খনিজ সম্পদ- চুনাপাথরের সর্বোত্তম ব্যবহার জরুরি by ইদ্রিস মিয়া ও মু. খুরশীদ আলম

চুনাপাথর অন্যতম পাললিক শিলা, যা প্রধানত ক্যালসিয়াম কার্বনেটের বিভিন্ন স্ফটিক অবস্থা। সাধারণত প্রবাল, শামুক ও ঝিনুকজাতীয় সামুদ্রিক প্রাণীর দেহাবশেষ থেকে চুনাপাথর গঠিত। এসব সামুদ্রিক প্রাণী লাখ লাখ বছর সঞ্চিত ও চাপা থাকার পর তাপ ও চাপে চুনাপাথরে রূপান্তরিত হয়।


সব পাললিক শিলার শতকরা ১০ ভাগ চুনাপাথর। যুগ যুগ ধরে চুনাপাথর নির্মাণসামগ্রী হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে। মিসরের পিরামিড থেকে শুরু করে গ্রিক ও রোমান সভ্যতায় নগরায়ণে চুনাপাথর ব্যবহূত হয়েছে। আধুনিক সভ্যতায় চুনাপাথরের ব্যবহার বহুমুখী ও ব্যাপক। এক-দুই শতাব্দী পূর্বেও ভবন নির্মাণের অন্যতম প্রধান উপাদান ছিল চুন-সুরকি। আধুনিক স্থাপত্যের অন্যতম প্রধান উপাদান সিমেন্ট, যা তৈরিতে ব্যবহূত হয় চুনাপাথর। সুতরাং সিমেন্ট তথা চুনাপাথর নগরায়ণের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার।
বাংলাদেশ এখনো একটি গ্রামপ্রধান দেশ। এ দেশের কৃষিজমির হ্রাস রোধ করা, মানুষের আবাসন ও শিল্পায়নের জন্য দ্রুত আধুনিক নগরায়ণ অত্যাবশ্যক। আর দ্রুত নগরায়ণে অল্প জায়গায় অনেক বহুতল ভবন নির্মিত হবে। এ জন্য প্রয়োজন প্রচুর সিমেন্ট। বর্তমানে এর সিংহভাগ পূরণ করা হচ্ছে আমদানি করা সিমেন্ট থেকে। ছাতকে দেশের প্রথম চুনাপাথরনির্ভর সিমেন্ট ফ্যাক্টরিটি চলছে ভারত থেকে আমদানি করা চুনাপাথর দিয়ে। তবে বাংলাদেশেও প্রচুর চুনাপাথরের মজুদ আছে।
প্রতিবেশী দেশ ভারতের মেঘালয়ে আছে উন্মুক্ত চুনাপাথরের বিশাল মজুদ। মেঘালয়সংলগ্ন বাংলাদেশ সীমান্তে তার ছিটেফোঁটা বিদ্যমান, যা ক্রমান্বয়ে ভূপৃষ্ঠের গভীরে চলে গেছে। এ চুনাপাথর সিমেন্ট লাইমস্টোন নামে পরিচিত। ১৯৫৯ সালে বগুড়া জেলার কুচমাতে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য কূপ খনন করলে তাতে সিলেট লাইমস্টোন শ্রেণীভুক্ত উন্নত মানের চুনাপাথর ও উন্নত মানের কয়লা পাওয়া যায়, কিন্তু তা এত গভীরে যে, তা উত্তোলনযোগ্য নয়। এ তথ্যের ওপর ভিত্তি করে গত শতাব্দীর ষাটের দশকে তদানীন্তন পাকিস্তান ভূতাত্ত্বিক জরিপ দপ্তর জাতিসংঘের সহযোগিতায় চুনাপাথরের ব্যাপক অনুসন্ধান করে। স্বাধীনতা-উত্তরকালে নবগঠিত বাংলাদেশ তা অব্যাহত রাখে। এ প্রক্রিয়া আজও চলমান।
অনুসন্ধানকাজের প্রথম দিকে জার্মান ভূপদার্থবিদ কাপল মাইয়ার তৎকালীন রাজশাহী বিভাগের বিস্তীর্ণ এলাকায় ভূপদার্থিক জরিপ পরিচালনা ও উপাত্ত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণপূর্বক দুরগাদহ-বুজরুক এলাকা বরাবর একটি চ্যুতি চিহ্নিত করেন। দুরগাদহের খনন কূপে ৫৪৭-৫৭৪ দশমিক ৫ মিটার (১৯৭৫-১৯৮৮ ফুট) গভীরতায় চুনাপাথর পাওয়া যায়। ভূকম্পন জরিপে এ চ্যুতির দক্ষিণ ভূখণ্ড নিম্ন ধাপ আর উত্তর ভূখণ্ড উচ্চ ধাপ রূপে প্রতীয়মান হয়। ধারণা করা হলো, উচ্চ ধাপ এলাকায় স্বল্প গভীরতায় চুনাপাথর ও নিম্ন ধাপ এলাকায় কয়লা পাওয়া যাবে, খননের মাধ্যমে যা নিশ্চিত করা হয়। এ ধারণা থেকেই জয়পুরহাটে চুনাপাথর উন্নয়ন কার্যক্রম শুরু করা হয়।
গত শতাব্দীর ষাটের দশকে ব্যাপক ভূপদার্থিক অনুসন্ধানের পর নওগাঁ জেলার পত্নীতলা থেকে জয়পুরহাট জেলার পাঁচবিবি পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকায় চুনাপাথরের উপস্থিতি চিহ্নিত করা হয়। চিহ্নিত কতিপয় স্থানে খননের ফলে ওই সব জায়গায় চুনাপাথরের উপস্থিতি নিশ্চিত করা হয়। জয়পুরহাট ও নওগাঁ জেলার বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন গভীরতায় চুনাপাথর পাওয়া যায়। এর গভীরতা ৩৩০ দশমিক ৫ মিটার (১০৮৪ ফুট) থেকে ৫৫০ মিটার (১৮০৫ ফুট) পর্যন্ত ও পুরুত্ব ১১ দশমিক ৩ মিটার (৩৭ ফুট) থেকে ৩২ মিটার (১০৫ ফুট) পর্যন্ত। নওগাঁ জেলার আমবাটিতে সবচেয়ে কম গভীরতায় চুনাপাথর পাওয়া যায়। তবে এর পুরুত্ব মাত্র ১১ দশমিক ৩ মিটার (৩৭ ফুট), যা সবচেয়ে কম। এলাকার ইনসিরাতে ২৭ দশমিক ৫ মিটার (৯০ ফুট) পুরুত্বের সবচেয়ে কম গভীরতা অর্থাৎ ৪১৩ মিটারে (১৩৫৫ ফুট) চুনাপাথর পাওয়া গেছে। সবদিক বিবেচনা করে জয়পুরহাট সদরসংলগ্ন এলাকায় চুনাপাথর উত্তোলনের জন্য খনি উন্নয়নের প্রস্তাব করা হয়। স্বাধীনতা-উত্তরকালে প্রস্তাবিত স্থানে আরও কিছু কূপ খনন করা হয়। এখানে চুনাপাথর ৫১৮ মিটার (১৭০০ ফুট) বা তার অধিক গভীরতা রয়েছে এবং গড় পুরুত্ব ২৭ দশমিক ৫ মিটার (৯০ ফুট)। অতি সম্প্রতি জয়পুরহাট জেলার পাঁচবিবিতে ৪৫৬ দশমিক ৫ মিটার (১৪৯৮ ফুট) গভীরতায় চুনাপাথর পাওয়া গেছে।
খনি উন্নয়নে আর্থিক ব্যয় ভূগর্ভস্থ তাপমাত্রার ওপর নির্ভরশীল। ভূ-অভ্যন্তরে যতই পাওয়া যায়, তাপমাত্রা ততই বৃদ্ধি পেতে থাকে। এ বৃদ্ধির হাট প্রতি ২০ মিটার (৬৫ দশমিক ৫ ফুট) থেকে ২৫ মিটারে (৮২ ফুট) ১º সে.। প্রস্তাবিত জয়পুরহাটে খনি প্রকল্প এলাকায় চুনাপাথর সর্বনিম্ন ৫১৮ মিটার (১৭০০ ফুট) নিচে। ওই এলাকার এ গভীরতায় তাপমাত্রা ৪৭º সে.। খনি বিশেষজ্ঞদের মতে, ৪৫º সে. তাপমাত্রায় চুনাপাথরের খনি উন্নয়ন অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক। জয়পুরহাটে ২º সে. তাপমাত্রা বেশি থাকায় খনি উন্নয়ন ব্যয় প্রায় দ্বিগুণ হওয়ার কারণে তৎকালে খনি উন্নয়নকাজ স্থগিত হয়ে যায়। ইনসিরাতে চুনাপাথরের গভীরতা জয়পুরহাট এলাকার চেয়ে ১০৫ মিটার (৩৪৫ ফুট) ওপরে বিধায় তথাকার তাপমাত্রা ৪২.৮º সে.। সুতরাং এখানে চুনাপাথর উত্তোলন সম্ভব। আমবাটিতে এ গভীরতা সর্বনিম্ন ৩৩০ দশমিক ৫ মিটার (১০৮৪ ফুট)। অর্থাৎ ইনসিরার চেয়ে আরও ৮২ দশমিক ৫ মিটার (২৭১ ফুট) কম। আর এ জন্য তাপমাত্রা ৩º সে. থেকে ৪º সে. কম হবে। অর্থাৎ তাপমাত্রা সামান্য কমবেশি ৪০º সে. হবে। তবে এ এলাকার চুনাপাথরের পুরুত্ব মাত্র ১১ দশমিক ৩ মিটার (৩৭ ফুট)। এ গভীরতায় বিস্তৃতি তথা মজুদ বেশি হলে খনি উন্নয়ন সম্ভব। সম্প্রতি পাঁচবিবিতে আবিষ্কৃত চুনাপাথরের পুরুত্ব তথা মজুদ যদি বেশি হয়, তবে তা-ও হবে উত্তোলনযোগ্য। কারণ, যে গভীরতায় এখানকার চুনাপাথর সঞ্চিত ভূ-অভ্যন্তরের তথাকার তাপমাত্রা ৪৫º সে. মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
চুনাপাথরের খনি উন্নয়নের পূর্বে মজুদের পরিমাণ নির্ধারণের পাশাপাশি যে বিষয়টি ভালো করে পরীক্ষা করা প্রয়োজন, তা হলো এর গুণগত মান। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন গবেষণাগারে এই এলাকার চুনাপাথরের ভৌত ও রাসায়নিক পরীক্ষা করা হয়। ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরির গবেষণাগারেও পরীক্ষা করা হয়। সব পরীক্ষার ফল অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। এ চুনাপাথর সিমেন্ট তৈরির জন্য অত্যন্ত উপযোগী। বাংলাদেশের প্রয়াত প্রথিতযশা ভূতত্ত্ববিদ, এ প্রকল্পের অন্যতম স্বপ্নদ্রষ্টা এফ এইচ খানের মতে, এ চুনাপাথর দিয়ে সাদা সিমেন্টও তৈরি করা যাবে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, চুনাপাথর বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপর্ণ খনিজ সম্পদ। জয়পুরহাট ও নওগাঁ জেলার চুনাপাথর উত্তোলন করে এ এলাকায় একটি বড় সিমেন্ট কারখানা তৈরি করা যায়, যার উৎপন্ন সিমেন্ট ব্যবহার করে এ দেশে স্বল্প ব্যয়ে দ্রুত নগরায়ণ সম্ভব। এর ফলে মানুষের আবাসন হবে ঊর্ধ্বমুখী। স্বল্প পরিসরে বড় বড় শিল্পকারখানা গড়ে উঠবে। রক্ষা পাবে উর্বর কৃষিজমি।
এমতাবস্থায় জয়পুরহাট ও নওগাঁ জেলার চুনাপাথর উত্তোলনের জন্য সেখানে খনি প্রতিষ্ঠার প্রকল্পটি পুনরায় শুরু করা প্রয়োজন। এ উদ্দেশ্যে ওই এলাকায় ব্যাপক ভূপদার্থিক, বিশেষ করে ভূকম্পন জরিপ পরিচালনা করে চুনাপাথরের বিস্তৃতি ও গভীরতা নির্ণয় করা অত্যাবশ্যক। ব্যাপক খননের মাধ্যমে চুনাপাথরের গভীরতা নিশ্চিত করে পুরুত্ব তথা মজুদের পরিমাণ বের করতে হবে। অতঃপর কারিগরি ও অর্থনৈতিকভাবে সুবিধাজনক স্থানে খনি উন্নয়নকাজ শুরুর সঙ্গে সঙ্গে সিমেন্ট কারখানাও প্রতিষ্ঠা করতে হবে। চুনাপাথর ছাড়া আর অন্যতম উপাদান ছাই পাওয়া যাবে পাশের বড়পুকুরিয়ার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে। তাহলে এ প্রকল্প বাংলাদেশের উদীয়মান দ্রুত নগরায়ণের সঙ্গে সঙ্গে সমৃদ্ধিও দ্রুততর করবে।
ড. ইদ্রিস মিয়া: বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তরের অবসরপ্রাপ্ত পরিচালক।
dr.idrismiah@gmail.com
মু. খুরশীদ আলম: বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তরের অবসরপ্রাপ্ত মহাপরিচালক।

No comments

Powered by Blogger.