গানের মানুষ- আশৈশব সুরের পথে by এমিলিয়া খানম
১৯৯৪ কি ৯৫ সাল। চট্টগ্রাম সরকারি সিটি কলেজে অনুষ্ঠান। ডলি সায়ন্তনী গান করবেন। তার আগেই ঘোষিত হলো এক নবীন শিল্পীর নাম। যন্ত্রশিল্পীরা মঞ্চে ঠিকঠাক উপস্থিত। কিন্তু যে গাইবে তাকে তো দেখাই যাচ্ছে না। সে কই? অবশেষে আয়োজকেরা শিল্পীকে দেখানোর ব্যবস্থা করলেন।
একটি টেবিল এনে তার ওপর তুলে দিলেন খুদে গায়িকা হৈমন্তীকে। টেবিলে দাঁড়িয়ে গান শুরু করার পরই বোঝা গেল, ছোট হলেও সুরের জাদুতে বড়দের মোহিত করার ক্ষমতা রাখে সে।
ওইটুকু বয়সে ভুবন কাঁপানো শিল্পী লতা মুঙ্গেশকর, আশা ভোঁসলের গান অনায়াসে গেয়ে দর্শকশ্রোতাদের মন জয় করে নিল। ছোটবেলা থেকেই এভাবে মঞ্চ মাতাতে পটু হৈমন্তী রক্ষিত।
সিটি কলেজের সেই অনুষ্ঠানটি কিন্তু হৈমন্তীর প্রথম অনুষ্ঠান নয়। তারও ছয় বছর আগে মঞ্চে গান গাওয়ার অভিষেক হয়েছিল তাঁর ১৯৮৯ সালে প্রথম শ্রেণীর ছাত্রী থাকাকালে। সেদিনের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে তিনি বললেন, ‘সব তো তেমন মনে নেই। কিছু তো বুঝতাম না, শুধু এটুকু বুঝতাম, আমাকে যে গানগুলো শিখিয়ে দেওয়া হয়েছে, সেগুলো গাইতে হবে। ব্যস গেয়ে দিলাম।’
এভাবেই শিশু বয়স থেকে গানের সঙ্গে, সুরের সঙ্গে বেড়ে ওঠা। কিন্তু এর শুরুটা কীভাবে? হৈমন্তী বললেন, ‘তখন আমার বয়স সাত বছর। একদিন বাণী কাকু (বাণী কুমার চৌধুরী) গান শোনাতে বললেন, তাঁকে দুইটা গান শোনালাম। আমার গান শুনে তিনি নিজেই বাবার কাছে আমাকে গান শেখানোর প্রস্তাব দিলেন। তখন আমার বয়স সাত বছর।’ এভাবেই বাণীকাকুর কাছে সংগীতে হাতেখড়ি। এরপর একে একে শিখেছেন বাসুদেব ঘোষ, সোহরাব খান, ওস্তাদ নীরদ বরণ বড়ুয়ার কাছে। এখনো নিয়মিত তালিম নিচ্ছেন ওস্তাদ স্বর্ণময় চক্রবর্তীর কাছে।
ছোটবেলার গানের শিক্ষক বাণী কুমার চৌধুরী আর বাসুদেবের উদ্যোগেই প্রথম একক অনুষ্ঠানটি হয়েছিল ১৯৮৯ সালে। এরপর ১৯৯৪ সালে মুসলিম ইনস্টিটিউট মিলনায়তন ও ৯৬ সালে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে দুটি শো হয় তাঁর। এসব অনুষ্ঠানে হৈমন্তীর সঙ্গে ছিল বিশাল যন্ত্রশিল্পীর দল। মোট কথা, সেই নব্বইয়ের দশক অর্থাৎ নয় বছর বয়স থেকেই তিনি পুরোদস্তুর পেশাদার গায়িকা।
বড়দের সহযোগিতায় শৈশবেই একক গানের অনুষ্ঠান করে ফেললেন। তা সম্ভব হয়েছে তাঁর সুরেলা কণ্ঠের জন্যই। তবে ছোটবেলাতেই এমন সুযোগ পাওয়ার কারণে নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে করেন তিনি। বললেন, ‘আমার পেছনে এত গুণী মানুষেরা সময় দিয়েছেন যে, আমাকে কখনোই কোনো কষ্ট করতে হয়নি। সবকিছু খুব সহজেই পেয়ে গেছি। মা-বাবা সব সময় পেছনে ছিলেন। ঠাকুরমা গান গাইতেন, তাই বাবা চাইতো আমিও যেন গান গাই। আর এখন তো জীবনসঙ্গী হিসেবে যাঁকে পেয়েছি, তিনি তো মূলত আমার সংগীতসঙ্গী। বর্তমানে গানটা চালিয়ে যেতে পারছি আমার স্বামী অসীম দাশের প্রেরণাতেই।’
তবে যে বয়সে তিনি আধুনিক গান গাওয়া শুরু করেছেন, তখনকার দিনে সে বয়সের কেউ ও রকম গান গাওয়ার কথা মনেই আনত না। ছোটরা নানা রকম ছড়াগান আর রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলগীতি ছাড়া তেমন গান গাইত না। হৈমন্তী ছিল তখন থেকেই ব্যতিক্রম। তাঁর কণ্ঠে শিশুসুলভ কোনো ব্যাপারই ছিল না। এ জন্য তাঁকে অনেকেই বলেছেন, ‘তোমার গানগুলো বয়সের সাথে যায় না, তুমি ছোট, ছোটদের গানই গাওয়া উচিত।’ বড়দের এ রকম মন্তব্যের পরও হৈমন্তী থেমে থাকেননি। বর্তমান সময়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতা, রিয়েলিটি শোগুলোতে শিশুদের মুখে বড়দের গাওয়া গান শুনে হৈমন্তীর নিজের শৈশবের কথা মনে পড়ে।
সেই শৈশব থেকে গানের সঙ্গে বেড়ে উঠতে উঠতে হৈমন্তীর এত দূর আসা। এর মধ্যে নিজের যোগ্যতায় অর্জনও করেছেন অনেক। ১৯৯৩-এ অংশ নেন জাতীয় শিশু-কিশোর পুরস্কার প্রতিযোগিতা ও নতুনকুঁড়িতে। সেখানে যথাক্রমে দেশাত্মবোধক ও নজরুলসংগীতে প্রথম হন। এরপর তেমন বড় কোনো প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করা হয়নি, কেননা ইতিমধ্যেই বেতার-টিভির তালিকাভুক্ত এবং মঞ্চের ব্যস্ত শিল্পী। অবশ্য ২০০৪-এ তারা বাংলায় প্রচারিত যতীন-ললিত প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে নিজেকে আরেকবার যাচাই করে নিলেন। এই প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের ছয়জন অংশ নিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত টিকেছিলেন হৈমন্তীই। যেতে যেতে সেমিফাইনাল পর্যন্ত গিয়েছিলেন। স্মরণীয় অনেক ঘটনাই আছে এই প্রতিযোগিতায়।
বাংলাদেশ থেকে গিয়ে সেখানে অনেক বড় শিল্পীর প্রশংসাও পেয়েছেন। সুযোগ পেয়েছেন শান, সুনিধি চৌহান, বাবুল সুপ্রিয়, অলকা ইয়াগনিক, উদিত নারায়ণের মতো তারকাশিল্পীদের সঙ্গে একই মঞ্চে গান গাওয়ার। তাঁর গান শুনেই যতীন ও ললিত দুজনেই তাঁকে ভারতে গিয়ে কাজ করার কথা বলেছিলেন।
হৈমন্তী সব সময় এ রকম বরেণ্য শিল্পীদের স্নেহধন্য হয়েছেন। তিনি বলেন, ‘একবার চট্টগ্রাম ক্লাবের অনুষ্ঠানে এসেছিলেন নচিকেতা। নচিকেতার কাছে আমি গান শেখার আগ্রহ দেখিয়েছিলাম। তিনি আমার প্রস্তাব সাদরে গ্রহণ করেছিলেন। ছোটখাটো কিছু উপদেশ দিয়েছিলেন, কলকাতায়ও যেতে বললেন, কিন্তু আমিই যেতে পারছি না।’
নিয়মিত দেশে-বিদেশে স্টেজ শো ছাড়াও চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক করছেন হৈমন্তী। অ্যালবামও বের হচ্ছে। তবে, এবার অসুস্থতার কারণে ঈদের লাইভ শো ও অন্যান্য অনুষ্ঠানগুলো করা হয়নি। সাজঘর ছবিতে ইমন সাহার সুরে গানে কণ্ঠ দেওয়ার মাধ্যমে প্লেব্যাকে যাত্রা শুরু। এরপর একে একে কণ্ঠ দেন ১০টি চলচ্চিত্রে। একক, মিক্সড, দ্বৈত সবমিলিয়ে এ পর্যন্ত তাঁর অ্যালবামের সংখ্যা ১১।
নিজের ব্যস্ততা সম্পর্কে হৈমন্তী বলেন, ‘কাজের জন্য এত বেশি ঢাকা-চট্টগ্রাম করি যে সকালে ঢাকা তো বিকেলে চট্টগ্রাম।’ হৈমন্তী এবার সিটি কলেজ থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর দিলেন। তবে পড়াশোনাটা এবার চালিয়ে যেতে চান সংগীত নিয়ে। সংগীতই তাঁর আরাধ্য, সুরের সাধনায় কাটিয়ে দিতে চান বাকি জীবনটা।
No comments