অরণ্যে রোদন-আমরাই চ্যাম্পিয়ন... by আনিসুল হক
২৬ মার্চ ২০১২ এই লেখাটি লিখছি—স্বাধীনতার ৪১তম বার্ষিকীর দিনটিতে। কী সুন্দর আলোকিত দিন! আমার এক চিলতে বারান্দায় সামনের ভবনের ফাঁক গলেও নাছোড় রোদ এসে পড়েছে। টবের সবুজ পাতায় পাতায় আলোর নাচন। ভালো লাগার এক স্নিগ্ধ অনুভূতিতে মনটা ভরে আছে।
আমি কম্পিউটারে লিখি। আমার ল্যাপটপ খুলতেই ওয়ালপেপারে সেই ছবিটা। সাকিব আল হাসানের বুকে মুশফিক আর নাসির। সাকিব দূরে তাকিয়ে কান্না চাপার চেষ্টা করছেন। তাঁর চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসছে।
কিন্তু এ ছবির দিকে তাকিয়ে কোনো দীর্ঘশ্বাস আমার বুক থেকে বেরিয়ে এল না। বরং একটা বিজয়ের গৌরব আমার অনুভূতিজুড়ে।
ফাইনাল খেলার দিন সকালে প্রথম আলোর অনলাইন সংস্করণে একটা লেখা লিখেছিলাম; ‘আমরা যেভাবে চ্যাম্পিয়ন হতে পারি’। তাতে বলেছিলাম, ক্রিকেট খুব অনিশ্চিত খেলা। জয়-পরাজয় আমাদের হাতে নেই। কিন্তু আমরা চ্যাম্পিয়ন হতে পারি সুখেলোয়াড়সুলভ আচরণ দিয়ে, স্বাগতিক হিসেবে অতিথিদের সঙ্গে মহত্তম আচরণ করে। ফলের প্রতিক্রিয়া সুন্দরভাবে প্রকাশ করার মাধ্যমে।
আমি খেলা দেখেছি যে গ্যালারিতে, সেখানেই ছিলেন পাকিস্তান থেকে আগত সেই ভদ্রলোক, যাঁর উচ্চতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘কাবুলিওয়ালা’ গল্পের রহমতের মতো, গোঁফ দুটো দশাসই। তিনি পাকিস্তানের পতাকা উড়িয়ে একটা বিকট ঢাক পেটাতে থাকেন। এর আগেও তাঁকে দেখেছি। তিনি এর আগে ঢাক পেটাতেন হাত দিয়ে। ফাইনাল খেলার দিন একটা বোতল দিয়ে এমনভাবে ঢাক বাজাচ্ছিলেন যে সেটা কর্ণপীড়ারই সৃষ্টি করছিল। একজন-দুজন দর্শক তাঁকে বললেন, ‘আপনি বোতল দিয়ে নয়, হাত দিয়ে বাজান। গ্যালারিতে বোতল নেওয়া তো নিষেধ।’ তিনি শুনলেন না। খেলা তখন শ্বাসরোধকারী উত্তেজনায় চলে গেছে। শেষ ওভার। চারদিকে নীরবতা। এর মধ্যে বাংলাদেশের উইকেট পড়তেই তাঁর ঢাক আবারও গর্জে উঠল। একজন দর্শক খেপে গেলেন। ‘এই মিয়া, তোমারে যে কইছি বোতল দিয়া বাজাইবা না, কথা শোনো না কেন?’ তখন খেলার যে অবস্থা, তাতে ওই ভদ্রলোকের গায়ে হাত পড়তে পারত। কিন্তু বিস্ময়করভাবে সবাই নিবৃত্ত করল ওই উত্তেজিত বাংলাদেশ সমর্থকটিকে এবং অন্তত ১০ জন স্যরি বলল ওই পাকিস্তানি ব্যক্তিটিকে। এই যে ধৈর্য, সহিষ্ণুতা, এই যে ঔদার্য, এই যে আতিথেয়তা—এটাই তো একটা দেশকে চ্যাম্পিয়ন করে তোলে। ইংল্যান্ডের মাটিতে যখন খেলা হয়, তখন ভারতীয় বংশোদ্ভূতেরা ভারতকে, বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতেরা বাংলাদেশকে সমর্থন করে। এই নিয়ে কোনো সমালোচনা হয় না। বাংলাদেশে ভিনদেশিরা আসবেন, তাঁরা নিজের দেশের দলকে সমর্থন জানাবেন। আমরা তাঁদের বাঙালির ঐতিহ্যবাহী আতিথেয়তা দেখাব। এতেই তো আমাদের গৌরব বাড়বে।
কিন্তু বহু ব্যাপারে আমাদের আচরণ একটু আদিম সমাজের মতো। রাস্তায় কোনো গাড়ি যদি দুর্ঘটনা ঘটায়, আমরা সেই গাড়ি তো ভাঙচুর করিই, এরপর যত গাড়ি সামনে পাই, তাতেও হামলে পড়ি। এই তো সেদিন ডাকাত সন্দেহে আমিনবাজারের কাছে কয়েকজন ছাত্রকে মেরে ফেলা হয়েছে গণপিটুনিতে। সাধারণ মানুষ এই রকম তো করেই, আমাদের রাষ্ট্রও অনেক সময় এসব অনুমোদন করে। ‘ক্রসফায়ারে’র নামে এই দেশে বিনা বিচারে মানুষ মেরে ফেলা হয়। সেই দেশে ক্রিকেটে হারলে প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে, আমরা জানি না। শুধু কি হারলে প্রতিক্রিয়া হয় মারাত্মক? জিতলেও হয়। আমরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়ি। রাস্তাঘাট বন্ধ করে গাড়ির ওপর উঠে লাফাতে থাকি। গাড়ি ভাঙচুর হয়। রং নিয়ে রাস্তায় নামি এবং নির্বিচারে রং ছুড়তে থাকি। আর মেয়েদের রাস্তায় দেখলে তাদের অসম্মানিত করাটা যেন বিজয়ীর বৈধ অধিকার বলে কখনো-সখনো ভেবে নিই। শ্রীলঙ্কার সঙ্গে জেতার পরও আমি স্টেডিয়াম থেকে বের হওয়ার পথে বিপন্ন বোধ করেছিলাম। আমাকে হাবিবুল বাশার বললেন, তিনিও তাঁর গাড়ি নিয়ে বিপদে পড়েছিলেন। আমাদের এক নারী সহকর্মী স্বামীসহ স্টেডিয়াম থেকে ফেরার পথে রং তো খেয়েইছেন, খুব বিপন্ন বোধ করে শেষে একটা টেলিভিশনের গাড়িতে আশ্রয় ভিক্ষা করেছেন।
জাতি হিসেবে আমাদের আরেকটু পরিপক্ব হতে হবে। আরেকটু শৃঙ্খলা, ভব্যতার চর্চা করতে হবে। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মতো যোগ্যতা ও পরিপক্বতার পরিচয় দিতে হবে।
২২ মার্চের ফাইনালে আসলে আমরা সেই পরীক্ষাতেই পাস করেছি। দুই রান তো কোনো ব্যাপারই নয়। এটা যেকোনোভাবেই হতে পারত। নাজমুল যদি আহত না হতেন, তাহলে তিনি আরও দুই ওভার বেশি বল করতে পারতেন। তাহলে পাকিস্তানের রান হয়তো ১০-১৫টা কম হতো। মুশকিকের ছক্কাটা হয়ে যেতে পারত, শেষ দুই বলে একটা চার হওয়া অসম্ভব কোনো ব্যাপার ছিল না। কিন্তু তা হয়নি। তাতে কোনো ক্ষতি হয়নি। পাকিস্তানের ইংরেজি দৈনিক ডন পর্যন্ত লিখেছে, পাকিস্তান এশিয়া কাপ জিতল আর বাংলাদেশ জিতল হূদয়।
আর সাকিব আল হাসান, মুশফিকদের কান্নার সঙ্গে কেঁদেছে পুরো বাংলাদেশ। সেই অশ্রুতে কোনো মালিন্য ছিল না। পরাজয়ের গ্লানি ছিল না। আমাদের ক্রিকেট পুরো জাতিকে একটা সূত্রে গ্রথিত করেছে—তা হলো, আমরা ১৬ কোটি মানুষ বাংলাদেশের জয় চাই। প্রশ্ন যখন দেশের জয়-পরাজয় নিয়ে, তখন আমরা সবাই এক, আমাদের সবার হূদয়ের চাওয়া অভিন্ন। সাবাস, মুশফিক, সাকিব, তামিম, মাশরাফি, নাসির। বাচ্চা বাচ্চা ছেলেগুলো পুরো জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছে।
এই দিনে আমার মনে পড়ছে আরেক জনের কথা। ১৯৭১ সালে তিনিও ছিলেন এদেরই মতো বাচ্চা ছেলে, মাত্র একুশ বছরের। তাঁর নাম আবদুল হালিম চৌধুরী। ডাকনাম জুয়েল। পূর্ব পাকিস্তান ক্রিকেট দলের উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান ছিলেন। ওই সময় যা দেখা যেত না, তা-ই করতেন জুয়েল। তিনি ছিলেন স্ট্রোক খেলোয়াড়, বল সীমানা পার করাতেন দেদারসে। মোহামেডানে খেলতেন, আগে খেলেছেন আজাদ বয়েজে।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনা ট্যাংক-কামান নিয়ে নিরস্ত্র দেশবাসীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। বস্তি পোড়ায়, ছাত্রাবাসে হামলা করে, ইপিআর আর পুলিশের ঘাঁটিতে কামান দাগে, যাকে সামনে পায় তাকেই গুলি করতে থাকে। ছাত্রাবাস থেকে ছাত্রদের ধরে এনে কাতারবন্দী করে গুলি করে। সেই অসংখ্য শহীদের একজন হচ্ছেন ক্রিকেট-সংগঠক মুশতাক; তিনি ছিলেন আজাদ বয়েজ স্পোর্টিং ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা। এখনকার এশিয়া ক্রিকেট কাউন্সিলের কর্মকর্তা সৈয়দ আশরাফুল হক আমাকে বলেছেন, ২৭ মার্চ দুপুরের দিকে তিনি আর জুয়েল মুশতাক ভাইয়ের লাশ দেখতে যান ঢাকা জেলা ক্রীড়া পরিষদ ভবনের সামনে। গিয়ে দেখেন, দুই দিনের বাসি মৃতদেহটা চিৎ হয়ে পড়ে আছে, হাত দুটো ওপরে ধরা।
সেদিনই জুয়েল প্রতিজ্ঞা করেন, এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হবে। তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে সীমান্ত পাড়ি দেন। আগরতলা থেকে ট্রেনিং নিয়ে ফিরে এসে ঢাকায় গেরিলা অপারেশনে যোগ দেন। যে হাতে ব্যাট চালাতেন, সেই হাতে তুলে নেন আগ্নেয়াস্ত্র। অনেকগুলো সফল অভিযান পরিচালনা করেন তাঁরা। সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন অপারেশনে জুয়েলের হাতে গুলি লাগে। তিনি ঢাকায় মগবাজার এলাকায় হাবিবুল আলমের (বীর প্রতীক) বাসায় থেকে হাতের চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। ১৯৭১ সালের ৩১ আগস্ট ঢাকার অনেক মুক্তিযোদ্ধা শেল্টারে হামলা করে পাকিস্তানি সেনারা। ওই দিন জুয়েলরা ছিলেন আজাদের বাসায়, যে আজাদ মা বইয়ের প্রধান চরিত্র। আজাদদের মগবাজারের বাড়ি থেকে পাকিস্তানি সেনারা ধরে নিয়ে যায় জুয়েল, আজাদসহ অনেককে। জুয়েল কিংবা আজাদ, রুমী কিংবা বদি—কেউ আর ফিরে আসেননি।
জুয়েল আর মুশতাকের স্মরণে বিজয় দিবসে শহীদ জুয়েল একাদশ বনাম শহীদ মুশতাক একাদশ প্রীতি ক্রিকেট ম্যাচ হয়। আর জুয়েলের নামে মিরপুর স্টেডিয়ামে গ্যালারি আছে শহীদ জুয়েল স্ট্যান্ড নামে।
মুক্তিযুদ্ধে যারা যোগ দিয়েছিল, তারা ছিল এমনি তরুণ, কিশোর। জাহানারা ইমামের ছেলে রুমী কেবল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্যচিত্রগুলোতে আমরা দেখি, মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে কিশোর যোদ্ধা ছিল অনেক আর ছিল সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। তাদের পায়ে জুতো ছিল না। পরনের কাপড় মলিন।
অনেক রক্তের দামে আমরা ৪১ বছর আগে স্বাধীনতা পেয়েছিলাম।
২৬ মার্চ ২০১২-এর প্রথম আলোর প্রধান খবরটা বলছে, ‘বাংলাদেশ এখন অনেক দেশের জন্যই উদাহরণ’। আমাদের গড় আয়ু বেড়েছে, ৯০ ভাগের বেশি ছেলেমেয়ে স্কুলে যায়, মাতৃমৃত্যুর হার কমেছে, দারিদ্র্য কমেছে, মাথাপিছু আয় বেড়েছে এবং মানব উন্নয়ন সূচকের অনেকগুলোতেই আমরা ভালো করছি। ১৯৭১ সালে মার্কিনিরা বলেছিল, বাংলাদেশ নামের দেশটা টিকবে না (‘ভায়াবল’) হবে না। ৪০ বছরে আমরা কেবল টিকে আছি তা-ই নয়, আমরা ক্রমাগত সামনের দিকে এগিয়ে প্রমাণ করেছি, স্বাধীনতাই হলো সেই বীজমন্ত্র, যা আমাদের টিকিয়ে রেখেছে, যা আমাদের ক্রমাগত এগিয়ে নিচ্ছে।
১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মার্চে পাকিস্তান ক্রিকেট দলে একজন মাত্র বাঙালি ক্রিকেটার খেলেছিলেন, তিনি রকিবুল হাসান। জুয়েল বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ স্বাধীন হবে, আমি খেলব স্বাধীন বাংলাদেশ দলের হয়ে।’ আজকে জুয়েল নেই, কিন্তু একটা আইসিসির পূর্ণ সদস্য দল আছে, যেখানে ১১ জন বাঙালি ক্রিকেট খেলেন, যাঁদের কাছে ভারত, শ্রীলঙ্কা পরাজিত হয়, পাকিস্তানও যাদের সঙ্গে খেলতে গিয়ে ভাবে, ‘আমরা কি অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে খেলছি?’
শহীদ জুয়েলের ব্যাট আজ মুশফিক-তামিমদের হাতে।
আমরা বিদেশি ক্রিকেট খেলোয়াড়দের ওপর গুলিবর্ষণ করি না, আমরা শচীন টেন্ডুলকারের শততম শতকের সময়ে দাঁড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন করি। শাকিব-মুশফিকদের অশ্রুর সঙ্গে মিশে যায় আমাদের প্রত্যেকের অশ্রু।
আর ক্রিকেট দলের পরাজয়ের প্রতিক্রিয়ায় একজনের আত্মহত্যা, আরেকজনের মৃত্যুর খবর পেয়ে মুশফিকুর রহমান কী সুন্দর বিবৃতিটাই না দিলেন। কী চমৎকার দায়িত্বশীলতার পরিচয়ই না পেলাম আমাদের অধিনায়কের কাছে।
আমরাই তো চ্যাম্পিয়ন।
জাতি হিসেবে আমাদের সাফল্যের ধারা যদি অব্যাহত থাকে, শিক্ষায়-দীক্ষায়, সভ্যতায়-ভব্যতায়, আচার-ব্যবহার-সুশৃঙ্খলায় আমরা জাতি এগিয়ে যেতে থাকি, ক্রিকেটে কেবল এশিয়া কাপে নয়, বিশ্বকাপেও আমরাই হব চ্যাম্পিয়ন।
আজ ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবসের উজ্জ্বল দিনটি আমাদের সেই সুন্দর আগামীর আগমনবার্তাই যেন জানান দিচ্ছে।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
কিন্তু এ ছবির দিকে তাকিয়ে কোনো দীর্ঘশ্বাস আমার বুক থেকে বেরিয়ে এল না। বরং একটা বিজয়ের গৌরব আমার অনুভূতিজুড়ে।
ফাইনাল খেলার দিন সকালে প্রথম আলোর অনলাইন সংস্করণে একটা লেখা লিখেছিলাম; ‘আমরা যেভাবে চ্যাম্পিয়ন হতে পারি’। তাতে বলেছিলাম, ক্রিকেট খুব অনিশ্চিত খেলা। জয়-পরাজয় আমাদের হাতে নেই। কিন্তু আমরা চ্যাম্পিয়ন হতে পারি সুখেলোয়াড়সুলভ আচরণ দিয়ে, স্বাগতিক হিসেবে অতিথিদের সঙ্গে মহত্তম আচরণ করে। ফলের প্রতিক্রিয়া সুন্দরভাবে প্রকাশ করার মাধ্যমে।
আমি খেলা দেখেছি যে গ্যালারিতে, সেখানেই ছিলেন পাকিস্তান থেকে আগত সেই ভদ্রলোক, যাঁর উচ্চতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘কাবুলিওয়ালা’ গল্পের রহমতের মতো, গোঁফ দুটো দশাসই। তিনি পাকিস্তানের পতাকা উড়িয়ে একটা বিকট ঢাক পেটাতে থাকেন। এর আগেও তাঁকে দেখেছি। তিনি এর আগে ঢাক পেটাতেন হাত দিয়ে। ফাইনাল খেলার দিন একটা বোতল দিয়ে এমনভাবে ঢাক বাজাচ্ছিলেন যে সেটা কর্ণপীড়ারই সৃষ্টি করছিল। একজন-দুজন দর্শক তাঁকে বললেন, ‘আপনি বোতল দিয়ে নয়, হাত দিয়ে বাজান। গ্যালারিতে বোতল নেওয়া তো নিষেধ।’ তিনি শুনলেন না। খেলা তখন শ্বাসরোধকারী উত্তেজনায় চলে গেছে। শেষ ওভার। চারদিকে নীরবতা। এর মধ্যে বাংলাদেশের উইকেট পড়তেই তাঁর ঢাক আবারও গর্জে উঠল। একজন দর্শক খেপে গেলেন। ‘এই মিয়া, তোমারে যে কইছি বোতল দিয়া বাজাইবা না, কথা শোনো না কেন?’ তখন খেলার যে অবস্থা, তাতে ওই ভদ্রলোকের গায়ে হাত পড়তে পারত। কিন্তু বিস্ময়করভাবে সবাই নিবৃত্ত করল ওই উত্তেজিত বাংলাদেশ সমর্থকটিকে এবং অন্তত ১০ জন স্যরি বলল ওই পাকিস্তানি ব্যক্তিটিকে। এই যে ধৈর্য, সহিষ্ণুতা, এই যে ঔদার্য, এই যে আতিথেয়তা—এটাই তো একটা দেশকে চ্যাম্পিয়ন করে তোলে। ইংল্যান্ডের মাটিতে যখন খেলা হয়, তখন ভারতীয় বংশোদ্ভূতেরা ভারতকে, বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতেরা বাংলাদেশকে সমর্থন করে। এই নিয়ে কোনো সমালোচনা হয় না। বাংলাদেশে ভিনদেশিরা আসবেন, তাঁরা নিজের দেশের দলকে সমর্থন জানাবেন। আমরা তাঁদের বাঙালির ঐতিহ্যবাহী আতিথেয়তা দেখাব। এতেই তো আমাদের গৌরব বাড়বে।
কিন্তু বহু ব্যাপারে আমাদের আচরণ একটু আদিম সমাজের মতো। রাস্তায় কোনো গাড়ি যদি দুর্ঘটনা ঘটায়, আমরা সেই গাড়ি তো ভাঙচুর করিই, এরপর যত গাড়ি সামনে পাই, তাতেও হামলে পড়ি। এই তো সেদিন ডাকাত সন্দেহে আমিনবাজারের কাছে কয়েকজন ছাত্রকে মেরে ফেলা হয়েছে গণপিটুনিতে। সাধারণ মানুষ এই রকম তো করেই, আমাদের রাষ্ট্রও অনেক সময় এসব অনুমোদন করে। ‘ক্রসফায়ারে’র নামে এই দেশে বিনা বিচারে মানুষ মেরে ফেলা হয়। সেই দেশে ক্রিকেটে হারলে প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে, আমরা জানি না। শুধু কি হারলে প্রতিক্রিয়া হয় মারাত্মক? জিতলেও হয়। আমরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়ি। রাস্তাঘাট বন্ধ করে গাড়ির ওপর উঠে লাফাতে থাকি। গাড়ি ভাঙচুর হয়। রং নিয়ে রাস্তায় নামি এবং নির্বিচারে রং ছুড়তে থাকি। আর মেয়েদের রাস্তায় দেখলে তাদের অসম্মানিত করাটা যেন বিজয়ীর বৈধ অধিকার বলে কখনো-সখনো ভেবে নিই। শ্রীলঙ্কার সঙ্গে জেতার পরও আমি স্টেডিয়াম থেকে বের হওয়ার পথে বিপন্ন বোধ করেছিলাম। আমাকে হাবিবুল বাশার বললেন, তিনিও তাঁর গাড়ি নিয়ে বিপদে পড়েছিলেন। আমাদের এক নারী সহকর্মী স্বামীসহ স্টেডিয়াম থেকে ফেরার পথে রং তো খেয়েইছেন, খুব বিপন্ন বোধ করে শেষে একটা টেলিভিশনের গাড়িতে আশ্রয় ভিক্ষা করেছেন।
জাতি হিসেবে আমাদের আরেকটু পরিপক্ব হতে হবে। আরেকটু শৃঙ্খলা, ভব্যতার চর্চা করতে হবে। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মতো যোগ্যতা ও পরিপক্বতার পরিচয় দিতে হবে।
২২ মার্চের ফাইনালে আসলে আমরা সেই পরীক্ষাতেই পাস করেছি। দুই রান তো কোনো ব্যাপারই নয়। এটা যেকোনোভাবেই হতে পারত। নাজমুল যদি আহত না হতেন, তাহলে তিনি আরও দুই ওভার বেশি বল করতে পারতেন। তাহলে পাকিস্তানের রান হয়তো ১০-১৫টা কম হতো। মুশকিকের ছক্কাটা হয়ে যেতে পারত, শেষ দুই বলে একটা চার হওয়া অসম্ভব কোনো ব্যাপার ছিল না। কিন্তু তা হয়নি। তাতে কোনো ক্ষতি হয়নি। পাকিস্তানের ইংরেজি দৈনিক ডন পর্যন্ত লিখেছে, পাকিস্তান এশিয়া কাপ জিতল আর বাংলাদেশ জিতল হূদয়।
আর সাকিব আল হাসান, মুশফিকদের কান্নার সঙ্গে কেঁদেছে পুরো বাংলাদেশ। সেই অশ্রুতে কোনো মালিন্য ছিল না। পরাজয়ের গ্লানি ছিল না। আমাদের ক্রিকেট পুরো জাতিকে একটা সূত্রে গ্রথিত করেছে—তা হলো, আমরা ১৬ কোটি মানুষ বাংলাদেশের জয় চাই। প্রশ্ন যখন দেশের জয়-পরাজয় নিয়ে, তখন আমরা সবাই এক, আমাদের সবার হূদয়ের চাওয়া অভিন্ন। সাবাস, মুশফিক, সাকিব, তামিম, মাশরাফি, নাসির। বাচ্চা বাচ্চা ছেলেগুলো পুরো জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছে।
এই দিনে আমার মনে পড়ছে আরেক জনের কথা। ১৯৭১ সালে তিনিও ছিলেন এদেরই মতো বাচ্চা ছেলে, মাত্র একুশ বছরের। তাঁর নাম আবদুল হালিম চৌধুরী। ডাকনাম জুয়েল। পূর্ব পাকিস্তান ক্রিকেট দলের উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান ছিলেন। ওই সময় যা দেখা যেত না, তা-ই করতেন জুয়েল। তিনি ছিলেন স্ট্রোক খেলোয়াড়, বল সীমানা পার করাতেন দেদারসে। মোহামেডানে খেলতেন, আগে খেলেছেন আজাদ বয়েজে।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনা ট্যাংক-কামান নিয়ে নিরস্ত্র দেশবাসীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। বস্তি পোড়ায়, ছাত্রাবাসে হামলা করে, ইপিআর আর পুলিশের ঘাঁটিতে কামান দাগে, যাকে সামনে পায় তাকেই গুলি করতে থাকে। ছাত্রাবাস থেকে ছাত্রদের ধরে এনে কাতারবন্দী করে গুলি করে। সেই অসংখ্য শহীদের একজন হচ্ছেন ক্রিকেট-সংগঠক মুশতাক; তিনি ছিলেন আজাদ বয়েজ স্পোর্টিং ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা। এখনকার এশিয়া ক্রিকেট কাউন্সিলের কর্মকর্তা সৈয়দ আশরাফুল হক আমাকে বলেছেন, ২৭ মার্চ দুপুরের দিকে তিনি আর জুয়েল মুশতাক ভাইয়ের লাশ দেখতে যান ঢাকা জেলা ক্রীড়া পরিষদ ভবনের সামনে। গিয়ে দেখেন, দুই দিনের বাসি মৃতদেহটা চিৎ হয়ে পড়ে আছে, হাত দুটো ওপরে ধরা।
সেদিনই জুয়েল প্রতিজ্ঞা করেন, এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হবে। তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে সীমান্ত পাড়ি দেন। আগরতলা থেকে ট্রেনিং নিয়ে ফিরে এসে ঢাকায় গেরিলা অপারেশনে যোগ দেন। যে হাতে ব্যাট চালাতেন, সেই হাতে তুলে নেন আগ্নেয়াস্ত্র। অনেকগুলো সফল অভিযান পরিচালনা করেন তাঁরা। সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন অপারেশনে জুয়েলের হাতে গুলি লাগে। তিনি ঢাকায় মগবাজার এলাকায় হাবিবুল আলমের (বীর প্রতীক) বাসায় থেকে হাতের চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। ১৯৭১ সালের ৩১ আগস্ট ঢাকার অনেক মুক্তিযোদ্ধা শেল্টারে হামলা করে পাকিস্তানি সেনারা। ওই দিন জুয়েলরা ছিলেন আজাদের বাসায়, যে আজাদ মা বইয়ের প্রধান চরিত্র। আজাদদের মগবাজারের বাড়ি থেকে পাকিস্তানি সেনারা ধরে নিয়ে যায় জুয়েল, আজাদসহ অনেককে। জুয়েল কিংবা আজাদ, রুমী কিংবা বদি—কেউ আর ফিরে আসেননি।
জুয়েল আর মুশতাকের স্মরণে বিজয় দিবসে শহীদ জুয়েল একাদশ বনাম শহীদ মুশতাক একাদশ প্রীতি ক্রিকেট ম্যাচ হয়। আর জুয়েলের নামে মিরপুর স্টেডিয়ামে গ্যালারি আছে শহীদ জুয়েল স্ট্যান্ড নামে।
মুক্তিযুদ্ধে যারা যোগ দিয়েছিল, তারা ছিল এমনি তরুণ, কিশোর। জাহানারা ইমামের ছেলে রুমী কেবল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্যচিত্রগুলোতে আমরা দেখি, মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে কিশোর যোদ্ধা ছিল অনেক আর ছিল সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। তাদের পায়ে জুতো ছিল না। পরনের কাপড় মলিন।
অনেক রক্তের দামে আমরা ৪১ বছর আগে স্বাধীনতা পেয়েছিলাম।
২৬ মার্চ ২০১২-এর প্রথম আলোর প্রধান খবরটা বলছে, ‘বাংলাদেশ এখন অনেক দেশের জন্যই উদাহরণ’। আমাদের গড় আয়ু বেড়েছে, ৯০ ভাগের বেশি ছেলেমেয়ে স্কুলে যায়, মাতৃমৃত্যুর হার কমেছে, দারিদ্র্য কমেছে, মাথাপিছু আয় বেড়েছে এবং মানব উন্নয়ন সূচকের অনেকগুলোতেই আমরা ভালো করছি। ১৯৭১ সালে মার্কিনিরা বলেছিল, বাংলাদেশ নামের দেশটা টিকবে না (‘ভায়াবল’) হবে না। ৪০ বছরে আমরা কেবল টিকে আছি তা-ই নয়, আমরা ক্রমাগত সামনের দিকে এগিয়ে প্রমাণ করেছি, স্বাধীনতাই হলো সেই বীজমন্ত্র, যা আমাদের টিকিয়ে রেখেছে, যা আমাদের ক্রমাগত এগিয়ে নিচ্ছে।
১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মার্চে পাকিস্তান ক্রিকেট দলে একজন মাত্র বাঙালি ক্রিকেটার খেলেছিলেন, তিনি রকিবুল হাসান। জুয়েল বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ স্বাধীন হবে, আমি খেলব স্বাধীন বাংলাদেশ দলের হয়ে।’ আজকে জুয়েল নেই, কিন্তু একটা আইসিসির পূর্ণ সদস্য দল আছে, যেখানে ১১ জন বাঙালি ক্রিকেট খেলেন, যাঁদের কাছে ভারত, শ্রীলঙ্কা পরাজিত হয়, পাকিস্তানও যাদের সঙ্গে খেলতে গিয়ে ভাবে, ‘আমরা কি অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে খেলছি?’
শহীদ জুয়েলের ব্যাট আজ মুশফিক-তামিমদের হাতে।
আমরা বিদেশি ক্রিকেট খেলোয়াড়দের ওপর গুলিবর্ষণ করি না, আমরা শচীন টেন্ডুলকারের শততম শতকের সময়ে দাঁড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন করি। শাকিব-মুশফিকদের অশ্রুর সঙ্গে মিশে যায় আমাদের প্রত্যেকের অশ্রু।
আর ক্রিকেট দলের পরাজয়ের প্রতিক্রিয়ায় একজনের আত্মহত্যা, আরেকজনের মৃত্যুর খবর পেয়ে মুশফিকুর রহমান কী সুন্দর বিবৃতিটাই না দিলেন। কী চমৎকার দায়িত্বশীলতার পরিচয়ই না পেলাম আমাদের অধিনায়কের কাছে।
আমরাই তো চ্যাম্পিয়ন।
জাতি হিসেবে আমাদের সাফল্যের ধারা যদি অব্যাহত থাকে, শিক্ষায়-দীক্ষায়, সভ্যতায়-ভব্যতায়, আচার-ব্যবহার-সুশৃঙ্খলায় আমরা জাতি এগিয়ে যেতে থাকি, ক্রিকেটে কেবল এশিয়া কাপে নয়, বিশ্বকাপেও আমরাই হব চ্যাম্পিয়ন।
আজ ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবসের উজ্জ্বল দিনটি আমাদের সেই সুন্দর আগামীর আগমনবার্তাই যেন জানান দিচ্ছে।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments