'শান্তিরক্ষী নারীযোদ্ধা' by আবদুল মান্নান চৌধুরী

বইমেলায় আকস্মিক পরিচয় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মেডিকেল কোরের সদস্য ডা. নাজমা বেগম রাজুর সঙ্গে। লে. কর্নেল পদমর্যাদায় এই নারী আইভরি কোস্টে শান্তিরক্ষী বাহিনীতে দায়িত্ব পালন করেছেন প্রায় ১ বছর। আইভরি কোস্টের নাম শুনে তার সঙ্গে আলোচনায় উৎসাহী হলাম। কেননা আমারও আফ্রিকার দেশ নাইজেরিয়ায় কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে।


মেলা থেকে কিনেছি তার রচিত 'শান্তিরক্ষী নারীযোদ্ধা'। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষীতে বাংলাদেশের প্রথম দু'জন নারীযোদ্ধার মধ্যে তিনি একজন। বইটি শুরু হয়েছে 'অজানা আফ্রিকার অচিন গহীনে' শিরোনাম দিয়ে। বইতে বিবৃত হয়েছে স্থানীয় মানুষের জীবন-জীবিকা, সংগ্রাম, যন্ত্রণা, অবিবাহিত মায়ের একাকিত্ব ও কঠোর সংগ্রাম, এইডসের ব্যাপকতা এবং দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত সাধারণ মানুষের অসাধারণ জীবনযাপন। একটি জেলা শহররূপী দালোয়ারে এসব অভিজ্ঞতা অর্জিত হলেও রাজধানী আবিদজানের দৃশ্যপট ভিন্নতর। দালোয়ার লেখিকার কর্মস্থল হলেও মাঝে মধ্যে জরুরি প্রয়োজনে যেতে হয়েছে আবিদজানে বা আশপাশে। উভয় জায়গায় মানুষের পরিচিতি সংকট তাকে বেদনার্ত করেছে। আবিদজানের ইউরোপীয় জীবন স্টাইল, সম্পদের বৈষম্য, জনসংখ্যার অর্ধেক মুসলমান হলেও নাইট ক্লাব ও মদ্যপানের ব্যাপকতা তাকে ব্যথিত ও বিব্রত করেছে।
বইটির নাম 'শান্তিরক্ষী নারীযোদ্ধা' হলেও কোথাও যুদ্ধের বর্ণনা নেই। আছে শান্তি প্রতিষ্ঠার আকুতি। নাজমাদের কন্টিনজেন্ট গতানুগতিক সেনা চিকিৎসায় ব্যাপৃত না থেকে মানবিক কারণে দুস্থ মানুষের সেবায়ও নিয়োজিত ছিল। মানবিকতার ছোঁয়া দিয়ে তারা জয় করেছেন স্থানীয় কালো মানুষের মন। লিখতে গিয়ে নাজমা নিজেকে নিয়ে গেছেন ভিন্ন জগতে, ব্যবহার করেছেন এমন সব রূপক বা উপমা, যা জীবনানন্দ দাশের কবিতার গুচ্ছ বলে ভুল হতে পারে। তার শব্দ চয়ন, বাক্যবিন্যাস, ঘটনার নিখুঁত বর্ণনা এমনকি প্রতিটি অধ্যায়ের শেষে তার স্বরচিত কবিতা বা কবিতাংশ বইটিকে সৌন্দর্যমণ্ডিত ও আকর্ষণীয় করেছে। ১৪১ পৃষ্ঠার বইটিতে ৮ পৃষ্ঠাব্যাপী রয়েছে ১৬টি রঙিন আলোকচিত্র। আলোকচিত্রগুলোও মনে হয় কখনও কখনও বাঙ্ময়। আইভরি কোস্ট বা কুর্দি ভাষার কালো এ মানুষগুলোকে নাজমা যেমন ভালোবেসেছেন, তেমনি বিদেশে বসে তিনি নতুনভাবে আবিষ্কার করেছেন তার দেশকে, দেশের মানুষকে, তার দেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ এবং পেছনে ফেলে আসা দুটি সন্তান, বৃদ্ধ মা ও অসুস্থ স্বামীকে। তার বইয়ের বহু জায়গায় সন্তান ও স্বামী বিচ্ছেদের অনুরণ একজন চিরায়ত বাঙালি নারীকে আমাদের সামনে তুলে এনেছেন।
বইটি পড়ে মুগ্ধ হয়েছি যখন দেখলাম একজন নারীযোদ্ধা বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষায় গদ্য ও কবিতা লিখে তা স্থানীয় পত্রিকায় প্রকাশও করেন। আরও গর্বের বিষয় হলো, আমাদের বাহিনীর কর্তব্যনিষ্ঠা, শৃঙ্খলাবোধ ও সাধারণ মানুষের প্রতি তাদের মমত্ববোধ। তার প্রতিদানও আমাদের মিলেছে। সত্যি আনন্দ লাগে যে, আইভরি কোস্টে শিক্ষিত-অশিক্ষিত, মার্জিত-অমার্জিত, ধনী-দরিদ্র, নারী-শিশু নির্বিশেষে অনেকেই অতি খাঁটি বাংলায় কথা বলতে পারে। গর্বে বুক ভরে ওঠে যখন মাইলফলকে বাংলাদেশের দূরত্ব লেখা দেখা যায়।

অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী :শিক্ষাবিদ ও মুক্তিযোদ্ধা

No comments

Powered by Blogger.