হরতাল 'সাংবিধানিক অধিকার' নয় by ড. ফেরদৌস আহমদ কোরেশী
শক্তি প্রয়োগ ও সন্ত্রাস সৃষ্টির মাধ্যমে জনগণকে জিম্মি করে 'হরতাল' পালনের রীতি আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে অতি স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেকে একে 'সাংবিধানিক অধিকার'ও মনে করছেন।
ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে দাবি আদায়ের জন্য ধর্মঘট ডাকা বিধেয়। সে ক্ষেত্রে ধর্মঘটীরা অন্যদের ধর্মঘটে যোগ দিয়ে কাজে যোগদানে বিরত থাকার আহ্বান জানাতে পারে। কিন্তু কাউকে জোর করে ধর্মঘটে যোগ দিতে বাধ্য করতে পারে না। তা ছাড়া আইন ও রীতি অনুযায়ী ধর্মঘট ডাকার আগে কর্তৃপক্ষকে সময় বেঁধে দিয়ে নোটিশ দিতে হয়। তাতে সমস্যার সন্তোষজনক সমাধান না হলে সংশ্লিষ্ট ট্রেড ইউনিয়নের অধিকাংশ সদস্যের সম্মতিক্রমে ধর্মঘট ডাকা যায়। এ জন্য প্রয়োজনে ভোটাভুটিতে যেতে হয়। কিন্তু আমাদের দেশে এসবের কোনো বালাই নেই। আমাদের কল-কারখানাগুলোয় যেকোনো অজুহাতে যেকোনো সময় হুট করে ধর্মঘট শুরু হয়ে যায়। নিয়ম-রীতি মেনে নোটিশ প্রদান বা অধিকাংশ শ্রমিকের সম্মতি নেওয়ার রেওয়াজ নেই বললেই চলে (অনেকে অবশ্য প্রথাগত ট্রেড ইউনিয়ন না থাকাকে এ জন্য দায়ী করে থাকেন)।
হরতালের ব্যাপারে আমরা আরো উদার। যে কেউ হরতাল ডাকতে পারে। এখানে ট্রেড ইউনিয়নের নিয়ম-রীতির প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই। যে কারণে বা দাবিতে হরতাল ডাকা হচ্ছে তার প্রতি সাধারণ মানুষের সমর্থন আছে কি নেই সেটা যাচাই করার প্রয়োজন হয় না। ইসলামী দল 'ইসলাম বিপন্ন' হওয়ার স্লোগান দিয়ে হরতাল ডাকে, বামপন্থীরা 'জনগণে'র নামে হরতাল ডাকে। একদল ইসলামের সোল এজেন্ট, আরেক দল জনগণের। অন্যরা হরতাল ডাকে স্রেফ ক্ষমতার পালাবদল ত্বরান্বিত করার উদ্দেশ্যে। কারো গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে, কারো দুর্নীতির মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে।
রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য 'হরতাল' নামক এই কর্মকাণ্ডের সূতিকাগার এই উপমহাদেশ। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে এর সূচনা। বিশেষ কোনো এলাকায় কোনো বড় রকমের অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটলে ওই এলাকার মানুষ তাদের সব কাজকর্ম বন্ধ করে দিয়ে কর্তৃপক্ষের ঘুম ভাঙানোর জন্য এই অস্ত্র ব্যবহার করে এসেছে। আবার বড় কোনো রাজনৈতিক ইস্যুতে দেশজুড়ে সব কাজকর্ম বন্ধ রেখে সরকারকে বিব্রত ও ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য হরতাল হয়েছে। পরাধীন দেশে দখলদার সরকারকে অচল করে দেওয়ার এটাই ছিল মোক্ষম অস্ত্র। পাকিস্তান আমলের শেষ দিকে এ দেশেও সেই লক্ষ্যে হরতাল হয়েছে।
পৃথিবীর অন্য কোনো দেশের রাজনীতিতে এই হরতালের সংস্কৃতি দৃশ্যমান নয়। হরতালে ক্ষমতাসীন সরকার বিব্রত হয় বটে; কিন্তু ক্ষতি হয় জনগণের এবং গোটা দেশের। আমাদের দেশে এক সরকারের মেয়াদে ১৭৩ দিন হরতালের নজির রয়েছে। এখন দেশের রাজনীতির যে হালচাল, তাতে সামনের দিনগুলোয় আবার তেমন নজির সৃষ্টি হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
আমাদের দুই বড় রাজনৈতিক দলই সরকারে থাকার সময় হরতালের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। হরতালের কারণে জনগণের দুর্ভোগ নিয়ে হা-হুতাশ করে। জাতীয় অর্থনীতির ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ তুলে ধরে শ্ব্বেতপত্র প্রকাশ করে। পরে বিরোধী দলে গেলে তারা কখনোই হরতাল ডাকবে না- সে রকম প্রতিশ্রুতিও দিয়ে থাকে। গত দুই মেয়াদে দুই ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রীই জোর গলায় সে রকম প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু ক্ষমতা হাতছাড়া হওয়ার পর সেই প্রতিশ্রুতি হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। আগের মেয়াদে শেখ হাসিনা তেমনটি করেছেন। এখন বিএনপির সেই পর্ব চলছে। ক্ষমতায় থাকাকালে হরতাল হচ্ছে দেশদ্রোহিতা। ক্ষমতা চলে যাওয়ার পর সেটা 'সাংবিধানিক অধিকার'। জনগণের স্বার্থরক্ষার একমাত্র হাতিয়ার।
বর্তমান সরকারের নেতারা এখন হরতালের বিরুদ্ধে খৰহস্ত। নিশ্চিত করেই বলা যায় আগামীতে তাঁদের যদি আবার বিরোধী দলে যেতে হয় তাহলে তাঁরা আবারও হরতাল ডাকবেন। এখন তাঁরা হরতালের বিরুদ্ধে যা কিছু বলছেন তা বেমালুম ভুলে যাবেন।
দেখা যাচ্ছে দুই বড় দলের পাশাপাশি ছোট দলগুলোও এখন হরতাল ডাকছে। ইতিপূর্বে আমরা ইসলামী ঐক্যজোটের হরতাল দেখেছি। কয়েক দিন আগে জামায়াতের হরতাল দেখলাম। আবার সেই 'হরতালের প্রতিবাদে হরতাল' দেখলাম।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেছেন, জামায়াতের 'ডরতালে'র জবাবে তাঁরা 'জনগণের হরতাল' ডেকেছেন। তাঁর মতে, ওরা ডর দেখিয়ে মানুষকে হরতালে বাধ্য করে। কিন্তু তাঁদের হরতাল হবে শান্তিপূর্ণ। একেবারেই ঢোঁড়া সাপের মতো। যে সাপের বিষ নেই, করে না-কো ফোঁস্-ফাঁস, মারে না-কো ঢুস্-ঢাস্! একেবারেই 'সুশীল'।
১৮ ডিসেম্বরের হরতাল অবশ্য সে রকম সুশীল হরতালই হয়েছে। 'সুশীতল'ও বলা যায়। এতই সুশীতল যে খোদ আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এই দৃষ্টান্ত অনুসরণ করতে অন্যদের আহ্বান জানিয়েছেন। পিকেটিং নেই, গাড়ি ভাঙচুর নেই, ঢিল ছোড়াছুড়ি নেই। পুলিশ এবং হরতালকারীতে গলাগলি ভাব। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। এমন হরতাল এ দেশে আর কখনো হতে দেখা যায়নি। আহা, সর্বদাই যদি এমন হতো!
কিন্তু দুই দিন পরই আবার সেই পুরনো চিত্র। ১৮ তারিখের বামপন্থী হরতালের বিরুদ্ধে ১২ ইসলামী দলের 'পাল্টা হরতাল' ২০ তারিখে। কিছুটা ঢিলে ঢালা হরতাল। কিন্তু পরিস্থিতি সুশীল বা সুশীতল থাকল না। ফিরে এসেছে হরতালের সেই চিরায়ত চিত্র। হরতালকারীরা যেখানে সুযোগ পেয়েছে মারমুখী হয়েছে। পাল্টা মারমুখী অবস্থানে পুলিশ-র্যাব। ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ। পুলিশের পিটুনি, গ্রেপ্তার। সবই তথৈবচ!
আসলে হরতাল ব্যাপারটাই যে সে রকম। 'সরকারি হরতাল' না হলে সব হরতালই এ রকম হতে বাধ্য। হরতাল শব্দটার সঙ্গেই মিশে আছে ভয় এবং আতঙ্ক। হরতাল কতটা ভয়ের ও কতটা আতঙ্কের হবে, সেটা নির্ভর করে হরতাল আহ্বানকারীদের বাহুবলের ওপর। যার যত বাহুবল, তার তত ফোঁস্-ফাঁস, ঢুস্-ঢাস্। সেলিম সাহেবদের এখন বাহুবল কম। তাই এখন তাঁকে সুশীল হরতালের ঘোষণাই দিতে হবে। তাঁর দলের বাহুবল যদি বাড়ে তখন তো তাঁকে সর্বহারা একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার মহতী লড়াই শুরু করতে হবে। তখন যে তাঁর ঢোঁড়া সাপ রুদ্রমূর্তি ধারণ করবে না এবং সুশীল হরতাল 'ডরতালে' পরিণত হবে না, সে নিশ্চয়তা দিতে হলে কমিউনিস্ট বিপ্লবের তত্ত্ব নতুন করে লিখতে হবে। ফরহাদ মজহার এ নিয়ে অন্য এক কাগজে তাঁকে এক হাত নিয়েছেন।
ভয়টা সেখানেই। সে জন্যই হরতালকে সুশীল চেহারা দেওয়ার চেষ্টা অর্থহীন। হরতাল কখনোই সুশীল হতে পারে না।
একটি কাগজে প্রীতিভাজন নূরে আলম সিদ্দিকী হরতালকে 'সাংবিধানিক অধিকার' বলে উল্লেখ করেছেন। ষাটের দশকে আমরা হরতাল ডেকেছিলাম শেখ মুজিবের ৬ দফা দাবির সমর্থনে। শেখ সাহেব লাহোরে আইয়ুব খানের ডাকা সর্বদলীয় বৈঠকে সেদিনের পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবির একটা সুনির্দিষ্ট রূপরেখা তুলে ধরেছিলেন ওই ৬ দফা দাবিনামায়। এ নিয়ে তোলপাড় লেগে যায় পাকিস্তানজুড়ে। এর মধ্যে পাকিস্তানের তৎকালীন শাসকশ্রেণী গভীর অশনিসংকেত দেখতে পেল। আইয়ুব খান রেগে আগুন। তিনি এর বিরুদ্ধে 'অস্ত্রের ভাষা' প্রয়োগ করার ঘোষণা দিলেন। শেখ মুজিব গ্রেপ্তার হয়ে গেলেন। আওয়ামী লীগের নেতারা তখনো দ্বিধান্বিত। অন্যান্য বিরোধী দল নিশ্চুপ। অনেকেই একে বাড়াবাড়ি মনে করছেন। এমনই অবস্থায় ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে আমরা ৬ দফার প্রতি দ্ব্যর্থহীন সমর্থন ঘোষণা করি। ৬ দফার সমর্থনে হরতাল ডাকলাম '৬৬ সালের ৭ জুন। এই হরতাল ছিল একান্তভাবেই ছাত্রলীগের হরতাল। হরতাল সফল করার জন্য আমরা নিজেদের মধ্যে দায়িত্ব ভাগ করে বিভিন্ন পয়েন্টে পিকেটিং করেছি। তেজগাঁও স্টেশনে ট্রেন থামাতে গেলে পুলিশের গুলিতে নিহত হন মনু মিয়া ও আরেকজন শ্রমিক। নূরে আলম সিদ্দিকী সেখান থেকে মিছিল করে মনু মিয়ার রক্তাক্ত লাশ কার্জন হল প্রাঙ্গণে আমাদের বিক্ষুব্ধ সমাবেশে নিয়ে আসেন। এই হরতালের মধ্য দিয়ে ৬ দফা দাবি বাংলাদেশের গণমানুষের দাবিতে পরিণত হয়। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এটি এক ক্রান্তিকালের স্বাক্ষর।
সেদিনের পাকিস্তানি সরকার ছিল আমাদের দৃষ্টিতে 'দখলদার' সরকার। আমরা সেই সরকার এবং সেই রাষ্ট্রযন্ত্রকে ধ্বংস করতেই রাস্তায় নেমেছিলাম। ওই কাজটি সাংবিধানিক, নাকি অসাংবিধানিক সে বিচারে যাইনি। যাওয়ার প্রয়োজনও ছিল না।
আজকের বাংলাদেশে হরতাল ডাকার বিষয়টিকে সেভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। একটি স্বাধীন দেশে হরতাল কিভাবে 'সাংবিধানিক অধিকার' বিবেচিত হতে পারে, তা আমার বোধগম্য নয়।
এই তথ্যপ্রযুক্তির যুগে জনগণের কাছে কোনো বক্তব্য প্রচার করার জন্য বিশাল বিশাল জনসমাবেশ কিংবা হরতালের মতো ভীতিকর কর্মসূচি একেবারেই নিষ্প্রয়োজন। এ দেশে ৩০০ থেকে ৪০০ সংবাদপত্র এখন ভোর না হতেই গ্রাম-গ্রামান্তরে পৌঁছে যায়। ১৫-২০টি টিভি চ্যানেল ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকছে। ইন্টারনেটের বদৌলতে অসংখ্য 'অনলাইন' পত্রিকা এবং নানা কিসিমের ওয়েবসাইটে নানাবিধ সংবাদ, সংবাদ পর্যালোচনা, মতামত ও লেখালেখির অবারিত সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। সর্বোপরি রয়েছে মোবাইল ফোন, প্রতি ঘরে নয়, হাতে হাতে। মোবাইল ব্যবহার করে ঢাকায় বসে জনসভায় বক্তৃতাও করা যায় যখন যেখানে খুশি। ব্যানার-ফেস্টুন কষ্ট করে হাতে লিখতে হয় না, ঝটপট তৈরি হয়ে যায় ডিজিটাল মেশিনে। ডিজিটাল প্রিন্টিংয়ের সুবাদে প্রচারপত্র, পুস্তকাদি তৈরি হয়ে যায় চোখের নিমেষে। এত সব সুবিধা কাজে লাগিয়ে জনসংযোগ না করে ঢাকঢোল পিটিয়ে টাকা খরচ করে মানুষ জড়ো করার কিংবা বলপ্রয়োগে হরতাল পালনের প্রয়োজন হচ্ছে কেন?
সংবিধানে রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তোলার অধিকার স্বীকৃত আছে বটে, কিন্তু তার কোথায়ও অন্যের নাগরিক অধিকারে হস্তক্ষেপ করার সুযোগ দেওয়া আছে বলে আমার জানা নেই। একদল মানুষ তাদের রাজনৈতিক বক্তব্য প্রচার বা রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য অন্য কোনো নাগরিকের স্বাভাবিক ব্যবসা-বাণিজ্য, চলাচল বা জীবনযাত্রায় বাধা সৃষ্টি করতে পারে না। করলে তা অবশ্যই দণ্ডনীয় অপরাধ।
নগরীর রাজপথ বন্ধ করে সভা করার অধিকার সংবিধানের কোনো পাতায় লেখা আছে? জনচলাচলের পরিবহন নির্বিচারে ভাঙচুর করা বা তাতে অগ্নিসংযোগ করার উন্মত্ততা গণতান্ত্রিক অধিকার হতে পারে না। হরতাল বা বিক্ষোভে সাধারণ মানুষের গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করার অধিকার কি সংবিধানে লিপিবদ্ধ আছে? কেউ একজন জরুরি কাজে রাস্তায় বের হয়েছেন গাড়ি নিয়ে। তিনি হয়তো কিছুই জানেন না- কারা, কেন হরতাল ডেকেছে। হঠাৎ একদল মানুষ তাঁর গাড়ি থামিয়ে এলোপাতাড়ি হামলা শুরু করল। তাঁর সর্বস্ব দিয়ে কেনা অতি প্রয়োজনীয় গাড়িটি আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হলো। এই নারকীয় বর্বরতা কেন ক্যাপিটাল পানিশ্মেন্টের আওতায় আসবে না?
সিদ্দিকী ঠিক বলেননি। হরতাল কোনোভাবেই 'সাংবিধানিক অধিকার' নয়। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে এই হরতালের কর্মসূচি একেবারেই ছেঁটে ফেলা দরকার।
লেখক : রাজনীতিক, ভূ-রাজনীতি ও উন্নয়ন গবেষক।
২৬ ডিসেম্বর, ২০১২
হরতালের ব্যাপারে আমরা আরো উদার। যে কেউ হরতাল ডাকতে পারে। এখানে ট্রেড ইউনিয়নের নিয়ম-রীতির প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই। যে কারণে বা দাবিতে হরতাল ডাকা হচ্ছে তার প্রতি সাধারণ মানুষের সমর্থন আছে কি নেই সেটা যাচাই করার প্রয়োজন হয় না। ইসলামী দল 'ইসলাম বিপন্ন' হওয়ার স্লোগান দিয়ে হরতাল ডাকে, বামপন্থীরা 'জনগণে'র নামে হরতাল ডাকে। একদল ইসলামের সোল এজেন্ট, আরেক দল জনগণের। অন্যরা হরতাল ডাকে স্রেফ ক্ষমতার পালাবদল ত্বরান্বিত করার উদ্দেশ্যে। কারো গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে, কারো দুর্নীতির মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে।
রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য 'হরতাল' নামক এই কর্মকাণ্ডের সূতিকাগার এই উপমহাদেশ। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে এর সূচনা। বিশেষ কোনো এলাকায় কোনো বড় রকমের অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটলে ওই এলাকার মানুষ তাদের সব কাজকর্ম বন্ধ করে দিয়ে কর্তৃপক্ষের ঘুম ভাঙানোর জন্য এই অস্ত্র ব্যবহার করে এসেছে। আবার বড় কোনো রাজনৈতিক ইস্যুতে দেশজুড়ে সব কাজকর্ম বন্ধ রেখে সরকারকে বিব্রত ও ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য হরতাল হয়েছে। পরাধীন দেশে দখলদার সরকারকে অচল করে দেওয়ার এটাই ছিল মোক্ষম অস্ত্র। পাকিস্তান আমলের শেষ দিকে এ দেশেও সেই লক্ষ্যে হরতাল হয়েছে।
পৃথিবীর অন্য কোনো দেশের রাজনীতিতে এই হরতালের সংস্কৃতি দৃশ্যমান নয়। হরতালে ক্ষমতাসীন সরকার বিব্রত হয় বটে; কিন্তু ক্ষতি হয় জনগণের এবং গোটা দেশের। আমাদের দেশে এক সরকারের মেয়াদে ১৭৩ দিন হরতালের নজির রয়েছে। এখন দেশের রাজনীতির যে হালচাল, তাতে সামনের দিনগুলোয় আবার তেমন নজির সৃষ্টি হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
আমাদের দুই বড় রাজনৈতিক দলই সরকারে থাকার সময় হরতালের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। হরতালের কারণে জনগণের দুর্ভোগ নিয়ে হা-হুতাশ করে। জাতীয় অর্থনীতির ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ তুলে ধরে শ্ব্বেতপত্র প্রকাশ করে। পরে বিরোধী দলে গেলে তারা কখনোই হরতাল ডাকবে না- সে রকম প্রতিশ্রুতিও দিয়ে থাকে। গত দুই মেয়াদে দুই ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রীই জোর গলায় সে রকম প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু ক্ষমতা হাতছাড়া হওয়ার পর সেই প্রতিশ্রুতি হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। আগের মেয়াদে শেখ হাসিনা তেমনটি করেছেন। এখন বিএনপির সেই পর্ব চলছে। ক্ষমতায় থাকাকালে হরতাল হচ্ছে দেশদ্রোহিতা। ক্ষমতা চলে যাওয়ার পর সেটা 'সাংবিধানিক অধিকার'। জনগণের স্বার্থরক্ষার একমাত্র হাতিয়ার।
বর্তমান সরকারের নেতারা এখন হরতালের বিরুদ্ধে খৰহস্ত। নিশ্চিত করেই বলা যায় আগামীতে তাঁদের যদি আবার বিরোধী দলে যেতে হয় তাহলে তাঁরা আবারও হরতাল ডাকবেন। এখন তাঁরা হরতালের বিরুদ্ধে যা কিছু বলছেন তা বেমালুম ভুলে যাবেন।
দেখা যাচ্ছে দুই বড় দলের পাশাপাশি ছোট দলগুলোও এখন হরতাল ডাকছে। ইতিপূর্বে আমরা ইসলামী ঐক্যজোটের হরতাল দেখেছি। কয়েক দিন আগে জামায়াতের হরতাল দেখলাম। আবার সেই 'হরতালের প্রতিবাদে হরতাল' দেখলাম।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেছেন, জামায়াতের 'ডরতালে'র জবাবে তাঁরা 'জনগণের হরতাল' ডেকেছেন। তাঁর মতে, ওরা ডর দেখিয়ে মানুষকে হরতালে বাধ্য করে। কিন্তু তাঁদের হরতাল হবে শান্তিপূর্ণ। একেবারেই ঢোঁড়া সাপের মতো। যে সাপের বিষ নেই, করে না-কো ফোঁস্-ফাঁস, মারে না-কো ঢুস্-ঢাস্! একেবারেই 'সুশীল'।
১৮ ডিসেম্বরের হরতাল অবশ্য সে রকম সুশীল হরতালই হয়েছে। 'সুশীতল'ও বলা যায়। এতই সুশীতল যে খোদ আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এই দৃষ্টান্ত অনুসরণ করতে অন্যদের আহ্বান জানিয়েছেন। পিকেটিং নেই, গাড়ি ভাঙচুর নেই, ঢিল ছোড়াছুড়ি নেই। পুলিশ এবং হরতালকারীতে গলাগলি ভাব। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। এমন হরতাল এ দেশে আর কখনো হতে দেখা যায়নি। আহা, সর্বদাই যদি এমন হতো!
কিন্তু দুই দিন পরই আবার সেই পুরনো চিত্র। ১৮ তারিখের বামপন্থী হরতালের বিরুদ্ধে ১২ ইসলামী দলের 'পাল্টা হরতাল' ২০ তারিখে। কিছুটা ঢিলে ঢালা হরতাল। কিন্তু পরিস্থিতি সুশীল বা সুশীতল থাকল না। ফিরে এসেছে হরতালের সেই চিরায়ত চিত্র। হরতালকারীরা যেখানে সুযোগ পেয়েছে মারমুখী হয়েছে। পাল্টা মারমুখী অবস্থানে পুলিশ-র্যাব। ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ। পুলিশের পিটুনি, গ্রেপ্তার। সবই তথৈবচ!
আসলে হরতাল ব্যাপারটাই যে সে রকম। 'সরকারি হরতাল' না হলে সব হরতালই এ রকম হতে বাধ্য। হরতাল শব্দটার সঙ্গেই মিশে আছে ভয় এবং আতঙ্ক। হরতাল কতটা ভয়ের ও কতটা আতঙ্কের হবে, সেটা নির্ভর করে হরতাল আহ্বানকারীদের বাহুবলের ওপর। যার যত বাহুবল, তার তত ফোঁস্-ফাঁস, ঢুস্-ঢাস্। সেলিম সাহেবদের এখন বাহুবল কম। তাই এখন তাঁকে সুশীল হরতালের ঘোষণাই দিতে হবে। তাঁর দলের বাহুবল যদি বাড়ে তখন তো তাঁকে সর্বহারা একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার মহতী লড়াই শুরু করতে হবে। তখন যে তাঁর ঢোঁড়া সাপ রুদ্রমূর্তি ধারণ করবে না এবং সুশীল হরতাল 'ডরতালে' পরিণত হবে না, সে নিশ্চয়তা দিতে হলে কমিউনিস্ট বিপ্লবের তত্ত্ব নতুন করে লিখতে হবে। ফরহাদ মজহার এ নিয়ে অন্য এক কাগজে তাঁকে এক হাত নিয়েছেন।
ভয়টা সেখানেই। সে জন্যই হরতালকে সুশীল চেহারা দেওয়ার চেষ্টা অর্থহীন। হরতাল কখনোই সুশীল হতে পারে না।
একটি কাগজে প্রীতিভাজন নূরে আলম সিদ্দিকী হরতালকে 'সাংবিধানিক অধিকার' বলে উল্লেখ করেছেন। ষাটের দশকে আমরা হরতাল ডেকেছিলাম শেখ মুজিবের ৬ দফা দাবির সমর্থনে। শেখ সাহেব লাহোরে আইয়ুব খানের ডাকা সর্বদলীয় বৈঠকে সেদিনের পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবির একটা সুনির্দিষ্ট রূপরেখা তুলে ধরেছিলেন ওই ৬ দফা দাবিনামায়। এ নিয়ে তোলপাড় লেগে যায় পাকিস্তানজুড়ে। এর মধ্যে পাকিস্তানের তৎকালীন শাসকশ্রেণী গভীর অশনিসংকেত দেখতে পেল। আইয়ুব খান রেগে আগুন। তিনি এর বিরুদ্ধে 'অস্ত্রের ভাষা' প্রয়োগ করার ঘোষণা দিলেন। শেখ মুজিব গ্রেপ্তার হয়ে গেলেন। আওয়ামী লীগের নেতারা তখনো দ্বিধান্বিত। অন্যান্য বিরোধী দল নিশ্চুপ। অনেকেই একে বাড়াবাড়ি মনে করছেন। এমনই অবস্থায় ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে আমরা ৬ দফার প্রতি দ্ব্যর্থহীন সমর্থন ঘোষণা করি। ৬ দফার সমর্থনে হরতাল ডাকলাম '৬৬ সালের ৭ জুন। এই হরতাল ছিল একান্তভাবেই ছাত্রলীগের হরতাল। হরতাল সফল করার জন্য আমরা নিজেদের মধ্যে দায়িত্ব ভাগ করে বিভিন্ন পয়েন্টে পিকেটিং করেছি। তেজগাঁও স্টেশনে ট্রেন থামাতে গেলে পুলিশের গুলিতে নিহত হন মনু মিয়া ও আরেকজন শ্রমিক। নূরে আলম সিদ্দিকী সেখান থেকে মিছিল করে মনু মিয়ার রক্তাক্ত লাশ কার্জন হল প্রাঙ্গণে আমাদের বিক্ষুব্ধ সমাবেশে নিয়ে আসেন। এই হরতালের মধ্য দিয়ে ৬ দফা দাবি বাংলাদেশের গণমানুষের দাবিতে পরিণত হয়। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এটি এক ক্রান্তিকালের স্বাক্ষর।
সেদিনের পাকিস্তানি সরকার ছিল আমাদের দৃষ্টিতে 'দখলদার' সরকার। আমরা সেই সরকার এবং সেই রাষ্ট্রযন্ত্রকে ধ্বংস করতেই রাস্তায় নেমেছিলাম। ওই কাজটি সাংবিধানিক, নাকি অসাংবিধানিক সে বিচারে যাইনি। যাওয়ার প্রয়োজনও ছিল না।
আজকের বাংলাদেশে হরতাল ডাকার বিষয়টিকে সেভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। একটি স্বাধীন দেশে হরতাল কিভাবে 'সাংবিধানিক অধিকার' বিবেচিত হতে পারে, তা আমার বোধগম্য নয়।
এই তথ্যপ্রযুক্তির যুগে জনগণের কাছে কোনো বক্তব্য প্রচার করার জন্য বিশাল বিশাল জনসমাবেশ কিংবা হরতালের মতো ভীতিকর কর্মসূচি একেবারেই নিষ্প্রয়োজন। এ দেশে ৩০০ থেকে ৪০০ সংবাদপত্র এখন ভোর না হতেই গ্রাম-গ্রামান্তরে পৌঁছে যায়। ১৫-২০টি টিভি চ্যানেল ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকছে। ইন্টারনেটের বদৌলতে অসংখ্য 'অনলাইন' পত্রিকা এবং নানা কিসিমের ওয়েবসাইটে নানাবিধ সংবাদ, সংবাদ পর্যালোচনা, মতামত ও লেখালেখির অবারিত সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। সর্বোপরি রয়েছে মোবাইল ফোন, প্রতি ঘরে নয়, হাতে হাতে। মোবাইল ব্যবহার করে ঢাকায় বসে জনসভায় বক্তৃতাও করা যায় যখন যেখানে খুশি। ব্যানার-ফেস্টুন কষ্ট করে হাতে লিখতে হয় না, ঝটপট তৈরি হয়ে যায় ডিজিটাল মেশিনে। ডিজিটাল প্রিন্টিংয়ের সুবাদে প্রচারপত্র, পুস্তকাদি তৈরি হয়ে যায় চোখের নিমেষে। এত সব সুবিধা কাজে লাগিয়ে জনসংযোগ না করে ঢাকঢোল পিটিয়ে টাকা খরচ করে মানুষ জড়ো করার কিংবা বলপ্রয়োগে হরতাল পালনের প্রয়োজন হচ্ছে কেন?
সংবিধানে রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তোলার অধিকার স্বীকৃত আছে বটে, কিন্তু তার কোথায়ও অন্যের নাগরিক অধিকারে হস্তক্ষেপ করার সুযোগ দেওয়া আছে বলে আমার জানা নেই। একদল মানুষ তাদের রাজনৈতিক বক্তব্য প্রচার বা রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য অন্য কোনো নাগরিকের স্বাভাবিক ব্যবসা-বাণিজ্য, চলাচল বা জীবনযাত্রায় বাধা সৃষ্টি করতে পারে না। করলে তা অবশ্যই দণ্ডনীয় অপরাধ।
নগরীর রাজপথ বন্ধ করে সভা করার অধিকার সংবিধানের কোনো পাতায় লেখা আছে? জনচলাচলের পরিবহন নির্বিচারে ভাঙচুর করা বা তাতে অগ্নিসংযোগ করার উন্মত্ততা গণতান্ত্রিক অধিকার হতে পারে না। হরতাল বা বিক্ষোভে সাধারণ মানুষের গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করার অধিকার কি সংবিধানে লিপিবদ্ধ আছে? কেউ একজন জরুরি কাজে রাস্তায় বের হয়েছেন গাড়ি নিয়ে। তিনি হয়তো কিছুই জানেন না- কারা, কেন হরতাল ডেকেছে। হঠাৎ একদল মানুষ তাঁর গাড়ি থামিয়ে এলোপাতাড়ি হামলা শুরু করল। তাঁর সর্বস্ব দিয়ে কেনা অতি প্রয়োজনীয় গাড়িটি আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হলো। এই নারকীয় বর্বরতা কেন ক্যাপিটাল পানিশ্মেন্টের আওতায় আসবে না?
সিদ্দিকী ঠিক বলেননি। হরতাল কোনোভাবেই 'সাংবিধানিক অধিকার' নয়। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে এই হরতালের কর্মসূচি একেবারেই ছেঁটে ফেলা দরকার।
লেখক : রাজনীতিক, ভূ-রাজনীতি ও উন্নয়ন গবেষক।
২৬ ডিসেম্বর, ২০১২
No comments