সুরঞ্জিতের ছেলের ব্যবসা রেলের দুর্নীতির টাকায়-আরটিভিকে আজম খান

বিতর্কিত সাবেক রেলমন্ত্রী (বর্তমানে দপ্তরবিহীন) সুরঞ্জিত সেনগুপ্তর এপিএস ওমর ফারুক তালুকদারের গাড়িচালক মো. আজম খান বলেছেন, সুরঞ্জিত বাবু শুধু মন্ত্রী হওয়ার পরই ঘুষের টাকা নেননি, একটি সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি থাকাকালেও নিয়োগ ও বদলিসংক্রান্ত দুর্নীতি তিনি করেছেন।


আজম খান বলেন, সুরঞ্জিত সেনগুপ্তর ছেলে সৌমেন সেনগুপ্তর টেলিকম ব্যবসার টাকাও রেলের দুর্নীতি থেকে পাওয়া।
বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল আরটিভিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আজম খান এসব কথা বলেন। আত্মগোপনে থাকা আজম খানের সাক্ষাৎকারটি শুক্রবার থেকে সম্প্রচার শুরু হলে দেশজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়। গতকাল শনিবার প্রচারিত হয় সচিত্র সাক্ষাৎকারের দ্বিতীয় পর্ব। সেখানে আজম খান আরো বলেন, 'কিছুদিন আগের ঘটনা; একদিন ফারুক সাহেবকে সুরঞ্জিত বাবু জিজ্ঞাসা করতেছেন, এখানে (বস্তায়) কী রকম অ্যামাউন্ট আছে? ফারুক বললেন, পুরো দুই কোটি আছে। ওই টাকা আমি নিজের হাতে করে আবার সেন বাবুর বাসায় রুমের ভিতরে ঢুকাইয়া দিয়ে আসছি।'
সাক্ষাৎকারের একপর্যায়ে আজম খান বলেন, 'বাইরে বের হইলে খুন বা গুম হইতে পারি। প্রধানমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে জীবনের নিরাপত্তা চাই। আমার মেয়ে অনেক কান্নাকাটি করে। আমারও অনেক খারাপ লাগে, বাবা-মাকে দেখতে মন চায়।'
গাড়িচালক আজম বলেন, 'প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যদি আমাকে হেল্প করেন, নিরাপত্তা দেন, আমি যাব। আমার বাড়িতে তারা (এপিএস ফারুক ও অন্যরা) যোগাযোগ করেছে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য। আমার শ্বশুরের সঙ্গে, আমার বউয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। আমার বাড়ি থেকে আমাকে জানিয়েছে, তারা (এপিএস ফারুকরা) নাকি অনেক হুমকি দিতেছে। আমার নম্বর চাইতেছে। কোথায় আছি জানতে চাইতেছে। আমি ফারুক সাহেবের কাছে ফোন দিছি। ফারুক সাহেব বললেন, দেখো আজম, এখনো সময় আছে।'
আরটিভির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে আজম খান বলেন, 'এর আগে আমি আজম নিজে এর চেয়ে বড় অ্যামাউন্টের টাকা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তর বাসায় দিয়েছি।' তিনি বলেন, 'প্রথম চালান তো আসছে ইউসুফ আলীর (পূর্বাঞ্চলীয় রেলের বরখাস্ত হওয়া জিএম ইউসুফ আলী মৃধা) অফিসার্স কোয়ার্টার থেকে। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত শুধু মন্ত্রী হওয়ার পরই ঘুষের টাকা নেননি; এর আগে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি থাকাকালেও নিয়োগ এবং বদলিসংক্রান্ত দুর্নীতি করেছেন। আইজিআর, জেলা চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বদলি ও নিয়োগ দিয়ে দুর্নীতি করেছেন।'
আজম বলেন, 'সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলামকে ফোন করে বলতেন, আমার এপিএসকে পাঠালাম। এই কয়েকটা কোটা ছিল। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত পাঁচটা পাঠালে এপিএস (ফারুক হোসেন তালুকদার) আরো পাঁচটা দিয়ে দিতেন। সেখান থেকে ফারুক টাকা পেতেন। ওই টাকার ভাগ সুরঞ্জিতের কাছেও যেত।'
আজম বলেন, 'মেইন হচ্ছেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। তিনি প্রথমেই রেলে গিয়ে বলেছেন, রেলের কালো বিড়াল ধরা হবে। এখন দেখতেছি যে, তিনি নিজেই কালো বিড়াল হয়ে গেছেন। তিনি নিজেই বড় দুর্নীতিবাজ। সবচেয়ে বড় দুর্নীতিবাজ তো তিনিই। তিনি মন্ত্রী হয়ে একটি মন্ত্রণালয়ের প্রধান হিসেবে দুর্নীতি করলে দেশটা কিভাবে চলবে?'
গাড়িচালক আজম খান আরো বলেন, 'সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ছেলে সৌমেন সেনগুপ্তের টেলিকম ব্যবসার টাকাও রেলের দুর্নীতির।' সৌমেনের টেলিকম ব্যবসার আলাপ তাঁর (আজম খান) সামনে হয়েছে বলেও দাবি করেন আজম।
আজম বলেন, 'রেলের অর্থ কেলেঙ্কারির ঘটনার পর সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে রক্ষা করতে তাঁর এপিএস ওমর ফারুক আমাকে নানা প্রলোভন দেখান। ফারুক সাহেব বলেন, এখনো সময় আছে। টাকাটা কোথায় যাচ্ছে, তুমিও জানো, আমিও জানি। সব ভার আমি নিয়েছি। তুমি আর কাউকে ফাঁসাইও না। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে ফাঁসাইও না। তুমি আমাকেই ফাঁসাও। টাকাটা আমার, তুমি বলো। আমাদের কথায় যদি তুমি রাজি থাকো তাহলে তোমাকে ভালো একটা অ্যামাউন্ট দেওয়া হবে।'
সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, 'এমনও বলেছেন, যদি ১০-২০ লাখ টাকা লাগে, আমি ইউসুফ আলী মৃধার কাছ থেকে এনে দেব।' আমি বলছি, 'এটা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।'
তিনি বলেন, আলোচনায় শুনছি যে, গাড়িতে আর টাকা নেওয়া হবে না। কারণ গাড়িতে টাকা নেওয়া রিস্ক। চট্টগ্রাম থেকে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এক বন্ধুর অ্যাকাউন্টে এই টাকা পাঠানো হবে। সেখান থেকে তাঁরা টাকা নেবেন।
আজম বলেন, 'যখন এটা জানতে পারি, তখনই আমি ঠিক করি, টাকাসহ তাঁদের ধরিয়ে দেব। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে আদর্শিত আমি। তা ছাড়া অনেক দিনের টার্গেট ছিল, টাকাসহ তাঁদের আমি ধরিয়ে দেব। গাড়িতে করে টাকা না নিলে তো আর ধরিয়ে দেওয়া যাবে না। তাই শেষ সুযোগ মনে করে ধরিয়ে দিয়েছি।'
উল্লেখ্য, গত ৯ এপ্রিল মধ্যরাতে তৎকালীন রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএস ওমর ফারুকের প্রাইভেটকার হঠাৎ করে বিজিবি সদর দপ্তরের গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকিয়ে ফেলেন চালক আজম খান। তিনি গাড়ি থেকে নেমে চিৎকার করে বলতে থাকেন, এই গাড়িতে টাকার বস্তা আছে। বিজিবি সদস্যরা এগিয়ে এসে গাড়িতে সুরঞ্জিতের এপিএস ওমর ফারুক, পূর্বাঞ্চলীয় রেলের জিএম ইউসুফ আলী মৃধা ও কমান্ড্যান্ট এনামুল হককে দেখতে পান। পরে বিজিবি সদস্যরা ওই গাড়ি থেকে টাকার বস্তাও উদ্ধার করেন। ঘটনাটি নিয়ে সারা দেশে ব্যাপক আলোচনার সূত্রপাত হয়।
আরটিভিতে প্রচারিত সাক্ষাৎকারে আজম খান সুরঞ্জিতপুত্র সৌমেন সেনগুপ্ত সম্পর্কে যে অভিযোগ তোলেন, সে প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া হলে সৌমেন সেন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমার টেলিকম ব্যবসা নিয়ে ড্রাইভার আজমের অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।' সৌমেন টেলিকমের কার্যক্রম নিয়ে সরকারি বিভিন্ন সংস্থা পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত করেছে। কোথাও দুর্নীতির সন্ধান মেলেনি। তিনি বলেন, সেন পরিবারকে হয়রানি করার জন্য একটি বিশেষ চক্রের কারসাজি ও ষড়যন্ত্রের অংশ এ সাক্ষাৎকার। মো. আজমের আরটিভিতে দেওয়া সাক্ষাৎকার নিয়ে প্রশ্ন তুলে সৌমেন বলেন, অর্থ কেলেঙ্কারির এ ঘটনা নিয়ে এত কিছু ঘটল, তখন কোথায় ছিল ড্রাইভার আজম? এত দিন পর সে কোথা থেকে উদয় হলো, সেটি ভাবার বিষয়।

No comments

Powered by Blogger.