মহামিলনের দিন by ফাদার বেঞ্জামিন কস্তা
খ্রিস্টজন্মোৎসব বা বড়দিন পালিত হয় একটি শিশুর জন্মকে কেন্দ্র করে। তার জন্মের বহু আগে থেকেই প্রবক্তাগণ ভাববাণী করেছিলেন : 'একটি ছেলে আমাদের জন্য জন্মগ্রহণ করবেন, একটি পুত্র আমাদের দেওয়া হবে।
শাসন করবার ভার তার কাঁধের ওপর থাকবে, আর তার নাম হবে আশ্চর্য পরামর্শদাতা, শক্তিশালী ঈশ্বর, চিরস্থায়ী পিতা, শান্তির রাজা।' (যিশা ৯:৬)
খ্রিস্টজন্মোৎসব উদযাপনের সময় খ্রিস্টবিশ্বাসীরা কোনো কল্পকাহিনী নয় বরং এটা সত্য নিয়েই ধ্যান-প্রার্থনা করে, আনন্দ-উৎসব করে। এ দিনে বেথলেহেমের গোশালায় শিশুটির জন্মের কাহিনী পাঠ ও ধ্যান করা হয়। সেই জন্মকাহিনী অবলম্বনে গির্জাঘরে, এমনকি প্রতিটি আবাসিক গৃহে খড়কুটো দিয়ে গোশালা নির্মাণ করে ফুলপাতা দিয়ে সাজানো হয়। গ্রামে গ্রামে ও পাড়ায় গান-বাজনা, নাম-সংকীর্তন, বাদ্য-বাজনা, আনন্দ-উল্লাস ইত্যাদি চলে। এসব বাহ্যিক উৎসব আয়োজনের ঊধর্ে্ব প্রকৃত খ্রিস্টবিশ্বাসীরা তাদের মন-হৃদয় ও অন্তরাত্মাকে পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করতে প্রয়াসী হয়। তাদের এই আনন্দ-উৎসব যাতে নিছক আনুষ্ঠানিকতা না হয় তার জন্য খ্রিস্টমণ্ডলী বিচিত্র উপায়ে বড়দিনের পূর্ববর্তী সপ্তাহব্যাপী আগমনকাল পালনের ব্যবস্থা করে। এ সময়ে খ্রিস্টভক্তরা ধ্যান-অনুধ্যান, মনপরীক্ষা, পাপ স্বীকার, পুনর্মিলন, ক্ষমা-অনুষ্ঠান ইত্যাদির মাধ্যমে মানুষে মানুষে ভগ্নসম্পর্কের পুনর্মিলন ও নবায়ন করতে সচেষ্ট হয়।
ঈশ্বর তো মানুষকে অনেক মর্যাদা দিয়ে নিজের প্রতিমূর্তিতে গড়েছেন। মানুষের প্রতি ঈশ্বরের মহানুভবতার কথা ধ্যান করে বিস্ময়াভিভূত হয়ে তাই সামরচয়িতা বলেন : 'মানুষ এমন কী যে, তুমি তার বিষয় চিন্তা কর? মানুষের সন্তানই-বা কী যে, তুমি তার দিকে মনোযোগ দাও? তুমি মানুষকে স্বর্গদূতের চেয়ে সামান্য নীচু করেছ; রাজমুকুট হিসেবে তুমি তাকে দান করেছ গৌরব ও সম্মান। তোমার হাতে সৃষ্টির শাসনভার তুমি তারই হাতে দিয়েছ' (সাম ৮:৪-৬)। মানুষকে ঈশ্বর অসীম মর্যাদা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। এই মর্যাদা তার নিজের অর্জন বা কৃতিত্ব নয়, এ হচ্ছে তার নিকট স্রষ্টার দান। এ জন্য তাকে সবসময় ঈশ্বরের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকতে হয়, কোনো প্রকার অহঙ্কার বা আত্মশ্লাঘার কোনো সুযোগই তার নেই।
মানুষ কিন্তু ঈশ্বরপ্রদত্ত তার সেই মর্যাদায় সন্তুষ্ট না থেকে অসৎ পথে আরও কিছু হওয়ার চেষ্টা করেছিল। শয়তানের প্রলোভনে পড়ে মানুষ ঈশ্বরের সমান হতে চেয়েছিল; তাই সে অবাধ্যতার পাপ করেছিল। আদিপুস্তকের রচয়িতা মানুষের পতনকে এভাবে দেখেছেন : ঈশ্বর আদম-ইভকে একটি গাছের ফল খেতে নিষেধ করেছিলেন। সৃষ্টজীবগুলো সৃষ্টিকর্তার প্রতি অনুগত ও বাধ্য থাকবে, এটাই তো স্বাভাবিক। তার বিধান মেনে চলার মধ্যেই তো মানুষের স্বস্তি ও শান্তি। উদাহরণস্বরূপ, মাছ পানিতেই স্বস্তিবোধ করবে। কিন্তু সেই মাছ যদি দাম্ভিকতাবশত ডাঙায় বিচরণ করতে চায় তবে তার মরণ অবশ্যম্ভাবী। অনুরূপভাবে বায়ুমণ্ডলে বাস করে মানুষ যদি বায়ুকে এড়িয়ে চলতে চায় তবে তার মৃত্য অনিবার্য। সেরূপ ঈশ্বর-মণ্ডলের বাইরে অর্থাৎ ঈশ্বরের ইচ্ছার বিরোধিতা করে মানুষ কখনও সুস্থ-স্বাভাবিক থাকতে পারে না। বিশ্বসৃষ্টির প্রভু যিনি, তার সমান হতে চাওয়া সসীম মরণশীল সৃষ্টজীব মানুষের জন্য স্রষ্টার বিধানের বিরোধিতা করা আত্মঘাতী। কিন্তু শয়তান মানুষকে ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা করল। সর্বজ্ঞ ঈশ্বর জানেন কিসে মানুষের মঙ্গল, আর কিসে অমঙ্গল। তাই ঈশ্বর মানুষের জন্য বিধান দিলেন; মানুষের হৃদয়ের মধ্যেই ঈশ্বর সেই বিধান লিখে দিয়েছেন (যিরমিয় ৩১ :৩১)। সেই বিধান হচ্ছে ভালোবাসার বিধান। যে ভালোবাসে সে অনন্ত জীবন পেয়েই গেছে। কিন্তু শয়তান ইভকে বলল :'ঈশ্বর জানেন, যেদিন তোমরা সেই গাছের ফল খাবে, সেই দিনই তোমাদের চোখ খুলে যাবে। তাতে ভালো-মন্দের জ্ঞান পেয়ে তোমরা ঈশ্বরের মতোই হয়ে উঠবে।'
শয়তান আজও প্রতিনিয়ত মানুষের মধ্যে সেই প্রলোভন জাগিয়ে দেয়। এ কারণে সে ঈশ্বরের সমান হতে চায়, অসীম ক্ষমতাধর হতে চায়। সে এমন কিছু হতে চায় যা তার পক্ষে হওয়া সম্ভব নয় বা উচিতও নয়। ভালোবাসার বিধান লঙ্ঘন করে মানুষ প্রকৃতপক্ষে তার মনুষ্যত্ব হারায়, সে পশুতুল্য হয়ে ওঠে। কিন্তু যা পশুসুলভ, তা কখনও মানবসুলভ হতে পারে না। সন্ত্রাস, দুর্নীতি, ঘুষ খাওয়া, চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই, ব্যভিচার, শোষণ-নির্যাতন, শত্রুতা, ঘৃণা, এসব তো সবার কাছেই নিন্দনীয় ও সযত্নে পরিত্যাজ্য। কিন্তু সমাজের কোনো কোনো মহল বা শ্রেণীর মানুষ এগুলোকেই বীরত্ব বা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথ বা পন্থা হিসেবে বেছে নেয়।
পাপ-স্বভাবের কারণে মানুষের মধ্যে কিছু মিথ্যা অহঙ্কার ও উচ্চাভিলাষ কাজ করে। কিন্তু মানুষের সংস্পর্শে, মানুষের সঙ্গে মানবিক আদান-প্রদানের ফলে মানুষের মধ্যে মানবসুলভ গুণাবলির বিকাশ ঘটে। মানুষ যদি সেটাকে মূল্য না দিয়ে সে যা দান হিসেবে পেয়েছে তা নিয়ে অহঙ্কারী হয়ে ওঠে এবং সবার কল্যাণের জন্য প্রদত্ত দানকে নিজের সম্পদ ভেবে তাকে পুঁজি করে অহংবোধে অন্ধ হয়ে পড়ে তবে তার পতন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে।
মানুষের মধ্যে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে শ্রেষ্ঠত্বের সর্বজনীন কতগুলো মানদণ্ড বা মাপকাঠি আছে। তার মধ্যে প্রধান হচ্ছে দয়ামায়া, করুণা, প্রেম, প্রীতি, ক্ষমা, ভালোবাসা, সহিষ্ণুতা, নম্রতা, পরার্থপরতা, দানশীলতা ইত্যাদি। রাষ্ট্র বা সমাজে যেসব নিয়মকানুন বা বিধিবিধান তৈরি হয় তার সবই এগুলোর অধীন। এগুলো মানুষের চরিত্র ও ব্যক্তিত্বকে মহৎ ও মহীয়ান করে তোলে। কিন্তু যার মধ্যে বিকৃত রুচিবোধ জন্ম নেয় সে পাশবিকতাকেই বীরত্ব বলে মনে করে, যা ঘৃণ্য তাকে প্রশংসার যোগ্য বলে ভাবে। সুতরাং মাস্তান ও সন্ত্রাসীরা যে পেশিশক্তি ও পশুশক্তির পূজা করবে তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই; কিন্তু ভদ্রলোক কখনও ঝগড়া-বিবাদ, দ্বন্দ্ব-কলহ, মারামারিকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিতে পারে না। কেননা সে জানে যে, হিংসাকে হিংসা দিয়ে, অহঙ্কারকে অহঙ্কার দিয়ে প্রশমিত বা নিরাময় করা যায় না। তার জন্য বিপরীতধর্মী শক্তি ও কার্যক্রমেরই প্রয়োজন হয়। এ জন্যই ভগবান বুদ্ধ বলেছেন, অহিংসা পরম ধর্ম। অধর্মকে ধর্ম দিয়ে, ঘৃণাকে ভালোবাসা দিয়ে, মিথ্যাকে সত্য দিয়ে জয় করা সম্ভব। এভাবেই গড়ে উঠতে পারে মানব পরিবারের মধ্যে অখণ্ড ভালোবাসা ও সম্প্রীতির বন্ধন_ মহামিলন ও অকপট ভ্রাতৃত্ব।
বড়দিন হচ্ছে উপরোক্ত অর্থে মহামিলনের দিন। সব দিনের সেরা এই দিন। এ দিন সব মানুষের সঙ্গে মিলনের দিন, ক্ষমা করার দিন, নম্র হওয়ার দিন। এদিনে মানুষ তার অন্তরগভীরে প্রবেশ করে সেখানে বিশ্বসৃষ্টির প্রভু পরমেশ্বরের উপস্থিতিতে বিশ্বসৃষ্টিতে অনুরণিত বিশ্বসঙ্গীতের সঙ্গে তাল মিলাতে সক্ষম, সেই বড়দিনের তাৎপর্য অনুধাবন করতে এবং যার জন্মোৎসব পালিত হয় তার সঙ্গে মিলিত হয়ে ঈশ্বরের আশিসধন্য সন্তান হিসেবে নিজের মর্যাদা অনুধাবন ও আস্বাদন করতে সক্ষম। এ দিনে ভক্তি-ভালোবাসায় আপ্লুত মানুষ বুঝতে পারে, তার নিজের মধ্যে গর্ব করার মতো অর্জন কিছুই নেই, তার যা আছে বা সে যা কিছু হয়েছে তার সবটাই অনুগ্রহ। 'বাণী একদিন হলেন রক্তমাংসের মানুষ: বাস করতে লাগলেন আমাদেরই মাঝখানে। আর আমরা তার মহিমা প্রত্যক্ষ করলাম, একমাত্র পুত্র হিসেবে পিতার কাছ থেকে পাওয়া সেই যে মহিমা ঐশ অনুগ্রহ ও সত্যের সেই পূর্ণতা।... সত্যিই তো আমরা সকলে তার সেই পূর্ণতা থেকে লাভবান হয়েছি; লাভ করেছি অনুগ্রহ আর অনুগ্রহ' (যেহান ১ :১৪, ১৬)।
ঈশ্বরের বিশেষ অনুগ্রহধন্য যিশুর মা কুমারী মারিয়া যিশুর দেহধারণের মর্মসত্য উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তাই ঐশ্বরিক ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে তিনি মনেপ্রাণে তা লালন করেছেন।
বড়দিনে তাই ভক্তজনের হৃদয়ানুভূতি ও গভীর আকুতি হলো এই : আমি মিলতে চাই, সকলকে আপন করে পেতে চাই, জানতে চাই, আমি দান চাই না, আমি দাতাকেই চাই। অন্য সবাই দান নিয়ে ফিরে যাক, আমি শুধু 'ওই আসনতলের মাটির 'পরে (রবীন্দ্রনাথ, স্বরবিতান ১৭)। আমি 'রে আনন্দযজ্ঞে তোমার নিমন্ত্রণে' পরিপূর্ণ সাড়া দিতে চাই।(স্বরবিতান ৩৭)। বড়দিন হচ্ছে স্বর্গীয় সম্পদে, মনুষ্যত্বের মহিমায়, মিলন, ভ্রাতৃত্বের সুষমায়, চিত্তবৃত্তি ও হৃদয়বৃত্তিতে সিক্ত হয়ে অনন্য বিশ্বপ্রভুর সঙ্গে, তার সৃষ্টির সঙ্গে, শ্রেষ্ঠ মানুষের সঙ্গে মহামিলনের দিন, উৎফুল্লচিত্তে সহভাগিতার দিন, নিজেকে সবার মধ্যে এবং সবাইকে নিজের মধ্যে উপলব্ধি করে সচ্চিদানন্দকে আস্বাদন করার দিন। সবার প্রতি রইল আনন্দময় বড়দিন ও খ্রীস্টিয় নববর্ষের শুভেচ্ছা।
স ফাদার বেঞ্জামিন কস্তা, পিএসসি : উপাচার্য নটর ডেম বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ (প্রস্তাবিত)
খ্রিস্টজন্মোৎসব উদযাপনের সময় খ্রিস্টবিশ্বাসীরা কোনো কল্পকাহিনী নয় বরং এটা সত্য নিয়েই ধ্যান-প্রার্থনা করে, আনন্দ-উৎসব করে। এ দিনে বেথলেহেমের গোশালায় শিশুটির জন্মের কাহিনী পাঠ ও ধ্যান করা হয়। সেই জন্মকাহিনী অবলম্বনে গির্জাঘরে, এমনকি প্রতিটি আবাসিক গৃহে খড়কুটো দিয়ে গোশালা নির্মাণ করে ফুলপাতা দিয়ে সাজানো হয়। গ্রামে গ্রামে ও পাড়ায় গান-বাজনা, নাম-সংকীর্তন, বাদ্য-বাজনা, আনন্দ-উল্লাস ইত্যাদি চলে। এসব বাহ্যিক উৎসব আয়োজনের ঊধর্ে্ব প্রকৃত খ্রিস্টবিশ্বাসীরা তাদের মন-হৃদয় ও অন্তরাত্মাকে পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করতে প্রয়াসী হয়। তাদের এই আনন্দ-উৎসব যাতে নিছক আনুষ্ঠানিকতা না হয় তার জন্য খ্রিস্টমণ্ডলী বিচিত্র উপায়ে বড়দিনের পূর্ববর্তী সপ্তাহব্যাপী আগমনকাল পালনের ব্যবস্থা করে। এ সময়ে খ্রিস্টভক্তরা ধ্যান-অনুধ্যান, মনপরীক্ষা, পাপ স্বীকার, পুনর্মিলন, ক্ষমা-অনুষ্ঠান ইত্যাদির মাধ্যমে মানুষে মানুষে ভগ্নসম্পর্কের পুনর্মিলন ও নবায়ন করতে সচেষ্ট হয়।
ঈশ্বর তো মানুষকে অনেক মর্যাদা দিয়ে নিজের প্রতিমূর্তিতে গড়েছেন। মানুষের প্রতি ঈশ্বরের মহানুভবতার কথা ধ্যান করে বিস্ময়াভিভূত হয়ে তাই সামরচয়িতা বলেন : 'মানুষ এমন কী যে, তুমি তার বিষয় চিন্তা কর? মানুষের সন্তানই-বা কী যে, তুমি তার দিকে মনোযোগ দাও? তুমি মানুষকে স্বর্গদূতের চেয়ে সামান্য নীচু করেছ; রাজমুকুট হিসেবে তুমি তাকে দান করেছ গৌরব ও সম্মান। তোমার হাতে সৃষ্টির শাসনভার তুমি তারই হাতে দিয়েছ' (সাম ৮:৪-৬)। মানুষকে ঈশ্বর অসীম মর্যাদা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। এই মর্যাদা তার নিজের অর্জন বা কৃতিত্ব নয়, এ হচ্ছে তার নিকট স্রষ্টার দান। এ জন্য তাকে সবসময় ঈশ্বরের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকতে হয়, কোনো প্রকার অহঙ্কার বা আত্মশ্লাঘার কোনো সুযোগই তার নেই।
মানুষ কিন্তু ঈশ্বরপ্রদত্ত তার সেই মর্যাদায় সন্তুষ্ট না থেকে অসৎ পথে আরও কিছু হওয়ার চেষ্টা করেছিল। শয়তানের প্রলোভনে পড়ে মানুষ ঈশ্বরের সমান হতে চেয়েছিল; তাই সে অবাধ্যতার পাপ করেছিল। আদিপুস্তকের রচয়িতা মানুষের পতনকে এভাবে দেখেছেন : ঈশ্বর আদম-ইভকে একটি গাছের ফল খেতে নিষেধ করেছিলেন। সৃষ্টজীবগুলো সৃষ্টিকর্তার প্রতি অনুগত ও বাধ্য থাকবে, এটাই তো স্বাভাবিক। তার বিধান মেনে চলার মধ্যেই তো মানুষের স্বস্তি ও শান্তি। উদাহরণস্বরূপ, মাছ পানিতেই স্বস্তিবোধ করবে। কিন্তু সেই মাছ যদি দাম্ভিকতাবশত ডাঙায় বিচরণ করতে চায় তবে তার মরণ অবশ্যম্ভাবী। অনুরূপভাবে বায়ুমণ্ডলে বাস করে মানুষ যদি বায়ুকে এড়িয়ে চলতে চায় তবে তার মৃত্য অনিবার্য। সেরূপ ঈশ্বর-মণ্ডলের বাইরে অর্থাৎ ঈশ্বরের ইচ্ছার বিরোধিতা করে মানুষ কখনও সুস্থ-স্বাভাবিক থাকতে পারে না। বিশ্বসৃষ্টির প্রভু যিনি, তার সমান হতে চাওয়া সসীম মরণশীল সৃষ্টজীব মানুষের জন্য স্রষ্টার বিধানের বিরোধিতা করা আত্মঘাতী। কিন্তু শয়তান মানুষকে ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা করল। সর্বজ্ঞ ঈশ্বর জানেন কিসে মানুষের মঙ্গল, আর কিসে অমঙ্গল। তাই ঈশ্বর মানুষের জন্য বিধান দিলেন; মানুষের হৃদয়ের মধ্যেই ঈশ্বর সেই বিধান লিখে দিয়েছেন (যিরমিয় ৩১ :৩১)। সেই বিধান হচ্ছে ভালোবাসার বিধান। যে ভালোবাসে সে অনন্ত জীবন পেয়েই গেছে। কিন্তু শয়তান ইভকে বলল :'ঈশ্বর জানেন, যেদিন তোমরা সেই গাছের ফল খাবে, সেই দিনই তোমাদের চোখ খুলে যাবে। তাতে ভালো-মন্দের জ্ঞান পেয়ে তোমরা ঈশ্বরের মতোই হয়ে উঠবে।'
শয়তান আজও প্রতিনিয়ত মানুষের মধ্যে সেই প্রলোভন জাগিয়ে দেয়। এ কারণে সে ঈশ্বরের সমান হতে চায়, অসীম ক্ষমতাধর হতে চায়। সে এমন কিছু হতে চায় যা তার পক্ষে হওয়া সম্ভব নয় বা উচিতও নয়। ভালোবাসার বিধান লঙ্ঘন করে মানুষ প্রকৃতপক্ষে তার মনুষ্যত্ব হারায়, সে পশুতুল্য হয়ে ওঠে। কিন্তু যা পশুসুলভ, তা কখনও মানবসুলভ হতে পারে না। সন্ত্রাস, দুর্নীতি, ঘুষ খাওয়া, চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই, ব্যভিচার, শোষণ-নির্যাতন, শত্রুতা, ঘৃণা, এসব তো সবার কাছেই নিন্দনীয় ও সযত্নে পরিত্যাজ্য। কিন্তু সমাজের কোনো কোনো মহল বা শ্রেণীর মানুষ এগুলোকেই বীরত্ব বা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথ বা পন্থা হিসেবে বেছে নেয়।
পাপ-স্বভাবের কারণে মানুষের মধ্যে কিছু মিথ্যা অহঙ্কার ও উচ্চাভিলাষ কাজ করে। কিন্তু মানুষের সংস্পর্শে, মানুষের সঙ্গে মানবিক আদান-প্রদানের ফলে মানুষের মধ্যে মানবসুলভ গুণাবলির বিকাশ ঘটে। মানুষ যদি সেটাকে মূল্য না দিয়ে সে যা দান হিসেবে পেয়েছে তা নিয়ে অহঙ্কারী হয়ে ওঠে এবং সবার কল্যাণের জন্য প্রদত্ত দানকে নিজের সম্পদ ভেবে তাকে পুঁজি করে অহংবোধে অন্ধ হয়ে পড়ে তবে তার পতন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে।
মানুষের মধ্যে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে শ্রেষ্ঠত্বের সর্বজনীন কতগুলো মানদণ্ড বা মাপকাঠি আছে। তার মধ্যে প্রধান হচ্ছে দয়ামায়া, করুণা, প্রেম, প্রীতি, ক্ষমা, ভালোবাসা, সহিষ্ণুতা, নম্রতা, পরার্থপরতা, দানশীলতা ইত্যাদি। রাষ্ট্র বা সমাজে যেসব নিয়মকানুন বা বিধিবিধান তৈরি হয় তার সবই এগুলোর অধীন। এগুলো মানুষের চরিত্র ও ব্যক্তিত্বকে মহৎ ও মহীয়ান করে তোলে। কিন্তু যার মধ্যে বিকৃত রুচিবোধ জন্ম নেয় সে পাশবিকতাকেই বীরত্ব বলে মনে করে, যা ঘৃণ্য তাকে প্রশংসার যোগ্য বলে ভাবে। সুতরাং মাস্তান ও সন্ত্রাসীরা যে পেশিশক্তি ও পশুশক্তির পূজা করবে তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই; কিন্তু ভদ্রলোক কখনও ঝগড়া-বিবাদ, দ্বন্দ্ব-কলহ, মারামারিকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিতে পারে না। কেননা সে জানে যে, হিংসাকে হিংসা দিয়ে, অহঙ্কারকে অহঙ্কার দিয়ে প্রশমিত বা নিরাময় করা যায় না। তার জন্য বিপরীতধর্মী শক্তি ও কার্যক্রমেরই প্রয়োজন হয়। এ জন্যই ভগবান বুদ্ধ বলেছেন, অহিংসা পরম ধর্ম। অধর্মকে ধর্ম দিয়ে, ঘৃণাকে ভালোবাসা দিয়ে, মিথ্যাকে সত্য দিয়ে জয় করা সম্ভব। এভাবেই গড়ে উঠতে পারে মানব পরিবারের মধ্যে অখণ্ড ভালোবাসা ও সম্প্রীতির বন্ধন_ মহামিলন ও অকপট ভ্রাতৃত্ব।
বড়দিন হচ্ছে উপরোক্ত অর্থে মহামিলনের দিন। সব দিনের সেরা এই দিন। এ দিন সব মানুষের সঙ্গে মিলনের দিন, ক্ষমা করার দিন, নম্র হওয়ার দিন। এদিনে মানুষ তার অন্তরগভীরে প্রবেশ করে সেখানে বিশ্বসৃষ্টির প্রভু পরমেশ্বরের উপস্থিতিতে বিশ্বসৃষ্টিতে অনুরণিত বিশ্বসঙ্গীতের সঙ্গে তাল মিলাতে সক্ষম, সেই বড়দিনের তাৎপর্য অনুধাবন করতে এবং যার জন্মোৎসব পালিত হয় তার সঙ্গে মিলিত হয়ে ঈশ্বরের আশিসধন্য সন্তান হিসেবে নিজের মর্যাদা অনুধাবন ও আস্বাদন করতে সক্ষম। এ দিনে ভক্তি-ভালোবাসায় আপ্লুত মানুষ বুঝতে পারে, তার নিজের মধ্যে গর্ব করার মতো অর্জন কিছুই নেই, তার যা আছে বা সে যা কিছু হয়েছে তার সবটাই অনুগ্রহ। 'বাণী একদিন হলেন রক্তমাংসের মানুষ: বাস করতে লাগলেন আমাদেরই মাঝখানে। আর আমরা তার মহিমা প্রত্যক্ষ করলাম, একমাত্র পুত্র হিসেবে পিতার কাছ থেকে পাওয়া সেই যে মহিমা ঐশ অনুগ্রহ ও সত্যের সেই পূর্ণতা।... সত্যিই তো আমরা সকলে তার সেই পূর্ণতা থেকে লাভবান হয়েছি; লাভ করেছি অনুগ্রহ আর অনুগ্রহ' (যেহান ১ :১৪, ১৬)।
ঈশ্বরের বিশেষ অনুগ্রহধন্য যিশুর মা কুমারী মারিয়া যিশুর দেহধারণের মর্মসত্য উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তাই ঐশ্বরিক ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে তিনি মনেপ্রাণে তা লালন করেছেন।
বড়দিনে তাই ভক্তজনের হৃদয়ানুভূতি ও গভীর আকুতি হলো এই : আমি মিলতে চাই, সকলকে আপন করে পেতে চাই, জানতে চাই, আমি দান চাই না, আমি দাতাকেই চাই। অন্য সবাই দান নিয়ে ফিরে যাক, আমি শুধু 'ওই আসনতলের মাটির 'পরে (রবীন্দ্রনাথ, স্বরবিতান ১৭)। আমি 'রে আনন্দযজ্ঞে তোমার নিমন্ত্রণে' পরিপূর্ণ সাড়া দিতে চাই।(স্বরবিতান ৩৭)। বড়দিন হচ্ছে স্বর্গীয় সম্পদে, মনুষ্যত্বের মহিমায়, মিলন, ভ্রাতৃত্বের সুষমায়, চিত্তবৃত্তি ও হৃদয়বৃত্তিতে সিক্ত হয়ে অনন্য বিশ্বপ্রভুর সঙ্গে, তার সৃষ্টির সঙ্গে, শ্রেষ্ঠ মানুষের সঙ্গে মহামিলনের দিন, উৎফুল্লচিত্তে সহভাগিতার দিন, নিজেকে সবার মধ্যে এবং সবাইকে নিজের মধ্যে উপলব্ধি করে সচ্চিদানন্দকে আস্বাদন করার দিন। সবার প্রতি রইল আনন্দময় বড়দিন ও খ্রীস্টিয় নববর্ষের শুভেচ্ছা।
স ফাদার বেঞ্জামিন কস্তা, পিএসসি : উপাচার্য নটর ডেম বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ (প্রস্তাবিত)
No comments