সময়ের কথা-দান-অনুদান-প্রতিদান by অজয় দাশগুপ্ত
অর্থমন্ত্রী হলমার্কের সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা ঋণকে বড় করে দেখেন না, কিন্তু শিক্ষকদের জন্য বছরে এক হাজার কোটি টাকা বাড়তি ব্যয়কে 'মস্ত বড় বোঝা' মনে করেন। সরকার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকদের বেতন-ভাতা কতটা বাড়াতে পারবে, সেটা বড় প্রশ্ন।
বর্তমানে একজন শিক্ষক বিএ-এমএ পাস করার পর বিএড-এমএড ট্রেনিং নিয়ে স্কুলে ১৫-২০ বছর 'মাস্টারি' করেও মাসে ১৫ হাজার টাকার বেশি বেতন পান না। সরকারি অফিসের পিয়ন-দারোয়ানরাও চাকরি জীবনের শেষ পর্যায়ে এ পরিমাণ বেতন পান। এ অবস্থায় কেন মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা স্কুলে পড়ানোর চাকরি নিতে আগ্রহী হবে?
হলমার্ক_ এমন আলোচিত শব্দ বোধকরি বাংলাদেশ বহুদিন পায়নি। সংবাদপত্র, বেতার ও টেলিভিশনের খবর ও প্রতিবেদন-আলোচনায় কেবলই হলমার্ক। বাংলা একাডেমীর ইংরেজি-বাংলা অভিধানে 'হল-মার্ক' শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ দেওয়া আছে এভাবে_ অলঙ্কারাদিতে ব্যবহৃত সোনা ও রূপার গুণগত মান নির্দেশক ছাপ।
হলমার্ক গ্রুপ কি এটা ভেবেই তাদের প্রতিষ্ঠানের নাম রেখেছিল? তারা বলতেই পারে_ 'গুণগত উন্নত মান' দেখাতে না পারলে কি সরকার পরিচালিত সোনালী ব্যাংক তাদের উপযুক্ত জামানত না রেখেই সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ দিয়েছে?
সত্তরের দশকের শেষ দিকে বাংলাদেশে সরকার পরিচালিত শিল্পঋণ সংস্থা (বিএসআরএস নামেও পরিচিত ছিল) শিল্প স্থাপনের জন্য অনেক প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিয়েছে। তখন কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া ওই ব্যাংকের ঋণ পর্যালোচনা করে সংবাদপত্রে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিলাম। তাতে বলতে চেয়েছি যে, বাংলাদেশের অনেক ধনবান ব্যক্তি যেমন দাবি করেন তারা গায়ের রক্ত জল করে এবং গাঁটের পয়সা খরচ করে শিল্প-কারখানা গড়ে তুলছেন_ প্রকৃতপক্ষে সব ক্ষেত্রে সেটা ঠিক নয়। শিল্পঋণ সংস্থা থেকে দেওয়া ঋণের চিত্রে দেখা যায়, বেশ কিছু শিল্প স্থাপনের জন্য এ প্রতিষ্ঠানটি উদ্যোক্তাদের মোট ব্যয়ের নব্বই-পঁচানব্বই শতাংশ পর্যন্ত ঋণ দিয়েছে। অর্থাৎ শিল্পটি স্থাপনের জন্য এক কোটি টাকা ব্যয় হলে তার মধ্যে ৯০-৯৫ লাখ টাকাই দিয়েছে ব্যাংক। উদ্যোক্তারা যে পাঁচ-দশ শতাংশ নিজের অর্থ বলে দাবি করছেন তাতেও রয়েছে বিস্তর ফাঁকফোকর। কারণ 'মালিকরা' তার যে জমির দাম বলেছেন পাঁচ লাখ টাকা_ বাস্তবে তা কেনা আরও কম দামে (ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর আগে জমির দাম এখনকার মতো চড়া ছিল না)। তদুপরি যে মেশিন কেনার জন্য এক কোটি টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে, বাস্তবে তার দাম হয়তো ৫০-৬০ লাখ টাকা। এভাবে হিসাবের কারচুপিতে কিছু লোক যে প্রতিষ্ঠানের মালিক হয়েছে তার প্রকৃত বাজার দর ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের তুলনায় অনেক কম। কৈ মাছের তেলে কৈ মাছ ভাজা_ এ প্রবাদ বাংলাদেশে হার মেনেছে লুটেরা ধনীদের প্রতি সরকারি ব্যাংকের পৃষ্ঠপোষকতায়!
হলমার্ক এখন বলতেই পারে, তিন দশক আগে 'বাংলাদেশের উদ্যোক্তোরা যে পথ দেখিয়ে গেছেন' আমরা সে পথেই চলেছি। ইঁদুর ধরার কল বসালে সবার জন্যই বসাতে হবে। আর এটা করা যে খুবই কঠিন সেটা তারা ভালো করেই জানেন। কারণ এটা করতে গেলে দেশের তাবৎ ধনীরা একজোট হয়ে মাঠে নেমে পড়বেন। হলমার্ক গ্রুপের কর্মীরা যে শুক্রবার ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করে যানবাহন চলাচল দীর্ঘ সময় বন্ধ রেখেছিল, সেটা তাদের একটি কৌশল মাত্র। তাদের ঝুলিতে আরও অনেক মতলব থাকতে পারে। ড. ফরাসউদ্দিন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর থাকাকালে একটি বড় ঋণখেলাপি গোষ্ঠীকে ঋণ পরিশোধের জন্য চাপ সৃষ্টি করলে তার প্রধান কর্ণধার এভাবেই হুমকি দিয়েছিলেন_ 'আমি যে ৩০ হাজার লোকের চাকরি দিয়েছি তারা বাংলাদেশ ব্যাংক ঘেরাও করলে মজা টের পাবেন।'
বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের একাধিক সংগঠন ৮ সেপ্টেম্বর শনিবার থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে টানা এক সপ্তাহের ধর্মঘট ডেকেছে। দাবি না মানলে শিক্ষকরা আরও বড় আন্দোলন করবেন_ এমন হুমকি দেওয়া আছে। যে কারণে ধর্মঘট_ বেসরকারি স্কুল-কলেজের প্রধান শিক্ষক, প্রিন্সিপাল থেকে শুরু করে সব পর্যায়ের শিক্ষক-কর্মচারীদের মাত্র ১০০ টাকা বাড়িভাড়া, ১৫০ টাকা মেডিকেল ভাতা, এক মাসের বেতনের এক-চতুর্থাংশ উৎসব ভাতা এবং পুরো চাকরিজীবনে একটি মাত্র ইনক্রিমেন্ট ও টাইম স্কেল প্রদানের অমানবিক ব্যবস্থার অবসান। শর্ত পূরণ হওয়া সত্ত্বেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তি না হওয়া, নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের নিয়োগপ্রাপ্তির পর মাসের পর মাস বেতন বন্ধ থাকা, অবসরের পর অবসর ভাতার নামে যৎসামান্য যা প্রদান করা হয় তা দুই-তিন বছরের মধ্যে না পাওয়া_ এসব সমস্যাকেও সামনে আনা হয়েছে। এসব সমস্যা নিয়ে শিক্ষকদের ক্ষোভ দীর্ঘদিনের। এই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশই হচ্ছে শিক্ষক ধর্মঘট, শিক্ষক আন্দোলন।
শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ফুটপাতে এক রাত থাকতে হলে মাস্তানদের ১০০ টাকা না দিলে ফুটপাতেও থাকা যায় না। একই প্রশ্ন উৎসব ভাতা ও চিকিৎসা ভাতা সম্পর্কেও। তাহলে শিক্ষকদের ১০০ টাকা বাড়িভাড়া, ১৫০ টাকা মেডিকেল ও মাসিক বেতনের এক-চতুর্থাংশ উৎসব ভাতা হিসেবে দিয়ে অসম্মান করা কেন?
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত হলমার্কের ঋণের অঙ্ক নিয়ে হৈচৈ করা পছন্দ করছেন না। সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা ঋণকে তিনি 'বড় অঙ্ক' বলতেও নারাজ। এ নিয়ে তিনি যে মন্তব্য প্রকাশ্যে করেছেন সেটাকে অনেকে পছন্দ করছে না। এমনকি জাতীয় সংসদে সরকারদলীয় সিনিয়র-জুনিয়র সদস্যরাও তার সমালোচনা করেছেন। এখন বেসরকারি স্কুলগুলোর হাজার হাজার শিক্ষক বলতেই পারেন যে, হলমার্কের সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা যদি সরকারের জন্য বড় অঙ্কের অর্থ না হয়, তাহলে এর চেয়ে ঢের কম অঙ্কের অর্থ ব্যয় করে শিক্ষকদের দাবি কেন মানছেন না?
শিক্ষকদের কাছে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় বিঘ্নকারী ধর্মঘট, কর্মবিরতি মোটেই কাম্য নয়; বিশেষ করে যখন সামনে পঞ্চম শ্রেণীর সমাপনী, অষ্টম শ্রেণীর জেএসসি, দশম শ্রেণীর টেস্ট এবং অন্যান্য শ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষা। রমজান ও ঈদ উৎসবের পর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলেছে ২৭ আগস্ট। এ পর্যায়ে এ ধর্মঘট অবশ্যই কাম্য ছিল না। শিক্ষকরা মনে করেন, এ পরিস্থিতির জন্য দায়ী পূর্বাপর সব সরকারের উদাসীনতা ও তাচ্ছিল্যের মনোভাব। অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, আন্দোলনরত শিক্ষকদের প্রতি কটাক্ষ, দায়িত্বজ্ঞানহীন উক্তি আন্দোলনকে দীর্ঘায়িত করেছে। অর্থমন্ত্রী হলমার্কের সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা ঋণকে বড় করে দেখেন না, কিন্তু শিক্ষকদের জন্য বছরে এক হাজার কোটি টাকা বাড়তি ব্যয়কে 'মস্ত বড় বোঝা' মনে করেন।
সরকার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকদের বেতন-ভাতা কতটা বাড়াতে পারবে, সেটা বড় প্রশ্ন। বর্তমানে একজন শিক্ষক বিএ-এমএ পাস করার পর বিএড-এমএড ট্রেনিং নিয়ে স্কুলে ১৫-২০ বছর 'মাস্টারি' করেও মাসে ১৫ হাজার টাকার বেশি বেতন পান না। সরকারি অফিসের পিয়ন-দারোয়ানরাও চাকরি জীবনের শেষ পর্যায়ে এ পরিমাণ বেতন পান। এ অবস্থায় কেন মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা স্কুলে পড়ানোর চাকরি নিতে আগ্রহী হবে? অনেকের মতো আমিও মনে করি, স্কুল শিক্ষকদের বেতন বর্তমানে মাসে ২৫-৩০ হাজার টাকা হলেই কেবল এমএ-এমকম-এমএসসিতে ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া ছাত্রছাত্রীরা 'মাস্টার' হতে চাইবে। কিন্তু সরকারের কি এত বেতন দেওয়ার ক্ষমতা আছে? এর সঙ্গে আরও একটি প্রশ্ন_ বর্তমানে শিক্ষকরা চাকরির শুরুতে ৭-৮ হাজার টাকা মাসে পান এবং এই চাকরি পেতেই তাদের ম্যানেজিং কমিটিকে লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়। মাসে বেতন ২৫ হাজার টাকা হলে ঘুষের অঙ্ক তো ৫ লাখ টাকা হয়ে যাবে। তখন ম্যানেজিং কমিটির সদস্য হতে ঘুষ-তদবির হবে আরও অনেক ব্যাপক মাত্রায়। যে দল দেশের ক্ষমতায় থাকবে তার এমপিদের বাজার হবে দারুণ রমরমা।
একেবারে ঠিক কথা। শিক্ষার প্রসার ও মান বাড়াতে হলে ম্যানেজিং কমিটির প্রতি অবশ্যই মনোযোগ দিতে হবে। 'গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত' ম্যানেজিং কমিটি শিক্ষার যে কতটা সর্বনাশ করছে তার অনুসন্ধান বিভিন্ন সময়ে হয়েছে। কিন্তু 'হলমার্ক কেলেঙ্কারি' যেমন সরকারের যথাযথ মনোযোগ পায় না, তেমনি উপেক্ষিত থাকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটি। সরকারি দলের এমপি এবং তাদের ঘনিষ্ঠজনরা নন্দলালের মতোই পণ করে আছেন_ শিক্ষার বারোটা না বাজিয়ে তারা ক্ষান্ত হবেন না।
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের কয়েক কোটি ছাত্রছাত্রীকে বিনামূল্যে বই প্রদান (এবং সময়মতো সেটা তাদের হাতে পেঁৗছানো) অবশ্যই বড় অর্জন। আমাদের মতো স্বল্পোন্নত কোনো দেশের এ ধরনের সাফল্য আছে কি-না আমার জানা নেই। কিন্তু একইসঙ্গে এ প্রশ্নও করব যে_ যে ছাত্র বা ছাত্রী পারিবারিক গাড়ি করে স্কুলে আসে, তাকে কেন বিনামূল্যে বই দেওয়া হবে? যে ধনবান পরিবারের সন্তান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম কিংবা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার জন্য ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় তাকে নামমাত্র বেতনে পড়ার সুযোগ প্রদানের যুক্তি কোথায়?
শিক্ষার জন্য সরকারের বিনিয়োগের অবশ্যই প্রয়োজন রয়েছে। সরকার যদি ধনবান শ্রেণীকে 'নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য' রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে অকাতরে ঋণ দিতে পারে (ফেরত না পাওয়ার সমূহ আশঙ্কা সত্ত্বেও) তাহলে শিক্ষার মতো লাভজনক মানবিক বিনিয়োগ খাতে কেন অর্থ ব্যয় করতে দ্বিধা করবে? এ প্রশ্নের অবশ্যই যৌক্তিকতা রয়েছে। তারপরও বলব, শিক্ষা খাতের সরকারি ব্যয় বাড়ানোর পাশাপাশি বেসরকারি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের দান-অনুদান আরও বাড়ানোর বিষয়টি গভীর বিবেচনায় নিতেই হবে। ম্যানেজিং কমিটির দুর্নীতি-অনিয়ম কমিয়ে আনতে পারা এ দান-অনুদান পাওয়ার অপরিহার্য শর্ত_ এটা কোনোভাবেই ভুললে চলবে না। আমাদের এ ভূখণ্ডে ব্যক্তিগত দানে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল। তারা জমি দিয়েছেন, ভবন নির্মাণে অর্থ দিয়েছেন। এখনও অনেকে সেটা করছেন এবং আরও করায় আগ্রহ রয়েছে। অর্থ সৎভাবে ব্যয় হবে, এটা নিশ্চিত করা গেলে দলে দলে ভালো মানুষ এগিয়ে আসবে, তাতে সন্দেহ নেই।
একটি বিষয় লক্ষ্য করার মতো_ স্কুলের শিক্ষকরা রাজপথে ক্লাসে তালা দিয়ে, কিন্তু ছাত্র সংগঠনগুলো নীরব। তারা এভাবেই নিজেদের ট্র্যাকের বাইরে নিয়ে গেছে।
অজয় দাশগুপ্ত :সাংবাদিক
ajoydg@gmail.com
হলমার্ক_ এমন আলোচিত শব্দ বোধকরি বাংলাদেশ বহুদিন পায়নি। সংবাদপত্র, বেতার ও টেলিভিশনের খবর ও প্রতিবেদন-আলোচনায় কেবলই হলমার্ক। বাংলা একাডেমীর ইংরেজি-বাংলা অভিধানে 'হল-মার্ক' শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ দেওয়া আছে এভাবে_ অলঙ্কারাদিতে ব্যবহৃত সোনা ও রূপার গুণগত মান নির্দেশক ছাপ।
হলমার্ক গ্রুপ কি এটা ভেবেই তাদের প্রতিষ্ঠানের নাম রেখেছিল? তারা বলতেই পারে_ 'গুণগত উন্নত মান' দেখাতে না পারলে কি সরকার পরিচালিত সোনালী ব্যাংক তাদের উপযুক্ত জামানত না রেখেই সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ দিয়েছে?
সত্তরের দশকের শেষ দিকে বাংলাদেশে সরকার পরিচালিত শিল্পঋণ সংস্থা (বিএসআরএস নামেও পরিচিত ছিল) শিল্প স্থাপনের জন্য অনেক প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিয়েছে। তখন কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া ওই ব্যাংকের ঋণ পর্যালোচনা করে সংবাদপত্রে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিলাম। তাতে বলতে চেয়েছি যে, বাংলাদেশের অনেক ধনবান ব্যক্তি যেমন দাবি করেন তারা গায়ের রক্ত জল করে এবং গাঁটের পয়সা খরচ করে শিল্প-কারখানা গড়ে তুলছেন_ প্রকৃতপক্ষে সব ক্ষেত্রে সেটা ঠিক নয়। শিল্পঋণ সংস্থা থেকে দেওয়া ঋণের চিত্রে দেখা যায়, বেশ কিছু শিল্প স্থাপনের জন্য এ প্রতিষ্ঠানটি উদ্যোক্তাদের মোট ব্যয়ের নব্বই-পঁচানব্বই শতাংশ পর্যন্ত ঋণ দিয়েছে। অর্থাৎ শিল্পটি স্থাপনের জন্য এক কোটি টাকা ব্যয় হলে তার মধ্যে ৯০-৯৫ লাখ টাকাই দিয়েছে ব্যাংক। উদ্যোক্তারা যে পাঁচ-দশ শতাংশ নিজের অর্থ বলে দাবি করছেন তাতেও রয়েছে বিস্তর ফাঁকফোকর। কারণ 'মালিকরা' তার যে জমির দাম বলেছেন পাঁচ লাখ টাকা_ বাস্তবে তা কেনা আরও কম দামে (ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর আগে জমির দাম এখনকার মতো চড়া ছিল না)। তদুপরি যে মেশিন কেনার জন্য এক কোটি টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে, বাস্তবে তার দাম হয়তো ৫০-৬০ লাখ টাকা। এভাবে হিসাবের কারচুপিতে কিছু লোক যে প্রতিষ্ঠানের মালিক হয়েছে তার প্রকৃত বাজার দর ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের তুলনায় অনেক কম। কৈ মাছের তেলে কৈ মাছ ভাজা_ এ প্রবাদ বাংলাদেশে হার মেনেছে লুটেরা ধনীদের প্রতি সরকারি ব্যাংকের পৃষ্ঠপোষকতায়!
হলমার্ক এখন বলতেই পারে, তিন দশক আগে 'বাংলাদেশের উদ্যোক্তোরা যে পথ দেখিয়ে গেছেন' আমরা সে পথেই চলেছি। ইঁদুর ধরার কল বসালে সবার জন্যই বসাতে হবে। আর এটা করা যে খুবই কঠিন সেটা তারা ভালো করেই জানেন। কারণ এটা করতে গেলে দেশের তাবৎ ধনীরা একজোট হয়ে মাঠে নেমে পড়বেন। হলমার্ক গ্রুপের কর্মীরা যে শুক্রবার ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করে যানবাহন চলাচল দীর্ঘ সময় বন্ধ রেখেছিল, সেটা তাদের একটি কৌশল মাত্র। তাদের ঝুলিতে আরও অনেক মতলব থাকতে পারে। ড. ফরাসউদ্দিন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর থাকাকালে একটি বড় ঋণখেলাপি গোষ্ঠীকে ঋণ পরিশোধের জন্য চাপ সৃষ্টি করলে তার প্রধান কর্ণধার এভাবেই হুমকি দিয়েছিলেন_ 'আমি যে ৩০ হাজার লোকের চাকরি দিয়েছি তারা বাংলাদেশ ব্যাংক ঘেরাও করলে মজা টের পাবেন।'
বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের একাধিক সংগঠন ৮ সেপ্টেম্বর শনিবার থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে টানা এক সপ্তাহের ধর্মঘট ডেকেছে। দাবি না মানলে শিক্ষকরা আরও বড় আন্দোলন করবেন_ এমন হুমকি দেওয়া আছে। যে কারণে ধর্মঘট_ বেসরকারি স্কুল-কলেজের প্রধান শিক্ষক, প্রিন্সিপাল থেকে শুরু করে সব পর্যায়ের শিক্ষক-কর্মচারীদের মাত্র ১০০ টাকা বাড়িভাড়া, ১৫০ টাকা মেডিকেল ভাতা, এক মাসের বেতনের এক-চতুর্থাংশ উৎসব ভাতা এবং পুরো চাকরিজীবনে একটি মাত্র ইনক্রিমেন্ট ও টাইম স্কেল প্রদানের অমানবিক ব্যবস্থার অবসান। শর্ত পূরণ হওয়া সত্ত্বেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তি না হওয়া, নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের নিয়োগপ্রাপ্তির পর মাসের পর মাস বেতন বন্ধ থাকা, অবসরের পর অবসর ভাতার নামে যৎসামান্য যা প্রদান করা হয় তা দুই-তিন বছরের মধ্যে না পাওয়া_ এসব সমস্যাকেও সামনে আনা হয়েছে। এসব সমস্যা নিয়ে শিক্ষকদের ক্ষোভ দীর্ঘদিনের। এই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশই হচ্ছে শিক্ষক ধর্মঘট, শিক্ষক আন্দোলন।
শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ফুটপাতে এক রাত থাকতে হলে মাস্তানদের ১০০ টাকা না দিলে ফুটপাতেও থাকা যায় না। একই প্রশ্ন উৎসব ভাতা ও চিকিৎসা ভাতা সম্পর্কেও। তাহলে শিক্ষকদের ১০০ টাকা বাড়িভাড়া, ১৫০ টাকা মেডিকেল ও মাসিক বেতনের এক-চতুর্থাংশ উৎসব ভাতা হিসেবে দিয়ে অসম্মান করা কেন?
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত হলমার্কের ঋণের অঙ্ক নিয়ে হৈচৈ করা পছন্দ করছেন না। সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা ঋণকে তিনি 'বড় অঙ্ক' বলতেও নারাজ। এ নিয়ে তিনি যে মন্তব্য প্রকাশ্যে করেছেন সেটাকে অনেকে পছন্দ করছে না। এমনকি জাতীয় সংসদে সরকারদলীয় সিনিয়র-জুনিয়র সদস্যরাও তার সমালোচনা করেছেন। এখন বেসরকারি স্কুলগুলোর হাজার হাজার শিক্ষক বলতেই পারেন যে, হলমার্কের সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা যদি সরকারের জন্য বড় অঙ্কের অর্থ না হয়, তাহলে এর চেয়ে ঢের কম অঙ্কের অর্থ ব্যয় করে শিক্ষকদের দাবি কেন মানছেন না?
শিক্ষকদের কাছে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় বিঘ্নকারী ধর্মঘট, কর্মবিরতি মোটেই কাম্য নয়; বিশেষ করে যখন সামনে পঞ্চম শ্রেণীর সমাপনী, অষ্টম শ্রেণীর জেএসসি, দশম শ্রেণীর টেস্ট এবং অন্যান্য শ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষা। রমজান ও ঈদ উৎসবের পর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলেছে ২৭ আগস্ট। এ পর্যায়ে এ ধর্মঘট অবশ্যই কাম্য ছিল না। শিক্ষকরা মনে করেন, এ পরিস্থিতির জন্য দায়ী পূর্বাপর সব সরকারের উদাসীনতা ও তাচ্ছিল্যের মনোভাব। অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, আন্দোলনরত শিক্ষকদের প্রতি কটাক্ষ, দায়িত্বজ্ঞানহীন উক্তি আন্দোলনকে দীর্ঘায়িত করেছে। অর্থমন্ত্রী হলমার্কের সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা ঋণকে বড় করে দেখেন না, কিন্তু শিক্ষকদের জন্য বছরে এক হাজার কোটি টাকা বাড়তি ব্যয়কে 'মস্ত বড় বোঝা' মনে করেন।
সরকার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকদের বেতন-ভাতা কতটা বাড়াতে পারবে, সেটা বড় প্রশ্ন। বর্তমানে একজন শিক্ষক বিএ-এমএ পাস করার পর বিএড-এমএড ট্রেনিং নিয়ে স্কুলে ১৫-২০ বছর 'মাস্টারি' করেও মাসে ১৫ হাজার টাকার বেশি বেতন পান না। সরকারি অফিসের পিয়ন-দারোয়ানরাও চাকরি জীবনের শেষ পর্যায়ে এ পরিমাণ বেতন পান। এ অবস্থায় কেন মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা স্কুলে পড়ানোর চাকরি নিতে আগ্রহী হবে? অনেকের মতো আমিও মনে করি, স্কুল শিক্ষকদের বেতন বর্তমানে মাসে ২৫-৩০ হাজার টাকা হলেই কেবল এমএ-এমকম-এমএসসিতে ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া ছাত্রছাত্রীরা 'মাস্টার' হতে চাইবে। কিন্তু সরকারের কি এত বেতন দেওয়ার ক্ষমতা আছে? এর সঙ্গে আরও একটি প্রশ্ন_ বর্তমানে শিক্ষকরা চাকরির শুরুতে ৭-৮ হাজার টাকা মাসে পান এবং এই চাকরি পেতেই তাদের ম্যানেজিং কমিটিকে লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়। মাসে বেতন ২৫ হাজার টাকা হলে ঘুষের অঙ্ক তো ৫ লাখ টাকা হয়ে যাবে। তখন ম্যানেজিং কমিটির সদস্য হতে ঘুষ-তদবির হবে আরও অনেক ব্যাপক মাত্রায়। যে দল দেশের ক্ষমতায় থাকবে তার এমপিদের বাজার হবে দারুণ রমরমা।
একেবারে ঠিক কথা। শিক্ষার প্রসার ও মান বাড়াতে হলে ম্যানেজিং কমিটির প্রতি অবশ্যই মনোযোগ দিতে হবে। 'গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত' ম্যানেজিং কমিটি শিক্ষার যে কতটা সর্বনাশ করছে তার অনুসন্ধান বিভিন্ন সময়ে হয়েছে। কিন্তু 'হলমার্ক কেলেঙ্কারি' যেমন সরকারের যথাযথ মনোযোগ পায় না, তেমনি উপেক্ষিত থাকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটি। সরকারি দলের এমপি এবং তাদের ঘনিষ্ঠজনরা নন্দলালের মতোই পণ করে আছেন_ শিক্ষার বারোটা না বাজিয়ে তারা ক্ষান্ত হবেন না।
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের কয়েক কোটি ছাত্রছাত্রীকে বিনামূল্যে বই প্রদান (এবং সময়মতো সেটা তাদের হাতে পেঁৗছানো) অবশ্যই বড় অর্জন। আমাদের মতো স্বল্পোন্নত কোনো দেশের এ ধরনের সাফল্য আছে কি-না আমার জানা নেই। কিন্তু একইসঙ্গে এ প্রশ্নও করব যে_ যে ছাত্র বা ছাত্রী পারিবারিক গাড়ি করে স্কুলে আসে, তাকে কেন বিনামূল্যে বই দেওয়া হবে? যে ধনবান পরিবারের সন্তান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম কিংবা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার জন্য ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় তাকে নামমাত্র বেতনে পড়ার সুযোগ প্রদানের যুক্তি কোথায়?
শিক্ষার জন্য সরকারের বিনিয়োগের অবশ্যই প্রয়োজন রয়েছে। সরকার যদি ধনবান শ্রেণীকে 'নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য' রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে অকাতরে ঋণ দিতে পারে (ফেরত না পাওয়ার সমূহ আশঙ্কা সত্ত্বেও) তাহলে শিক্ষার মতো লাভজনক মানবিক বিনিয়োগ খাতে কেন অর্থ ব্যয় করতে দ্বিধা করবে? এ প্রশ্নের অবশ্যই যৌক্তিকতা রয়েছে। তারপরও বলব, শিক্ষা খাতের সরকারি ব্যয় বাড়ানোর পাশাপাশি বেসরকারি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের দান-অনুদান আরও বাড়ানোর বিষয়টি গভীর বিবেচনায় নিতেই হবে। ম্যানেজিং কমিটির দুর্নীতি-অনিয়ম কমিয়ে আনতে পারা এ দান-অনুদান পাওয়ার অপরিহার্য শর্ত_ এটা কোনোভাবেই ভুললে চলবে না। আমাদের এ ভূখণ্ডে ব্যক্তিগত দানে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল। তারা জমি দিয়েছেন, ভবন নির্মাণে অর্থ দিয়েছেন। এখনও অনেকে সেটা করছেন এবং আরও করায় আগ্রহ রয়েছে। অর্থ সৎভাবে ব্যয় হবে, এটা নিশ্চিত করা গেলে দলে দলে ভালো মানুষ এগিয়ে আসবে, তাতে সন্দেহ নেই।
একটি বিষয় লক্ষ্য করার মতো_ স্কুলের শিক্ষকরা রাজপথে ক্লাসে তালা দিয়ে, কিন্তু ছাত্র সংগঠনগুলো নীরব। তারা এভাবেই নিজেদের ট্র্যাকের বাইরে নিয়ে গেছে।
অজয় দাশগুপ্ত :সাংবাদিক
ajoydg@gmail.com
No comments