উৎসবের অর্থনীতির নানা দিক
মুক্তবাজার অর্থনীতির এ যুগে কোন একটি অনুষঙ্গকে পুঁজি করে ব্যবসা বাণিজ্য বাড়ানোর কৌশল আজকের দিনে অনেকটাই প্রতিষ্ঠিত। দেশে দেশে সামাজিক, রাষ্ট্রীয় এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদির সমন্বয়ে উৎসবের কমতি নেই, যদিও এর পিছনে রয়েছে বিশাল অর্থনৈতিক কার্যক্রম তথা বাণিজ্য।
ইন্টারনেট ও মিডিয়ার কল্যাণে বিশ্বময় ঘটে যাওয়া যে কোন ঘটনা এবং উৎসবের ইমেজ মুহূর্তের মধ্যে পৌঁছে যায় সর্বত্র। এমনিভাবে প্রতিটি উৎসবকে কেন্দ্র করে অর্থনীতিতে ব্যাপক আয় প্রবাহ সৃষ্টি হয় যা কর্মসংস্থানের জন্যও ইতিবাচক। আজ থেকে দুই তিন দশক পূর্বেও আমাদের দেশে বিশ্বব্যাপী আয়োজিত ক্রীড়া অনুষ্ঠানসহ (অলিম্পিক, বিশ্বকাপ ফুটবল এবং ক্রিকেট ইত্যাদি) নানা নামের দিবস (ভ্যালেন্টাইন ডে, ফ্রেন্ডশিপ ডে, মাদারস্ ডে ইত্যাদি) উদযাপনের সঙ্গে করপোরেট হাউসসহ ব্যবসায়ী ও মিডিয়ার এতটা জোড়তোড় দেখা যেত না। অবাধ তথ্য প্রবাহের এ যুগে তাই আমরাও পিছিয়ে নেই। এ সকল উদযাপনের সাথে বিশাল অর্থনৈতিক কার্যক্রম যে জড়িত তা সম্প্রতি লন্ডনে অনুষ্ঠিত অলিম্পিকের আয়োজন থেকেই অনেকটা অনুমান করা যায়। এবারের অলিম্পিক বাণিজ্য লন্ডনসহ ইউরোপীয় অর্থনীতির মন্দাকে কাক্সিক্ষত মাত্রায় নাড়া দিতে পারেনি, তাই হয়ত লন্ডনকে অলিম্পিক আয়োজনের বেশ কিছু ব্যয়বহুল কার্যক্রম ও উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আলোর ঝলকানির জন্য বরাদ্দ সময় পঞ্চাশ মিনিট কমিয়ে দিতে হয়েছে। উৎসবকে কেন্দ্র করে অর্থনীতিতে বিনিয়োগ বাড়ানোর লক্ষ্যেই ব্রাজিল ২০১৪ সালে বিশ্বকাপ ফুটবল এবং ২০১৬ সালে অলিম্পিক খেলার আয়োজক হয়েছে। এত গেল বিশ্বময় সমগ্র জাতি গোষ্ঠীর সমন্বিত আয়োজনের উৎসবের অর্থনীতির কথা যার প্রভাব আয়োজক না হলেও সকল দেশে শত কেটি ডলারের বাণিজ্য সৃষ্টি করে থাকে। এক হিসেবে দেখা যায় ভ্যালেন্টাইনডেকে উদ্দেশ্য করে আমাদের মতো দেশেও প্রায় ১০০ কোটি টাকার ফুল, কার্ড, চকলেটসহ অন্যান্য সেক্টরে বাণিজ্য হয়ে থাকে।
আমাদের অর্থনীতিতে বিশ্বব্যাপী আয়োজিত এ সব উৎসবের পাশাপাশি সার্বজনীন বাংলা নববর্ষ এবং ঈদ, পূজাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে অনেক ব্যবসা। আমাদের দেশেও যে ভোক্তার ক্রয় ক্ষমতা বাড়ছে এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই কেননা প্রতিবছর ঈদের সময় নগর-শহর সর্বত্র বেড়ে যায় ব্যাপক অর্থনৈতিক কার্যক্রম। রমজান মাসে ইফতার কেন্দ্রিক কিছু পণ্য যেমন ছোলা, ডাল, খেজুরের আমদানি বাড়ে যার প্রভাবে স্বল্পকালীন শ্রমের বাজরের বিস্তৃতি ঘটে ব্যাপকভাবে। রমজানে মুসলমানরা আরেকটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে তা হলো যাকাত প্রদান যার মাধ্যমে সাময়িক দারিদ্র্য বিমোচনের পাশাপাশি অনেকে কর্মসংস্থানমূলক পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে যেমন রিকশা, সেলাই মেশিন, দোকান ইত্যাদি বিভিন্ন আয়বর্ধক কাজে পুঁজি সরবরাহ করা হয় যাকাতের মাধ্যমে।
ভাসমান অর্থনীতি (হকার, ফুটপাত ব্যবসায়ী, ভিক্ষুক এবং মোবাইল/ভ্যানগাড়ি বিক্রেতা ইত্যাদি) সবচেয়ে বেশি চাঙ্গা হয় উৎসবকে কেন্দ্র করে। নববর্ষে বৈশাখী মেলায় এবং বিভিন্ন পর্যটন স্পটে, ধর্মীয় উৎসবে ভাসমান অর্থনীতি ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে থাকে। শুধু ঢাকা শহরেই রয়েছে কম করে ২০ লাখ ভাসমান অর্থনীতির কর্মী । তাদের যদি মাসে গড়ে ১০০০০ টাকার আয় হয় তাহলেও ২০০০ কোটি টাকার আয় প্রবাহ সৃষ্টি হয় অর্থনীতিতে; যে কোন উৎসবের সময় যা আরও কয়েকগুণ বেড়ে যায়।
এমনিভাবে উৎসবের ধরন অনুসারে মিডিয়ার প্রচারণার ফলে ফ্যাশন ও বৈচিত্র্য বিবেচনায় ক্রেতাদের নিকট হতে ক্রয় ক্ষমতার সবটুকু বিক্রেতারা আদায় করতে সক্ষম হয়। এ বছর ঈদের ক্ষেত্রে তেমনটিই দেখা গেছে। বাংলাদেশে চামড়ার কাঁচামাল ৫০ শতাংশ কোরবানীর ঈদে আর ২০ শতাংশ আসে ঈদ-উল-ফিতরে। উৎসবের সময় এত বড় বাজরকে যেমন মান সম্মতভাবে ভেজালমুক্ত রাখা যায় না তেমনি এ সময় বেশ কিছু নেতিবাচক ঘটনা ঘটে। অতিরিক্ত দাম হাঁকিয়ে একদল বলে কম দামী পণ্য বিক্রয়, অধিক চাহিদা সম্পন্ন দ্রব্যের ভেজাল তৈরি করা, নগর/শহর কেন্দ্রিক অধিক মাত্রায় ভাসমান অথনৈতিক কার্যক্রম বেড়ে গিয়ে নগর জনজট ও যানজটের মাধ্যমে পরিবেশ বিপর্যয় করা এবং ছিনতাই, চাঁদাবাজি, পেশাদার ভিক্ষাবৃত্তি বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি সামগ্রিক জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করে। ধর্মীয় উৎসবে সরকারী বেসরকারী কর্মচারীরা আর্থিক ইনসেনটিভ পায় যা হাজার কোটি টাকার ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধি করে যা ব্যবসাবাণিজ্যের গতিকে ব্যাপকতর করে। প্রবাসীদের প্রেরিত রেমিটেন্সের আধিক্য দেখা যায় উৎসবকে কেন্দ্র করে। গত জুন জুলাই মাসে বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে ১১ হাজার বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে রেকর্ড করেছে। সব কিছু মিলিয়ে অর্থনীতি স্বাভাবিক অবস্থা থেকে কয়েকগুণ বেশি গতিশীল হয় উৎসবকে কেন্দ্র করে যার বৃহৎ ধাক্কা সামগ্রিক প্রবৃদ্ধিকে ৬ ডিজিটের ওপরে রাখছে। আমাদের ভোগ প্রবণতাই আমাদের অর্থনীতির প্রাণশক্তি যা দেশের বৃহৎ দুটি উৎসব এবং অন্যান্য ছোটোখাট উৎসবের সময় লক্ষ্য করা যায়। সারা বছর অর্থনীতিতে যা ঘটে বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে এবং সামাজিক, জাতীয়, ধর্মীয় এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে অর্থনীতির চাকা যেভাবে গতি পায় তাকে আরও বেশি গতিময় ও আবর্তিত করতে পারলে আমাদের প্রবৃদ্ধি খুব অল্প সময়ে দুই ডিজিটে পৌঁছে যাবে। সরকার ও জনগণের সার্বিক প্রচেষ্টায় আমাদের উৎসবের আনন্দ আরও বেশি জাতীয় উন্নয়ন সহযোগী হতে পারে এবং সকল অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে আমরাও যে উদযাপনের ক্ষেত্রে বিশ্বে অন্যতম তার প্রমাণ রাখা সম্ভব।
মিনহাজ উদ্দীন আহাম্মদ
সহকারী অধ্যাপক (অর্থনীতি) ও সংযুক্ত কর্মকর্তা (পরিকল্পনা উইং), শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
আমাদের অর্থনীতিতে বিশ্বব্যাপী আয়োজিত এ সব উৎসবের পাশাপাশি সার্বজনীন বাংলা নববর্ষ এবং ঈদ, পূজাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে অনেক ব্যবসা। আমাদের দেশেও যে ভোক্তার ক্রয় ক্ষমতা বাড়ছে এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই কেননা প্রতিবছর ঈদের সময় নগর-শহর সর্বত্র বেড়ে যায় ব্যাপক অর্থনৈতিক কার্যক্রম। রমজান মাসে ইফতার কেন্দ্রিক কিছু পণ্য যেমন ছোলা, ডাল, খেজুরের আমদানি বাড়ে যার প্রভাবে স্বল্পকালীন শ্রমের বাজরের বিস্তৃতি ঘটে ব্যাপকভাবে। রমজানে মুসলমানরা আরেকটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে তা হলো যাকাত প্রদান যার মাধ্যমে সাময়িক দারিদ্র্য বিমোচনের পাশাপাশি অনেকে কর্মসংস্থানমূলক পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে যেমন রিকশা, সেলাই মেশিন, দোকান ইত্যাদি বিভিন্ন আয়বর্ধক কাজে পুঁজি সরবরাহ করা হয় যাকাতের মাধ্যমে।
ভাসমান অর্থনীতি (হকার, ফুটপাত ব্যবসায়ী, ভিক্ষুক এবং মোবাইল/ভ্যানগাড়ি বিক্রেতা ইত্যাদি) সবচেয়ে বেশি চাঙ্গা হয় উৎসবকে কেন্দ্র করে। নববর্ষে বৈশাখী মেলায় এবং বিভিন্ন পর্যটন স্পটে, ধর্মীয় উৎসবে ভাসমান অর্থনীতি ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে থাকে। শুধু ঢাকা শহরেই রয়েছে কম করে ২০ লাখ ভাসমান অর্থনীতির কর্মী । তাদের যদি মাসে গড়ে ১০০০০ টাকার আয় হয় তাহলেও ২০০০ কোটি টাকার আয় প্রবাহ সৃষ্টি হয় অর্থনীতিতে; যে কোন উৎসবের সময় যা আরও কয়েকগুণ বেড়ে যায়।
এমনিভাবে উৎসবের ধরন অনুসারে মিডিয়ার প্রচারণার ফলে ফ্যাশন ও বৈচিত্র্য বিবেচনায় ক্রেতাদের নিকট হতে ক্রয় ক্ষমতার সবটুকু বিক্রেতারা আদায় করতে সক্ষম হয়। এ বছর ঈদের ক্ষেত্রে তেমনটিই দেখা গেছে। বাংলাদেশে চামড়ার কাঁচামাল ৫০ শতাংশ কোরবানীর ঈদে আর ২০ শতাংশ আসে ঈদ-উল-ফিতরে। উৎসবের সময় এত বড় বাজরকে যেমন মান সম্মতভাবে ভেজালমুক্ত রাখা যায় না তেমনি এ সময় বেশ কিছু নেতিবাচক ঘটনা ঘটে। অতিরিক্ত দাম হাঁকিয়ে একদল বলে কম দামী পণ্য বিক্রয়, অধিক চাহিদা সম্পন্ন দ্রব্যের ভেজাল তৈরি করা, নগর/শহর কেন্দ্রিক অধিক মাত্রায় ভাসমান অথনৈতিক কার্যক্রম বেড়ে গিয়ে নগর জনজট ও যানজটের মাধ্যমে পরিবেশ বিপর্যয় করা এবং ছিনতাই, চাঁদাবাজি, পেশাদার ভিক্ষাবৃত্তি বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি সামগ্রিক জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করে। ধর্মীয় উৎসবে সরকারী বেসরকারী কর্মচারীরা আর্থিক ইনসেনটিভ পায় যা হাজার কোটি টাকার ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধি করে যা ব্যবসাবাণিজ্যের গতিকে ব্যাপকতর করে। প্রবাসীদের প্রেরিত রেমিটেন্সের আধিক্য দেখা যায় উৎসবকে কেন্দ্র করে। গত জুন জুলাই মাসে বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে ১১ হাজার বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে রেকর্ড করেছে। সব কিছু মিলিয়ে অর্থনীতি স্বাভাবিক অবস্থা থেকে কয়েকগুণ বেশি গতিশীল হয় উৎসবকে কেন্দ্র করে যার বৃহৎ ধাক্কা সামগ্রিক প্রবৃদ্ধিকে ৬ ডিজিটের ওপরে রাখছে। আমাদের ভোগ প্রবণতাই আমাদের অর্থনীতির প্রাণশক্তি যা দেশের বৃহৎ দুটি উৎসব এবং অন্যান্য ছোটোখাট উৎসবের সময় লক্ষ্য করা যায়। সারা বছর অর্থনীতিতে যা ঘটে বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে এবং সামাজিক, জাতীয়, ধর্মীয় এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে অর্থনীতির চাকা যেভাবে গতি পায় তাকে আরও বেশি গতিময় ও আবর্তিত করতে পারলে আমাদের প্রবৃদ্ধি খুব অল্প সময়ে দুই ডিজিটে পৌঁছে যাবে। সরকার ও জনগণের সার্বিক প্রচেষ্টায় আমাদের উৎসবের আনন্দ আরও বেশি জাতীয় উন্নয়ন সহযোগী হতে পারে এবং সকল অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে আমরাও যে উদযাপনের ক্ষেত্রে বিশ্বে অন্যতম তার প্রমাণ রাখা সম্ভব।
মিনহাজ উদ্দীন আহাম্মদ
সহকারী অধ্যাপক (অর্থনীতি) ও সংযুক্ত কর্মকর্তা (পরিকল্পনা উইং), শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
No comments