একাত্তরের বন্ধু by আসিফ আহমেদ

কুমিল্লার সন্তান দিলীপ সেনগুপ্ত সম্পর্কে একজন একবার স্মৃতিচারণ করছিলেন এভাবে_ শিক্ষকতা জীবনে একটি ছেলের কথা কিছুতেই ভুলতে পারি না। হাতের লেখা সুন্দর, ম্যাগাজিন সম্পাদনা করত। সুন্দর ব্যবহার। ভালো বক্তৃতা দিত। ক্রিকেট প্রতিযোগিতায় সেরা খেলোয়াড়ের ক্যাপ জয় করল।


এক সময়ে দিলীপ সেনগুপ্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি নিয়ে এমএ পড়ার জন্য ভর্তি হন। খেলাধুলায় ছিলেন চ্যাম্পিয়ন। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তার জীবনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করে দেয়। ১৯৪৩ সালে অল ইন্ডিয়া রেডিওর প্রোগ্রাম এসিস্ট্যান্ট হিসেবে চাকরিতে নিযুক্ত হন। কাজ করেন ঢাকা কেন্দ্রে।
একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় এই দিলীপ সেনগুপ্ত ছিলেন আকাশবাণী কলিকাতা কেন্দ্রের স্টেশন ডিরেক্টর। এ কেন্দ্রের কর্ণধার হিসেবে তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গড়ে তোলায় রাখেন অনন্য অবদান। ইন্দিরা গান্ধী প্রধানমন্ত্রী পদে নিযুক্ত হওয়ার আগে লালবাহাদুর শাস্ত্রীর মন্ত্রিসভায় ছিলেন তথ্য ও সম্প্রচার দফতরের দায়িত্বে। একবার আকাশবাণী স্টেশন ডিরেক্টরদের সভায় কোনো কোনো অফিসার মন্ত্রীর কাছে কিছু বিষয়ের সমাধান চাইলে তিনি বলেন, 'সেভাবে কাজ করুন, যেমনটি করছেন দিলীপ সেনগুপ্ত।' এই দিলীপ সেনগুপ্ত একাত্তরে আকাশবাণী কলিকাতা কেন্দ্রের শীর্ষ পদে থাকায় স্বভাবতই ইন্দিরা গান্ধী অনেকটা নির্ভার ছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রণবেশ সেন, দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় ও উপেন তরফদার হানাদার অধ্যুষিত এলাকায় ঘরে ঘরে উচ্চারিত নাম হয়ে উঠেছিলেন। তারা এ বেতার কেন্দ্রে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে নানা ধরনের আকর্ষণীয় অনুষ্ঠান করতেন। বিবিসি ও আকাশবাণীতে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন পঙ্কজ সাহা। দিলীপ সেনগুপ্তকে নিয়ে প্রকাশিত 'আমাদের বাবার কথা' বইয়ে তিনি লিখেছেন, আকাশবাণী সে সময় অসাধারণ কাজ করেছিল, যা আজ ইতিহাসের পাতায়। এর পেছনে দিলীপ সেনগুপ্তের অভিভাবকত্ব ও নেতৃত্বের কথা আমাদের মনে রাখতে হবে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার কাজেও তিনি নানাভাবে সহায়তা প্রদান করেছেন। বাংলাদেশের যেসব শিল্পী ও কলাকুশলী সেই ভয়ঙ্কর সময়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে কলিকাতায় পেঁৗছেছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে কাজ করার জন্য, তারা দিলীপ সেনগুপ্তের কর্মদক্ষতায় মুগ্ধ হয়েছেন। সে সময়ে আকাশবাণীর হেড অব নিউজ অপারেশন দ্বীপেশ চন্দ্র ভৌমিক লিখেছেন, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার খবর জানার পরপরই দিলীপ সেনগুপ্তকে দিলি্ল ডেকে পাঠানো হয়। সেখানে গিয়ে দেখতে পান, তথ্য মন্ত্রণালয় ছাড়াও পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা উপস্থিত রয়েছেন বৈঠকে। তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়, এমনভাবে খবর ও অন্যান্য অনুষ্ঠান প্রচার করতে হবে, যাতে বাংলাদেশের জনগণের চাহিদা পূরণ হয়। রাতে দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠে প্রচারিত সংবাদ পরিক্রমায় বাংলাদেশ প্রসঙ্গ বিশেষভাবে স্থান পেতে থাকা ছিল এরই ফল। রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের কাছেও এসব অনুষ্ঠান ছিল আকর্ষণীয়।
তার পুত্র বিবেক সেনগুপ্ত এখন খ্যাতিমান সাংবাদিক। দিলি্লতে কর্মরত। কন্যা সোমা দাশগুপ্ত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তার স্ত্রী সবিতা সেনগুপ্ত বরিশালের গৈলার মেয়ে এবং অনেক বছর কলিকাতার বিখ্যাত সাউথ পয়েন্ট স্কুলে শিক্ষকতা করেন। পুত্রবধূ শোভা সেনগুপ্ত পাঞ্জাবের মেয়ে। বিয়ের পর বাড়ির পুরনো কাগজপত্র রাখা একটি ট্রাঙ্ক ঘাঁটতে গিয়ে তিনি দেখতে পান_ দিলীপ সেনগুপ্তকে একাত্তরে আকাশবাণী কেন্দ্রে সাফল্যের সঙ্গে দায়িত্ব পালনের জন্য পদ্মশ্রী পদকে সম্মানিত করা হয়েছে। কিন্তু এ নিয়ে প্রচারে তার কোনো আগ্রহ ছিল না। পুত্রবধূ এ সম্মাননাপত্র বাঁধিয়ে তাকে উপহার দিয়েছিলেন। ১৯৭৬ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। এ সময়ে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাকে অনুরোধ করেছিলেন চাকরিতে এক্সটেনশনের জন্য আবেদন করতে। কিন্তু কোনো দিন নিজের জন্য বিশেষ সুবিধা গ্রহণে অনাগ্রহী দিলীপ সেনগুপ্ত প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে সাড়া দেননি। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ সফরে এসে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে একাত্তরে যুদ্ধের সময় আকাশবাণীর বিভিন্ন অনুষ্ঠানের রেকর্ডকৃত অনুষ্ঠানগুলোর টেপ উপহার দিয়েছিলেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অবদান রাখার জন্য সরকার নানা দেশের বিশিষ্টজনদের সম্মানিত করছে। ওই সময়ে আকাশবাণী কেন্দ্রের কর্ণধার দিলীপ সেনগুপ্তকে (১৯৯১ সালে প্রয়াত) মরণোত্তর সম্মান প্রদর্শনের বিষয়টি সরকার বিবেচনা করতে পারে।
 

No comments

Powered by Blogger.