শ্রদ্ধাঞ্জলি-তিনি আর ফিরবেন না by মোহাম্মদ মাজহারুল হান্নান

মনে পড়ছে ২০০৯ সালের ১৪ মার্চ কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আমার বড় ভাই ড. মো. মোজাহারুল ইসলাম বাংলাদেশে এসেছিলেন মা ও ভাই-বোনদের দেখতে। কটা দিন আপনজনদের মাঝে কাটিয়ে আবার ফিরে গিয়েছিলেন কেমব্রিজে। ২৮ মার্চ গভীর রাতে আমি ও ইফতেখার হোসেন (তৎকালীন পিইও) তাঁকে বিদায় জানাতে বিমানবন্দরে


গিয়েছিলাম। বিমানবন্দরে পৌঁছে নিরাপত্তাবেষ্টনীর ভেতরে যাওয়ার জন্য তাঁকে যখন বিদায় দিলাম, তখন রাত দুইটা বেজে গেছে। আমরা কেন জানি ফিরতে পারলাম না। মনে হলো ফিরে যাওয়ার আগে আর একবার ভাইয়ের্রসঙ্গে দেখা করে যাই। তাই বিমানবন্দরের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে আবার বিমানবন্দরের ভেতরে গিয়ে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের লাউঞ্জে ভাইয়ের কাছে গেলাম। আমাদের দেখে তিনি কিছুটা অবাক হলেন আবার খুশিও হলেন। তখন তিনি বলছিলেন যে ‘ভাবছি, এরপর তো আর ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ ঢাকায় আসবে না,’ অর্থাৎ ২০০৯ সালের ২৮ মার্চ ভোররাতে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের যে ফ্লাইটটি ঢাকা থেকে হিথ্রো বিমানবন্দরে গিয়েছিল, সেটিই ছিল ঢাকা-লন্ডন শেষ ফ্লাইট। তাই তো তিনি বলেছিলেন, ‘আমি এরপর কীভাবে আসব?’ কেননা ব্রিটিশ এয়ারওয়েজে লন্ডন থেকে সরাসরি ঢাকায় আসতে তিনি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। তিনি ছিলেন শান্তিপ্রিয়, সুশৃঙ্খল মানুষ। তাই তিনি সহজ ও সোজা পথ পছন্দ করতেন। কে জানত যে এ মানুষটির ঢাকা-লন্ডন-কেমব্রিজ পথে এটাই শেষ যাত্রা? হয়তো আবার কখনো ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ লন্ডন থেকে ঢাকা আসবে, আবার ঢাকা থেকে লন্ডনের পথে যাত্রাও করবে। কিন্তু ড. ইসলাম আর কোনো দিন যেমন আসবেন না, তেমনি বিদায় নিয়েও যাবেন না।
ঠিক এক সপ্তাহ পর, ৩ এপ্রিল ২০০৯ শুক্রবার রাত আটটায় বাড়ির টেলিফোনটি বেজে উঠল। ও প্রান্ত থেকে একজন বললেন, ‘আমি কেমব্রিজ থেকে ড. শেখ আবদুল মাবুদ বলছি। আপনার বড় ভাই ড. মো. মোজাহারুল ইসলাম আজ সকালে ইন্তেকাল করেছেন।’ আমি কোনোভাবেই তখন এ কথা মেনে নিতে পারছিলাম না। এরপর আমি আমার বাল্যবন্ধু হাজরা আওয়াল, যিনি কেমব্রিজে দীর্ঘদিন ধরে থাকেন, তাঁকে টেলিফোন করে সব বললাম। তিনি খোঁজখবর নিয়ে দ্রুত আমাকে ভাইয়ের মৃত্যুর খবর সঠিক বলে জানান।
তারপর ১০ এপ্রিল ২০০৯ শুক্রবার দুপুরে খুলনার কৃতী সন্তান ড. ইসলামের লাশ ঢাকা বিমানবন্দরে পৌঁছাল। ১১ এপ্রিল খুলনা মহানগরের টুটপাড়া গোরস্থানে তাঁকে দাফন করা হলো। কিছুদিন পর আমি কেমব্রিজে গিয়েছিলাম এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে যা জেনেছিলাম—৩ এপ্রিল ২০০৯ শুক্রবার সকালে ভাই তাঁর স্বাভাবিক নিয়মে বাড়ি থেকে দুই কিলোমিটার পথ হেঁটে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজ দায়িত্ব পালনের জন্য যাচ্ছিলেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে পৌঁছে যখন সেন্ট জনস্ কলেজের সামনে পৌঁছেছিলেন, ঠিক তখন হঠাৎ বুকে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন, তারপর সামান্য দু-তিন পা পেছনের দিকে যেতে গিয়ে রাস্তার ওপর পড়ে যান এবং সামনের কফি-স্টল থেকে কয়েকজন ছুটে এসে তাঁকে সাহায্য করার চেষ্টা করে। কিন্তু তাঁকে নির্বাক, নিশ্চুপ দেখে তারা পুলিশকে খবর দেয়। পুলিশ দ্রুত অ্যাম্বুলেন্স এনে তাঁকে কেমব্রিজ এডেনব্রুক হাসপাতালে নিয়ে যায়। হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁকে পরীক্ষা করে ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকের কারণে তাঁর মৃত্যু হয়েছে বলে জানান। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাইয়ের সহকর্মীদের সঙ্গে দেখা করতে গেলে তাৎক্ষণিভাবে তাঁরা এক সভায় মিলিত হয়ে সবাই অনেকভাবে তাঁর প্রশংসা করেন।
মো. মোজাহারুল ইসলাম ১৯৪৩ সালের ১ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মরহুম শাহ্ মোহাম্মদ ও মাতা উন্মেহানি খাতুনের তিনি ছিলেন প্রথম সন্তান। খুলনার সেন্ট যোসেফ হাইস্কুল থেকে ১৯৫৭ সালে ম্যাট্রিক পাস করে দৌলতপুর ব্রজলাল কলেজ থেকে ১৯৫৯ সালে ইন্টারমিডিয়েট এবং ১৯৬১ সালে গণিতে বিএসসি (অনার্স) (দুই বছরের) সমাপ্ত করেন। এরপর ১৯৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে মাস্টার ডিগ্রি অর্জন করে ঢাকা আণবিক কেন্দ্রে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা পদে যোগদান করেন এবং সেখান থেকে স্কলারশিপ নিয়ে পিএইচডি করার জন্য ১৯৬৬ সালে তিনি যুক্তরাজ্যের লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ে যান। যেখান থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের পর তিনি লন্ডন কুইন মেরি কলেজে ও লন্ডন ইউনিভার্সিটি কলেজে শিক্ষকতা করেন। সর্বশেষে তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করে সেখানেই জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ২২ বছরেরও বেশি কাজ করেছেন।
মো. মোজাহারুল ইসলাম ১৯৮৪ সালে কানাডার নিউ ফাউন্ডল্যান্ডের সুইনি পরিবারের শার্লি সুইনিকে বিবাহ করেন। তাঁর পারিবারিক জীবন ছিল সুখের। শার্লি ইসলাম দুরারোগ্য ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে ২০০৩ সালের ২ নভেম্বর কেমব্রিজেই ইন্তেকাল করেন। স্ত্রী শার্লির মৃত্যুর পর ২০০৪ সালে দেশে এসে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য আবদুল কাদির ভূঁইয়ার কাছে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে শার্লি ইসলামের নামে একটি লাইব্রেরি নির্মাণের জন্য আর্থিক অনুদান প্রদানের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৪ সালের ১১ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০৪তম সিন্ডিকেট সভায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘শার্লি ইসলাম লাইব্রেরি’ স্থাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
তিনি লাইব্রেরি নির্মাণ করতে প্রায় কোটি টাকা প্রদান করেছিলেন এবং বিলম্বে হলেও এখন লাইব্রেরি ভবনটি নির্মিত হয়েছে। তবে কেন জানি না আজও তার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়নি। আমাদের শিক্ষা কার্যক্রম প্রসারে একজন শিক্ষক ড. ইসলাম তাঁর সারা জীবনের কষ্টার্জিত সঞ্চয় থেকে অর্থ দান করে যে অবদান রেখেছেন, তা সত্যিই স্মরণীয়।
এই লাইব্রেরির পঠন-পাঠন কার্যক্রমের উদ্বোধনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অনতিবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন—আজ মো. মোজাহারুল ইসলামের মৃত্যুবার্ষিকীতে এ প্রত্যাশাই করি এবং তাঁর আত্মার মাগফিরাত কামনা করি।

No comments

Powered by Blogger.