বীর মুক্তিযোদ্ধা- তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না
৫০৬ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। মনসুর আলী, বীর প্রতীক কোদালকাটি যুদ্ধের বীর যোদ্ধা ৪ আগস্ট, ১৯৭১। সকালে একের পর এক শব্দ। গোলা পড়ছে কোদালকাটি ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে। শান্ত এলাকা নিমেষে চঞ্চল। সাধারণ মানুষ প্রাণভয়ে ছোটাছুটি করছে।
তখন কোদালকাটির অদূরে যাদুরচরে ছিলেন মনসুর আলীসহ একদল মুক্তিযোদ্ধা। ছোট একদল (প্লাটুন)। দলনেতা মনসুর আলী নিজেই। ওই দলের সবাই সহজেই বুঝতে পারেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনী আক্রমণ করেছে। কুড়িগ্রাম জেলার রৌমারী উপজেলার অন্তর্গত কোদালকাটি।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ৩ আগস্ট পর্যন্ত গোটা রৌমারী মুক্ত ছিল। কোদালকাটি ও এর আশপাশের বিভিন্ন স্থানে ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি দল (প্লাটুন)। একটি দলের নেতৃত্বে ছিলেন মনসুর আলী। সেদিন পাকিস্তান সেনাবাহিনী বিরাট একটি দল নিয়ে আকস্মিক আক্রমণ চালিয়ে কোদালকাটি দখল করে। কোদালকাটিতে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়নি।
প্রতিপক্ষের শক্তি ছিল তাঁদের চেয়ে কয়েক গুণ। সে জন্য কৌশলগত কারণে তাঁরা পিছে হটে শংকর-মাধবপুর গ্রামের পূর্ব প্রান্তে সমবেত হন। এ সময় মনসুর আলী যাদুরচর থেকে তাঁর দল নিয়ে কোদালকাটিতে যান। ফায়ার সাপোর্ট দিয়ে পশ্চাদপসরণে সহায়তা করেন।
কয়েক দিন পর ১৩ আগস্ট পাকিস্তান সেনাবাহিনী রৌমারী থানা সদর দখলের লক্ষ্যে কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে কোদালকাটি থেকে রাজীবপুরের দিকে অগ্রসর হয়। বিভিন্ন দিক দিয়ে আক্রমণ চালিয়ে তারা রাজীবপুর দখলের চেষ্টা করে।
মনসুর আলীর অবস্থান এলাকা দিয়েও পাকিস্তান সেনাবাহিনী অগ্রসর হয়। তিনি সীমিত শক্তি নিয়েই সাহসিকতার সঙ্গে সেনাবাহিনীর ওই দলের অগ্রযাত্রা প্রতিহত করেন। পাকিস্তানিরা পরে আরও কয়েকবার তাঁর অবস্থান এলাকা দিয়ে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করে। প্রতিবারই তিনি সাহসিকতার সঙ্গে তা প্রতিহত করেন।
সেপ্টেম্বর মাসের শেষে মুক্তিযোদ্ধাদের শক্তি বৃদ্ধি হয়। এরপর তাঁরা কোদালকাটি থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে চূড়ান্তভাবে উচ্ছেদের জন্য আক্রমণ করেন। মূল আক্রমণে অংশগ্রহণকারী চারটি দলের একটি ছিল মনসুর আলীর দল।
আক্রমণের সময় নির্ধারিত ছিল ২ অক্টোবর রাত। আগের দিন তিনি তাঁর সহযোদ্ধাদের নিয়ে সাজাই-শংকর-মাধবপুর গ্রামের মাঝামাঝি অবস্থান নেন। দ্বিতীয় দল ওই গ্রামের শেষ প্রান্তে ভেলামারী গ্রামে, তৃতীয় দল মাধবপুর গ্রামের উত্তরে এবং চতুর্থ দল পূর্ব প্রান্তে অবস্থান নেয়।
কিন্তু পাকিস্তান সেনাবাহিনী মুক্তিবাহিনীর উপস্থিতি টের পেয়ে যায়। ২ অক্টোবর দুপুরে তারা ব্যাপক মর্টার ফায়ারের ছত্রচ্ছায়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের সব অবস্থানে একযোগে আক্রমণ করে। মনসুর আলী ও তাঁর সহযোদ্ধারা বিপুল বিক্রমে পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ প্রতিহতের মাধ্যমে পাল্টা আক্রমণ করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের অন্যান্য দলও পাল্টা আক্রমণ করে। সারা দিন বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধ চলে।
মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে পাকিস্তানি সেনারা দিশেহারা হয়ে পড়ে। হতাহত হয় অনেক পাকিস্তানি সেনা। সন্ধ্যার পর তারা আহত ও নিহত সেনাদের নিয়ে পিছু হটে নিজেদের ক্যাম্পে সমবেত হয়। পরদিন সকালে মুক্তিযোদ্ধারা জানতে পারেন পাকিস্তানি সেনারা পালিয়ে গেছে।
মনসুর আলী চাকরি করতেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে। ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। এর অবস্থান ছিল সৈয়দপুর সেনানিবাসে। তখন তাঁর পদবি ছিল হাবিলদার। ২৫ মার্চ তিনি গাইবান্ধা জেলার পলাশবাড়ীতে মোতায়েন ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। বিভিন্ন স্থানে সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করেন।
মুক্তিযুদ্ধে, বিশেষত কোদালকাটি যুদ্ধে সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য মনসুর আলীকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৭৬।
মনসুর আলী স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে সুবেদার হিসেবে অবসর নেন। ২০০৫ সালে মারা গেছেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর উপজেলার গুঞ্জুর গ্রামে। বাবার নাম কেরামত আলী ফকির, মা সূর্যবান বেগম। স্ত্রী মনোয়ারা বেগম। তাঁদের পাঁচ ছেলে, পাঁচ মেয়ে।
সূত্র: মেজর (অব.) ওয়াকার হাসান বীর প্রতীক এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ ব্রিগেডভিত্তিক ইতিহাস।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
rashedtr@prothom-alo.info
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ৩ আগস্ট পর্যন্ত গোটা রৌমারী মুক্ত ছিল। কোদালকাটি ও এর আশপাশের বিভিন্ন স্থানে ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি দল (প্লাটুন)। একটি দলের নেতৃত্বে ছিলেন মনসুর আলী। সেদিন পাকিস্তান সেনাবাহিনী বিরাট একটি দল নিয়ে আকস্মিক আক্রমণ চালিয়ে কোদালকাটি দখল করে। কোদালকাটিতে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়নি।
প্রতিপক্ষের শক্তি ছিল তাঁদের চেয়ে কয়েক গুণ। সে জন্য কৌশলগত কারণে তাঁরা পিছে হটে শংকর-মাধবপুর গ্রামের পূর্ব প্রান্তে সমবেত হন। এ সময় মনসুর আলী যাদুরচর থেকে তাঁর দল নিয়ে কোদালকাটিতে যান। ফায়ার সাপোর্ট দিয়ে পশ্চাদপসরণে সহায়তা করেন।
কয়েক দিন পর ১৩ আগস্ট পাকিস্তান সেনাবাহিনী রৌমারী থানা সদর দখলের লক্ষ্যে কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে কোদালকাটি থেকে রাজীবপুরের দিকে অগ্রসর হয়। বিভিন্ন দিক দিয়ে আক্রমণ চালিয়ে তারা রাজীবপুর দখলের চেষ্টা করে।
মনসুর আলীর অবস্থান এলাকা দিয়েও পাকিস্তান সেনাবাহিনী অগ্রসর হয়। তিনি সীমিত শক্তি নিয়েই সাহসিকতার সঙ্গে সেনাবাহিনীর ওই দলের অগ্রযাত্রা প্রতিহত করেন। পাকিস্তানিরা পরে আরও কয়েকবার তাঁর অবস্থান এলাকা দিয়ে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করে। প্রতিবারই তিনি সাহসিকতার সঙ্গে তা প্রতিহত করেন।
সেপ্টেম্বর মাসের শেষে মুক্তিযোদ্ধাদের শক্তি বৃদ্ধি হয়। এরপর তাঁরা কোদালকাটি থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে চূড়ান্তভাবে উচ্ছেদের জন্য আক্রমণ করেন। মূল আক্রমণে অংশগ্রহণকারী চারটি দলের একটি ছিল মনসুর আলীর দল।
আক্রমণের সময় নির্ধারিত ছিল ২ অক্টোবর রাত। আগের দিন তিনি তাঁর সহযোদ্ধাদের নিয়ে সাজাই-শংকর-মাধবপুর গ্রামের মাঝামাঝি অবস্থান নেন। দ্বিতীয় দল ওই গ্রামের শেষ প্রান্তে ভেলামারী গ্রামে, তৃতীয় দল মাধবপুর গ্রামের উত্তরে এবং চতুর্থ দল পূর্ব প্রান্তে অবস্থান নেয়।
কিন্তু পাকিস্তান সেনাবাহিনী মুক্তিবাহিনীর উপস্থিতি টের পেয়ে যায়। ২ অক্টোবর দুপুরে তারা ব্যাপক মর্টার ফায়ারের ছত্রচ্ছায়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের সব অবস্থানে একযোগে আক্রমণ করে। মনসুর আলী ও তাঁর সহযোদ্ধারা বিপুল বিক্রমে পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ প্রতিহতের মাধ্যমে পাল্টা আক্রমণ করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের অন্যান্য দলও পাল্টা আক্রমণ করে। সারা দিন বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধ চলে।
মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে পাকিস্তানি সেনারা দিশেহারা হয়ে পড়ে। হতাহত হয় অনেক পাকিস্তানি সেনা। সন্ধ্যার পর তারা আহত ও নিহত সেনাদের নিয়ে পিছু হটে নিজেদের ক্যাম্পে সমবেত হয়। পরদিন সকালে মুক্তিযোদ্ধারা জানতে পারেন পাকিস্তানি সেনারা পালিয়ে গেছে।
মনসুর আলী চাকরি করতেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে। ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। এর অবস্থান ছিল সৈয়দপুর সেনানিবাসে। তখন তাঁর পদবি ছিল হাবিলদার। ২৫ মার্চ তিনি গাইবান্ধা জেলার পলাশবাড়ীতে মোতায়েন ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। বিভিন্ন স্থানে সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করেন।
মুক্তিযুদ্ধে, বিশেষত কোদালকাটি যুদ্ধে সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য মনসুর আলীকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৭৬।
মনসুর আলী স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে সুবেদার হিসেবে অবসর নেন। ২০০৫ সালে মারা গেছেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর উপজেলার গুঞ্জুর গ্রামে। বাবার নাম কেরামত আলী ফকির, মা সূর্যবান বেগম। স্ত্রী মনোয়ারা বেগম। তাঁদের পাঁচ ছেলে, পাঁচ মেয়ে।
সূত্র: মেজর (অব.) ওয়াকার হাসান বীর প্রতীক এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ ব্রিগেডভিত্তিক ইতিহাস।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
rashedtr@prothom-alo.info
No comments