স্বাধীনতা দিবস-বিলবোর্ড-ব্যানারে সরব সন্ত্রাসীরা! by একরামুল হক

চট্টগ্রামের তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী আবদুল কাদের ওরফে মাছ কাদের, মামুনুর রশিদ মামুন ওরফে কমিশনার মামুনের সৌজন্যে শহরে ডিজিটাল ব্যানার সাঁটানো হয়েছে। একইভাবে হত্যা মামলার আসামি ও যুবলীগের কর্মী মো. আলী হোসেন, হুমায়ুন কবির, খোকন চন্দ্র তাঁতী, দাঙ্গা-হাঙ্গামা মামলার আসামি দেলোয়ার হোসেন ওরফে দেলু, তৌহিদ আজিজ, জোশেপ পিনেরো প্রমুখের সৌজন্যেও শহরজুড়ে ব্যানার-পোস্টার।


চট্টগ্রামে কাল বুধবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মহাসমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। এই সমাবেশ সফল করার আহ্বান এবং তাঁকে স্বাগত জানিয়ে এসব ব্যানার সাঁটানো হয়েছে। এ নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতারাও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। একাধিক নেতা বলেছেন, জনসভাকে উপলক্ষ করে এরা কৌশলে নিজেদের প্রচারণায় নেমেছে।
নগরের টাইগারপাসের কাছে পলোগ্রাউন্ড মাঠে হবে প্রধানমন্ত্রীর সমাবেশ। এই সমাবেশ সামনে রেখে টাইগারপাস ও আশপাশের এলাকায় প্রায় সব বিলবোর্ড দখল হয়ে গেছে। বড় বড় ডিজিটাল ব্যানারে বিলবোর্ডগুলো ঢাকা পড়েছে। ব্যানারে বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা ও চট্টগ্রামের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের ছবির পাশে এসব সন্ত্রাসী আর পাতি নেতা নিজেদের ছবি ও নাম প্রচার করেছেন।
গত ৯ জানুয়ারি খালেদা জিয়ার মহাসমাবেশও একই মাঠে হয়েছিল। বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরও মহাসমাবেশের প্রচারণার জন্য একইভাবে ডিজিটাল ব্যানার ঝুলিয়েছিল শহরজুড়ে। ওই সময় ব্যানার ও পোস্টার সাঁটানোর জন্য সিটি করপোরেশনের জনবল ও গাড়ি ব্যবহার করা হয়েছিল।
নগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক খোরশেদ আলম সন্ত্রাসী ও দলীয় পাতি নেতা-কর্মীদের কঠোর সমালোচনা করে বলেন, ‘বিএনপি ৯ জানুয়ারির মহাসমাবেশের আগে বিলবোর্ড দখল করে যে খারাপ নজির স্থাপন করেছিল, সেটা কেন আওয়ামী লীগ অনুকরণ করবে?’ তিনি বলেন, ‘২৮ মার্চের মহাসমাবেশে আমাদের নেত্রী শেখ হাসিনা ভাষণ দেবেন। অথচ সন্ত্রাসী ও পাতি নেতা-কর্মীরা কিছু ডিজিটাল ব্যানারের এক কোণায় শেখ হাসিনার ছবি ছোট করে দিয়ে নিজের ছবি বড় করে প্রচার করছে। এরা জনসভার নয়, নিজেদের প্রচারে নেমেছে।’
নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘নিয়ম না মেনে রাতারাতি ডিজিটাল ব্যানার লাগানো হয়েছে। এই সুযোগে ওরা নিজেদের প্রচারণাও চালাচ্ছে, যা উচিত হয়নি।’
বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান নিজেদের পণ্য ও ব্যবসায়িক প্রচারণার জন্য বার্ষিক চুক্তিতে বিলবোর্ডগুলো ভাড়া নিয়েছে। সিটি করপোরেশন ও বাংলাদেশ রেলওয়ে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে তা ইজারা দিয়েছে। এই অবস্থায় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের পণ্যের প্রচারণা ঢেকে গেছে ওই সব ডিজিটাল ব্যানারে।
বিলবোর্ড ব্যবহারকারী একজন ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে বলেন, ‘পানিতে থেকে কুমিরের সঙ্গে লড়াই করতে চাই না। দুই দলই একই কাজ করল।’
নগর আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক শফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্যক্তি উদ্যোগে ডিজিটাল ব্যানার সাঁটানো হয়েছে। মহাসমাবেশকে আকর্ষণীয় করা এবং লোকসমাগম বাড়ানোর জন্য তা করা হয়েছে। তবে নিজেদের ছবি লাগিয়ে কেউ ব্যানার বা পোস্টার লাগাতে পারবে না বলে দলের সভাপতি মহিউদ্দিন চৌধুরীর নির্দেশনা ছিল। অনেকে এই নির্দেশনা মানেনি, যা দুঃখজনক।’
নির্দেশনা যারা মানেনি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না, জানতে চাইলে শফিকুল বলেন, ‘এটা ওপরের বিষয়।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতি বর্গফুট ডিজিটাল ব্যানারের জন্য খরচ হয় ১৩ থেকে ১৫ টাকা। একেকটি ব্যানারের আয়তন ২০ থেকে এক হাজার বর্গফুট পর্যন্ত। ফলে সন্ত্রাসীদের এসব ব্যানার তৈরির টাকার উৎস নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
মামুন ও মাছ কাদের র‌্যাব এবং পুলিশের তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী। মামুন পুলিশের খাতায় পলাতক থাকলেও প্রকাশ্যেই রাজনৈতিক তৎপরতা চালাচ্ছেন।
গতকাল যোগাযোগ করা হলে আবদুল কাদের প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি ১০ বছর জেলে ছিলাম। আমার ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে। গত তিন বছর শুধু আগের মামলায় হাজিরা দিয়ে আসছি। আমার বিরুদ্ধে নতুন করে কোনো অভিযোগ নেই। প্রধানমন্ত্রী আসছেন বলে আমি প্রচারণা চালাতে ব্যানার টানিয়েছি। এতে দোষের কী আছে?’
একপর্যায়ে কাদের বলেন, ‘আমাকে ব্যবহার করে অনেকে নেতা হয়েছেন, দামি গাড়ি হাঁকান। অথচ আমি বাবার ভিটায় নতুন করে একটি দেয়ালও তুলতে পারিনি।’
আলী হোসেন টাইগার পাস এলাকায় সংঘটিত আমিনুল ইসলাম ও প্রকৌশলী সঞ্জীব হত্যা মামলার আসামি। খোকন চন্দ্র তাঁতীও আমিনুল ইসলাম হত্যা মামলার আসামি।
আলী হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি ৪৫০, ৬০০ ও ৯০০ বর্গফুটের তিনটি ডিজিটাল ব্যানার লাগিয়েছি।’ টাকার উৎস সম্পর্কে জানতে চাইলে আলী বলেন, ‘আমার নিজের ব্যবসা আছে। পরিচিত কিছু ব্যক্তির কাছ থেকেও সামান্য চাঁদা নিয়েছি।’ একপর্যায়ে তিনি বলেন, ‘আমি ছোট মানুষ। আপনি কেন আমার পেছনে লেগেছেন?’
খোকন চন্দ্র তাঁতী বলেন, ‘একসময় ছাত্ররাজনীতি করতাম। এ কারণে আমার অনেক অনুসারী আছে। তারাই এই ব্যানার লাগিয়েছে।’
হুমায়ুন কবির নগরের আরেক হুমায়ুন ও মাইনুল হত্যা মামলার আসামি। রাজীব দত্ত ওরফে রিংকু ইসলামিয়া কলেজের ছাত্রনেতা ফরিদ হত্যা মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামি। দেলোয়ার হোসেন হত্যাচেষ্টা ও জমি দখল মামলার আসামি। নেতাদের ছবির পাশে নিজের ছবি দিয়ে তাঁরা শহরময় ব্যানার সাঁটিয়েছেন।
এঁদের বিষয়ে বক্তব্য নেওয়ার জন্য একাধিক পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তাঁরা কেউই কথা বলতে রাজি হননি।

No comments

Powered by Blogger.