বিশ্বব্যাপী কমছে শিল্প উৎপাদন

বিশ্বব্যাপী শিল্পপণ্য উৎপাদনের মাত্রা কমছে ব্যাপকহারে। দিন দিন যেখানে মানুষ বাড়ছে, মানুষের চাহিদা বাড়ছে সেখানে শিল্পপণ্য উৎপাদনের মাত্রা কমে যাওয়া সমগ্র বিশ্বের জন্যই অশনিসঙ্কেত। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরো অঞ্চলে যেমন শিল্পপণ্যের উৎপাদন কমেছে তেমনি চীনের মতো শিল্পপণ্য উৎপাদনে বৃহৎ দেশের কারখানাগুলোতে উৎপাদন


সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে। বৈশ্বিক মন্দার কারণে সারা বিশ্বের অর্থনীতির টালমাটাল অবস্থার কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি কমে এসেছে আর এর প্রভাব অন্যান্য সকল সেক্টরের মতো শিল্প খাতের ওপরও পড়েছে। বিশ্বজুড়ে প্রবৃদ্ধির যে নিম্নগামিতা পরিলক্ষিত হচ্ছে এটার থেকে যদি অতি দ্রুত উত্তরণ না করা যায় তবে শিল্প খাত ভয়াবহ বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে যাবে। বিশ্লেষকদের মতে যদি শিল্পখাতে এই রকম বিপর্যয় সৃষ্টি হয় তবে ভবিষ্যতে বিশ্বজুড়েই প্রবৃদ্ধি সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছাবে। একটি জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়, ইউরো অঞ্চলের সতেরোটি দেশে অর্থনৈতিক অস্থিরতার বিরূপ প্রভাব দেখা দিয়েছে উৎপাদন খাতে। বিশেষ করে শিল্পপণ্য উৎপাদন খাতে।
এই অঞ্চলে উৎপাদন ক্রমান্বয়ে উৎপাদন কমছে। টানা এগারো মাস এ খাতে নিম্নমুখী প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এর প্রভাব এশিয়া ও আফ্রিকার শিল্প উৎপাদনেও পড়ছে। আইএনজির ইউরো অঞ্চলবিষয়ক প্রধান অর্থনীতিবিদ ভেনদেন হাউট বলেন, ঋণসঙ্কটের কারণে ইউরো অঞ্চল অনেক দিন ধরেই সংগ্রাম করে যাচ্ছে আর এর ফলে সঙ্কুচিত হচ্ছে বিশ্ব অর্থনীতি। ইউরোপের মধ্যে জার্মানি, ফ্রান্স ইংল্যান্ডের অবস্থা মোটামুটি হলেও অন্য দেশগুলো ব্যাপকভাবে ঋণসঙ্কট সমস্যাসহ নানামুখী সমস্যার মাঝে ডুবে আছে। বিশেষ করে ইতালি, স্পেন ও গ্রিসের অবস্থা খুবই ভয়াবহ। ইউরোপের অর্থনৈতিক অবস্থার নাজুক পরিস্থিতি এই অঞ্চলের কলকারখানাগুলোর উৎপাদনে যেমন প্রভাব রাখছে তেমনি প্রতিকূল অবস্থা বিরাজ করায় রফতানি কমেছে চীন ও ভারতের। কারণ এদের রফতানিকৃত পণ্যের অধিকাংশ সরবরাহ করা হয় ইউরোপের দেশগুলোয়। ফলে ইউরো অঞ্চলের ঋণসঙ্কট এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রবৃদ্ধির মন্থর গতির কারণে এসব দেশের শিল্পপণ্যের উৎপাদন সঙ্কুচিত হয়ে পড়ছে। মিল মালিকরা বেশি পরিমাণ পণ্য উৎপাদন করার সাহস পাচ্ছে না। তাছাড়া কৃচ্ছ্রসাধনের যে নীতি ইউরোপ গ্রহণ করেছে তাতে ভোক্তারা তাদের ব্যয় সঙ্কোচনের দিকেই মনোনিবেশ করছে। যা শিল্প পণ্যর উৎপাদনকে নিরুৎসাহিত করছে। ঋণ সঙ্কট মোকাবেলায় শুধু ইউরোপের সরকারগুলোই বাজেট কমাচ্ছে তা নয়, ব্যয়ের লাগাম টানছে এ অঞ্চলের জনসাধারণও। আগে যেখানে তারা দামী পণ্য ব্যবহার করত, সেখানে ব্যয় কমানোর জন্য সস্তা পণ্যের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। আরও বেশি সস্তায় পণ্য পাওয়ার জন্য অনলাইনে ক্রমাগত সার্চ করছে। ভোক্তারা মিতব্যয়ী হয়ে যাওয়ায় উৎপাদন প্রতিষ্ঠানগুলোর মুনাফা কমছে।
ওয়াশিংটনভিত্তিক কমনওয়েলথ ফরেন এক্সচেঞ্জের প্রধান বাজার বিশ্লেষক ওমর এসিনার বলেন, উৎপাদন খাতে প্রতিকূল অবস্থা বিরাজ করছে। এ থেকে উত্তোরণের কোন পথই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এ কারণে তিনি পুরো বিশ্বকে এক কাতারে এসে একযোগে এই সমস্যা সমাধানের জন্য কাজ করার পরামর্শ দেন। মারকিটের ইউরোজোন পারচেজিং ম্যানেজার ইনডেক্স অনুযায়ী উৎপাদন খাত সঙ্কুচিত হয়ে ৪৪ পয়েন্টে এসে দাঁড়িয়েছে। ২০০৯ সালের জুনের পর এটাই সর্বনিম্ন সূচক। ব্রিটেনে উৎপাদন খাত তিন বছরের মধ্যে সবচেয়ে দ্রুতগতিতে সঙ্কুচিত হয়েছে যা এই দেশটির অর্থনীতির জন্য চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইউএস ম্যানুফ্যাকচারিং ইনডেক্স অনুযায়ী এক মাসে সূচক দাঁড়িয়েছে ৪৯ দশমিক ৮ পয়েন্ট। এ ছাড়া দুই থেকে আড়াই বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে দেশটিতে। এবং ব্যয় কমিয়ে দিয়েছে ভোক্তারা। এতে যুক্তরাষ্ট্রের গাড়ি প্রস্তুতকারী তিনটি প্রতিষ্ঠানের সব ক’টি তাদের প্রত্যাশার থেকেও অনেক কম গাড়ি বিক্রি করেছে। শীর্ষ গাড়ি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান জেনারেল মোটরসের বিক্রির পরিমাণ কমেছে ৬ শতাংশ। ব্রাজিলে এইচ এসবিসি ম্যানেজার ইনডেক্স ৫০ পয়েন্টের নিচে নেমে এসেছে। বিশ্ব চাহিদা কমে যাওয়ার পাশাপাশি বিনিময় হার অনুকূলে না থাকায় এ সূচক কমছে। ইউরোপের ঋণসঙ্কটের কারণে প্রভাবিত হচ্ছে এশিয়ার প্রতিষ্ঠানগুলো। চীনের পিএম আই সূচক আট মাসের মধ্যে জুলাইয়ে সর্বনিম্ন ৫০ দশমিক ১ শতাংশে নেমে এসেছে। চীনের ১১টি প্রধান সাব-ইনডেক্সের মধ্যে ১০ পিএমআই ৫০ পয়েন্টের নিচে অবস্থান করছে। যা প্রমাণ করছে যে, উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে। এছাড়া দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান ও ভারতে উৎপাদন খাত ও সঙ্কুচিত হচ্ছে। বিশ্ব অর্থনীতির এই দুর্দশায় প্রবৃদ্ধি উত্তরণের চাপে আছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোও।
যদি বৈশ্বিক মন্দা থেকে উত্তরণ না পাওয়া যায় তবে ভেঙ্গে পড়বে সমগ্র বিশ্বের সামগ্রিক অর্থনীতি। সামষ্টিক অর্থনীতিতে যদি এভাবে শিল্প উৎপাদন কমতে থাকে তবে আরও বেশি বেকারত্ব সৃষ্টি হবে, রফতানি আয় কমে যাবে ফলে অর্থনৈতিক অস্থিরতা দীর্ঘমেয়াদী হয়ে পড়বে। যে সকল দেশ মূলত শিল্প পণ্য উৎপাদন ও রফতানিনির্ভর সে সব দেশ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও অন্যান্য দেশ যে এর নেতিবাচক বলয় থেকে বেঁচে যাবে তা বলা যায় না। শুধু শিল্প উৎপাদনই নয়, অন্য সকল সেক্টরই বৈশ্বিক মন্দা ও ইউরো অঞ্চলের ঋণসঙ্কটের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আর এর ফলে মানুষের জীবনযাত্রার মান কমে যাচ্ছে যার প্রমাণ ভোক্তা সূচক ব্যয়ের নিম্নমুখিতা । এই নিম্নমুখিতা উৎপাদন খাতের জন্য হুমকিস্বরূপ। বিশ্বজুড়েই দেখা যাচ্ছে অর্থনৈতিক অস্থিরতা যা থেকে পরিত্রাণের জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো যেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে তেমনি বিশ্বের সকল দেশকে একযোগে কাজ করতে হবে। আর তা না হলে শুধু উৎপাদন হ্রাসই নয়, এর থেকেও ভয়াবহ বিপর্যয় হিসেবে নেমে আসতে পারে মহা দুর্ভিক্ষ।
মোঃ আরিফুর রহমান

No comments

Powered by Blogger.