কুড়িয়ে পাওয়া সংলাপ-কালপ্রিটস কালপ্রিট-এর রক্তবীজ by রণজিৎ বিশ্বাস
মানুষ আসলে কিসের জোরে হাসেখেলে, কিসের জোরে ঠেলেঠুলে- আপনি জানেন? অথবা আপনি কি জানেন, তারা কিসের জোরে নড়েচড়ে ও নাচেকোঁদে?: জানি। মানুষ ঠেলাঠুলি ও নাচনকোঁদনের প্রশ্নে দুগ্ধ ও আমিষপ্রদায়ী একটি চতুষ্পদ ও স্তন্যপায়ী প্রাণীর মতো।
প্রাণীর নাম ছাগল। ছাগল যেমন খুঁটির জোরে নাচে, মানুষও তেমন। অনেক সময় তারা নাচে পোষণ-পৃষ্ঠপোষণের বলে, প্রকৃত অথবা ডাকাতুত মেটারনাল আঙ্গেলদের বলে। যেমন যুদ্ধাপরাধীরা নাচে বাইচান্স মুক্তিযোদ্ধা ও ছদ্মসাম্প্রদায়িক কীটদের বলে। তাদের অনুগ্রহে-বরাভয়ে ওদের গলায় বোল সরে ও নাচে তাল ওঠে।
: এখন যারা যুদ্ধাপরাধের জন্য বিচারের কাঠগড়ায় তাদের আপনি কাছে থেকে দেখেছেন?
: দেখেছি। আলীম, কামারুজ্জামান ও কাদের মোল্লা ছাড়া অন্যদের কাছে থেকে দেখেছি। ভাগ্য ভালো, কারও সঙ্গে কখনও আমার হাত মেলাতে হয়নি। ভবিষ্যতের কথা জানি না। এদের একজনের কাছে, পরিচিত ব্যক্তির সূত্র ধরে আমি তদবিরেও গিয়েছিলাম। তাও একবার নয়, দুবার।
: কাজ হয়েছে?
: না, হয়নি। দুটোই গেছে আমার। আমও গেছে, ছালাও। : তেমন মানুষের কাছে আপনি তদবিরে গেলেন কেন?!
: যেয়ে যেয়ে মানবসৃষ্ট কারণে আমার মতো বঞ্চিত কেউ কেউ সাক্ষাৎ পার পেয়ে যাচ্ছিল, কারণ তখন তারা বাইচান্স মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাড়ে, পিঠে ও মাথায় বসে এবং তাদের কান ধরে ক্ষমতা এনজয় করছিল। এইটি দেখে মহাবঞ্চিত আমার ভেতর একটা লুব্ধতা তৈরি হয়েছিল। ডুবন্ত মানুষ যখন ভালোমন্দ বিবেচনার সময় হারিয়ে একটা কিন্তু ধরে বাঁচতে চায়, আমিও তেমন করেছিলাম। করেছিলাম বলেই বুঝতে পাচ্ছি, তেমন করা উচিত নয়। যন্ত্রণা ও বঞ্চনার গৌরব তাতে হারিয়ে যায়, মৃত্যুর সৌরভ ও সুবাস তাতে ফিকে হয়ে যায়। সীমাবদ্ধ মানুষ তো ঠেকেই শেখে আর শিখতে শিখতে জপ করে ভুলে ভরা জীবন। এ জীবনে ভুলের কোনো শেষ নেই।
: যাদের যুদ্ধাপরাধের জন্য এখন বিচার হচ্ছে এবং যাদের প্রাপ্য বুঝে নেওয়ার দিনটি দেখার জন্য জাতি বড় ব্যগ্রতায় প্রহর গুনছে, তাদের কাউকে আপনি সর্বশেষ কবে দেখেছেন?
: টেলিভিশনের পর্দায়?
: না! সেটি আবার দেখা হলো নাকি?! বাস্তবে দেখার কথা বলছি। চোখের সামনে মানুষের করুণা ও লজ্জাশূন্যতার মাঝে নড়াচড়ার কথা বলছি।
: তেমন দেখা লাস্ট কবে দেখেছি, আমার মনে পড়ছে না। ওদের সঙ্গে দেখা হওয়ার বিষয়টি আমি ঘৃণায়, বিবমিষায়, হতাশায় ও লজ্জায় এড়িয়ে চলতাম।
তবে, কয়েকদিন আগে, চট্টগ্রাম এয়ারপোর্টে, ওদের একজনের রক্তবীজ থেকে উৎপন্ন এক প্রতিনিধিকে কাছে থেকে নজর করেছি। কয়েক মিনিটের জন্য। বিশেষ যাত্রীদের বিশ্রামকক্ষে।
: ওরা কি ওই সম্মানও পায়?!
: খর্বশ্মশ্রূতে আবৃত মুখে, স্থূল শরীরে ও শুভ্রাতিশুভ্র পাজামা-পাঞ্জাবিতে তরুণটিকে তো ঢুকে যেতে দেখলাম! বড় একটা সোফায় এলিয়ে বসতে দেখে বিরক্তও হলাম। তাতে কার কী যায় আসে জেনেও।
বেশি দামের টিকিটের প্রাইভেট বিমানটি যথাসময়ে ছেড়ে গেল। এবং বালকটি নিষ্ক্রান্ত হয়ে রুমটি হাল্কা করে গেল। কম দামের টিকিট নিয়ে দেশি বিমানের হপিং ফ্লাইটে চড়ার জন্য আমি বসে থাকলাম। 'বিমান'-এর একটি ফ্লাইট ঝাড়া দু'ঘণ্টা লেইট। সকাল সাড়ে ৭টার ফ্লাইট যাবে সাড়ে ৯টায়। আগে থেকে বিলম্বশঙ্কার কোনো ঘোষণাও ছিল না। খুব বিমর্ষ হয়ে ভাবছিলাম, এই বিলম্বের জন্য ঢাকায় ঘড়িবাঁধা আমার কোন কোন কাজের বারোটা বেজে গেল।
এয়ারপোর্টে আমাকে ছাড়তে আসা যুদ্ধাপরাধের শিকার একটি পরিবারের বৃদ্ধপ্রায় এক সন্তান জানতে চাইলেন-
: লোকটিকে কি আপনি চিনতে পেরেছেন? ওই যে ওইখানে ওই সোফায় বসেছিল! এই মাত্র ইউনাইটেড-এর ফ্লাইট ধরতে চলে গেল!
: পেরেছি। ওই কালপ্রিটের ছেলে না?!
: আপনি যখন ওর বাবার গোত্রের কালপ্রিট ক্রিমিনালদের বিচারের কথা বলছিলেন, আপনার দিকে বারবার তাকাচ্ছিল। এমনভাবে তাকাচ্ছিল যেন আপনাকে খেয়ে ফেলবে, কাঁচা এবং লবণ ছাড়া!
: তাকাক। তাকালেও কী করব আমি! কালপ্রিটস্য কালপ্রিট, ক্রিমিনালস্য ক্রিমিনাল, দুশমনস্য দুশমন ও সাম্প্রদায়িকস্য সাম্প্রদায়িক ওই বালকটির বাবাকে আমি তো আমার ঘৃণার তালিকা থেকে বাদ দিতে পারব না!
লেখক : রণজিৎ বিশ্বাস, রম্য লেখক
: এখন যারা যুদ্ধাপরাধের জন্য বিচারের কাঠগড়ায় তাদের আপনি কাছে থেকে দেখেছেন?
: দেখেছি। আলীম, কামারুজ্জামান ও কাদের মোল্লা ছাড়া অন্যদের কাছে থেকে দেখেছি। ভাগ্য ভালো, কারও সঙ্গে কখনও আমার হাত মেলাতে হয়নি। ভবিষ্যতের কথা জানি না। এদের একজনের কাছে, পরিচিত ব্যক্তির সূত্র ধরে আমি তদবিরেও গিয়েছিলাম। তাও একবার নয়, দুবার।
: কাজ হয়েছে?
: না, হয়নি। দুটোই গেছে আমার। আমও গেছে, ছালাও। : তেমন মানুষের কাছে আপনি তদবিরে গেলেন কেন?!
: যেয়ে যেয়ে মানবসৃষ্ট কারণে আমার মতো বঞ্চিত কেউ কেউ সাক্ষাৎ পার পেয়ে যাচ্ছিল, কারণ তখন তারা বাইচান্স মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাড়ে, পিঠে ও মাথায় বসে এবং তাদের কান ধরে ক্ষমতা এনজয় করছিল। এইটি দেখে মহাবঞ্চিত আমার ভেতর একটা লুব্ধতা তৈরি হয়েছিল। ডুবন্ত মানুষ যখন ভালোমন্দ বিবেচনার সময় হারিয়ে একটা কিন্তু ধরে বাঁচতে চায়, আমিও তেমন করেছিলাম। করেছিলাম বলেই বুঝতে পাচ্ছি, তেমন করা উচিত নয়। যন্ত্রণা ও বঞ্চনার গৌরব তাতে হারিয়ে যায়, মৃত্যুর সৌরভ ও সুবাস তাতে ফিকে হয়ে যায়। সীমাবদ্ধ মানুষ তো ঠেকেই শেখে আর শিখতে শিখতে জপ করে ভুলে ভরা জীবন। এ জীবনে ভুলের কোনো শেষ নেই।
: যাদের যুদ্ধাপরাধের জন্য এখন বিচার হচ্ছে এবং যাদের প্রাপ্য বুঝে নেওয়ার দিনটি দেখার জন্য জাতি বড় ব্যগ্রতায় প্রহর গুনছে, তাদের কাউকে আপনি সর্বশেষ কবে দেখেছেন?
: টেলিভিশনের পর্দায়?
: না! সেটি আবার দেখা হলো নাকি?! বাস্তবে দেখার কথা বলছি। চোখের সামনে মানুষের করুণা ও লজ্জাশূন্যতার মাঝে নড়াচড়ার কথা বলছি।
: তেমন দেখা লাস্ট কবে দেখেছি, আমার মনে পড়ছে না। ওদের সঙ্গে দেখা হওয়ার বিষয়টি আমি ঘৃণায়, বিবমিষায়, হতাশায় ও লজ্জায় এড়িয়ে চলতাম।
তবে, কয়েকদিন আগে, চট্টগ্রাম এয়ারপোর্টে, ওদের একজনের রক্তবীজ থেকে উৎপন্ন এক প্রতিনিধিকে কাছে থেকে নজর করেছি। কয়েক মিনিটের জন্য। বিশেষ যাত্রীদের বিশ্রামকক্ষে।
: ওরা কি ওই সম্মানও পায়?!
: খর্বশ্মশ্রূতে আবৃত মুখে, স্থূল শরীরে ও শুভ্রাতিশুভ্র পাজামা-পাঞ্জাবিতে তরুণটিকে তো ঢুকে যেতে দেখলাম! বড় একটা সোফায় এলিয়ে বসতে দেখে বিরক্তও হলাম। তাতে কার কী যায় আসে জেনেও।
বেশি দামের টিকিটের প্রাইভেট বিমানটি যথাসময়ে ছেড়ে গেল। এবং বালকটি নিষ্ক্রান্ত হয়ে রুমটি হাল্কা করে গেল। কম দামের টিকিট নিয়ে দেশি বিমানের হপিং ফ্লাইটে চড়ার জন্য আমি বসে থাকলাম। 'বিমান'-এর একটি ফ্লাইট ঝাড়া দু'ঘণ্টা লেইট। সকাল সাড়ে ৭টার ফ্লাইট যাবে সাড়ে ৯টায়। আগে থেকে বিলম্বশঙ্কার কোনো ঘোষণাও ছিল না। খুব বিমর্ষ হয়ে ভাবছিলাম, এই বিলম্বের জন্য ঢাকায় ঘড়িবাঁধা আমার কোন কোন কাজের বারোটা বেজে গেল।
এয়ারপোর্টে আমাকে ছাড়তে আসা যুদ্ধাপরাধের শিকার একটি পরিবারের বৃদ্ধপ্রায় এক সন্তান জানতে চাইলেন-
: লোকটিকে কি আপনি চিনতে পেরেছেন? ওই যে ওইখানে ওই সোফায় বসেছিল! এই মাত্র ইউনাইটেড-এর ফ্লাইট ধরতে চলে গেল!
: পেরেছি। ওই কালপ্রিটের ছেলে না?!
: আপনি যখন ওর বাবার গোত্রের কালপ্রিট ক্রিমিনালদের বিচারের কথা বলছিলেন, আপনার দিকে বারবার তাকাচ্ছিল। এমনভাবে তাকাচ্ছিল যেন আপনাকে খেয়ে ফেলবে, কাঁচা এবং লবণ ছাড়া!
: তাকাক। তাকালেও কী করব আমি! কালপ্রিটস্য কালপ্রিট, ক্রিমিনালস্য ক্রিমিনাল, দুশমনস্য দুশমন ও সাম্প্রদায়িকস্য সাম্প্রদায়িক ওই বালকটির বাবাকে আমি তো আমার ঘৃণার তালিকা থেকে বাদ দিতে পারব না!
লেখক : রণজিৎ বিশ্বাস, রম্য লেখক
No comments