দাহকালের কথা-এলআইপি by মাহমুদুজ্জামান বাবু
আমি ‘মৃত্তিকা’ নামে একটি গানের দলের সদস্য। বাংলাদেশের সংবিধান নিয়ে আমাদের একটি গান আছে। সংবিধান ও দেশের মানুষের মৌলিক অধিকার সম্পর্কে গানটিতে কিছু জিজ্ঞাসা আছে, কিছু উপলব্ধিও। গানটির দুটি লাইন: ‘জানতে চেয়েই মানুষ গেছে চাঁদে/ চাঁদের কোথাও চরকা বুড়ি নেই।’ ছোটবেলায় মুখস্থ করতে হয়েছিল, ‘চাঁদের বুড়ি চরকা কাটে।’
বড়বেলায় এসে জানা হলো, অ্যাপোলো-১১ নামের নভোযানে উড়ে গিয়ে চাঁদের মাটিতে পায়ের ছাপ রেখে এসে আর্মস্ট্রং, কলিন্স ও অলড্রিন জানাল যে, বুড়ি আর চরকা দূরে থাক—চাঁদে কোনো বাতাসই নেই। বাতাস নেই মানে শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ারও কোনো উপায় নেই। বাতাস ছাড়া তো মানুষ বাঁচে না! সুতরাং, বুড়িও নেই। মানুষ একটা সত্য আবিষ্কার করল। আবিষ্কারটা আপনা-আপনি হয়নি, মানুষের সচেতন প্রয়াসের ফলে হয়েছিল। তা-ই হয়। এটাই নিয়ম।
সমাজ-সভ্যতা যতটুকু বিকাশ লাভ করেছে, তার পেছনে মূল প্রণোদনা হচ্ছে মানুষের বিরামহীন প্রচেষ্টা। প্রথমত, যা মানুষের যাপিত জীবনের যেকোনো ক্ষেত্রেই প্রতিবন্ধক বা সমস্যা, তাকে প্রথমে চিহ্নিত করা হয়েছে, পরে তার কার্যকারণ সম্পর্ক আবিষ্কার করা হয়েছে, ব্যবচ্ছেদ করা হয়েছে এবং সমাধানের উপায় নির্দিষ্ট হয়েছে। যখন সমাধান হয়েছে, তখন তার উপযোগিতা সব মানুষ গ্রহণ করেছে অথবা সুফল ভোগ করেছে। রোগ-শোক বা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখে নিরুপায় মানুষ একসময় তুকতাক বা মন্ত্রপাঠকেই নিরাময়ের উপায় বলে মানত। তাতেও যখন বিপর্যয় নির্বিকার থাকল, বাস্তব অভিজ্ঞতা তখন মানব-মস্তিষ্কে নানা রকমের প্রশ্নের জন্ম দিল, জিজ্ঞাসা ও অনুসন্ধান তীব্র হলো আর তাতেই না মানুষ বিরুদ্ধ প্রকৃতির সঙ্গে কোমর বেঁধে লড়াই করে তার প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা করল। বিজ্ঞানের নানা শাখায় যারা মাথা ঘামাল, মগ্ন হয়ে চর্চা করল, তারা এবং তাদের সম্প্রদায়-সমাজ-রাষ্ট্র মাথা উঁচু করে দাঁড়াল অনেক, এগোলও অনেক। যারা পিছিয়ে থাকল, তারা থাকল অন্ধকারে, উপায়হীন। উপায়হীন জনপদে উপায়সর্বস্বরা জাহাজে করে, বনাঞ্চল পেরিয়ে হইহই রইরই করতে করতে হাজির, ঈশ্বরের চেয়ে অনেক শক্তিশালী উপায়সর্বস্বদের পদানত দাস হলো উপায়হীনেরা।
ব্রিটিশ-ভারতে ঠিক তা-ই হয়েছিল। দাসোচিত জীবনে থাকতে থাকতেই একটু একটু করে প্রশ্ন উঠতে থাকল—নিপীড়িতদের মগজে-ভাবনায়, কী কারণে তাদের এই অসম্মানের জীবন, কেন জীবনের সর্বক্ষেত্রে সীমাহীন বঞ্চনা! পরাধীনতাকে ‘পরাধীন’ বলে চিনতে শিখছিল তাদের বিজ্ঞানমনস্কতা, একটু একটু করে তাদের চোখ শিক্ষার আলোয় উজ্জ্বল হচ্ছিল, এই তো হয়, যে আলোর উজ্জ্বলতা খুব তীব্রতায় গাঢ় অন্ধকারকে চিহ্নিত করতে পারে। আলোকিত মন প্রশ্ন করতে শিখছিল, একই সঙ্গে শিখছিল কর্তব্যবোধ। ‘ধানের জমিতে নীল চাষ/ কৃষকের গলায় ফাঁস’—এই উপলব্ধি প্রবচনে পৌঁছে যেতে না-যেতেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মমতার অকূল সাগরে ডুব দিয়ে তুলে আনলেন জিজ্ঞাসার অমূল্য রতন: ব্রিটিশরাজকে প্রশ্নবাণ ছুড়লেন, বিলেতে ছাত্রছাত্রীদের তোমরা পড়াচ্ছ জন স্টুয়ার্ট মিলের লজিক বা যুক্তিবিদ্যা, আর ভারতবর্ষে পাঠ্যসূচিতে পড়তে দিয়েছ বেদ-বেদান্ত, বাইবেল। কেন? বিলেতিরা হবে যুক্তিবাদী মানুষ আর ভারতবাসী শিক্ষার্থীরা ঈশ্বরের কৃপা খুঁজে খুঁজে আভূমি নতমুখ? তাতে তো তোমাদের লুটপাট, শোষণ-নিপীড়ন বাধাহীন, প্রতিরোধবিহীন। এইটুকু বুঝে, ঝলসে ওঠা এক না-কিশোর, না-তরুণ ক্ষুদিরাম ব্রিটিশ অনাচারের মুখে ছুড়ে দিল ক্ষোভের বোমা। ভাগ্যিস, মানুষ প্রশ্ন করার মতো একটি উন্নত মস্তিষ্ক পেয়েছিল! অসম্মানকে অসম্মান বলে চিনতে শিখেছিল!
আমাদের চারপাশেও ব্যক্তিগত অসম্মান প্রতিদিন বাড়ছে। পৃথিবীর সব জাতির, সব সমাজের, সব ব্যক্তির নানাবিধ মানবিক অধিকার সংরক্ষণের জন্য সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়েছে, তার নাম জাতিসংঘ। যথাযথ কাজ করুক না-করুক, মানুষ ও মানবতাসংক্রান্ত বেশ কিছু ধারা ও বিধানসংবলিত একটা সনদ তার আছে। আবার বিভিন্ন দেশের নিজস্ব সংবিধান আছে। এর সব কয়টিতেই মানুষের সমানাধিকারের বিধানটি পুনরাবৃত্ত হয়ে লেখা আছে। কিন্তু প্রয়োগ? চর্চা? স্বীকৃতি? এই প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে একটা অশ্বডিম্ব। একটা বাগাড়ম্বর। প্রমাণ দেব?
দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত একটা সংবাদে চোখ থমকে গিয়েছিল সেদিন। মন্ত্রী-সাংসদদের সম্পদের হিসাব চেয়ে নয়, অনুরোধ জানিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কাছে চিঠি দেওয়ার পর তারা একটি খসড়া তৈরি করেছে, পরে সেটার সারসংক্ষেপ করা হয়েছে এবং অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত তাতে স্বাক্ষরও করেছেন। গণতন্ত্রে তো এই-ই নিয়ম! কিন্তু, এটা যে বাংলাদেশ! সেই হিসাব কিন্তু প্রকাশ করবে না সরকার, অর্থমন্ত্রী সেই সিদ্ধান্তও জানিয়ে দিয়েছেন (প্রথম আলো, ২১ মার্চ)। কদিন আগে অন্যান্য দিনের মতোই স্কয়ার হাসপাতালের সামনে থেকে রিকশা নিয়ে সেন্ট্রাল রোডের স্টুডিওতে যাচ্ছিলাম। গ্রিন রোড সংযোগ-সড়কের সামনে আসতেই দুই পুলিশ সদস্য রিকশা থামালেন। বলা হলো, নামেন। প্রশ্ন করলাম, কেন? উত্তর, রিকশা যাবে না এই রাস্তায়। জানতে চাইলাম, কেন? কঠোর জবাব, এটা ভিআইপি রোড। পেছনের রিকশা থেকে কোলের শিশুসন্তান নিয়ে দুজন ভদ্রমহিলাও নামলেন। মাথার ওপরে মার্চ মাসের স্বাধীনতার আকাশ, অথচ চোখে-মুখে অসম্মানের কালো মেঘ মেখে চৌরাস্তার মোড়ে আমরা কজন এলআইপি (লেস ইম্পর্ট্যান্ট পারসন) দাঁড়িয়ে আছি। আমার চোখ নেমে আসে পায়ের দিকে, পথের দিকেও। এই পায়ে আরও অনেকের সঙ্গে নব্বইয়ে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে হেঁটেছিলাম। আবার হাঁটতে হবে?
হা মানুষ! হা জীবন!
মাহমুদুজ্জামান বাবু: গায়ক ও সংস্কৃতিকর্মী।
che21c@yahoo.com
সমাজ-সভ্যতা যতটুকু বিকাশ লাভ করেছে, তার পেছনে মূল প্রণোদনা হচ্ছে মানুষের বিরামহীন প্রচেষ্টা। প্রথমত, যা মানুষের যাপিত জীবনের যেকোনো ক্ষেত্রেই প্রতিবন্ধক বা সমস্যা, তাকে প্রথমে চিহ্নিত করা হয়েছে, পরে তার কার্যকারণ সম্পর্ক আবিষ্কার করা হয়েছে, ব্যবচ্ছেদ করা হয়েছে এবং সমাধানের উপায় নির্দিষ্ট হয়েছে। যখন সমাধান হয়েছে, তখন তার উপযোগিতা সব মানুষ গ্রহণ করেছে অথবা সুফল ভোগ করেছে। রোগ-শোক বা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখে নিরুপায় মানুষ একসময় তুকতাক বা মন্ত্রপাঠকেই নিরাময়ের উপায় বলে মানত। তাতেও যখন বিপর্যয় নির্বিকার থাকল, বাস্তব অভিজ্ঞতা তখন মানব-মস্তিষ্কে নানা রকমের প্রশ্নের জন্ম দিল, জিজ্ঞাসা ও অনুসন্ধান তীব্র হলো আর তাতেই না মানুষ বিরুদ্ধ প্রকৃতির সঙ্গে কোমর বেঁধে লড়াই করে তার প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা করল। বিজ্ঞানের নানা শাখায় যারা মাথা ঘামাল, মগ্ন হয়ে চর্চা করল, তারা এবং তাদের সম্প্রদায়-সমাজ-রাষ্ট্র মাথা উঁচু করে দাঁড়াল অনেক, এগোলও অনেক। যারা পিছিয়ে থাকল, তারা থাকল অন্ধকারে, উপায়হীন। উপায়হীন জনপদে উপায়সর্বস্বরা জাহাজে করে, বনাঞ্চল পেরিয়ে হইহই রইরই করতে করতে হাজির, ঈশ্বরের চেয়ে অনেক শক্তিশালী উপায়সর্বস্বদের পদানত দাস হলো উপায়হীনেরা।
ব্রিটিশ-ভারতে ঠিক তা-ই হয়েছিল। দাসোচিত জীবনে থাকতে থাকতেই একটু একটু করে প্রশ্ন উঠতে থাকল—নিপীড়িতদের মগজে-ভাবনায়, কী কারণে তাদের এই অসম্মানের জীবন, কেন জীবনের সর্বক্ষেত্রে সীমাহীন বঞ্চনা! পরাধীনতাকে ‘পরাধীন’ বলে চিনতে শিখছিল তাদের বিজ্ঞানমনস্কতা, একটু একটু করে তাদের চোখ শিক্ষার আলোয় উজ্জ্বল হচ্ছিল, এই তো হয়, যে আলোর উজ্জ্বলতা খুব তীব্রতায় গাঢ় অন্ধকারকে চিহ্নিত করতে পারে। আলোকিত মন প্রশ্ন করতে শিখছিল, একই সঙ্গে শিখছিল কর্তব্যবোধ। ‘ধানের জমিতে নীল চাষ/ কৃষকের গলায় ফাঁস’—এই উপলব্ধি প্রবচনে পৌঁছে যেতে না-যেতেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মমতার অকূল সাগরে ডুব দিয়ে তুলে আনলেন জিজ্ঞাসার অমূল্য রতন: ব্রিটিশরাজকে প্রশ্নবাণ ছুড়লেন, বিলেতে ছাত্রছাত্রীদের তোমরা পড়াচ্ছ জন স্টুয়ার্ট মিলের লজিক বা যুক্তিবিদ্যা, আর ভারতবর্ষে পাঠ্যসূচিতে পড়তে দিয়েছ বেদ-বেদান্ত, বাইবেল। কেন? বিলেতিরা হবে যুক্তিবাদী মানুষ আর ভারতবাসী শিক্ষার্থীরা ঈশ্বরের কৃপা খুঁজে খুঁজে আভূমি নতমুখ? তাতে তো তোমাদের লুটপাট, শোষণ-নিপীড়ন বাধাহীন, প্রতিরোধবিহীন। এইটুকু বুঝে, ঝলসে ওঠা এক না-কিশোর, না-তরুণ ক্ষুদিরাম ব্রিটিশ অনাচারের মুখে ছুড়ে দিল ক্ষোভের বোমা। ভাগ্যিস, মানুষ প্রশ্ন করার মতো একটি উন্নত মস্তিষ্ক পেয়েছিল! অসম্মানকে অসম্মান বলে চিনতে শিখেছিল!
আমাদের চারপাশেও ব্যক্তিগত অসম্মান প্রতিদিন বাড়ছে। পৃথিবীর সব জাতির, সব সমাজের, সব ব্যক্তির নানাবিধ মানবিক অধিকার সংরক্ষণের জন্য সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়েছে, তার নাম জাতিসংঘ। যথাযথ কাজ করুক না-করুক, মানুষ ও মানবতাসংক্রান্ত বেশ কিছু ধারা ও বিধানসংবলিত একটা সনদ তার আছে। আবার বিভিন্ন দেশের নিজস্ব সংবিধান আছে। এর সব কয়টিতেই মানুষের সমানাধিকারের বিধানটি পুনরাবৃত্ত হয়ে লেখা আছে। কিন্তু প্রয়োগ? চর্চা? স্বীকৃতি? এই প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে একটা অশ্বডিম্ব। একটা বাগাড়ম্বর। প্রমাণ দেব?
দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত একটা সংবাদে চোখ থমকে গিয়েছিল সেদিন। মন্ত্রী-সাংসদদের সম্পদের হিসাব চেয়ে নয়, অনুরোধ জানিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কাছে চিঠি দেওয়ার পর তারা একটি খসড়া তৈরি করেছে, পরে সেটার সারসংক্ষেপ করা হয়েছে এবং অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত তাতে স্বাক্ষরও করেছেন। গণতন্ত্রে তো এই-ই নিয়ম! কিন্তু, এটা যে বাংলাদেশ! সেই হিসাব কিন্তু প্রকাশ করবে না সরকার, অর্থমন্ত্রী সেই সিদ্ধান্তও জানিয়ে দিয়েছেন (প্রথম আলো, ২১ মার্চ)। কদিন আগে অন্যান্য দিনের মতোই স্কয়ার হাসপাতালের সামনে থেকে রিকশা নিয়ে সেন্ট্রাল রোডের স্টুডিওতে যাচ্ছিলাম। গ্রিন রোড সংযোগ-সড়কের সামনে আসতেই দুই পুলিশ সদস্য রিকশা থামালেন। বলা হলো, নামেন। প্রশ্ন করলাম, কেন? উত্তর, রিকশা যাবে না এই রাস্তায়। জানতে চাইলাম, কেন? কঠোর জবাব, এটা ভিআইপি রোড। পেছনের রিকশা থেকে কোলের শিশুসন্তান নিয়ে দুজন ভদ্রমহিলাও নামলেন। মাথার ওপরে মার্চ মাসের স্বাধীনতার আকাশ, অথচ চোখে-মুখে অসম্মানের কালো মেঘ মেখে চৌরাস্তার মোড়ে আমরা কজন এলআইপি (লেস ইম্পর্ট্যান্ট পারসন) দাঁড়িয়ে আছি। আমার চোখ নেমে আসে পায়ের দিকে, পথের দিকেও। এই পায়ে আরও অনেকের সঙ্গে নব্বইয়ে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে হেঁটেছিলাম। আবার হাঁটতে হবে?
হা মানুষ! হা জীবন!
মাহমুদুজ্জামান বাবু: গায়ক ও সংস্কৃতিকর্মী।
che21c@yahoo.com
No comments