এ অধিবেশনে যোগ না দিলেও এমপি পদ যাচ্ছে না বিরোধী দলের by নাজনীন আখতার
এ অধিবেশনেও নিরাপদ বিএনপি। সংসদের চলতি চতুর্থ অধিবেশনে যোগ না দিলেও সংসদ সদস্যপদ হারাচ্ছে না বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিরোধী দলের কোন সাংসদ। তবে পদ ধরে রাখতে হলে আগামী পঞ্চম অধিবেশনের মেয়াদ নূ্যনতম ১৩ কার্যদিবস হলেও সংসদে যোগ দিতে হবে বিএনপিকে।
নিয়ম অনুযায়ী কোন সংসদ সদস্য অধিবেশনের টানা ৯০ কার্যদিবস অনুপস্থিত থাকলে তাঁর সংসদ সদস্যপদ খারিজ হয়ে যাবে। ফলে ইতোমধ্যে বিএনপি ঘোষণা দিয়েছে সদস্যপদ ধরে রাখতে ৮৯ কার্যদিবসের দিন অধিবেশনে যোগ দেবে। সে হিসেবে চলতি অধিবেশন নির্ধারিত ১৮ ফেব্রম্নয়ারি পর্যনত্ম পুরো সময় ধরে চললেও সদস্যপদ হারানোর শঙ্কা নেই দলটির। সংসদের চারটি অধিবেশনের ৮৭ কার্যদিবসের মধ্যে বিএনপি টানা ৪৮ কার্যদিবস অনুপস্থিত আছে। তবে বিরোধী দলের কোন কোন সদস্যের ব্যক্তিগত অনুপস্থিতির হার অনেক বেশি। উপনির্বাচনে জয়ী ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার ও ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ শপথ নেয়ার পর দলীয় সিদ্ধানত্মের কারণে একদিনও সংসদে যোগ দেয়ার সুযোগ পাননি।
এদিকে অধিবেশন যোগ দেয়া না দেয়া প্রসঙ্গে সরকার ও বিরোধী দলের পরস্পরকে দোষারোপ চলছে। বিএনপির অভিযোগ সরকারের অসহযোগিতামূলক আচরণ তাদের সংসদ থেকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে। অন্যদিকে সরকারী দল বিরোধী দলের কঠোর সমালোচনা করে বলছে, নানা অজুহাত তৈরি করে সংসদে না ফিরে বিরোধী দল গণতন্ত্র হরণ করছে।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জনগণের বিপুল রায় নিয়ে ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট। ২০০৯ সালের ২৫ জানুয়ারি নবম জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন শুরম্ন হয়। তিনটি অধিবেশনে মোট ৮৬ কার্যদিবস সংসদ চলে। গত ৪ জানুয়ারি শুরম্ন হওয়া সংসদের একটি কার্যদিবস যোগ করলে মোট কার্যদিবস হয় ৮৭টি। ২৫ জানুয়ারি শুরম্ন হওয়া সংসদের প্রথম অধিবেশন চলে ৭ এপ্রিল পর্যনত্ম। কার্যদিবস ছিল মোট ৩৯টি। এর মধ্যে চার দলীয় জোটের সংসদ সদস্যরা ২৩ কার্যদিবস বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। এ সময়ের মধ্যে বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল সামনের সারিতে আসন বাড়ানোসহ বিভিন্ন ইসু্যতে কয়েকদিন সংসদ বর্জন করে। আসন বাড়ানোর ব্যাপারে স্পীকারের আশ্বাসে দলটি সংসদে ফিরে এসে শেষ কার্যদিবস ৭ এপ্রিল পর্যনত্ম সংসদে উপস্থিত থাকে। সেদিন বিরোধী দলের নেতা বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া অধিবেশনে দাঁড়িয়ে দীর্ঘ ভাষণ দেন। শেষ দিন পর্যনত্ম দলটির উপস্থিতির কারণে দলের সংসদ সদস্যদের অনুপস্থিতি গণনা করা হবে দ্বিতীয় অধিবেশন থেকে। গত ৪ জুন শুরম্ন হওয়া বাজেট অধিবেশন শেষ হয় ৯ জুলাই। এ সময়ের ২৫ কার্যবিসের পুরোটাই অনুপস্থিত থাকে বিরোধী দল। অনুপস্থিতি অব্যাহত ছিল তৃতীয় অধিবেশনেও। তৃতীয় অধিবেশন ৭ সেপ্টেম্বর থেকে ৫ নবেম্বর পর্যনত্ম চলে। মোট কার্যদিবস ২২টি। ফলে এ দুই অধিবেশনে বিএনপির টানা অনুপস্থিতি ৪৭ কার্যদিবস। নতুন বছরে ৪ জানুয়ারি শুরম্ন হওয়া চতুর্থ অধিবেশনের প্রথম দিনও যোগ দেয়নি বিএনপি। ফলে অনুপস্থিতি দাঁড়ায় মোট ৪৮ কার্যদিবস। অধিবেশন ১১ জানুয়ারি পর্যনত্ম মুলতবি আছে। ১৮ ফেব্রম্নয়ারি পর্যনত্ম অধিবেশন চলবে বলে সিদ্ধানত্ম নেয়া হয়েছে কার্যোপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে। ছুটির দিন বাদ দিয়ে কোন বিরতি ছাড়া ১১ জানুয়ারি থেকে ১৮ ফেব্রম্নয়ারি পর্যনত্ম সংসদ অধিবেশন চললেও মোট কার্যদিবস হয় ২৯টি। ফলে চতুর্থ অধিবেশনে অনুপস্থিত থাকলে বিএনপি তথা বিরোধী দলের টানা অনুপস্থিতি দাঁড়াবে ৭৭ কার্যদিবসে। তাই এ অধিবেশনে বিএনপি যোগ না দিলেও দলের সংসদ সদস্যদের পদ হারাবার কোন আশঙ্কা নেই। তবে পদ ধরে রাখতে হলে আগামী পঞ্চম অধিবেশনের মেয়াদ নূ্যনতম ১৩ কার্যদিবস হলেও যোগ দিতে হবে বিএনপিকে।
সংশিস্নষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল টানা ৪৮ কার্যদিবস অনুপস্থিত থাকলেও বিরোধী দলের কোন কোন সংসদ সদস্যের অনুপস্থিতির হার আরও অনেক বেশি। চারদলীয় জোটের শরিক বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) একমাত্র সদস্য পার্থ আন্দালিব টানা ৬০ কার্যদিবস সংসদ অধিবেশনে অনুপস্থিত আছেন। ২৯ ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচনে নিজ আসনে পরাজিত বিএনপি নেতা সাবেক স্পীকার ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার ও ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বেগম খালেদা জিয়ার ছেড়ে দেয়া দু'টি আসনে উপনির্বাচনে অংশ নেয়ার সুযোগ পান। গত ২ এপ্রিল অনুষ্ঠিত উপনির্বাচনে বগুড়া-৬ আসন থেকে জমিরউদ্দিন সরকার এবং বগুড়া-৭ আসন থেকে মওদুদ আহমদ নির্বাচিত হন। ৮ এপ্রিল তাঁরা সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নিলেও সংসদে যোগ দিতে পারেননি।
এদিকে সংসদ বর্জন নিয়ে সরকার ও বিরোধী দলের একে অপরকে দোষারোপ চলছেই। সংসদে ফেরার শর্ত হিসেবে ১০ দফা দাবি তুলে ধরেছে বিএনপি। ১০ দফা দাবির মধ্যে রয়েছে_ তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বাড়ির লিজ বাতিলের চিঠি প্রত্যাহার করতে হবে। বেগম খালেদা জিয়ার প্রাপ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। বেগম খালেদা জিয়া, তারেক রহমান, আরাফাত রহমান কোকোসহ বিএনপি নেতাদের বিরম্নদ্ধে সকল মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। বিরোধী দলের সংসদ সদস্যের দেয়া মুলতবি প্রসত্মাব গ্রহণ করে অধিবেশনে আলোচনার সুযোগ দেয়া। টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে আলোচনার সুযোগ দিতে হবে। এশিয়ান হাইওয়ের নামে করিডর দেয়া বন্ধ করতে হবে। আইনশৃঙ্খলার অবনতি, টেন্ডারবাজি, দখল, সরকারী দলের নিপীড়ন নির্যাতন নিয়ে সংসদে আলোচনা করার সুযোগ দিতে হবে। দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতি নিয়ে আলোচনা করতে দিতে হবে। সরকারের দেয়া প্রতিশ্রম্নতি মোতাবেক স্থায়ী কমিটির আরও দু'টি সভাপতির পদ দিতে হবে এবং বিরোধী দলের নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের এলাকায় সংরৰিত আওয়ামী মহিলা সংসদ সদস্যদের যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তা প্রত্যাহার করতে হবে। বিরোধী দলের চীফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারম্নক দলের পৰে ১০ দফা দাবি তুলে ধরার পাশাপাশি সাংবাদিকদের এও জানিয়েছেন, ৮৯ কার্যদিবসের দিন তাঁরা সংসদে যাবেন।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির সংসদ সদস্য শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা সংসদে না গেলেও জনগণের পাশে আছি। তাঁর মতে, বিরোধী দল না থাকায় সংসদ অকার্যকর হয়ে পড়ছে। প্রাণবনত্ম নয়। সরকারী দলের সংসদ সদস্যরা পর্যনত্ম সংসদে অনুপস্থিত থাকেন।
এদিকে বিরোধী দলের সংসদ বর্জন গণতন্ত্রের ভবিষ্যতকে অন্ধকার করে ফেলছে বলে মনে করেন আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা ও অভিজ্ঞ সংসদ সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, আমরা অনেক দুর্ভাগা জাতি। সংসদীয় গণতন্ত্রের জন্য প্রতিশ্রম্নতিবদ্ধ হয়েও আমরা এর সঠিক চর্চা করি না। চর্চা করতে গিয়ে গণতন্ত্রের বিপৰে অবস্থান নেই। গণতন্ত্রের নীতির বিরম্নদ্ধে চলে যাই। এ সংস্কৃতি থেকে বের হতে না পারলে যতই দিন যাবে ততই অন্ধকার বাড়বে। ততই কলঙ্কজনক অধ্যায় তৈরি হবে। বিরোধী দল সংসদে না গিয়ে সংবিধান লঙ্ঘন করছে, গণতন্ত্রকে হরণ করছে, জনগণের রায় উপেৰা করছে। আমি সেই দিনের অপেৰায় আছি যেদিন জনগণ এ ধরনের কর্মকা-ের জন্য তাদের উপেৰা করবে। ভোটের মাধ্যমে পরাজিত করবে।
No comments