দুদকের তদন্ত- ডেসটিনিসহ পাঁচ কোম্পানির পকেটে ৫ হাজার কোটি টাকা by অনিকা ফারজানা

আলোচিত-বিতর্কিত ছয় বহুস্তর বিপণন বা এমএলএম কোম্পানি সাধারণ মানুষের প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। বেশি মুনাফার লোভ দেখিয়ে অর্থ সংগ্রহ করে কোম্পানিগুলোর মালিকেরা ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাবে তা সরিয়ে নেন।


দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্তে সাধারণ মানুষকে প্রতারণা করে অর্থ তুলে নেওয়ার এই তথ্য পাওয়া গেছে। দুদকের তদন্ত অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানগুলো জনগণের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছে চার হাজার ৯৬৩ কোটি ২৪ লাখ ৮৭ হাজার ২৩৩ টাকা। এর মধ্যে নিজেদের ব্যক্তিগত হিসাবে সরিয়ে ফেলা হয় চার হাজার ৬০০ কোটি ৮৪ লাখ ৩০ হাজার ৩৮৩ টাকা। এর বাইরে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে থাকা ৪২০ কোটি ১৪ লাখ টাকা জব্দ করেছে। বাকি অর্থ ফেরত পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে।
বিতর্কিত এই ছয় বহুস্তরের বা মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) কোম্পানিগুলো হলো: ইউনিপেটুইউ বিডি লিমিটেড, ইউনিগেটওয়ে টু ইউ ট্রেডিং প্রাইভেট লিমিটেড, ইউনি রুট ফাইন্যান্স অ্যান্ড কমার্স লিমিটেড, মা পলিকম লিমিটেড এবং ডেসটিনি গ্রুপের দুই প্রতিষ্ঠান ডেসটিনি ট্রি প্ল্যান্টেশন লিমিটেড ও ডেসনিটি ২০০০ লিমিটেড। এর মধ্যে বেশি অর্থ সরিয়ে নিয়েছে সবচেয়ে আলোচিত প্রতিষ্ঠান ডেসটিনি। এর পরই রয়েছে ইউনিপেটুইউ বিডি লিমিটেড।
দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান তদন্ত প্রসঙ্গে প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাধারণ মানুষের স্বার্থ না দেখে যেসব ব্যক্তি তাদের সামান্য পুঁজি নিয়ে প্রতারণা করেছে, চূড়ান্ত তদন্ত শেষে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে দুদক।’ জব্দ করা অর্থ গ্রাহকদের মধ্যে ফিরিয়ে দেওয়া প্রসঙ্গে চেয়ারম্যান বলেন, ‘এটি আদালত ও সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে।’
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, এমএলএম সব দেশেই একটি বিতর্কিত ব্যবসা। যেসব অভিযুক্তের বিরুদ্ধে তদন্ত হচ্ছে, তাদের দোষ প্রমাণিত হলে অবশ্যই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। প্রতারণার শিকার হওয়া গ্রাহকদের অর্থ ফিরিয়ে দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে সরকারকেই। তা না হলে জনগণের ভেতর অনাস্থা তৈরি হবে। পাশাপাশি, সাধারণ জনগণ যেন বেশি মুনাফার লোভে পড়ে প্রতারণার শিকার না হয়, সে জন্য সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে সচেতনতামূলক প্রচারণা চালানো প্রয়োজন।
ডেসটিনি গ্রুপ: দুদক ডেসটিনি গ্রুপের দুটি প্রতিষ্ঠানের ওপর তদন্ত করছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থ সরিয়েছে ডেসটিনি ট্রি প্ল্যান্টেশন লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির মূল ব্যবসা গাছ বিক্রি। গাছ বিক্রি করে তারা সংগ্রহ করেছে দুই হাজার ৩৩৫ কোটি ৭৪ লাখ ৮৫ হাজার ৫০০ টাকা। এর মধ্যে দুই হাজার ১০৬ কোটি ৬৪ লাখ ৬৫ হাজার ৫০০ টাকাই সরিয়ে নেওয়া হয়।
দুদকের তদন্ত অনুযায়ী, ডেসটিনি ২০০০ এবং ডেসটিনি ট্রি প্ল্যান্টেশন কর্তৃপক্ষ অবৈধভাবে নিজ নিজ হিসাবে এই অর্থ স্থানান্তর করেছে। ২০০৬ সালের মার্চ থেকে ২০১২ সালের এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার এ কাজ করা হয়।
২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে চলতি বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত সময়ে ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেড এক হাজার ১৭৮ কোটি ৬১ লাখ ৬৫ হাজার ৫০০ টাকা ঋণ, লভ্যাংশ ও কমিশনের নামে নিজেদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে স্থানান্তর করেছে। জনগণের কাছ থেকে সংগ্রহ করা অর্থ তাদের না জানিয়ে অন্য হিসাবে স্থানান্তর করা অর্থের অবৈধ ব্যবহারসংক্রান্ত (মানি লন্ডারিং) অপরাধ। একই সঙ্গে তা সমবায় সমিতি আইন ও সমবায় সমিতি বিধিমালা ও সোসাইটির আইনেরও লঙ্ঘন।
এ ঘটনায় ইতিমধ্যে ডেসটিনির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল আমীন, চেয়ারম্যান হারুন-অর-রশিদসহ মোট ২১ জনের বিরুদ্ধে রাজধানীর কলাবাগান থানায় দুটি পৃথক মামলা করেছে দুদক।
কোনো গ্রাহক অর্থ ফেরত চাইলে কী করবেন—প্রশ্নের জবাবে মোহাম্মদ রফিকুল আমীন গতকাল শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘গ্রাহক আমার কাছে বুঝেশুনেই অর্থ দিয়েছে। হঠাৎ করে কেন চাইবে। এর পরও কারও প্রয়োজন হলে সে লিখিত আবেদন করতে পারে। সেটা আমরা বিবেচনা করব। প্রয়োজনে সেই আবেদনপত্র সরকারের কাছে পাঠাব।’
ইউনিপেটুইউ বিডি: প্রতিষ্ঠানটি সাধারণ মানুষের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছে এক হাজার ৩৫১ কোটি ২০ লাখ ৫৫ হাজার ৮৯২ টাকা। ২০ শতাংশ লাভসহ মাত্র ১০ মাসে দ্বিগুণ পরিমাণ অর্থ ফেরত দেওয়ার লোভ দেখিয়ে অবৈধভাবে এই অর্থ তোলা হয়।
দুদকের সহকারী পরিচালক মো. তৌফিকুল ইসলামের অনুসন্ধান অনুযায়ী, প্রতারণার মাধ্যমে সংগ্রহ করা এই অর্থ প্রতিষ্ঠানের তিনটি চলতি হিসাবে জমা হয়। এর মধ্যে ৯৩১ কোটি ছয় লাখ ২৬ হাজার ২২৯ টাকা তুলে প্রতিষ্ঠানের পরিচালকদের ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর করা হয়। এ ছাড়া গ্রাহক-প্রতিনিধি ও স্বার্থসংশ্লিষ্টের নামে পরিচালিত বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে আরও ২৬৯ কোটি ৬৮ লাখ ৫৮ হাজার ৮৫৭ টাকা স্থানান্তর করা হয়। ইউনিপেটুইউ বিডি সব মিলিয়ে এক হাজার ২০০ কোটি ৭৪ লাখ ৮৫ হাজার ৮৬ টাকা স্থানান্তর করেছে।
২০০৯ সালের অক্টোবরে মালয়েশিয়াভিত্তিক এই প্রতিষ্ঠান কার্যক্রম শুরু করে। প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মুনতাসির হোসেন ও চেয়ারম্যান মো. শহীদুজ্জামান, মহাব্যবস্থাপক জামশেদুর রহমান, পরিচালক এম এ মুকিতসহ প্রতিষ্ঠানের আরও দুই কর্মকর্তাকে আসামি করে রাজধানীর শাহবাগ থানায় দুদক একটি মামলা করে। গত ৫ মে মোহাম্মদপুর থানা মুনতাসির হোসেন ও জামশেদুর রহমান এবং ২৭ মে এম এ মুকিতকে গ্রেপ্তার করে। মামলার পরে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে থাকা ৪২০ কোটি ১৪ লাখ ২৯ হাজার ৬৬৩ টাকা জব্দ করে। এ ছাড়া ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ দেশের প্রায় প্রতিটি জেলায় ইউনিপেটুইউর বিরুদ্ধে তিন শতাধিক মামলা হয়েছে।
ইউনিগেটওয়ে টু ইউ ট্রেডিং প্রাইভেট লিমিটেড: প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ এবং অন্য কোম্পানিতে অর্থ স্থানান্তরের অভিযোগে দুদক এই এমএলএম প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তদন্ত করছে। এ জন্য অভিযুক্ত করা হয়েছে ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মোশফিকুর রহমান, চেয়ারম্যান ফজল আবদুর রহমান ও সাবেক চেয়ারম্যান আবুল ফয়েজ মো. জিয়াউর রহমানকে। আবুল ফয়েজ বর্তমানে আরেক এমএলএম কোম্পানি বুলিয়ান ভল্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
ওই তিন কর্মকর্তা মোট ২৯ কোটি ২২ লাখ ৪০ হাজার ২২৭ টাকা নিজেদের ব্যক্তিগত ও অন্য প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর বা নগদ তুলে নিয়েছেন। এ বিষয়ে রাজধানীর গুলশান থানায় দুদক মামলা করেছে।
ইউনি রুট ফাইন্যান্স অ্যান্ড কমার্স লিমিটেড: অল্প সময়ে বেশি মুনাফা দেওয়ার লোভ দেখিয়ে সংগ্রহ করা অর্থ স্থানান্তর ছাড়াও তা বৈদেশিক মুদ্রায় রূপান্তরের অভিযোগ রয়েছে এই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মোবারক হোসেন ১৬ কোটি তিন লাখ ৭৯ হাজার ৫৩০ টাকা নিজের হিসাবে স্থানান্তর এবং বিদেশি মুদ্রায় রূপান্তর করেন।
রাজধানীর পল্টন থানায় মো. মোবারক হোসেনের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে বর্তমানে তদন্ত করেছেন কমিশনের উপপরিচালক মো. মোনায়েম হোসেন। অনুসন্ধান ও তদন্ত বিভাগের সূত্র জানান, মোবারক হোসেনের বিভিন্ন ব্যাংক হিসাব খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
মা পলিকম লিমিটেড: চট্টগ্রামের এই এমএলএম প্রতিষ্ঠানটিও অল্প সময়ে বেশি মুনাফার লোভ দেখিয়ে জনগণের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে। প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল আজিজ ও চেয়ারম্যান সাদিয়া রহমান নিজেদের বিভিন্ন হিসাবে মোট ৩৪ কোটি ৭৮ লাখ ৬৮ হাজার ৫০৮ টাকা স্থানান্তর করেছেন। ২০১০ সালের আগস্ট থেকে পরের বছরের জানুয়ারি মাসের মধ্যে এই অর্থ সরিয়ে নেওয়া হয়।
এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানায় একটি মামলা দায়ের করেন দুদকের সহকারী পরিচালক মুহাম্মদ মাহবুবুল আলম। তদন্তকারী কর্মকর্তা ইতিমধ্যে এই মামলার অভিযোগপত্র দাখিলের জন্য কমিশনের কাছে সুপারিশ করেছেন।
চট্টগ্রাম থেকে আমাদের প্রতিবেদক জানান, গতকাল শনিবার ৪০ কদম মোবারক, রুম নম্বর ৫০, মোমিন রোড, চট্টগ্রাম গিয়ে দেখা যায়, মা পলিকমের কোনো নাম নেই ওই দোকানের সাইনবোর্ডে। তালাবদ্ধ দোকানের ওপর লেখা মেসার্স শাহ মোটরস। আশপাশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা জানান, আগে মা পলিকমের সাইনবোর্ড থাকলেও অনেক আগেই সেটি সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। একেক সময় একেক নাম দেওয়া হয় এই দোকানের। তিন-চার মাস ধরে বেশির ভাগ সময় কক্ষটি বন্ধ রয়েছে বলে তাঁরা জানান।

No comments

Powered by Blogger.