যুক্তি তর্ক গল্প- জেগে উঠছে প্রকৃত বাংলাদেশ by আবুল মোমেন
বিজয়ের চার দশক পেরিয়ে বিজয়ের মাসে ভাবতে হচ্ছে, সংবাদপত্রে কি প্রকৃত বাংলাদেশের খবর মেলে? সংবাদপত্র মুখ্যত দৈনন্দিন ঘটনার খবর ছাপে—যেগুলো জনসমক্ষে ঘটে আর যে চাপা খবরগুলো ফাঁস হয় সেগুলো।
হাসির চেয়ে কান্নার, জন্মের চেয়ে মৃত্যুর অভিঘাত যেমন প্রবল, তেমনি পাঠককে নাড়া দেওয়ার ক্ষমতা বেশি দুঃসংবাদেরই। মানুষের বিবেককে তার শ্রেষ্ঠ সম্পদ ভাবা হয়। সেই বিবেক সম্পদে-আনন্দে তেমন সাড়া দেয় না, জাগ্রত হয় মানুষের সংকটে-বিপদে।
একসময় ঢাকাকে বলা হতো মসজিদের নগর, এখন বলা যাবে গণমাধ্যমের নগর। শুনেছি, ছোট-বড় ২০০ বা তার বেশি পত্রিকার ডিক্লারেশন আছে, বেসরকারি চ্যানেলের সংখ্যা কুড়িতে পৌঁছেছে। না, পৃথিবীর ধনী দেশ যাদের নাগরিকদের পরার ও কেনার ক্ষমতা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি, তাদের কোথাও গণমাধ্যমের এ রকম বান ডাকেনি। সেসব দেশে এলাকাভিত্তিক ছোট ছোট অসংখ্য কাগজ আছে, যারা নিজ এলাকার ঘটনাগুলো ছাপে—তাতে সুসংবাদই থাকে বেশি। জাতীয় দৈনিক হওয়ার অভিলাষ ও ক্ষমতা তাদের সবার থাকে না—সেটি যেখান থেকেই প্রকাশিত হোক।
কিন্তু আমাদের এখানে কেউই নিজ এলাকায় সেবা দিয়ে সন্তুষ্ট হন না, সবাই ‘জাতীয় দায়িত্ব’ পালন করতে চান। বিন্দুতেই যে সিন্ধু হয়, সে বিশ্বাস আমাদের নেই। সবাই যেন প্রতিযোগিতায় নেমেছেন জাতির বিবেককে জাগিয়ে তোলা, জাগিয়ে রাখার জন্য। জাত তুলে গাল পাড়তে আমাদের জুড়ি নেই—বাঙালি আলসে, তোষামুদে, দুর্নীতিবাজ, ভিতু, পরশ্রীকাতর, ফাঁকিবাজ, মিথ্যাবাদী ইত্যাদি ইত্যাদি। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ উৎপাদনের জন্য, উপার্জনের জন্য দেশ-বিদেশে যা করছে, তা জেনেও তাদের আলসে বলে ফাঁকিবাজ বলে গাল দেওয়া শুধু তাকেই সাজে, যে নিজে আলসে ও ফাঁকিবাজ। আর জিন্নাহর মুখের ওপর যাঁরা কিনা না বলেছেন, লাঠি-সড়কি নিয়ে যাঁরা অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়েছেন, তাঁদের তোষামুদে আর ভীতু বলা তারই সাজে যে তোষামুদে ও ভীতুর দলেই শুধু বিচরণ করে।
আছে অবশ্যই আলসেমি, পরশ্রীকাতরতা, তোষামুদি, দুর্নীতি, ফাঁকিবাজি, মিথ্যাচার ইত্যাদি। সব দেশে সব সমাজে কমবেশি আছে, তবে এসব ক্ষতিকর পর্যায়ে পৌঁছেছে কেবল শহুরে শিক্ষিত সমাজে। প্রাতঃস্মরণীয় বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্র, বেগম রোকেয়া, নজরুল এবং আরও অসংখ্য বাঙালি চিন্তাবিদ যাঁদের কষাঘাত করেছেন, যাঁদের সম্পর্কে সমালোচনামুখর হয়েছেন তাঁরা এই শ্রেণীর মানুষ। এঁরাই সংবাদপত্রের পাঠক ও পৃষ্ঠপোষক বটে, কিন্তু জনগণের ক্ষুদ্র একটি অংশ। এঁরাই যে সমাজের প্রভাবশালী তার কারণ ক্ষমতা ও গণমাধ্যম তাঁদেরই হাতে, তাঁদের ভাবনার প্রতিফলন ঘটে এতে। সেটা, বলা বাহুল্য, দেশের আম-জনগণের ভাবনা বা মতামত নয়।
সাধারণ মানুষ অভাব-অনটনে থাকে সত্য, সুযোগ পেলে অভাব-অভিযোগ তুলে ধরে বটে, কিন্তু তার ভাবনা-জগৎ এবং বিবেক এ নিয়ে মত্ত নয়, সে আশুতোষ, সামান্যতেই তুষ্ট বলে দুঃখ-দারিদ্র্যের কাছে পরাজয় মানে না। ওর মধ্যেই সে বাঁচে—বেড়ার ফাঁক দিয়ে আসা সূর্যালোকের মতো সামান্য আলোই তাকে জীবনবাদী হওয়ার প্রেরণা দেয়।
হ্যাঁ, আমরা ও তারা—একটা বিভাজন এ দেশে আছে। এর মধ্যে দূরত্ব ও ব্যবধান বিশাল এবং তা ক্রমবর্ধমান আর দুপক্ষেই তার মাত্রাগত বহুতর শ্রেণীভেদ তৈরি হচ্ছে। তবে এখনো মোটা দাগে আমরা ও তারা বিভক্ত আছি। রাজনীতি একসময় এই বিভাজনের মাঝে সেতুবন্ধ রচনা করেছিল। প্রগতিশীল রাজনীতি বরাবর ওই ‘তাহাদের’ পাশে থেকে সেতুবন্ধ রচনার কাজটি করেছিল। আর বঙ্গবন্ধু ‘আমরা’র প্রতিনিধিত্বশীল রাজনীতিক হলেও তাঁর দেশপ্রেম ও মানবপ্রেমের জাদুকরি নেতৃত্বের জোরে এমন জোয়ার আনলেন সমাজে যে রাজনীতির সব বিভেদ ঘুচে একাকার হয়ে গেল। বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বড় অর্জন ও অবদান বাঙালির এই ঐক্যসাধন, এক ধাক্কায় মধ্যবিত্তের কুঁড়েমি-স্বার্থচিন্তা-পরশ্রীকাতরতা ইত্যাদি ইত্যাদি উড়িয়ে দিয়ে ঐক্যবদ্ধ জাতিকে ত্যাগের মন্ত্রে উজ্জীবিত বীরের জাতিতে রূপান্তর করলেন। একাত্তর বাঙালির এক অভূতপূর্ব জাগরণ ও পরিবর্তনের ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছে। তাই এ আমাদের ইতিহাসের গৌরবময় অধ্যায়, মহৎ অর্জন।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি হলো, আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব শিল্পোন্নত পশ্চিমের অনুকরণ করতে গিয়ে নিজ দেশের বাস্তবতা ভুলে গেছে। এ যে কৃষি ও গ্রামপ্রধান খেটে খাওয়া মানুষের দেশ, সে কথা সম্পূর্ণ ভুলে যাওয়ায় আজ রাজনীতি যেন দেশ ও মানুষের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ঘরের বিলাসব্যসনে বন্দী হয়ে পড়েছে। শহরের যে মধ্য, উচ্চমধ্য ও উচ্চবিত্ত শ্রেণী ক্ষমতা ও উন্নয়নের ভাগ পাচ্ছে, তারা ক্রমাগত পশ্চিমা জীবনাভ্যাসে গা ভাসিয়ে মূল দেশ ও মানুষের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। নিজেদের ভাগ ও ভোগের আয়োজনে যাতে কোনো কমতি না হয়, যাতে এ জীবনের জৌলুশ বজায় থাকে, পাল্লা দিয়ে বাড়ে তা বজায় রেখে তারপর ভাবা হয় ‘তাহাদের’ কথা—যারা আছে নেপথ্যে, নিছক কিছু পরিসংখ্যানের আধার হয়ে। এই পদ্ধতি অবাস্তব, তাই এ অন্যায় এবং অবাস্তব অন্যায়ের ফসল হবে দুর্নীতি, যাকে রক্ষা করতে ঘটবে অপরাধ। এই বিষচক্রটা কেমন ফুলে-ফেঁপে জোরদার হয়ে উঠেছে দেশে, সে তো আমরা দেখছি প্রতিদিন। এই বিকারের হলাহলই নিত্যদিন সংবাদপত্রে উঠে আসছে। এটা এ সমাজের অসুস্থ, অবক্ষয়িত অংশ, যা টিকে থাকার জন্য নানা নেতিবাচক কাজে জড়িয়ে যাচ্ছে। এই অংশে ইতির চেয়ে নেতি বেশি। বিবেকের দোহাই দিয়ে তা ঢাকাও যাচ্ছে না, নেতির ছোঁয়া বাঁচিয়ে চলাও যাবে না।
খোঁজখবর নিলে দেখা যাবে, গ্রামে গ্রামে আগের মতো হাহাকার নেই, কৃষিতে নীরবে বিপ্লব ঘটে গেছে—কেবল উৎপাদন তিন গুণ হয়েছে তা নয়, নতুন প্রযুক্তি আর চাষাবাদ চালু হচ্ছে। গ্রামের মানুষ সাহস করে বিদেশে পাড়ি দিয়ে ভাগ্যোন্নয়ন করছে। আর গ্রামীণ ব্যাংক এবং ব্র্যাকসহ আরও বেশ কিছু এনজিওর কল্যাণে গ্রামীণ নারী ঘরের বাইরে এসে কাজে নেমেছে। ক্ষুদ্রঋণ কেবল তাদের কাজের সুযোগ করে দিচ্ছে তা নয়, তাদের দিয়েছে ব্যক্তির মর্যাদা এবং আত্মবিশ্বাসের মতো অমূল্য দুই সম্পদ।
তাই বলব, বাংলাদেশ পাল্টে যাচ্ছে। আর শুভসংবাদ হলো, সেটা ঘটছে নিচের তলায়, যারা আদতে ‘তাহারা’—যারা আমাদের অভ্যস্ত গণ্ডির বাইরে, সুদূর, অনুপস্থিত এবং আমাদের বিবেচনায় যারা অকাজের, কেবল হুকুম তামিল করে গায়ে খেটে সব সচল রাখবে। কিন্তু এই জাগরণ টের পাওয়া যাচ্ছে, তাদের মধ্যে অদম্য মেধাবীদের সংখ্যা কীভাবে দিন দিন বাড়ছে তা দেখে; লিমন এবং বিশেষত তার মায়ের ন্যায়যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার মনোবল দেখে।
গ্রামবাংলায় ঘুরলে দেখা যায়, দিবানিদ্রা আর অলস জীবনের চিত্র পাল্টে যাচ্ছে। নারীরাই অগ্রণী। আগে তারা কেবল গার্হস্থ্য কর্মে উদয়াস্ত খাটত, এখন উৎপাদনে-উপার্জনে হাত লাগাচ্ছে। কল্যাণী হাতে মাটি কাটছে, ইট ভাঙছে, ট্রাকে চেপে বালু তুলছে-ফেলছে, খেতে চারা বুনছে, কেউ কেউ লোকজন খাটাচ্ছে। আর চোখ-জুড়ানো দৃশ্য হলো, সবুজ ধানখেতের বুক চিরে যাওয়া আলপথ ধরে সুদৃশ্য ইউনিফর্ম পরে মেয়ের দল চলেছে স্কুলে।
আজ দরকার ছিল দেশ পরিচালনার কাজে এই ‘তাহাদের’ অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া। আশা ছিল, শেখ হাসিনা তাঁর বাবার আরব্ধ কাজ সঠিকভাবে শেষ করবেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার একটি আরব্ধ কাজ নিঃসন্দেহে। কিন্তু রাজনীতিকে জনবিচ্ছিন্ন করে, বিশেষত ‘তাহাদের’ কাছ থেকে সরিয়ে মুষ্টিমেয় দুর্নীতিবাজ-তদবিরবাজ-পরজীবী মানুষের দরবারে সীমাবদ্ধ করার যে কাজ সামরিক একনায়কেরা শুরু করেছিলেন, তাকে থামিয়ে দিয়ে গণমানুষকে জায়গা দেওয়ার রাজনীতি ফিরিয়ে আনা আরও বড় আরব্ধ কাজ।
বাংলাদেশ শিল্পোন্নত পশ্চিম নয়, কৃষিপ্রধান জনবহুল একটি দেশ—যার জনগণ উদ্যমী, পরিশ্রমী, ভাগ্যান্বেষী। এমন মানুষ তো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে আর পরিবর্তন আনতে সদা প্রস্তুত। কেবল সুযোগটুকু চাই, সামরিক শাসকেরা সে সুযোগ বন্ধ করে টাকার খেলার জনবিচ্ছিন্ন রাজনীতি শুরু করেছিলেন। শেখ হাসিনার জন্য মূল আরব্ধ কাজ হলো রাজনীতির সেই বিভেদের অর্গল খুলে দেওয়া। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, তিনি চলেছেন উল্টো পথে। যেন সামরিক শাসকদের আরব্ধ কাজ শেষ করতে চলেছেন। তবে মানুষ অর্থাৎ সেই ‘তাহারা’ বসে থাকছে না। তামাদি হয়ে পড়েছে বরং আমাদের রাজনীতি। অনেক সময় পথের বাধাও বটে। একটি সক্রিয় প্রাণবন্ত সমাজ রাজনীতির এই অপমৃত্যু মেনে নেবে না। তারা কী পরিবর্তন ঘটায়, সেটাই দেখতে চাই আমরা। এই পরিবর্তনের প্রয়োজন, দাবি, চাপ আমাদের রাজনীতি বুঝতে পারে কি না, তাতে সাড়া দেয় কি না, সেটাও আমরা দেখতে চাই। কিন্তু পরিস্থিতি বদলাবেই, মানুষের জাগরণের আলামত স্পষ্ট, আর তাই—পরিবর্তকামীদের পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় আজ। একটু কান পাতলে সবাই শুনতে পাবেন।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
একসময় ঢাকাকে বলা হতো মসজিদের নগর, এখন বলা যাবে গণমাধ্যমের নগর। শুনেছি, ছোট-বড় ২০০ বা তার বেশি পত্রিকার ডিক্লারেশন আছে, বেসরকারি চ্যানেলের সংখ্যা কুড়িতে পৌঁছেছে। না, পৃথিবীর ধনী দেশ যাদের নাগরিকদের পরার ও কেনার ক্ষমতা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি, তাদের কোথাও গণমাধ্যমের এ রকম বান ডাকেনি। সেসব দেশে এলাকাভিত্তিক ছোট ছোট অসংখ্য কাগজ আছে, যারা নিজ এলাকার ঘটনাগুলো ছাপে—তাতে সুসংবাদই থাকে বেশি। জাতীয় দৈনিক হওয়ার অভিলাষ ও ক্ষমতা তাদের সবার থাকে না—সেটি যেখান থেকেই প্রকাশিত হোক।
কিন্তু আমাদের এখানে কেউই নিজ এলাকায় সেবা দিয়ে সন্তুষ্ট হন না, সবাই ‘জাতীয় দায়িত্ব’ পালন করতে চান। বিন্দুতেই যে সিন্ধু হয়, সে বিশ্বাস আমাদের নেই। সবাই যেন প্রতিযোগিতায় নেমেছেন জাতির বিবেককে জাগিয়ে তোলা, জাগিয়ে রাখার জন্য। জাত তুলে গাল পাড়তে আমাদের জুড়ি নেই—বাঙালি আলসে, তোষামুদে, দুর্নীতিবাজ, ভিতু, পরশ্রীকাতর, ফাঁকিবাজ, মিথ্যাবাদী ইত্যাদি ইত্যাদি। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ উৎপাদনের জন্য, উপার্জনের জন্য দেশ-বিদেশে যা করছে, তা জেনেও তাদের আলসে বলে ফাঁকিবাজ বলে গাল দেওয়া শুধু তাকেই সাজে, যে নিজে আলসে ও ফাঁকিবাজ। আর জিন্নাহর মুখের ওপর যাঁরা কিনা না বলেছেন, লাঠি-সড়কি নিয়ে যাঁরা অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়েছেন, তাঁদের তোষামুদে আর ভীতু বলা তারই সাজে যে তোষামুদে ও ভীতুর দলেই শুধু বিচরণ করে।
আছে অবশ্যই আলসেমি, পরশ্রীকাতরতা, তোষামুদি, দুর্নীতি, ফাঁকিবাজি, মিথ্যাচার ইত্যাদি। সব দেশে সব সমাজে কমবেশি আছে, তবে এসব ক্ষতিকর পর্যায়ে পৌঁছেছে কেবল শহুরে শিক্ষিত সমাজে। প্রাতঃস্মরণীয় বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্র, বেগম রোকেয়া, নজরুল এবং আরও অসংখ্য বাঙালি চিন্তাবিদ যাঁদের কষাঘাত করেছেন, যাঁদের সম্পর্কে সমালোচনামুখর হয়েছেন তাঁরা এই শ্রেণীর মানুষ। এঁরাই সংবাদপত্রের পাঠক ও পৃষ্ঠপোষক বটে, কিন্তু জনগণের ক্ষুদ্র একটি অংশ। এঁরাই যে সমাজের প্রভাবশালী তার কারণ ক্ষমতা ও গণমাধ্যম তাঁদেরই হাতে, তাঁদের ভাবনার প্রতিফলন ঘটে এতে। সেটা, বলা বাহুল্য, দেশের আম-জনগণের ভাবনা বা মতামত নয়।
সাধারণ মানুষ অভাব-অনটনে থাকে সত্য, সুযোগ পেলে অভাব-অভিযোগ তুলে ধরে বটে, কিন্তু তার ভাবনা-জগৎ এবং বিবেক এ নিয়ে মত্ত নয়, সে আশুতোষ, সামান্যতেই তুষ্ট বলে দুঃখ-দারিদ্র্যের কাছে পরাজয় মানে না। ওর মধ্যেই সে বাঁচে—বেড়ার ফাঁক দিয়ে আসা সূর্যালোকের মতো সামান্য আলোই তাকে জীবনবাদী হওয়ার প্রেরণা দেয়।
হ্যাঁ, আমরা ও তারা—একটা বিভাজন এ দেশে আছে। এর মধ্যে দূরত্ব ও ব্যবধান বিশাল এবং তা ক্রমবর্ধমান আর দুপক্ষেই তার মাত্রাগত বহুতর শ্রেণীভেদ তৈরি হচ্ছে। তবে এখনো মোটা দাগে আমরা ও তারা বিভক্ত আছি। রাজনীতি একসময় এই বিভাজনের মাঝে সেতুবন্ধ রচনা করেছিল। প্রগতিশীল রাজনীতি বরাবর ওই ‘তাহাদের’ পাশে থেকে সেতুবন্ধ রচনার কাজটি করেছিল। আর বঙ্গবন্ধু ‘আমরা’র প্রতিনিধিত্বশীল রাজনীতিক হলেও তাঁর দেশপ্রেম ও মানবপ্রেমের জাদুকরি নেতৃত্বের জোরে এমন জোয়ার আনলেন সমাজে যে রাজনীতির সব বিভেদ ঘুচে একাকার হয়ে গেল। বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বড় অর্জন ও অবদান বাঙালির এই ঐক্যসাধন, এক ধাক্কায় মধ্যবিত্তের কুঁড়েমি-স্বার্থচিন্তা-পরশ্রীকাতরতা ইত্যাদি ইত্যাদি উড়িয়ে দিয়ে ঐক্যবদ্ধ জাতিকে ত্যাগের মন্ত্রে উজ্জীবিত বীরের জাতিতে রূপান্তর করলেন। একাত্তর বাঙালির এক অভূতপূর্ব জাগরণ ও পরিবর্তনের ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছে। তাই এ আমাদের ইতিহাসের গৌরবময় অধ্যায়, মহৎ অর্জন।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি হলো, আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব শিল্পোন্নত পশ্চিমের অনুকরণ করতে গিয়ে নিজ দেশের বাস্তবতা ভুলে গেছে। এ যে কৃষি ও গ্রামপ্রধান খেটে খাওয়া মানুষের দেশ, সে কথা সম্পূর্ণ ভুলে যাওয়ায় আজ রাজনীতি যেন দেশ ও মানুষের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ঘরের বিলাসব্যসনে বন্দী হয়ে পড়েছে। শহরের যে মধ্য, উচ্চমধ্য ও উচ্চবিত্ত শ্রেণী ক্ষমতা ও উন্নয়নের ভাগ পাচ্ছে, তারা ক্রমাগত পশ্চিমা জীবনাভ্যাসে গা ভাসিয়ে মূল দেশ ও মানুষের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। নিজেদের ভাগ ও ভোগের আয়োজনে যাতে কোনো কমতি না হয়, যাতে এ জীবনের জৌলুশ বজায় থাকে, পাল্লা দিয়ে বাড়ে তা বজায় রেখে তারপর ভাবা হয় ‘তাহাদের’ কথা—যারা আছে নেপথ্যে, নিছক কিছু পরিসংখ্যানের আধার হয়ে। এই পদ্ধতি অবাস্তব, তাই এ অন্যায় এবং অবাস্তব অন্যায়ের ফসল হবে দুর্নীতি, যাকে রক্ষা করতে ঘটবে অপরাধ। এই বিষচক্রটা কেমন ফুলে-ফেঁপে জোরদার হয়ে উঠেছে দেশে, সে তো আমরা দেখছি প্রতিদিন। এই বিকারের হলাহলই নিত্যদিন সংবাদপত্রে উঠে আসছে। এটা এ সমাজের অসুস্থ, অবক্ষয়িত অংশ, যা টিকে থাকার জন্য নানা নেতিবাচক কাজে জড়িয়ে যাচ্ছে। এই অংশে ইতির চেয়ে নেতি বেশি। বিবেকের দোহাই দিয়ে তা ঢাকাও যাচ্ছে না, নেতির ছোঁয়া বাঁচিয়ে চলাও যাবে না।
খোঁজখবর নিলে দেখা যাবে, গ্রামে গ্রামে আগের মতো হাহাকার নেই, কৃষিতে নীরবে বিপ্লব ঘটে গেছে—কেবল উৎপাদন তিন গুণ হয়েছে তা নয়, নতুন প্রযুক্তি আর চাষাবাদ চালু হচ্ছে। গ্রামের মানুষ সাহস করে বিদেশে পাড়ি দিয়ে ভাগ্যোন্নয়ন করছে। আর গ্রামীণ ব্যাংক এবং ব্র্যাকসহ আরও বেশ কিছু এনজিওর কল্যাণে গ্রামীণ নারী ঘরের বাইরে এসে কাজে নেমেছে। ক্ষুদ্রঋণ কেবল তাদের কাজের সুযোগ করে দিচ্ছে তা নয়, তাদের দিয়েছে ব্যক্তির মর্যাদা এবং আত্মবিশ্বাসের মতো অমূল্য দুই সম্পদ।
তাই বলব, বাংলাদেশ পাল্টে যাচ্ছে। আর শুভসংবাদ হলো, সেটা ঘটছে নিচের তলায়, যারা আদতে ‘তাহারা’—যারা আমাদের অভ্যস্ত গণ্ডির বাইরে, সুদূর, অনুপস্থিত এবং আমাদের বিবেচনায় যারা অকাজের, কেবল হুকুম তামিল করে গায়ে খেটে সব সচল রাখবে। কিন্তু এই জাগরণ টের পাওয়া যাচ্ছে, তাদের মধ্যে অদম্য মেধাবীদের সংখ্যা কীভাবে দিন দিন বাড়ছে তা দেখে; লিমন এবং বিশেষত তার মায়ের ন্যায়যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার মনোবল দেখে।
গ্রামবাংলায় ঘুরলে দেখা যায়, দিবানিদ্রা আর অলস জীবনের চিত্র পাল্টে যাচ্ছে। নারীরাই অগ্রণী। আগে তারা কেবল গার্হস্থ্য কর্মে উদয়াস্ত খাটত, এখন উৎপাদনে-উপার্জনে হাত লাগাচ্ছে। কল্যাণী হাতে মাটি কাটছে, ইট ভাঙছে, ট্রাকে চেপে বালু তুলছে-ফেলছে, খেতে চারা বুনছে, কেউ কেউ লোকজন খাটাচ্ছে। আর চোখ-জুড়ানো দৃশ্য হলো, সবুজ ধানখেতের বুক চিরে যাওয়া আলপথ ধরে সুদৃশ্য ইউনিফর্ম পরে মেয়ের দল চলেছে স্কুলে।
আজ দরকার ছিল দেশ পরিচালনার কাজে এই ‘তাহাদের’ অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া। আশা ছিল, শেখ হাসিনা তাঁর বাবার আরব্ধ কাজ সঠিকভাবে শেষ করবেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার একটি আরব্ধ কাজ নিঃসন্দেহে। কিন্তু রাজনীতিকে জনবিচ্ছিন্ন করে, বিশেষত ‘তাহাদের’ কাছ থেকে সরিয়ে মুষ্টিমেয় দুর্নীতিবাজ-তদবিরবাজ-পরজীবী মানুষের দরবারে সীমাবদ্ধ করার যে কাজ সামরিক একনায়কেরা শুরু করেছিলেন, তাকে থামিয়ে দিয়ে গণমানুষকে জায়গা দেওয়ার রাজনীতি ফিরিয়ে আনা আরও বড় আরব্ধ কাজ।
বাংলাদেশ শিল্পোন্নত পশ্চিম নয়, কৃষিপ্রধান জনবহুল একটি দেশ—যার জনগণ উদ্যমী, পরিশ্রমী, ভাগ্যান্বেষী। এমন মানুষ তো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে আর পরিবর্তন আনতে সদা প্রস্তুত। কেবল সুযোগটুকু চাই, সামরিক শাসকেরা সে সুযোগ বন্ধ করে টাকার খেলার জনবিচ্ছিন্ন রাজনীতি শুরু করেছিলেন। শেখ হাসিনার জন্য মূল আরব্ধ কাজ হলো রাজনীতির সেই বিভেদের অর্গল খুলে দেওয়া। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, তিনি চলেছেন উল্টো পথে। যেন সামরিক শাসকদের আরব্ধ কাজ শেষ করতে চলেছেন। তবে মানুষ অর্থাৎ সেই ‘তাহারা’ বসে থাকছে না। তামাদি হয়ে পড়েছে বরং আমাদের রাজনীতি। অনেক সময় পথের বাধাও বটে। একটি সক্রিয় প্রাণবন্ত সমাজ রাজনীতির এই অপমৃত্যু মেনে নেবে না। তারা কী পরিবর্তন ঘটায়, সেটাই দেখতে চাই আমরা। এই পরিবর্তনের প্রয়োজন, দাবি, চাপ আমাদের রাজনীতি বুঝতে পারে কি না, তাতে সাড়া দেয় কি না, সেটাও আমরা দেখতে চাই। কিন্তু পরিস্থিতি বদলাবেই, মানুষের জাগরণের আলামত স্পষ্ট, আর তাই—পরিবর্তকামীদের পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় আজ। একটু কান পাতলে সবাই শুনতে পাবেন।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
No comments