘আসুন, আগে যুদ্ধ থামাই। আপনাদের উত্তরের অপেক্ষায় রইলাম।’...
১৯৭১ সালে দক্ষিণ এশিয়ায় বিশেষ করে, পাকিস্তান ও ভারতে আমেরিকার অস্ত্র বিক্রিনীতি ঠিক কী রকম ছিল, তা রহস্যময়। ১ ডিসেম্বর দিল্লির মার্কিন দূতাবাসে একটি টেলিগ্রাম যায় মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে। এতে বলা হয়, ‘ভারত যেভাবে পাকিস্তানের সঙ্গে তার ভূখণ্ডে গিয়ে প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধে সম্পৃক্ত হচ্ছে, তাতে আমরা উদ্বিগ্ন। ভাবছি, তাদের সঙ্গে সমরাস্ত্র বিক্রির সম্পর্ক ছেদ করব কি না। পাকিস্তান যখন বাংলাদেশের সঙ্গে যুদ্ধে জড়ায়, তখন আমরাও ইসলামাবাদের প্রতি শীতল মনোভাব দেখাই।’ ভারতের সঙ্গে গোলাবারুদ তৈরিসংক্রান্ত প্রায় ২০ লাখ ডলারের যে চুক্তি ছিল, এদিনই নিক্সন তা বাতিলের ঘোষণা দেন।
ন্যাটোর আদলে সেন্টো নামের একটি জোট ছিল। এর লক্ষ্য ছিল সোভিয়েত ঠেকাও। একাত্তরের ডিসেম্বরে পাকিস্তান মরিয়া হয়ে সেন্টোকে ব্যবহার করতে চেয়েছিল। তবে ১ ডিসেম্বর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রজার্স সিদ্ধান্ত দেন, নীরবতা পালন করাই ঠিক হবে। (চলবে)
কিন্তু ইয়াহিয়া রাজি হননি। ফরাসি রাষ্ট্রদূতের কাছ থেকে চিঠি পেয়ে ইয়াহিয়া চিৎকার করে ওঠেন। বলেন, তিনি ‘দুর্বৃত্তদের’ সঙ্গে সংলাপ করবেন না। বরং রাষ্ট্রদ্রোহী ও বিশ্বাসঘাতকদের বিচার করবেন। ১ ডিসেম্বর দিল্লিতে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে দেখা করে সে কথাই তাঁকে বলেন ভারতে নিযুক্ত ফরাসি রাষ্ট্রদূত লেগার্ড। তাঁর পর্যবেক্ষণ, পাকিস্তান ও ভারত যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে। তবে ইন্দিরা দুই ফ্রন্টে যুদ্ধ চান না।
১৮ নভেম্বরে পম্পেন্দুর চিঠি ইয়াহিয়াকে দেওয়া হয়। ২৭ নভেম্বর ইয়াহিয়ার প্রতিক্রিয়া লেগার্ড ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব ব্যানার্জিকে জানান। জবাবে ব্যানার্জি বলেন, ইয়াহিয়া তো মনস্থির করে ফেলেছেন। ২৯ নভেম্বর পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিংকে লেগার্ড একই কথা বলেন। ১ ডিসেম্বর ১৮৫৬৯ নম্বর তারবার্তায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত কেনেথ কিটিং জানান, লেগার্ডকে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ইয়াহিয়া যদি এখনো রাজনৈতিক আপসের পথ বেছে নেন, তাহলেও পরিস্থিতির উন্নতি ঘটতে পারে।
ভারত কি আট মাস পরে এসে প্রকাশ্যে এটা বলবে যে তারা পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্যেই পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন মানতে প্রস্তুত আছে? শরণ সিং এর সরাসরি উত্তর দেননি। বলেছেন, ‘ইয়াহিয়া প্রয়োজনীয় উদ্যোগ যে নেবেন তার কোনো লক্ষণ নেই।’
২৭ নভেম্বর দিল্লিতে নিযুক্ত সোভিয়েত রাষ্ট্রদূত পেগভের সঙ্গে দেখা করেন লেগার্ড। এ সময় পেগভ তাঁকে বলেন, পাক-ভারত যুদ্ধ নিকটবর্তী। কিটিং লিখেছেন, ‘আজ আমার সঙ্গে পৃথকভাবে সাক্ষাৎ করেন অস্ট্রেলীয় হাইকমিশনার মি. শ। ১০ দিন আগে তিনি পেগভের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। আজ তিনিও বলেন, এই প্রথম তিনি দেখলেন যে, পেগভ প্রচণ্ড বিমর্ষ। লেগার্ডের মতে পেগভ তাঁকে বলেন যে, এখন একটি মাত্র পথ খোলা। সেটা হলো ইয়াহিয়াকে পশ্চিম ফ্রন্ট থেকে সৈন্য প্রত্যাহারে রাজি করানো। এ জন্য আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।’ চীনের মনোভাব সম্পর্কে পেগভ বলেন, তারা বুলি ঝাড়বে। কিন্তু পাকিস্তানের পক্ষে যুদ্ধ করবে না।
বাংলাদেশ সরকারের একজন প্রতিনিধির সঙ্গে নৈশভোজ করেছিলেন লেগার্ড। ওই মুক্তিযোদ্ধা লেগার্ডকে বলেন, ‘১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে আমরা যশোর এবং ১ জানুয়ারির মধ্যে ঢাকায় পৌঁছাব।’
দিল্লি থেকে পররাষ্ট্র দপ্তরে ১ ডিসেম্বর পাঠানো কিটিংয়ের আরেকটি বার্তায় দেখা যায়, রক্তপাত ও হানাহানির মধ্যেও জেনারেল ইয়াহিয়া ইন্দিরা গান্ধীর কাছে ঈদের শুভেচ্ছা পাঠিয়েছিলেন। দিল্লির এক মার্কিন কূটনীতিকের কাছে ঘরোয়া আলোচনায় এ তথ্য প্রকাশ করেছিলেন ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব জে এন দীক্ষিত। তিনি তখন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশবিষয়ক ডেস্কের (প্রটেক্ট ইউনিট) পরিচালক।
৩০ নভেম্বর দীক্ষিত মার্কিন কূটনীতিকের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে খোলামেলা কথা বলেন। এ সময় তিনি বলেন, ইয়াহিয়া প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরার কাছে শুভেচ্ছা পাঠিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী এর উত্তরে মৌখিক বার্তা পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন। সে অনুযায়ী, ভারতের হাইকমিশনার অটল ইয়াহিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বলেন, আপনার শুভেচ্ছার প্রতিদান হিসেবে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী এবং ঈদের উৎসব সামনে রেখে তিনি মুজিবের প্রতি তাঁর অনুকম্পা আশা করছেন। ইন্দিরার বরাত দিয়ে হাইকমিশনার এ সময় আরও বলেন, সংলাপ শুরু করার জন্য তাঁর (প্রধানমন্ত্রী) অভিপ্রায় হলো, আপনি শেখ মুজিবকে মুক্তি দিন। কেনেথ কিটিং লিখেছেন, ইয়াহিয়া এ কথা শোনার পরে কাঁধ ঝাঁকিয়ে তা উড়িয়ে দেন।
কেনেথ কিটিং তাঁর এদিনের তারবার্তার ষষ্ঠ অনুচ্ছেদে বলেন, পাকিস্তানকে ভেঙে কয়েক টুকরা করার পরিকল্পনা ভারতের নেই। তারা পাকিস্তানের সঙ্গে দুই ফ্রন্টে যুদ্ধে জড়াতে চায় না। তবে তারা মুজিবের নিয়তি নিয়ে উদ্বিগ্ন। কারণ, তারা শুনেছে যে, ইরানের পার্সিপোলিস শহরে গিয়ে ইয়াহিয়া শাহকে বলেছেন, মুজিবের স্বাস্থ্য খুব ভালো যাচ্ছে না। দীক্ষিত সাফ বলেছেন, যদি মুজিবের কিছু ঘটে তাহলে ইয়াহিয়া সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাবে। এ সময় এক প্রশ্নের জবাবে দীক্ষিত বলেছেন, ‘যদি আমরা খবর পাই যে, মুজিব মারা গেছেন কিংবা শারীরিকভাবে অসমর্থ হয়ে পড়েছেন, তাহলে ভারত পূর্ব পাকিস্তানে আক্রমণ তীব্র করবে। এবং তখন পাক-ভারত যুদ্ধের আশঙ্কা বাস্তব রূপ নিতে পারে।’
কেনেথ কিটিং ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ২৯ নভেম্বর। নিক্সনের বার্তা ইন্দিরাকে পৌঁছে দিয়েছেন কিটিং। চিঠি পেয়েই দ্রুত তা পাঠ করেছিলেন ইন্দিরা। বলেছিলেন, তিনি শিগগিরই এর উত্তর দেবেন। তবে তাৎক্ষণিকভাবে যা বলার তা বলে দিয়েছিলেন ইন্দিরা। কিটিংয়ের বয়ানই কিসিঞ্জার আজ জানান নিক্সনকে।
ওই সময় নিক্সনকে ইন্দিরা কী বলবেন, সেটা জানতে মার্কিনিদের উদ্বেগ ছিল। সে কারণে ওই মার্কিন কর্মকর্তা ৩০ নভেম্বরও দীক্ষিতের কাছে খোঁজ নিচ্ছিলেন ইন্দিরা কী বলতে পারেন। দীক্ষিত তাঁকে বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ভারত অধিকতর অনুরক্ত হতে পারে, যদি তারা মুজিবকে মুক্ত এবং রাজনৈতিক সংলাপ শুরু করতে ইয়াহিয়াকে রাজি করাতে পারে।
নিক্সন ইন্দিরাকে বলেছিলেন, ইয়াহিয়াকে তিনি অনুরোধ করছেন পশ্চিম পাকিস্তানের সীমান্ত থেকে তাদের সেনা সরাতে। তবে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকেও তিনি তখন অনুরূপ পদক্ষেপ আশা করবেন। অনেক দেশই তো পাকিস্তানের প্রতি সেনা প্রত্যাহারে অনুরোধ করেছে। কিন্তু কোনো সুফল মিলেছি কি?
এই আলোচনা সম্পর্কে কিসিঞ্জার নিক্সনকে জানিয়েছেন, কিটিং কথার ফাঁকে যেই বললেন যে ভারতের সেনাবাহিনী পাকিস্তানি ভূখণ্ডে অনুপ্রবেশ করেছে, তখন ইন্দিরা তাঁকে থামিয়ে দেন এই বলে, ‘আমরা এমন উপদেশ গ্রহণ করতে পারব না, যা আমাদের দুর্বল করে দেয়।’ কিটিং মন্তব্য করেছেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য ছিল স্পষ্ট এবং তাতে তাঁর কঠোরতার ছাপ ছিল স্পষ্ট।
ওদিকে সোভিয়েত নেতা কোসিগিনকে লেখা নিক্সনের চিঠির উত্তর পেতে মস্কোতে একইভাবে উদ্গ্রীব মার্কিন কূটনীতিক বিয়াম। সোভিয়েত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আমেরিকান ডেস্ক প্রধান তখন কোরনিয়েঙ্কো। এক পার্টিতেই বিয়াম তাঁকে জোরাজুরি করেন। তিনি ওয়াশিংটনে পাঠানো এক বার্তায় বলেন, কোরনিয়েঙ্কো আমার কথা শুনেই বলেন, ‘মুজিবের মুক্তিই সংকটের সমাধানসূত্র। আমি বলি, ইয়াহিয়াকে চাপ দেওয়ার অবস্থানে আমরা নেই।’ পশ্চিম ফ্রন্টে ভারতকে সামলাতেই নিক্সন কোসিগিনের কাছে চিঠি লিখেছিলেন। তাই বিয়াম তাঁকে বলেন, ‘আসুন, আগে যুদ্ধ থামাই। আপনাদের উত্তরের অপেক্ষায় রইলাম।’...
১৯৭১ সালে দক্ষিণ এশিয়ায় বিশেষ করে, পাকিস্তান ও ভারতে আমেরিকার অস্ত্র বিক্রিনীতি ঠিক কী রকম ছিল, তা রহস্যময়। ১ ডিসেম্বর দিল্লির মার্কিন দূতাবাসে একটি টেলিগ্রাম যায় মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে। এতে বলা হয়, ‘ভারত যেভাবে পাকিস্তানের সঙ্গে তার ভূখণ্ডে গিয়ে প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধে সম্পৃক্ত হচ্ছে, তাতে আমরা উদ্বিগ্ন। ভাবছি, তাদের সঙ্গে সমরাস্ত্র বিক্রির সম্পর্ক ছেদ করব কি না। পাকিস্তান যখন বাংলাদেশের সঙ্গে যুদ্ধে জড়ায়, তখন আমরাও ইসলামাবাদের প্রতি শীতল মনোভাব দেখাই।’ ভারতের সঙ্গে গোলাবারুদ তৈরিসংক্রান্ত প্রায় ২০ লাখ ডলারের যে চুক্তি ছিল, এদিনই নিক্সন তা বাতিলের ঘোষণা দেন।
ন্যাটোর আদলে সেন্টো নামের একটি জোট ছিল। এর লক্ষ্য ছিল সোভিয়েত ঠেকাও। একাত্তরের ডিসেম্বরে পাকিস্তান মরিয়া হয়ে সেন্টোকে ব্যবহার করতে চেয়েছিল। তবে ১ ডিসেম্বর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রজার্স সিদ্ধান্ত দেন, নীরবতা পালন করাই ঠিক হবে। (চলবে)
No comments