বিশেষ সাক্ষাৎকার : গোলাম মওলা রনি-এই সরকার পদ্মা সেতুর একটি খুঁটিও গাড়তে পারবে না : গোলাম মওলা রনি
গোলাম মওলা রনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে পটুয়াখালীর একটি আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। তরুণ এই সংসদ সদস্য ব্যাপক আলোচনায় এসেছেন নিজ দলের অনেক মন্ত্রীর কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে। তিনি কালের কণ্ঠের সঙ্গে নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন।
তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আরিফুজ্জামান তুহিন
কালের কণ্ঠ : ২৩ দফা দিয়ে আপনারা ক্ষমতায় এসেছেন; কিন্তু একটি দফাও আপনারা পূরণ করতে পারেননি। কেন?
গোলাম মওলা রনি : আসলে বাংলাদেশে যাঁরা নির্বাচনী ইশতেহার তৈরি করেন, মাঠের রাজনীতি ও প্রকৃত বাস্তবতা সম্পর্কে তাঁদের কোনো ধারণা নেই। এটা শুধু আওয়ামী লীগ-বিএনপি নয়, প্রতিটি রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রে সত্য। এ কাজটি করেন একধরনের বুদ্ধিজীবী, যাঁদের 'হরবোলা' বলা হয়। তাঁরা হল ভাড়া করা বুদ্ধিজীবী। মানুষকে আকৃষ্ট করার জন্য কাব্য দিয়ে তাঁরা এসব নির্বাচনী ইশতেহার বানান। এভাবে গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৩ দফা নির্বাচনী ইশতেহার দিয়েছিল, যা বাস্তবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। যেমন প্রতিটি পরিবারে একজনকে চাকরি দেওয়া- এটা পৃথিবীর কোনো দেশ কখনোই পারবে না। অথচ বিষয়টি কিন্তু এমনভাবে বলা যেত, সরকার এমন একটি অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট তৈরি করবে, যাতে প্রতিটি পরিবারের অন্তত একজন প্রত্যক্ষভাবে হোক অথবা পরোক্ষভাবে হোক, অর্থনৈতিক কাজের সঙ্গে যুক্ত হতে পারবেন।
তবে এই সরকারের কিছু অবিস্মরণীয় কাজ রয়েছে, যা শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারত নয়, সারা পৃথিবীতে ব্যতিক্রম। এর মধ্যে একটি হলো পাটের জেনম আবিষ্কার। পাশাপাশি ছত্রাকের আক্রমণের কারণ আবিষ্কার করা গেছে। এটা কিন্তু সারা পৃথিবীতে আর কেউ পারেনি। এর ফলে বাংলাদেশে খাদ্যশস্য উৎপাদন বেড়ে যাবে।
পাকিস্তান আমলে আমাদের দেশে শিল্পকারখানা তৈরি হয়েছে। সেখানে প্রচুর শ্রমিক কাজ করতেন। বাংলাদেশে যে গার্মেন্টগুলো চলছে, সেগুলো কিন্তু শিল্প নয়। কোনো গার্মেন্ট মালিক কিন্তু বলতে পারবেন না, আমাদের এখানে প্রভিডেন্ট ফান্ড আছে, বীমা আছে, গ্রাচুইটি আছে। এসব শিল্প নয়, এগুলো সব বোগাস। গার্মেন্ট, এই অর্থনীতি টলটলায়মান। এ অবস্থা থেকে সরকার মাইক্রো লেভেলে, কৃষিতে ব্যাপক মনোযোগ দিয়েছে। কৃষি একটা শিল্প। ফলে কৃষকরা নানা ধরনের নতুন নতুন ফসল উদ্ভাবন করছেন, যা দিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে। এ সরকারের এটাই সফলতা।
সরকার যখন ক্ষমতায় আসে তখন কিন্তু বিদ্যুতের হাহাকার ছিল। এখন কুইক রেন্টালের যে সমালোচনা আছে, সেটা ঠিক আছে। মানুষ কিন্তু বিদ্যুৎ পাচ্ছে। এই সরকারের আমলে কিন্তু ৭০ হাজার কিলোমিটার সড়ক আমরা মেরামত করেছি। ৬০টির মতো দরিদ্র ভাতা রয়েছে, যা আমরা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে দিয়েছি। শিক্ষা খাতেও আমাদের সাফল্য রয়েছে।
আমরা রাস্তাঘাট আশা করি ইংল্যান্ড-আমেরিকার মতো; কিন্তু ট্যাক্স দিই বাংলাদেশের মতো। তাহলে সমস্যার সমাধান হবে না।
কালের কণ্ঠ : আপনার দাবি অনুযায়ী আপনাদের সরকারের অনেক সাফল্য রয়েছে। সেগুলো কেন প্রচার করছেন না?
গোলাম মওলা রনি : আওয়ামী লীগের প্রচার বিভাগ মারাত্মক দুর্বল। সরকারের বিভিন্ন প্রচার বিভাগ ও পার্টির প্রচার বিভাগের মধ্যে যে সমন্বয় থাকবে, তা হয়নি। ফলে সরকারের সাফল্যগুলোর কোনো প্রচার নেই। আমাদের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক, ঢাকা মহানগর প্রচার সম্পাদক অর্থাৎ গুরুত্বপূর্ণ প্রচার বিভাগগুলো নিষ্ক্রিয়। সরকারের যে উন্নয়নমূলক কাজ, তা দলের প্রচার বিভাগের কাছে নেই। তারা কী করে সরকারের সাফল্য প্রচার করবে?
এ কাজটি করার মতো যে দক্ষতা, তা কিন্তু প্রচার বিভাগের নেই। আপনি এখনই আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক নূহ উল লেনিন সাহেবের কাছে যান, তাঁকে গিয়ে আই ফোন-৪-এর বিষয় কথা বলেন, তিনি কিছু বলতে পারবেন না। সরকার চায় ডিজিটাল বাংলাদেশ আর তার আশপাশের মানুষ হলো এনালগ।
কালের কণ্ঠ : আপনার মতো সরকারও দাবি করছে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের উন্নয়ন হয়েছে। অথচ গ্যাস ও বিদ্যুতের অভাবের কারণে শত শত কলকারখানা উৎপাদনে যেতে পারছে না।
গোলাম মওলা রনি : আমরা বিদ্যুতের উন্নয়ন বলতে আসলে বুঝিয়েছি বাতি জ্বলা। আগে যেখানে বিদ্যুৎ যেত ২০ বার, আমরা সেটাকে কমিয়ে এনে পাঁচবারে এনেছি। উন্নতি বলতে এটুকু। সফলতা হলো- বিএনপি সরকারের আমলে খাম্বা টানা হয়েছিল; কিন্তু বিদ্যুৎ দেওয়া হয়নি। এই সরকারের আমলে আমরা প্রায় ২৪ লাখ বিদ্যুতের কানেকশন দিয়েছি। এতে প্রায় এক কোটি লোক নতুন করে বিদ্যুতের আওতায় এসেছে।
আর গ্যাসের বিষয়টি ভিন্ন। গ্যাসের সমস্যার সমাধান হয়নি শাসক দলগুলোর সঙ্গে ও দেশি-বিদেশি চক্রান্তের কারণে। এই টোটাল সেক্টরটি চলে গেছে বিদেশিদের হাতে। বাপেক্স দুর্বল হয়েছে। এই সরকার ক্ষমতায় আসার পর তেল-গ্যাস উত্তোলনের জন্য আমরা একটি রিগ ক্রয় করেছি। আমরা কৈলাসটিলা, সুন্দলপুর, সূনেত্রতে গ্যাস পেয়েছি। বেশ কিছু জায়গা থেকে গ্যাস উত্তোলনও করেছি।
আমার নিজের একটা কম্পানি কিন্তু আর্থিক লোকসানির কারণে বিক্রি করে দিয়েছি। কারণ সময়মতো গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ পাইনি। যখন পেয়েছি তখন আমার আর্থিক ক্ষতি এত বেশি যে তা আর নতুন করে চালু করতে পারব না।
গ্যাস সংকটের কারণে সারকারখানাগুলো আট মাস বন্ধ থাকে। প্রয়োজনীয় গ্যাসের ৫০ শতাংশও সরবরাহও করা যায় না। গ্যাসের অভাবে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বন্ধ থাকছে। এ অবস্থায় আমরা শত শত কোটি টাকা খরচ করে রাজশাহী পর্যন্ত গ্যাসের পাইপলাইন টেনে নিয়ে গেছি। এটা হলো পুরোটাই অপরিকল্পিত শাসনের চিত্র।
কালের কণ্ঠ : আপনার বলছেন আপনাদের সরকারের আমলে বাপেক্স শক্তিশালী হয়েছে আর বিগত সরকারগুলো বিদেশিদের কাছে গ্যাস সেক্টর তুলে দিয়েছে। কিন্তু সাড়া জাগানো বিকল্প গণমাধ্যম উইকিলিস সূত্রে জানা যাচ্ছে, ঢাকায় নিযুক্ত তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেএফ মরিয়র্টিকে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী কথা দিয়েছেন যে সাগরে দুটি বিরোধীহীন ব্লক দেওয়া হবে। তাহলে কি আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আসার পেছনে এসব দেওয়া-নেওয়ার একটা সম্পর্ক আছে?
গোলাম মওলা রনি : বাপেক্সের যে সক্ষমতা তা স্থলভাগের। এর বাইরে তারা সাগরে কাজ করেনি। সেই কারিগরি জ্ঞান ও যন্ত্রপাতিও আমাদের নেই। দেখুন, বাংলাদেশে সব থেকে বেশি গ্যাস উত্তোলন করে শেভরন। এখন শেভরনের যে সক্ষমতা তা যদি অর্জন করতে হয় তাহলে বাপেক্সকে যদি সরকার সাপোর্ট দেয় তবু ১০ বছর লাগবে। সমুদ্রে কাজ করার জন্য আরো অনেক প্রস্তুতি দরকার। তবে সে ক্ষেত্রে জয়েন্টভেঞ্চার করা যেতে পারে। সমুদ্রের গ্যাস উত্তোলনের জন্য আমাদের বিদেশি কম্পানির সঙ্গে যেতেই হবে।
শুধু আমাদের মতো দেশ নয়, সৌদি আরব-ইরানের মতো দেশের তেল-গ্যাস সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর দখলে রয়েছে। বাংলাদেশে এ ধরনের কোনো প্রেশার আছে কি না আমি জানি না। আমেরিকার রাষ্ট্রদূত তাঁদের দেশের কোনো ব্যবসায়ীর ছোট কোনো স্বার্থ থাকলেও ছুটে আসবেন। এটা তাঁদের পলিসি। হয়তো এ কারণেই জ্বালানি উপদেষ্টার সঙ্গে তাঁরা দেখা করেছেন। জ্বালানি উপদেষ্টা তখন হয়তো বলেছেন, আমাদের দিক থেকে সর্বোচ্চ যা যা করার তা করব। এটা একটা কূটনৈতিক পরিভাষা। এটাই হয়তো উইকিলিস ফাঁস করেছে।
কালের কণ্ঠ : যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক যে প্রভাব, সেখানে কি তাদের সঙ্গে আমাদের এ ধরনের কূটনৈতিক সাদামাটা আশ্বাস দেওয়ার মতো পর্যায় আছে?
গোলাম মওলা রনি : যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কেন থাকবে না! আমরা তাদের ভয় করছি এমনি এমনি। সাপের দংশনে যেসব মানুষ মারা যায় তাদের মধ্যে ৯৯ শতাংশ মারা যায় হার্ট অ্যাটাক করে। কারণ আমাদের দেশের ১ শতাংশ সাপে বিষ আছে। যুক্তরাষ্ট্রকে আমাদের দেশের মানুষের ভয়ের কোনো কারণ নেই। আমরা সামরিক সরঞ্জাম ক্রয় করি চীন থেকে, আমাদের সবচেয়ে বেশি সাহায্য দেয় জাপান আর আমরা ভয় পাই আমেরিকাকে!
কালের কণ্ঠ : আপনার ভাষ্য মতে বিদেশি রাষ্ট্রদূতরা নিজ নিজ দেশের স্বার্থ রক্ষার জন্য সেখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শতাধিক দেশ ভ্রমণ করেছেন। এই সরকারের আমলে বিদেশে বাংলাদেশের কি নতুন কোনো বাজার তৈরি হয়েছে বলে আপনি মনে করেন?
গোলাম মওলা রনি : পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় শতভাগ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর অধীনে নয়। আমাদের একটি মিশনে অনেক কাজ রয়েছে, যার মধ্যে অনেক বিভাগ কাজ করে। ফলে কাজের সমন্বয় হয় না। আর আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একজন ডাক্তার। ডাক্তারি শিখে তিনি গেলেন যে আমি আর ডাক্তারি করব না, আমি এখন উকালতি করব। এখন তিনি রাজনীতি করতে এসে মন্ত্রী হয়ে গেলেন। মন্ত্রী হয়ে তিনি ১৩৭টি দেশ ভ্রমণ করলেন। যদি প্রতিটি ভ্রমণে পাঁচ দিন করে সময় লাগে, তাহলে কত দিন লাগে (৬৮৫ দিন)?
এখন বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোকে যদি দেশের অর্থনৈতিক বাজার খোঁজার জন্য নিয়োজিত করতে হয় তাহলে দরকার তো তথ্য-উপাত্ত ও গবেষণার। এখন আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কোনো সাহায্যকারী নেই, তাঁর প্রতিমন্ত্রী নেই। সে সময় তিনি পাননি। বাংলাদেশের শুধু মানবসম্পদই নয়, দেশের ব্যাটারি, ওষুধ, গার্মেন্ট পণ্য, চানাচুর, আমাদের সবজি- সব কিছু রপ্তানি করা যায়।
আমাদের দেশের পর্যটনের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। অথচ পর্যটন নামে আমাদের দূতাবাসগুলোতে আলাদা কোনো বিভাগ নেই। কিন্তু যদি আপনি সুযোগ-সুবিধার কথা বিবেচনা করেন তাহলে আমাদের দূতাবাসগুলোতে কিন্তু সুযোগ-সুবিধার অভাব নেই। দরকার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। বিএনপির সময় ৯২ সালে এ ধরনের একটি পরিকল্পনা ছিল। এ জন্য সে সময় বিএনপি ঠিক করল তারা জাপানের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক তৈরি করবে। এ জন্য বিএনপি মোর্শেদ খানকে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত বানিয়ে দিলেন। মোর্শেদ খান অনেক কাজ করলেন। এরপর যখন বিএনপি আবার ক্ষমতায় এলো, মোর্শেদ খানকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বানিয়ে দিলেন। জাপানের সঙ্গে কিন্তু সেই থেকে আমাদের সম্পর্ক ভালো।
বর্তমান সরকার চীন, ভারত, মালেশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করার চেষ্টা করছে। কিন্তু এগুলোর তো ধারাবাহিকতা দরকার। যদি এর পরের সরকার তা না করে তাহলে কিন্তু হলো না।
কালের কণ্ঠ : সরকারের শেষ সময় নুতন মন্ত্রী নিয়োগ দেওয়া হলো। এর মধ্যে কয়েকজনকে ঘিরে বিতর্ক রয়েছে। আপনি এই নতুন মন্ত্রী নিয়োগের বিষয়টি কিভাবে দেখছেন?
গোলাম মওলা রনি : মন্ত্রী নিয়োগের বিষয়টি আসলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিষয়। তাঁর মেধা, যোগ্যতা, তাঁর চিন্তা-চেতনার সঙ্গে মেলে- এসব ভেবেই তিনি নিয়োগ দিয়েছেন। এ ব্যাপারে আসলে আমাদের কারো কিছু বলার নেই। এখানে যদি কোনো সফলতা আসে, সেটাও প্রধানমন্ত্রীর কৃতিত্ব। আর যদি সমাালোচনা আসে, তাহলে সেটাও তাঁর।
যেহেতু সরকারের শেষ সময়, সরকার যে গতিতে আগাচ্ছিল, এই মন্ত্রিসভার পরিবর্তনের কারণে কোনো পরিবর্তন হবে বলে আমি মনে করি না।
কালের কণ্ঠ : এবার আসি বিশ্বব্যাংক ও পদ্মা সেতু প্রকল্পে। আপনি কি মনে করেন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন করবে? এ সরকারের সময়ে কি পদ্মা সেতুর কাজ শুরু হবে?
গোলাম মওলা রনি : বিশ্বব্যাংক নিয়ে আমার তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে। প্রধানমন্ত্রী সংসদে ভাষণে একবার বললেন, পদ্মা সেতু নিজেদের অর্থে করব। আবার বললেন, রেল সেতু বাদ দিয়ে পদ্মা সেতু করব। আমি এ কথাটির জন্য তাঁকে সালাম জানাই। আজ থেকে তিন বছর আগে এ বিষয়ে সংসদে যে মিটিং হয়েছিল, সেখানে বলেছিলাম, বিশ্বব্যাংক এই সরকারের আমলে টাকা দেবে না। পদ্মা সেতু তৈরি তো দূরের কথা, আপনারা একটা খুঁটিও গাড়তে পারবেন না এই সরকারের আমলে। পারলে নিজেদের অর্থায়নে করুন। প্রধানমন্ত্রীকে বোঝান। কারণ যেসব কাগজপত্র আদান-প্রদান হয়েছে, তা পড়ে এটা আমার মনে হয়েছে। সেখানে তৎকালীন সচিব ও যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনও ছিলেন।
এই পদ্মা সেতুটির সঙ্গে যদি রেল সেতু করেন তাহলে ব্যয় দাঁড়াবে ১২ হাজার কোটি টাকা। এই বারো হাজার কোটি থেকে ব্যয় বাড়তে বাড়তে এটা হয়েছে এখন ২৬ হাজার কোটি টাকা। পদ্মা সেতুর যে আট মাস দেরি হলো, তাতে আরো দুই হাজার কোটি টাকা বেড়ে গেছে। আর যদি আপনি শুধু সড়ক সেতু করেন তাহলে আট থেকে দশ হাজার কোটি টাকায় হয়ে যাবে। আমরা ২০ হাজার কোটি বাড়তি খরচ করে রেল সেতু করছি; কিন্তু আগামী ২০ বছরেও কিন্তু রেল চালু করতে পারব না। কারণ রেল চালু করতে হলে রেললাইনের পেছনেসহ অন্যান্য খরচ হবে আরো ৬০ হাজার কোটি টাকা। যেখানে আমরা ২৫-৩০ হাজার কোটি টাকা জোগাড় করতে পারি না, কিভাবে ৬০ হাজার কোটি টাকা জোগাড় করব? ফলে এই রেল সেতুতে তখন আপনাকে বাচ্চাদের খেলনা চালাতে হবে। এটা পড়ে থাকবে।
বিশ্বব্যাংকের ফিরে আসা নিয়ে সরকার ভয়াবহ বিব্রত হবে। বিশ্বব্যাংক দুর্নীতি দমন কমিশনের সঙ্গে বসবে। তারপর বড় বড় কর্তাদের মিডিয়ার সামনে এনে পর্যুদস্ত করবে। দেখবেন তখন সরকারের কাপড়চোপড়ও থাকবে না। তখন না পারবে গিলতে, না পারবে ঠেলতে। তখন যদি সরকার কোনোভাবে কিছু বলে, তাহলে বিশ্বব্যাংক বলবে, দুর্নীতি তদন্তে সহায়তা না করায় আমরা গেলাম।
বিশ্বব্যাংকের খপ্পরে যারা একবার পড়েছে, তাদের সব কিছু গেছে। হয় আপনাকে শেষ করে দেবে, নতুবা একদম কুকুরের মতো মাথা নত করে প্রভুর সামনে থাকবেন। আমরা ভিক্ষুকদের সঙ্গে যেমন আচরণ করি, বিশ্বব্যাংকও আমাদের সঙ্গে সে রকম আচরণ করে।
কোটি কোটি মাথাকে বিকিয়ে দিয়ে আমাদের পদ্মা সেতু দরকার কি না, তা ভাবতে হবে।
চুয়াত্তর সালে বিশ্বব্যাংক ও আমেরিকার কবলে পড়ে কিন্তু দুর্ভিক্ষ হয়েছিল বাংলাদেশে। আমরা আবার সেদিকে যাচ্ছি।
কালের কণ্ঠ : আপনাদের আমলে শেয়ার, ডেসটিনি, হলমার্ক কেলেঙ্কারির মতো ঘটনা ঘটছে। আপনারা মূলত তরুণদের ভোটে ক্ষমতায় এসেছেন। এই তরুণদের জন্য আগামী নির্বাচনে কী বলবেন?
গোলাম মওলা রনি : শেয়ার মার্কেট, হলমার্ক কেলেঙ্কারির মতো ঘটনায় সবাই হতবাক হয়েছে। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে আমরা তরুণদের ভোটের কারণে বিশাল ব্যবধানে জয় পেয়েছি। এই কেলেঙ্কারির জন্য আমাদের সামাজিক যে অবিচার, এটা তারই বহিঃপ্রকাশ। তবে সরকার চেষ্টা করছে। হলমার্ক যে ঘটনাটি ঘটিয়েছে তা কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে চলেছে। মিডিয়া এই দুর্নীতির বিষয়টি ফাঁস করে দিয়েছে। সরকারদলীয় যেসব লোকের নাম আসছে, সরকারের উচিত তাঁদের কোনো ছাড় না দেওয়া। জাতীয়ভাবে তরুণ ভোটারদের কী বলা হবে, সে বিষয়ে হয়তো মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও নির্বাচন পরিচালনা বোর্ড সিদ্ধান্ত নেবে। কিন্তু আমার এলাকার তরুণ ভোটাররা আমার পক্ষেই আছে। ভোট যার অধীনেই হোক না কেন, আমি সেখান থেকে আগের থেকে বেশি ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়ে আসব।
কালের কণ্ঠ : আপনার কি মনে হয়, সব দল নিয়ে একটি নির্বাচন হবে?
গোলাম মওলা রনি : নির্বাচন এ দেশে হবে। তবে কার অধীনে হবে সে সিদ্ধান্ত দেওয়ার মতো সময় এখনো আসেনি। এই মুহূর্তে রাজনীতিবিদদের বক্তব্য শুনে বলা যাবে না, রাজনীতি কোথায় যাচ্ছে। রাজনীতি কোথায় যাচ্ছে এর জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে আগামী বছরের এপ্রিল পর্যন্ত।
কালের কণ্ঠ : সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
গোলাম মওলা রনি : আপনাকে ও কালের কণ্ঠ পরিবারকেও ধন্যবাদ।
কালের কণ্ঠ : ২৩ দফা দিয়ে আপনারা ক্ষমতায় এসেছেন; কিন্তু একটি দফাও আপনারা পূরণ করতে পারেননি। কেন?
গোলাম মওলা রনি : আসলে বাংলাদেশে যাঁরা নির্বাচনী ইশতেহার তৈরি করেন, মাঠের রাজনীতি ও প্রকৃত বাস্তবতা সম্পর্কে তাঁদের কোনো ধারণা নেই। এটা শুধু আওয়ামী লীগ-বিএনপি নয়, প্রতিটি রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রে সত্য। এ কাজটি করেন একধরনের বুদ্ধিজীবী, যাঁদের 'হরবোলা' বলা হয়। তাঁরা হল ভাড়া করা বুদ্ধিজীবী। মানুষকে আকৃষ্ট করার জন্য কাব্য দিয়ে তাঁরা এসব নির্বাচনী ইশতেহার বানান। এভাবে গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৩ দফা নির্বাচনী ইশতেহার দিয়েছিল, যা বাস্তবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। যেমন প্রতিটি পরিবারে একজনকে চাকরি দেওয়া- এটা পৃথিবীর কোনো দেশ কখনোই পারবে না। অথচ বিষয়টি কিন্তু এমনভাবে বলা যেত, সরকার এমন একটি অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট তৈরি করবে, যাতে প্রতিটি পরিবারের অন্তত একজন প্রত্যক্ষভাবে হোক অথবা পরোক্ষভাবে হোক, অর্থনৈতিক কাজের সঙ্গে যুক্ত হতে পারবেন।
তবে এই সরকারের কিছু অবিস্মরণীয় কাজ রয়েছে, যা শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারত নয়, সারা পৃথিবীতে ব্যতিক্রম। এর মধ্যে একটি হলো পাটের জেনম আবিষ্কার। পাশাপাশি ছত্রাকের আক্রমণের কারণ আবিষ্কার করা গেছে। এটা কিন্তু সারা পৃথিবীতে আর কেউ পারেনি। এর ফলে বাংলাদেশে খাদ্যশস্য উৎপাদন বেড়ে যাবে।
পাকিস্তান আমলে আমাদের দেশে শিল্পকারখানা তৈরি হয়েছে। সেখানে প্রচুর শ্রমিক কাজ করতেন। বাংলাদেশে যে গার্মেন্টগুলো চলছে, সেগুলো কিন্তু শিল্প নয়। কোনো গার্মেন্ট মালিক কিন্তু বলতে পারবেন না, আমাদের এখানে প্রভিডেন্ট ফান্ড আছে, বীমা আছে, গ্রাচুইটি আছে। এসব শিল্প নয়, এগুলো সব বোগাস। গার্মেন্ট, এই অর্থনীতি টলটলায়মান। এ অবস্থা থেকে সরকার মাইক্রো লেভেলে, কৃষিতে ব্যাপক মনোযোগ দিয়েছে। কৃষি একটা শিল্প। ফলে কৃষকরা নানা ধরনের নতুন নতুন ফসল উদ্ভাবন করছেন, যা দিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে। এ সরকারের এটাই সফলতা।
সরকার যখন ক্ষমতায় আসে তখন কিন্তু বিদ্যুতের হাহাকার ছিল। এখন কুইক রেন্টালের যে সমালোচনা আছে, সেটা ঠিক আছে। মানুষ কিন্তু বিদ্যুৎ পাচ্ছে। এই সরকারের আমলে কিন্তু ৭০ হাজার কিলোমিটার সড়ক আমরা মেরামত করেছি। ৬০টির মতো দরিদ্র ভাতা রয়েছে, যা আমরা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে দিয়েছি। শিক্ষা খাতেও আমাদের সাফল্য রয়েছে।
আমরা রাস্তাঘাট আশা করি ইংল্যান্ড-আমেরিকার মতো; কিন্তু ট্যাক্স দিই বাংলাদেশের মতো। তাহলে সমস্যার সমাধান হবে না।
কালের কণ্ঠ : আপনার দাবি অনুযায়ী আপনাদের সরকারের অনেক সাফল্য রয়েছে। সেগুলো কেন প্রচার করছেন না?
গোলাম মওলা রনি : আওয়ামী লীগের প্রচার বিভাগ মারাত্মক দুর্বল। সরকারের বিভিন্ন প্রচার বিভাগ ও পার্টির প্রচার বিভাগের মধ্যে যে সমন্বয় থাকবে, তা হয়নি। ফলে সরকারের সাফল্যগুলোর কোনো প্রচার নেই। আমাদের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক, ঢাকা মহানগর প্রচার সম্পাদক অর্থাৎ গুরুত্বপূর্ণ প্রচার বিভাগগুলো নিষ্ক্রিয়। সরকারের যে উন্নয়নমূলক কাজ, তা দলের প্রচার বিভাগের কাছে নেই। তারা কী করে সরকারের সাফল্য প্রচার করবে?
এ কাজটি করার মতো যে দক্ষতা, তা কিন্তু প্রচার বিভাগের নেই। আপনি এখনই আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক নূহ উল লেনিন সাহেবের কাছে যান, তাঁকে গিয়ে আই ফোন-৪-এর বিষয় কথা বলেন, তিনি কিছু বলতে পারবেন না। সরকার চায় ডিজিটাল বাংলাদেশ আর তার আশপাশের মানুষ হলো এনালগ।
কালের কণ্ঠ : আপনার মতো সরকারও দাবি করছে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের উন্নয়ন হয়েছে। অথচ গ্যাস ও বিদ্যুতের অভাবের কারণে শত শত কলকারখানা উৎপাদনে যেতে পারছে না।
গোলাম মওলা রনি : আমরা বিদ্যুতের উন্নয়ন বলতে আসলে বুঝিয়েছি বাতি জ্বলা। আগে যেখানে বিদ্যুৎ যেত ২০ বার, আমরা সেটাকে কমিয়ে এনে পাঁচবারে এনেছি। উন্নতি বলতে এটুকু। সফলতা হলো- বিএনপি সরকারের আমলে খাম্বা টানা হয়েছিল; কিন্তু বিদ্যুৎ দেওয়া হয়নি। এই সরকারের আমলে আমরা প্রায় ২৪ লাখ বিদ্যুতের কানেকশন দিয়েছি। এতে প্রায় এক কোটি লোক নতুন করে বিদ্যুতের আওতায় এসেছে।
আর গ্যাসের বিষয়টি ভিন্ন। গ্যাসের সমস্যার সমাধান হয়নি শাসক দলগুলোর সঙ্গে ও দেশি-বিদেশি চক্রান্তের কারণে। এই টোটাল সেক্টরটি চলে গেছে বিদেশিদের হাতে। বাপেক্স দুর্বল হয়েছে। এই সরকার ক্ষমতায় আসার পর তেল-গ্যাস উত্তোলনের জন্য আমরা একটি রিগ ক্রয় করেছি। আমরা কৈলাসটিলা, সুন্দলপুর, সূনেত্রতে গ্যাস পেয়েছি। বেশ কিছু জায়গা থেকে গ্যাস উত্তোলনও করেছি।
আমার নিজের একটা কম্পানি কিন্তু আর্থিক লোকসানির কারণে বিক্রি করে দিয়েছি। কারণ সময়মতো গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ পাইনি। যখন পেয়েছি তখন আমার আর্থিক ক্ষতি এত বেশি যে তা আর নতুন করে চালু করতে পারব না।
গ্যাস সংকটের কারণে সারকারখানাগুলো আট মাস বন্ধ থাকে। প্রয়োজনীয় গ্যাসের ৫০ শতাংশও সরবরাহও করা যায় না। গ্যাসের অভাবে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বন্ধ থাকছে। এ অবস্থায় আমরা শত শত কোটি টাকা খরচ করে রাজশাহী পর্যন্ত গ্যাসের পাইপলাইন টেনে নিয়ে গেছি। এটা হলো পুরোটাই অপরিকল্পিত শাসনের চিত্র।
কালের কণ্ঠ : আপনার বলছেন আপনাদের সরকারের আমলে বাপেক্স শক্তিশালী হয়েছে আর বিগত সরকারগুলো বিদেশিদের কাছে গ্যাস সেক্টর তুলে দিয়েছে। কিন্তু সাড়া জাগানো বিকল্প গণমাধ্যম উইকিলিস সূত্রে জানা যাচ্ছে, ঢাকায় নিযুক্ত তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেএফ মরিয়র্টিকে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী কথা দিয়েছেন যে সাগরে দুটি বিরোধীহীন ব্লক দেওয়া হবে। তাহলে কি আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আসার পেছনে এসব দেওয়া-নেওয়ার একটা সম্পর্ক আছে?
গোলাম মওলা রনি : বাপেক্সের যে সক্ষমতা তা স্থলভাগের। এর বাইরে তারা সাগরে কাজ করেনি। সেই কারিগরি জ্ঞান ও যন্ত্রপাতিও আমাদের নেই। দেখুন, বাংলাদেশে সব থেকে বেশি গ্যাস উত্তোলন করে শেভরন। এখন শেভরনের যে সক্ষমতা তা যদি অর্জন করতে হয় তাহলে বাপেক্সকে যদি সরকার সাপোর্ট দেয় তবু ১০ বছর লাগবে। সমুদ্রে কাজ করার জন্য আরো অনেক প্রস্তুতি দরকার। তবে সে ক্ষেত্রে জয়েন্টভেঞ্চার করা যেতে পারে। সমুদ্রের গ্যাস উত্তোলনের জন্য আমাদের বিদেশি কম্পানির সঙ্গে যেতেই হবে।
শুধু আমাদের মতো দেশ নয়, সৌদি আরব-ইরানের মতো দেশের তেল-গ্যাস সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর দখলে রয়েছে। বাংলাদেশে এ ধরনের কোনো প্রেশার আছে কি না আমি জানি না। আমেরিকার রাষ্ট্রদূত তাঁদের দেশের কোনো ব্যবসায়ীর ছোট কোনো স্বার্থ থাকলেও ছুটে আসবেন। এটা তাঁদের পলিসি। হয়তো এ কারণেই জ্বালানি উপদেষ্টার সঙ্গে তাঁরা দেখা করেছেন। জ্বালানি উপদেষ্টা তখন হয়তো বলেছেন, আমাদের দিক থেকে সর্বোচ্চ যা যা করার তা করব। এটা একটা কূটনৈতিক পরিভাষা। এটাই হয়তো উইকিলিস ফাঁস করেছে।
কালের কণ্ঠ : যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক যে প্রভাব, সেখানে কি তাদের সঙ্গে আমাদের এ ধরনের কূটনৈতিক সাদামাটা আশ্বাস দেওয়ার মতো পর্যায় আছে?
গোলাম মওলা রনি : যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কেন থাকবে না! আমরা তাদের ভয় করছি এমনি এমনি। সাপের দংশনে যেসব মানুষ মারা যায় তাদের মধ্যে ৯৯ শতাংশ মারা যায় হার্ট অ্যাটাক করে। কারণ আমাদের দেশের ১ শতাংশ সাপে বিষ আছে। যুক্তরাষ্ট্রকে আমাদের দেশের মানুষের ভয়ের কোনো কারণ নেই। আমরা সামরিক সরঞ্জাম ক্রয় করি চীন থেকে, আমাদের সবচেয়ে বেশি সাহায্য দেয় জাপান আর আমরা ভয় পাই আমেরিকাকে!
কালের কণ্ঠ : আপনার ভাষ্য মতে বিদেশি রাষ্ট্রদূতরা নিজ নিজ দেশের স্বার্থ রক্ষার জন্য সেখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শতাধিক দেশ ভ্রমণ করেছেন। এই সরকারের আমলে বিদেশে বাংলাদেশের কি নতুন কোনো বাজার তৈরি হয়েছে বলে আপনি মনে করেন?
গোলাম মওলা রনি : পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় শতভাগ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর অধীনে নয়। আমাদের একটি মিশনে অনেক কাজ রয়েছে, যার মধ্যে অনেক বিভাগ কাজ করে। ফলে কাজের সমন্বয় হয় না। আর আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একজন ডাক্তার। ডাক্তারি শিখে তিনি গেলেন যে আমি আর ডাক্তারি করব না, আমি এখন উকালতি করব। এখন তিনি রাজনীতি করতে এসে মন্ত্রী হয়ে গেলেন। মন্ত্রী হয়ে তিনি ১৩৭টি দেশ ভ্রমণ করলেন। যদি প্রতিটি ভ্রমণে পাঁচ দিন করে সময় লাগে, তাহলে কত দিন লাগে (৬৮৫ দিন)?
এখন বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোকে যদি দেশের অর্থনৈতিক বাজার খোঁজার জন্য নিয়োজিত করতে হয় তাহলে দরকার তো তথ্য-উপাত্ত ও গবেষণার। এখন আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কোনো সাহায্যকারী নেই, তাঁর প্রতিমন্ত্রী নেই। সে সময় তিনি পাননি। বাংলাদেশের শুধু মানবসম্পদই নয়, দেশের ব্যাটারি, ওষুধ, গার্মেন্ট পণ্য, চানাচুর, আমাদের সবজি- সব কিছু রপ্তানি করা যায়।
আমাদের দেশের পর্যটনের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। অথচ পর্যটন নামে আমাদের দূতাবাসগুলোতে আলাদা কোনো বিভাগ নেই। কিন্তু যদি আপনি সুযোগ-সুবিধার কথা বিবেচনা করেন তাহলে আমাদের দূতাবাসগুলোতে কিন্তু সুযোগ-সুবিধার অভাব নেই। দরকার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। বিএনপির সময় ৯২ সালে এ ধরনের একটি পরিকল্পনা ছিল। এ জন্য সে সময় বিএনপি ঠিক করল তারা জাপানের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক তৈরি করবে। এ জন্য বিএনপি মোর্শেদ খানকে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত বানিয়ে দিলেন। মোর্শেদ খান অনেক কাজ করলেন। এরপর যখন বিএনপি আবার ক্ষমতায় এলো, মোর্শেদ খানকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বানিয়ে দিলেন। জাপানের সঙ্গে কিন্তু সেই থেকে আমাদের সম্পর্ক ভালো।
বর্তমান সরকার চীন, ভারত, মালেশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করার চেষ্টা করছে। কিন্তু এগুলোর তো ধারাবাহিকতা দরকার। যদি এর পরের সরকার তা না করে তাহলে কিন্তু হলো না।
কালের কণ্ঠ : সরকারের শেষ সময় নুতন মন্ত্রী নিয়োগ দেওয়া হলো। এর মধ্যে কয়েকজনকে ঘিরে বিতর্ক রয়েছে। আপনি এই নতুন মন্ত্রী নিয়োগের বিষয়টি কিভাবে দেখছেন?
গোলাম মওলা রনি : মন্ত্রী নিয়োগের বিষয়টি আসলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিষয়। তাঁর মেধা, যোগ্যতা, তাঁর চিন্তা-চেতনার সঙ্গে মেলে- এসব ভেবেই তিনি নিয়োগ দিয়েছেন। এ ব্যাপারে আসলে আমাদের কারো কিছু বলার নেই। এখানে যদি কোনো সফলতা আসে, সেটাও প্রধানমন্ত্রীর কৃতিত্ব। আর যদি সমাালোচনা আসে, তাহলে সেটাও তাঁর।
যেহেতু সরকারের শেষ সময়, সরকার যে গতিতে আগাচ্ছিল, এই মন্ত্রিসভার পরিবর্তনের কারণে কোনো পরিবর্তন হবে বলে আমি মনে করি না।
কালের কণ্ঠ : এবার আসি বিশ্বব্যাংক ও পদ্মা সেতু প্রকল্পে। আপনি কি মনে করেন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন করবে? এ সরকারের সময়ে কি পদ্মা সেতুর কাজ শুরু হবে?
গোলাম মওলা রনি : বিশ্বব্যাংক নিয়ে আমার তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে। প্রধানমন্ত্রী সংসদে ভাষণে একবার বললেন, পদ্মা সেতু নিজেদের অর্থে করব। আবার বললেন, রেল সেতু বাদ দিয়ে পদ্মা সেতু করব। আমি এ কথাটির জন্য তাঁকে সালাম জানাই। আজ থেকে তিন বছর আগে এ বিষয়ে সংসদে যে মিটিং হয়েছিল, সেখানে বলেছিলাম, বিশ্বব্যাংক এই সরকারের আমলে টাকা দেবে না। পদ্মা সেতু তৈরি তো দূরের কথা, আপনারা একটা খুঁটিও গাড়তে পারবেন না এই সরকারের আমলে। পারলে নিজেদের অর্থায়নে করুন। প্রধানমন্ত্রীকে বোঝান। কারণ যেসব কাগজপত্র আদান-প্রদান হয়েছে, তা পড়ে এটা আমার মনে হয়েছে। সেখানে তৎকালীন সচিব ও যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনও ছিলেন।
এই পদ্মা সেতুটির সঙ্গে যদি রেল সেতু করেন তাহলে ব্যয় দাঁড়াবে ১২ হাজার কোটি টাকা। এই বারো হাজার কোটি থেকে ব্যয় বাড়তে বাড়তে এটা হয়েছে এখন ২৬ হাজার কোটি টাকা। পদ্মা সেতুর যে আট মাস দেরি হলো, তাতে আরো দুই হাজার কোটি টাকা বেড়ে গেছে। আর যদি আপনি শুধু সড়ক সেতু করেন তাহলে আট থেকে দশ হাজার কোটি টাকায় হয়ে যাবে। আমরা ২০ হাজার কোটি বাড়তি খরচ করে রেল সেতু করছি; কিন্তু আগামী ২০ বছরেও কিন্তু রেল চালু করতে পারব না। কারণ রেল চালু করতে হলে রেললাইনের পেছনেসহ অন্যান্য খরচ হবে আরো ৬০ হাজার কোটি টাকা। যেখানে আমরা ২৫-৩০ হাজার কোটি টাকা জোগাড় করতে পারি না, কিভাবে ৬০ হাজার কোটি টাকা জোগাড় করব? ফলে এই রেল সেতুতে তখন আপনাকে বাচ্চাদের খেলনা চালাতে হবে। এটা পড়ে থাকবে।
বিশ্বব্যাংকের ফিরে আসা নিয়ে সরকার ভয়াবহ বিব্রত হবে। বিশ্বব্যাংক দুর্নীতি দমন কমিশনের সঙ্গে বসবে। তারপর বড় বড় কর্তাদের মিডিয়ার সামনে এনে পর্যুদস্ত করবে। দেখবেন তখন সরকারের কাপড়চোপড়ও থাকবে না। তখন না পারবে গিলতে, না পারবে ঠেলতে। তখন যদি সরকার কোনোভাবে কিছু বলে, তাহলে বিশ্বব্যাংক বলবে, দুর্নীতি তদন্তে সহায়তা না করায় আমরা গেলাম।
বিশ্বব্যাংকের খপ্পরে যারা একবার পড়েছে, তাদের সব কিছু গেছে। হয় আপনাকে শেষ করে দেবে, নতুবা একদম কুকুরের মতো মাথা নত করে প্রভুর সামনে থাকবেন। আমরা ভিক্ষুকদের সঙ্গে যেমন আচরণ করি, বিশ্বব্যাংকও আমাদের সঙ্গে সে রকম আচরণ করে।
কোটি কোটি মাথাকে বিকিয়ে দিয়ে আমাদের পদ্মা সেতু দরকার কি না, তা ভাবতে হবে।
চুয়াত্তর সালে বিশ্বব্যাংক ও আমেরিকার কবলে পড়ে কিন্তু দুর্ভিক্ষ হয়েছিল বাংলাদেশে। আমরা আবার সেদিকে যাচ্ছি।
কালের কণ্ঠ : আপনাদের আমলে শেয়ার, ডেসটিনি, হলমার্ক কেলেঙ্কারির মতো ঘটনা ঘটছে। আপনারা মূলত তরুণদের ভোটে ক্ষমতায় এসেছেন। এই তরুণদের জন্য আগামী নির্বাচনে কী বলবেন?
গোলাম মওলা রনি : শেয়ার মার্কেট, হলমার্ক কেলেঙ্কারির মতো ঘটনায় সবাই হতবাক হয়েছে। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে আমরা তরুণদের ভোটের কারণে বিশাল ব্যবধানে জয় পেয়েছি। এই কেলেঙ্কারির জন্য আমাদের সামাজিক যে অবিচার, এটা তারই বহিঃপ্রকাশ। তবে সরকার চেষ্টা করছে। হলমার্ক যে ঘটনাটি ঘটিয়েছে তা কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে চলেছে। মিডিয়া এই দুর্নীতির বিষয়টি ফাঁস করে দিয়েছে। সরকারদলীয় যেসব লোকের নাম আসছে, সরকারের উচিত তাঁদের কোনো ছাড় না দেওয়া। জাতীয়ভাবে তরুণ ভোটারদের কী বলা হবে, সে বিষয়ে হয়তো মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও নির্বাচন পরিচালনা বোর্ড সিদ্ধান্ত নেবে। কিন্তু আমার এলাকার তরুণ ভোটাররা আমার পক্ষেই আছে। ভোট যার অধীনেই হোক না কেন, আমি সেখান থেকে আগের থেকে বেশি ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়ে আসব।
কালের কণ্ঠ : আপনার কি মনে হয়, সব দল নিয়ে একটি নির্বাচন হবে?
গোলাম মওলা রনি : নির্বাচন এ দেশে হবে। তবে কার অধীনে হবে সে সিদ্ধান্ত দেওয়ার মতো সময় এখনো আসেনি। এই মুহূর্তে রাজনীতিবিদদের বক্তব্য শুনে বলা যাবে না, রাজনীতি কোথায় যাচ্ছে। রাজনীতি কোথায় যাচ্ছে এর জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে আগামী বছরের এপ্রিল পর্যন্ত।
কালের কণ্ঠ : সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
গোলাম মওলা রনি : আপনাকে ও কালের কণ্ঠ পরিবারকেও ধন্যবাদ।
No comments