শেষ প্রহরের গান by জালাল আহমেদ চৌধুরী

আজ সন্ধ্যায় শেষ আসর। গায়ক-যন্ত্রীদের অর্ধেককে জানি, বাকি অর্ধেক সম্পর্কে ধারণা করতে পারি কিন্তু নিশ্চিত নই। অবশ্য আপনি এ লেখা পড়ার সময় পুরো ছবিটাই নিশ্চিত দেখতে পারছেন, আমি প্রথম সেমিফাইনালটা দেখা শেষ করে লিখতে বসে বলতে পারছি না, স্বাগতিক শ্রীলঙ্কা আজ চূড়ান্ত খেলায় অস্ট্রেলিয়া না ওয়েস্ট ইন্ডিজ কাকে প্রতিপক্ষ হিসেবে পাচ্ছে।


প্রতিপক্ষভেদে মাহেলার দলের ওপর চাপের মাত্রার রকমফের হবে। এ মুহূর্তে এসব অবান্তর, যুক্তিহীন কথা বলে সময় নষ্ট করার মানে হয় না। আসুন কাজের কথায় ফেরা যাক। ধারণার যান্ত্রিক হিসাব-নিকাশে অস্ট্রেলিয়াই মনে হয় খেলছে। আর আমরা যদি আজ ওয়াটসন-হাসিদের মিস করি তবে সেটা হবে গৌরবময় অনিশ্চয়তার আরেক সোনালি ফসল। সেই ফসলের হাসি যদি আমরা দেখি তাহলে এতদিন এই আসরে যে প্রত্যাশিত ক্রিস গেইলকে দেখতে পাইনি, সেই গেইলকে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে অবশ্যই দেখতে পেয়েছেন আপনারা। বাস্তবতা যাই হোক, চতুর্থ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের শেষ খেলার উত্তেজনা বা রোমাঞ্চ সঞ্চারে কোনো হেরফের হবে না। উৎসবের চূড়ান্ত আবেশে ভাসছে শ্রীলঙ্কা। ঘরের ছেলেরা ঘরের মাঠে বিশ্বকাপে চুমো খাচ্ছে, কল্পনা করতে করতে খেলা দেখবে শ্রীলঙ্কাবাসী। প্রেমাদাসার সেই আনন্দ আবহে আমরাও ভাসব। আর তো মাত্র কয়েক ঘণ্টা। মাহেলা জয়াবর্ধনের দলের প্রতি কিঞ্চিৎ পক্ষপাত নিয়ে অপেক্ষায় আছি। ওরা বিশ্বকাপটা জিতলে সে জয়ের বাতাস আমাদেরও অনেকটা তাতিয়ে তুলবে। প্রতিবেশী বলে কথা। ওদের মেধা আছে, ওরা পরিশ্রমী; আত্মপ্রয়োগ আছে, আছে বিজয়াভিসারী একাগ্রতা। আর আছে পরিবেশগত আনুকূল্য। শ্রীলঙ্কা জিতলে ভালোই লাগবে। তবে চূড়ান্ত খেলাটির সঙ্গে সঙ্গে তিন সপ্তাহের উপভোগ্য ক্রিকেট সময়টা শেষ হয়ে যাওয়ার হালকা বেদনাও আমাদের ছুঁয়ে থাকবে বেশ খানিকটা সময়। বেশ তো কাটল ক্রিকেটময় একটা সময়। হাট ভেঙে গেলে দর্শকের মনের কোণে জমে থাকবে তৃপ্তি-অতৃপ্তির খণ্ড খণ্ড অংশ। স্মৃতির জাবর কাটার জন্য রয়ে যাবে অনেক বর্ণিল, অনেক মলিন উপকরণ। ক্রিকেটের প্রতিটি আসরই তো এ রকম কিছু রেশ রেখে যায়।
তরতাজা স্মৃতি হয়ে ভাসছে শ্রীলঙ্কা-পাকিস্তান সেমিফাইনালের স্নায়ুক্ষয়ী প্রহর। শেষ দুই ওভারের আগের পুরোটা সময় ওভারে ওভারে ভাবনাকে দুলিয়ে চলেছে। ব্যাটিং গোঁয়ার্তুমির খেসারত দিয়েছে পাকিস্তান। অন্যদিকে চিন্তাশীল ঠান্ডা মাথায় বন্দরে তরী ভিড়িয়েছে শ্রীলঙ্কা। ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে খেলতে গেলে ব্যাটে-বলে সংযোগ নিশ্চিত করতে হয়। পাকিস্তানিরা সেটা মানেনি। প্রেমাদাসার আগলা মাটির উইকেট কিছু নির্দেশ দিচ্ছিল, শ্রীলঙ্কানরা সেসব নির্দেশের গুরুত্ব দিয়েছে। টি-টোয়েন্টি বলেই উড়িয়ে মারতে যায়নি। ফাঁকা জায়গা খুঁজেছে, নিশ্চিত হয়ে হাত খুলেছে। তাদের লড়াই করার চাপ বিমুক্ত থাকার একাগ্রতা আমাদের মুগ্ধ করেছে। শ্রীলঙ্কার নব আবিষ্কৃত কিশোর স্পিনার আকালি ধনঞ্জয়ের সেদিন ছিল জন্মদিন। তাঁকে জন্মদিনে বিশ্রাম দিয়ে রঙ্গনা হেরাথকে খেলিয়ে বিচক্ষণতার প্রমাণ দিল শ্রীলঙ্কান থিং ট্যাংক। জন্মদিনের উপহার পেয়ে উল্লসিত ধনঞ্জয়ের সঙ্গে সারা শ্রীলঙ্কা। বিশ্ব ক্রিকেটের স্পিন অধ্যায়ে এবারের আসরের উপহার ওই ধনঞ্জয়, পাকিস্তানের বাঁহাতি সদ্য যুবক রাজা হাসান। অস্ট্রেলিয়ার ডোহার্টিও ভালোই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। শ্রীলঙ্কার অজন্তা মেন্ডিস, পাকিস্তানের সাঈদ আজমলদের নিয়ে তো নতুন করে বলার কিছু নেই। দ্রুত বোলারদের চমক লাগানোর স্পেল আমরা কম দেখিনি এবার। টিম সাউদির রাউন্ড দ্য উইকেট আক্রমণ একটি নতুন ভাবনা। ইংল্যান্ডের স্টিভেন ফিনও ভালোই আনন্দ দিয়েছেন। ভারতের কাছে দক্ষিণ আফ্রিকা হারলেও স্টেইন ও মরনে মরকেলের নতুন বলে গম্ভীর ও শেবাগের পলায়নপর ভঙ্গি দ্রুততার ভয়ংকর সুন্দর রূপ তুলে ধরেছিল। শ্রীলঙ্কার শ্লথ উইকেটে ব্যাটসম্যানরা টি-টোয়েন্টির প্রত্যাশিত মাত্রায় আবির্ভূত হতে পারেননি। তবুও ওয়াটসন, ম্যাককালাম, রাইট, কোহলি, নাসির জামশেদ, মাহেলা, সাঙ্গাকারা, দিলশানরা ধারাবাহিকতায় উজ্জ্বল ছিলেন। আমাদের স্মৃতিতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সাকিব আল হাসানের অনন্যসাধারণ ৮৪ আসরের অন্যতম সেরা ইনিংস হয়ে থাকবে। আম্পায়ারিংয়ের তারকা চিহ্নিত ভুলগুলোও এবারের আসরকে মনে করাবে। এ আসর বুঝিয়ে দিয়ে গেল শুধু চরম ব্যাটিংবান্ধব উইকেটে খেলা হবে না। অন্য রকম উইকেটেও টি-টোয়েন্টি খেলতে হবে। খেলার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। শেষ করার আগে একটি ভারতীয় বিজ্ঞাপনের কথা বলতে ইচ্ছে করছে। বলা হচ্ছে, টি-টোয়েন্টি এমন খেলা যা না তমিজের সঙ্গে খেলা যায়, না তমিজের সঙ্গে দেখা যায়। আমি আরেকটা যোগ করে বলতে চাই যে, ‘...না ভব্যতার সঙ্গে দেখানো যায়।’ আমাদের বিটিভির অগোছালো বিশ্বকাপ সম্প্রচারটা মনে করে কথাটা বলা।

No comments

Powered by Blogger.