শ্রদ্ধাঞ্জলি- আমাদের আপা by নাসরিন চৌধুরী
আমি আর তাজিন—পাঁচ ভাইবোনের সবচেয়ে ছোট দুজন। আমাদের বড় বোন সেলিনা আমার চেয়ে আট বছর, তাজিনের চেয়ে ১০ বছরের বড়। আমাদের বাবা স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে প্যারালাইজড হয়ে পড়েন ১৯৫৩ সালে।
তার পর থেকে বাবাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন আমাদের মা—আনোয়ারা বাহার চৌধুরী। তখন থেকে আমার ও তাজিনের অনেক দায়িত্ব বহন করেন বড় আপা সেলিনা বাহার জামান। ১৯৬৫ সালে বিয়ের আগ পর্যন্ত আপা ছিলেন আমাদের প্রায় সার্বক্ষণিক সঙ্গী। আমাদের লেখাপড়া তদারকি, বেড়াতে নিয়ে যাওয়া, রেডিওতে নিয়ে যাওয়া—সবই করেছেন আপা।
আমার ম্যাট্রিক পরীক্ষার এক বছর আগের কথা। আপা সবে যোগ দিয়েছেন সরকারি কলেজে শিক্ষকতায়। তিনি এবং আমাদের মা ঠিক করলেন ম্যাট্রিক পরীক্ষায় আমার অ্যাডিশনাল বিষয় থাকবে ‘মিউজিক’। আমি রাজি। সব দায়িত্ব নিয়ে ওস্তাদ মুন্সি রইসউদ্দিনকে আপা আমার গানের শিক্ষক করে দিলেন। শিক্ষক হিসেবে মুন্সি রইসউদ্দিনকে পেয়ে উচ্চাঙ্গসংগীতে আমার ভালো দখল এসেছিল।
নাচ-গান-আবৃত্তি আপার খুব পছন্দ। তিনি চাইতেন আমরা ছোট দুজন নাচ-গানে দক্ষ হই। কোথাও গানের প্রতিযোগিতা হলে আপা আমাদের দুজনের নাম তালিকাভুক্ত করে আসতেন। মহড়া করিয়ে আমাদের তৈরি করে নিয়ে যেতেন প্রতিযোগিতার আসরে। ১৯৬৪ সাল। আমার আইএসসি পরীক্ষা চলছে। রেডিওতে ‘নিখিল পূর্ব পাকিস্তান সংগীত প্রতিযোগিতা’ শুরু হয়েছে। আপা আমাদের দুজনের নাম দিয়ে এসেছেন। পদার্থবিদ্যা পরীক্ষা শেষে হল থেকে আপা আমাকে নিয়ে এলেন শাহবাগে অবস্থিত বেতার কেন্দ্রে। আমি আর তাজিন দুজনেই প্রতিযোগিতায় অংশ নিলাম, পুরস্কার পেলাম, বেতারের নিয়মিত শিল্পী তালিকায় আমাদের নাম অন্তর্ভুক্ত হলো।
সেলিনা আপা স্কুলে নাচ শিখেছিলেন শিল্পী ভক্তিময় দাশগুপ্তর কাছে। স্কুল ও কলেজে নাচে তিনি নিয়মিত অংশগ্রহণ করতেন। লেখাপড়ার পাশাপাশি বিদ্যায়তনে সব রকম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনে অংশ নিতেন। অনুষ্ঠানেও অংশ নিতেন। অনুষ্ঠান পরিচালনায় আপা বিশেষ দক্ষতার পরিচয় দিয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতেন। আপা লেখাপড়ায় সব সময় ভালো ছিলেন। স্কুলে তিনি দুবার ডাবল প্রমোশন পেয়েছিলেন।
আপার বাচনভঙ্গি ছিল সাবলীল এবং স্পষ্ট। তাঁর বক্তব্য সব সময় হতো যুক্তিগ্রাহ্য এবং বাহুল্যবর্জিত। সাহসী বক্তব্য দিতে তিনি কখনো পিছপা হতেন না। উপস্থিত বক্তৃতা প্রতিযোগিতায় আপা বহুবার পুরস্কার পেয়েছেন।
নাচে আপার ছিল বিশেষ ঝোঁক। তিনি নৃত্যনাট্য পরিচালনা করেছেন কয়েকবার। আপার প্রযোজনায় শ্যামল মাটির ধরা তলে নৃত্যনাট্য পরিবেশিত হয়েছিল।
আবু হেনা সাদউদ্দিন (হেনু ভাই) রবীন্দ্রসংগীত দিয়ে সাজিয়ে রচনা করেছিলেন নৃত্যনাট্য স্বর্গ হতে বিদায়। আপার প্রযোজনায় এটি অভিনীত হয়েছিল। বুলবুল ললিতকলা একাডেমীর হয়ে আপার প্রযোজনায় নৃত্যনাট্য মায়ার খেলা মঞ্চস্থ হয়েছিল। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রজয়ন্তী শতবর্ষে উইমেন্স হলে (বর্তমান রোকেয়া হল) অভিনীত হয় চণ্ডালিকা নৃত্যনাট্য। আপা মায়ের ভূমিকায় নৃত্য পরিবেশন করেন।
নাচ পরিবেশনের সুযোগ আপা ছাড়তেন না। ১৯৯৭ সালে চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। সেই বছর আপা বন্ধুদের নিয়ে কামরুন্নেসা অ্যালামনাই অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। এই অনুষ্ঠানে আপা তাঁর নৃত্যসঙ্গী জিনাত আহমদকে নিয়ে স্টেজে নেচেছিলেন। তখন তাঁদের দুজনেরই সত্তরোর্ধ্ব বয়স। স্টেজে নৃত্য পরিবেশনের সুযোগ পেলে আপা বয়সের কথা ভুলে থাকতেন।
আমি সবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগে শিক্ষক হয়ে যোগ দিয়েছি। আপা তখন সময় পেলেই বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতেন—পদার্থবিদ্যা ও গণিত বিভাগে ঢুঁ মারতেন। পরিচিত ব্যক্তিদের সঙ্গে কিছু সময় কাটাতেন। পুরোনো পিয়নদের সঙ্গে কুশলাদি বিনিময় করতেন। ক্লাস শেষ করে শিক্ষকের কক্ষে ঢুকেই দেখতাম আপা জমিয়ে শিক্ষকদের সঙ্গে অথবা পিয়নদের সঙ্গে আলাপ করছেন। আমাকে দেখেই আপা ডেকে উঠতেন ‘বাচ্চু, এসো এসো’। আমার চেহারায় পরিবর্তন লক্ষ করে তিনি শুধরে নিয়ে বলতেন, ‘নাসরিন, এসো’। আপার আগমনের খবর পেলেই আদরের গঙ্গাদা এবং অন্য পিয়নরা ছুটে এসে আপার ভালোমন্দ শুধিয়ে নিত, আপাও তাদের সবার খবর জেনে নিতেন।
সেলিনা আপার কাছে আত্মীয়তা ও সামাজিকতায় কোনো পার্থক্য ছিল, এমন আমার মনে হয়নি। আশপাশে কাছে-দূরে, আত্মীয়-অনাত্মীয় বন্ধুবান্ধব সবাইকে তিনি আপন করে নিতেন। সমস্যা হলে সাহায্যের জন্য এগিয়ে যাওয়াই ছিল তাঁর ধর্ম। অসুখ-বিসুখে পাশে দাঁড়ানোর অভ্যাস তাঁর এত বেশি ছিল, তা আমাদের অনেকের কাছে অবিশ্বাস্য। তাঁর একজন সহকর্মীর পিজি হাসপাতালে শয্যা প্রয়োজন, অস্ত্রোপচার হবে। ওই সহকর্মীর কোনো আত্মীয় বাংলাদেশে ছিল না। বেডের অপেক্ষায় এক দিন রোগীকে নিয়ে আপা ছয় ঘণ্টা বসে রইলেন। সিট হলো। আপা রোগীকে সেখানে ভর্তি করে বাড়ি গেলেন। দীর্ঘদিন ভোগা সেই রোগীর পরিচর্যায় আপাকে বেশ সময় দিতে হয়েছিল।
১৯৬৮ সালে স্বামীকে নিয়ে চিকিৎসার উদ্দেশ্যে ভারতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। আপা আমাদের সঙ্গে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলেন এবং সঙ্গে গেলেন। কলকাতায় আপা আমাদের সঙ্গে থাকায় আমরা বিশেষভাবে উপকৃত হয়েছিলাম। ওখানে তাঁর পরিচিতি এত বেশি যে আগে তা আমরা জানতাম না।
আজ ১ ডিসেম্বর আপার অষ্টম মৃত্যুবার্ষিকী। তাঁকে মনে পড়ছে বলেই এই স্মৃতিচারণা।
আপার মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ৮ ডিসেম্বর সপ্তম ‘সেলিনা বাহার জামান স্মারক বক্তৃতা’ দেবেন কথাশিল্পী সেলিনা হোসেন। অনুষ্ঠানটি হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরসি মজুমদার মিলনায়তনে, বিকেল চারটায়।
নাসরিন চৌধুরী
আমার ম্যাট্রিক পরীক্ষার এক বছর আগের কথা। আপা সবে যোগ দিয়েছেন সরকারি কলেজে শিক্ষকতায়। তিনি এবং আমাদের মা ঠিক করলেন ম্যাট্রিক পরীক্ষায় আমার অ্যাডিশনাল বিষয় থাকবে ‘মিউজিক’। আমি রাজি। সব দায়িত্ব নিয়ে ওস্তাদ মুন্সি রইসউদ্দিনকে আপা আমার গানের শিক্ষক করে দিলেন। শিক্ষক হিসেবে মুন্সি রইসউদ্দিনকে পেয়ে উচ্চাঙ্গসংগীতে আমার ভালো দখল এসেছিল।
নাচ-গান-আবৃত্তি আপার খুব পছন্দ। তিনি চাইতেন আমরা ছোট দুজন নাচ-গানে দক্ষ হই। কোথাও গানের প্রতিযোগিতা হলে আপা আমাদের দুজনের নাম তালিকাভুক্ত করে আসতেন। মহড়া করিয়ে আমাদের তৈরি করে নিয়ে যেতেন প্রতিযোগিতার আসরে। ১৯৬৪ সাল। আমার আইএসসি পরীক্ষা চলছে। রেডিওতে ‘নিখিল পূর্ব পাকিস্তান সংগীত প্রতিযোগিতা’ শুরু হয়েছে। আপা আমাদের দুজনের নাম দিয়ে এসেছেন। পদার্থবিদ্যা পরীক্ষা শেষে হল থেকে আপা আমাকে নিয়ে এলেন শাহবাগে অবস্থিত বেতার কেন্দ্রে। আমি আর তাজিন দুজনেই প্রতিযোগিতায় অংশ নিলাম, পুরস্কার পেলাম, বেতারের নিয়মিত শিল্পী তালিকায় আমাদের নাম অন্তর্ভুক্ত হলো।
সেলিনা আপা স্কুলে নাচ শিখেছিলেন শিল্পী ভক্তিময় দাশগুপ্তর কাছে। স্কুল ও কলেজে নাচে তিনি নিয়মিত অংশগ্রহণ করতেন। লেখাপড়ার পাশাপাশি বিদ্যায়তনে সব রকম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনে অংশ নিতেন। অনুষ্ঠানেও অংশ নিতেন। অনুষ্ঠান পরিচালনায় আপা বিশেষ দক্ষতার পরিচয় দিয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতেন। আপা লেখাপড়ায় সব সময় ভালো ছিলেন। স্কুলে তিনি দুবার ডাবল প্রমোশন পেয়েছিলেন।
আপার বাচনভঙ্গি ছিল সাবলীল এবং স্পষ্ট। তাঁর বক্তব্য সব সময় হতো যুক্তিগ্রাহ্য এবং বাহুল্যবর্জিত। সাহসী বক্তব্য দিতে তিনি কখনো পিছপা হতেন না। উপস্থিত বক্তৃতা প্রতিযোগিতায় আপা বহুবার পুরস্কার পেয়েছেন।
নাচে আপার ছিল বিশেষ ঝোঁক। তিনি নৃত্যনাট্য পরিচালনা করেছেন কয়েকবার। আপার প্রযোজনায় শ্যামল মাটির ধরা তলে নৃত্যনাট্য পরিবেশিত হয়েছিল।
আবু হেনা সাদউদ্দিন (হেনু ভাই) রবীন্দ্রসংগীত দিয়ে সাজিয়ে রচনা করেছিলেন নৃত্যনাট্য স্বর্গ হতে বিদায়। আপার প্রযোজনায় এটি অভিনীত হয়েছিল। বুলবুল ললিতকলা একাডেমীর হয়ে আপার প্রযোজনায় নৃত্যনাট্য মায়ার খেলা মঞ্চস্থ হয়েছিল। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রজয়ন্তী শতবর্ষে উইমেন্স হলে (বর্তমান রোকেয়া হল) অভিনীত হয় চণ্ডালিকা নৃত্যনাট্য। আপা মায়ের ভূমিকায় নৃত্য পরিবেশন করেন।
নাচ পরিবেশনের সুযোগ আপা ছাড়তেন না। ১৯৯৭ সালে চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। সেই বছর আপা বন্ধুদের নিয়ে কামরুন্নেসা অ্যালামনাই অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। এই অনুষ্ঠানে আপা তাঁর নৃত্যসঙ্গী জিনাত আহমদকে নিয়ে স্টেজে নেচেছিলেন। তখন তাঁদের দুজনেরই সত্তরোর্ধ্ব বয়স। স্টেজে নৃত্য পরিবেশনের সুযোগ পেলে আপা বয়সের কথা ভুলে থাকতেন।
আমি সবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগে শিক্ষক হয়ে যোগ দিয়েছি। আপা তখন সময় পেলেই বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতেন—পদার্থবিদ্যা ও গণিত বিভাগে ঢুঁ মারতেন। পরিচিত ব্যক্তিদের সঙ্গে কিছু সময় কাটাতেন। পুরোনো পিয়নদের সঙ্গে কুশলাদি বিনিময় করতেন। ক্লাস শেষ করে শিক্ষকের কক্ষে ঢুকেই দেখতাম আপা জমিয়ে শিক্ষকদের সঙ্গে অথবা পিয়নদের সঙ্গে আলাপ করছেন। আমাকে দেখেই আপা ডেকে উঠতেন ‘বাচ্চু, এসো এসো’। আমার চেহারায় পরিবর্তন লক্ষ করে তিনি শুধরে নিয়ে বলতেন, ‘নাসরিন, এসো’। আপার আগমনের খবর পেলেই আদরের গঙ্গাদা এবং অন্য পিয়নরা ছুটে এসে আপার ভালোমন্দ শুধিয়ে নিত, আপাও তাদের সবার খবর জেনে নিতেন।
সেলিনা আপার কাছে আত্মীয়তা ও সামাজিকতায় কোনো পার্থক্য ছিল, এমন আমার মনে হয়নি। আশপাশে কাছে-দূরে, আত্মীয়-অনাত্মীয় বন্ধুবান্ধব সবাইকে তিনি আপন করে নিতেন। সমস্যা হলে সাহায্যের জন্য এগিয়ে যাওয়াই ছিল তাঁর ধর্ম। অসুখ-বিসুখে পাশে দাঁড়ানোর অভ্যাস তাঁর এত বেশি ছিল, তা আমাদের অনেকের কাছে অবিশ্বাস্য। তাঁর একজন সহকর্মীর পিজি হাসপাতালে শয্যা প্রয়োজন, অস্ত্রোপচার হবে। ওই সহকর্মীর কোনো আত্মীয় বাংলাদেশে ছিল না। বেডের অপেক্ষায় এক দিন রোগীকে নিয়ে আপা ছয় ঘণ্টা বসে রইলেন। সিট হলো। আপা রোগীকে সেখানে ভর্তি করে বাড়ি গেলেন। দীর্ঘদিন ভোগা সেই রোগীর পরিচর্যায় আপাকে বেশ সময় দিতে হয়েছিল।
১৯৬৮ সালে স্বামীকে নিয়ে চিকিৎসার উদ্দেশ্যে ভারতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। আপা আমাদের সঙ্গে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলেন এবং সঙ্গে গেলেন। কলকাতায় আপা আমাদের সঙ্গে থাকায় আমরা বিশেষভাবে উপকৃত হয়েছিলাম। ওখানে তাঁর পরিচিতি এত বেশি যে আগে তা আমরা জানতাম না।
আজ ১ ডিসেম্বর আপার অষ্টম মৃত্যুবার্ষিকী। তাঁকে মনে পড়ছে বলেই এই স্মৃতিচারণা।
আপার মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ৮ ডিসেম্বর সপ্তম ‘সেলিনা বাহার জামান স্মারক বক্তৃতা’ দেবেন কথাশিল্পী সেলিনা হোসেন। অনুষ্ঠানটি হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরসি মজুমদার মিলনায়তনে, বিকেল চারটায়।
নাসরিন চৌধুরী
No comments