রঙ্গব্যঙ্গ-হলমার্ক by মোস্তফা কামাল
ইদানীং একটা প্রচলন বেশ লক্ষ করা যাচ্ছে। ব্যবসা মানেই গ্রুপ কম্পানি হতে হবে। তা না হলে কিসের ব্যবসায়ী? আলু-পটলের ব্যবসা করলেও তার একটা কম্পানি থাকা চাই। এর সঙ্গে আরো দুটি ভুয়া কম্পানির রেজিস্ট্রেশন নিয়ে গ্রুপ কম্পানির চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দৃষ্টিনন্দন ভিজিটিং কার্ডের ভাবসাবই আলাদা।
ঢাকা শহরে পথ চলতেই নানা গ্রুপের বড় বড় সাইনবোর্ড চোখে পড়ে। এ রকমই হঠাৎ গজিয়ে ওঠা একটি গ্রুপ কম্পানি হলো হলমার্ক। এই গ্রুপের এমডি হচ্ছেন তানভীর মাহমুদ। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দরিদ্র পরিবারের সন্তান। কিন্তু আলাদিনের চেরাগ পাওয়ার মতো সোনালী ব্যাংক থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকা লোন পেয়ে তিনি হঠাৎ বড়লোক হয়ে যান। তাঁর বড়লোক হয়ে ওঠার কাহিনীটি তাঁর কাছ থেকেই শোনা যাক! প্রিয় পাঠক, প্রশ্ন-উত্তরের মধ্য দিয়ে এবার তানভীর সাহেবের কাল্পনিক কথাবার্তা উপস্থাপন করা হলো।
প্রশ্ন : তানভীর সাহেব, ঢাকা শহরে হলমার্কের কিছু দোকান দেখি, কার্ডটার্ড বিক্রি করে! সেটাই তো আপনার, নাকি?
উত্তর : না না! কী যে বলেন! আপনি আমাকে এত ছোট ভাবছেন কেন? আমি অনেক বড় ব্যবসায়ী। আমি কত বড় তা আপনি চিন্তাও করতে পারবেন না। হলমার্ক হচ্ছে এ দেশের একটি বড় ব্যবসায়ী গ্রুপ।
প্রশ্ন : কিন্তু কোনো দিন তো এই কম্পানির নামগন্ধও শুনিনি।
উত্তর : নাম শোনেননি! না শুনলে সেটা আপনার ব্যর্থতা। তাই বলে তো আর আমরা ছোট না!
প্রশ্ন : ঠিক বলেছেন। আচ্ছা, আপনার গ্রুপে কতটি কম্পানি আছে?
উত্তর : হিসাব নাই। ৫০-৬০টি হবে।
প্রশ্ন : বলেন কী! সবই কি লাভজনক?
উত্তর : জি জি, ১০০%।
প্রশ্ন : আপনার মূলত কী ধরনের ব্যবসা?
উত্তর : নানা রকম ব্যবসা, বুঝলেন! সব কিছু কি আর মনে রাখা যায়!
প্রশ্ন : সোনালী ব্যাংক থেকে এত টাকা লোন নিয়ে কী করলেন?
উত্তর : নিলাম আর কি! অনেক বড় পরিকল্পনা নিয়ে নামছি।
প্রশ্ন : এত টাকা লোন কিভাবে নিলেন?
উত্তর : কী যে বলেন! আমার মতো ব্যবসায়ীকে লোন দেওয়ার জন্য ব্যাংক হাঁ করে বসে থাকে। তা ছাড়া আমাদের লোকজন আছে না?
প্রশ্ন : লোকজন!
উত্তর : না মানে, ব্যবসা যখন করি ওপর মহলের সঙ্গে হাত তো রাখতেই হয়! আরে ভাই, আমাদের আত্মীয়স্বজনও তো আছে, নাকি!
প্রশ্ন : শুনেছি, লোন নিতে হলে জমি মর্টগেজ রাখতে হয়। আপনি কী করেছেন?
উত্তর : জমিই যদি মর্টগেজ দেব তাহলে আর লোক ধরব কেন? তবে কিছু ভুয়া জমির কাগজপত্র জমা দিয়েছি, বুঝলেন!
প্রশ্ন : লোনের টাকা কোন খাতে ব্যয় করলেন?
উত্তর : ব্যক্তিগত উন্নয়ন খাত!
প্রশ্ন : বলেন কী! আপনার নাকি বড় প্রজেক্ট করার কথা!
উত্তর : কাছে আসেন। কানে কানে বলি। সব কথা তো আর সবাইকে বলা যায় না! লোনের টাকা দিয়ে নিজের ও স্ত্রীর নামে জমি কিনেছি। দামি কয়েকটা গাড়ি কিনেছি। গ্রামে সুরম্য একটি বাড়ি বানিয়েছি। আর কিছু টাকা ওপরে দিতে হয়েছে। এবার বুঝলেন তো!
প্রশ্ন : ওপরে মানে!
উত্তর : যাঁরা তদবির করে আমার লোন অনুমোদন করিয়েছেন। বাহ রে! তাঁদের দিতে হবে না? তাঁরা এমনি এমনি কেন করবেন?
প্রশ্ন : আচ্ছা, আপনার উত্থানের পেছনে কার ভূমিকা ছিল বা আছে বলেন তো!
উত্তর : আমার বাবা নূরুল ইসলাম কালু মিয়ার।
প্রশ্ন : তিনি কী করেন?
উত্তর : কৃষিজমি দেখাশোনা করেন। তিনি জমি বিক্রি করে আমাকে ব্যবসার জন্য কিছু টাকা দিয়েছিলেন। সেই টাকা নিয়ে আমি ঢাকায় চলে আসি।
প্রশ্ন : কত বছর আগে?
উত্তর : এই পাঁচ-সাত বছর হবে।
প্রশ্ন : বলেন কী!
উত্তর : জি জি, বাবা তখন ঢাকায় না পাঠালে আমি এত বড় ব্যবসায়ী হতে পারতাম না।
প্রশ্ন : ঢাকায় এসে কী করলেন?
উত্তর : সে অনেক কথা। সেটা নাই বা শুনলেন। তবে অনেক কষ্ট করেছি। ব্যাংকপাড়ায় ঘুরে ঘুরে পায়ের স্যান্ডেল ক্ষয় করেছি। ঘুরতে ঘুরতেই একটা লাইন পেয়ে গেলাম। আমার নামে শত শত একর জমির ভুয়া দলিল বানিয়ে ব্যাংকের কাছে লোন চাইলাম। সংশ্লিষ্ট কিছু কর্মকর্তাকে ২০% ঘুষ অফার করলাম। ব্যস, কাজ হয়ে গেল। তারপর টুকটাক ব্যবসা।
প্রশ্ন : কিসের ব্যবসা?
উত্তর : এত প্রশ্ন করেন কেন? আপনি শুনতে থাকেন।
প্রশ্ন : আচ্ছা, আচ্ছা...
উত্তর : আমার মূল ব্যবসা আসলে ব্যাংক লোন। কী করে লোন বাগানো যায় সেটাই ছিল আমার একমাত্র ব্রত। একটা সময় ছিল, ব্যাংক থেকে এক লাখ টাকা লোন নিতে হলেও জমি মর্টগেজ রাখতে হতো। কী আর করা! ভুয়া দলিল বানিয়ে শত শত একর জমির মালিক হয়ে গেলাম! এরপর যে ব্যাংকেই দরখাস্ত করি, সেই বলে, নাও কত লাগবে?
এই করে করেই হলমার্ক গ্রুপের এমডি হয়ে গেলাম। আপনি লোন নিতে যান, পাবেন না। আপনাকে হাইকোর্ট দেখাবে। বুঝতে পারছেন?
প্রশ্ন : হুম। কিন্তু ধরা তো খেতে হলো! এখন কী করবেন?
উত্তর : ম্যানেজ করে ফেলব।
প্রশ্ন: কী করে ম্যানেজ করবেন?
উত্তর : কিছুদিন পর দেখবেন, এটা মাটিচাপা পড়ে যাবে। অন্য একটা ইস্যু উঠে আসবে।
প্রশ্ন : যদি তা সম্ভব না হয়?
উত্তর : তাহলে অন্য ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে পরিশোধ করে দেব!
প্রশ্ন : আপনার সব তথ্য তো ফাঁস হয়ে গেল! এখন অন্য ব্যাংক লোন দেবে?
উত্তর : দেবে না আবার! অবশ্যই দেবে। এমন টোপ দেব, লোন না দিয়ে যাবে কোথায়!
প্রশ্নকর্তা বিস্ময়ের দৃষ্টিতে লোকটির দিকে তাকিয়ে রইলেন।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
প্রশ্ন : তানভীর সাহেব, ঢাকা শহরে হলমার্কের কিছু দোকান দেখি, কার্ডটার্ড বিক্রি করে! সেটাই তো আপনার, নাকি?
উত্তর : না না! কী যে বলেন! আপনি আমাকে এত ছোট ভাবছেন কেন? আমি অনেক বড় ব্যবসায়ী। আমি কত বড় তা আপনি চিন্তাও করতে পারবেন না। হলমার্ক হচ্ছে এ দেশের একটি বড় ব্যবসায়ী গ্রুপ।
প্রশ্ন : কিন্তু কোনো দিন তো এই কম্পানির নামগন্ধও শুনিনি।
উত্তর : নাম শোনেননি! না শুনলে সেটা আপনার ব্যর্থতা। তাই বলে তো আর আমরা ছোট না!
প্রশ্ন : ঠিক বলেছেন। আচ্ছা, আপনার গ্রুপে কতটি কম্পানি আছে?
উত্তর : হিসাব নাই। ৫০-৬০টি হবে।
প্রশ্ন : বলেন কী! সবই কি লাভজনক?
উত্তর : জি জি, ১০০%।
প্রশ্ন : আপনার মূলত কী ধরনের ব্যবসা?
উত্তর : নানা রকম ব্যবসা, বুঝলেন! সব কিছু কি আর মনে রাখা যায়!
প্রশ্ন : সোনালী ব্যাংক থেকে এত টাকা লোন নিয়ে কী করলেন?
উত্তর : নিলাম আর কি! অনেক বড় পরিকল্পনা নিয়ে নামছি।
প্রশ্ন : এত টাকা লোন কিভাবে নিলেন?
উত্তর : কী যে বলেন! আমার মতো ব্যবসায়ীকে লোন দেওয়ার জন্য ব্যাংক হাঁ করে বসে থাকে। তা ছাড়া আমাদের লোকজন আছে না?
প্রশ্ন : লোকজন!
উত্তর : না মানে, ব্যবসা যখন করি ওপর মহলের সঙ্গে হাত তো রাখতেই হয়! আরে ভাই, আমাদের আত্মীয়স্বজনও তো আছে, নাকি!
প্রশ্ন : শুনেছি, লোন নিতে হলে জমি মর্টগেজ রাখতে হয়। আপনি কী করেছেন?
উত্তর : জমিই যদি মর্টগেজ দেব তাহলে আর লোক ধরব কেন? তবে কিছু ভুয়া জমির কাগজপত্র জমা দিয়েছি, বুঝলেন!
প্রশ্ন : লোনের টাকা কোন খাতে ব্যয় করলেন?
উত্তর : ব্যক্তিগত উন্নয়ন খাত!
প্রশ্ন : বলেন কী! আপনার নাকি বড় প্রজেক্ট করার কথা!
উত্তর : কাছে আসেন। কানে কানে বলি। সব কথা তো আর সবাইকে বলা যায় না! লোনের টাকা দিয়ে নিজের ও স্ত্রীর নামে জমি কিনেছি। দামি কয়েকটা গাড়ি কিনেছি। গ্রামে সুরম্য একটি বাড়ি বানিয়েছি। আর কিছু টাকা ওপরে দিতে হয়েছে। এবার বুঝলেন তো!
প্রশ্ন : ওপরে মানে!
উত্তর : যাঁরা তদবির করে আমার লোন অনুমোদন করিয়েছেন। বাহ রে! তাঁদের দিতে হবে না? তাঁরা এমনি এমনি কেন করবেন?
প্রশ্ন : আচ্ছা, আপনার উত্থানের পেছনে কার ভূমিকা ছিল বা আছে বলেন তো!
উত্তর : আমার বাবা নূরুল ইসলাম কালু মিয়ার।
প্রশ্ন : তিনি কী করেন?
উত্তর : কৃষিজমি দেখাশোনা করেন। তিনি জমি বিক্রি করে আমাকে ব্যবসার জন্য কিছু টাকা দিয়েছিলেন। সেই টাকা নিয়ে আমি ঢাকায় চলে আসি।
প্রশ্ন : কত বছর আগে?
উত্তর : এই পাঁচ-সাত বছর হবে।
প্রশ্ন : বলেন কী!
উত্তর : জি জি, বাবা তখন ঢাকায় না পাঠালে আমি এত বড় ব্যবসায়ী হতে পারতাম না।
প্রশ্ন : ঢাকায় এসে কী করলেন?
উত্তর : সে অনেক কথা। সেটা নাই বা শুনলেন। তবে অনেক কষ্ট করেছি। ব্যাংকপাড়ায় ঘুরে ঘুরে পায়ের স্যান্ডেল ক্ষয় করেছি। ঘুরতে ঘুরতেই একটা লাইন পেয়ে গেলাম। আমার নামে শত শত একর জমির ভুয়া দলিল বানিয়ে ব্যাংকের কাছে লোন চাইলাম। সংশ্লিষ্ট কিছু কর্মকর্তাকে ২০% ঘুষ অফার করলাম। ব্যস, কাজ হয়ে গেল। তারপর টুকটাক ব্যবসা।
প্রশ্ন : কিসের ব্যবসা?
উত্তর : এত প্রশ্ন করেন কেন? আপনি শুনতে থাকেন।
প্রশ্ন : আচ্ছা, আচ্ছা...
উত্তর : আমার মূল ব্যবসা আসলে ব্যাংক লোন। কী করে লোন বাগানো যায় সেটাই ছিল আমার একমাত্র ব্রত। একটা সময় ছিল, ব্যাংক থেকে এক লাখ টাকা লোন নিতে হলেও জমি মর্টগেজ রাখতে হতো। কী আর করা! ভুয়া দলিল বানিয়ে শত শত একর জমির মালিক হয়ে গেলাম! এরপর যে ব্যাংকেই দরখাস্ত করি, সেই বলে, নাও কত লাগবে?
এই করে করেই হলমার্ক গ্রুপের এমডি হয়ে গেলাম। আপনি লোন নিতে যান, পাবেন না। আপনাকে হাইকোর্ট দেখাবে। বুঝতে পারছেন?
প্রশ্ন : হুম। কিন্তু ধরা তো খেতে হলো! এখন কী করবেন?
উত্তর : ম্যানেজ করে ফেলব।
প্রশ্ন: কী করে ম্যানেজ করবেন?
উত্তর : কিছুদিন পর দেখবেন, এটা মাটিচাপা পড়ে যাবে। অন্য একটা ইস্যু উঠে আসবে।
প্রশ্ন : যদি তা সম্ভব না হয়?
উত্তর : তাহলে অন্য ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে পরিশোধ করে দেব!
প্রশ্ন : আপনার সব তথ্য তো ফাঁস হয়ে গেল! এখন অন্য ব্যাংক লোন দেবে?
উত্তর : দেবে না আবার! অবশ্যই দেবে। এমন টোপ দেব, লোন না দিয়ে যাবে কোথায়!
প্রশ্নকর্তা বিস্ময়ের দৃষ্টিতে লোকটির দিকে তাকিয়ে রইলেন।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
No comments