সড়ক দুর্ঘটনা-নক্ষত্রগুলো ঝরে পড়ছে by রাশেদ মেহেদী

তারেক মাসুদের খুব সামান্য সানি্নধ্য পেয়েছিলাম, বাকিটা সময় তিনি ছিলেন দূর থেকে দেখা কাছের মানুষ। কিন্তু ১৩ আগস্ট দুপুরে তার চলে যাওয়ার নির্মম সংবাদটি শোনার পর থেকে মন কিছুতেই মানছে না। সবসময় তারেক মাসুদের মুখটা চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে।


কিসের যেন তীব্র কষ্ট! হয়তো খুব বেশি অসহায়
বোধ করার কষ্ট তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীর চলে যাওয়ার পর কেমন অসহায় মনে হচ্ছে নিজেদের। ওই দুটি অতি উজ্জ্বল মুখের কথা মনে হলেই কেমন একটা শূন্যতা তীব্রভাবে গ্রাস করছে। চোখ দিয়ে জল গড়ায় না, কিন্তু নিজের চেতনার অনেক গভীর থেকে একটা বোবা কান্না সমস্ত অনুভূতিকে নিস্তব্ধ করে দেয়। চারপাশের ভয়ঙ্কর অরাজকতার কাছে আমরা যেন সবাই খুব তুচ্ছ হয়ে গেছি। যারা এই অরাজকতার জন্ম দেয় কিংবা নিয়ন্ত্রণ করে তাদের কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করা ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় নেই। এই অসহায়ত্ব আরও বাড়িয়ে দিয়েছে তথাকথিত নামি হাসপাতালে চিকিৎসকের অবহেলায় স্বনামধন্য লোকসঙ্গীত গবেষক ড. মৃদুল কান্তির চলে যাওয়ার ঘটনা। অনেক সৃষ্টির সম্ভাবনা বুকে নিয়ে আমাদের নক্ষত্রগুলো অকালে ঝরে যাচ্ছে। বারবার রাজপথে নামছে শোক মিছিল। কারও চলে যাওয়া ভাবায়, কারও চলে যাওয়া কাঁদায়।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলাম। সেই সুবাদেই তারেক মাসুদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে একবার 'মুক্তির গান', আর একবার 'মুক্তির কথা'র প্রদর্শনীর আয়োজন করতে গিয়ে বেশ কয়েকবার আলাপ হয়েছে তারেক মাসুদের সঙ্গে। খুব কম সময়ে অনেক বেশি কাছে টানার অদ্ভুত এক ক্ষমতা ছিল তার। সেই সময় থেকেই তাকে খুব কাছের একজন মনে হতো। ২০০২ সালে 'মাটির ময়না'র নির্মাণ শেষ হওয়ার পর তৎকালীন জোট সরকারের সেন্সর বোর্ড ছবিটি প্রথমে আটকে দিয়েছিল একেবারে যুক্তিহীনভাবে। রাজপথে মিছিল-মিটিং, প্রতিবাদের পর সরকার 'মাটির ময়না' মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছিল। সে সময় দৈনিক সংবাদের জন্য সাক্ষাৎকার নিতে তার বাসায় গিয়েছিলাম। সন্ধ্যার সময় প্রায় দুই ঘণ্টা আলাপ হয়েছিল চলচ্চিত্রের নানা প্রসঙ্গ নিয়ে। সেদিনের আলাপের একটা কথা এখন খুব প্রাণে বাজে। 'একটা বিষয় লক্ষ্য কর, আমাদের চলচ্চিত্রের দুই নক্ষত্র অপঘাতে, অবেলায় চলে গেছেন। জহির রায়হান হারিয়ে গেলেন, আলমগীর কবীর বাঁচতে পারলেন না। আলমগীর কবীরের অকালে চলে যাওয়াটা আমাদের চলচ্চিত্রের জন্য একটা বড় ক্ষতি হয়েছে। তিনি একটা উর্বর ক্ষেত্র তৈরি করার সব আয়োজন চূড়ান্ত করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে খুব তুচ্ছভাবে চলে গেলেন।' জহির রায়হান, আলমগীর কবীর ট্র্যাজেডির যাত্রাপথের সঙ্গী হলেন তারেক মাসুদ নিজেও। বাংলা চলচ্চিত্রের তিন রত্নের একইভাবে চলে যাওয়া! জহির রায়হান, আলমগীর কবীরের পর তারেক মাসুদই সার্থকভাবে বাংলা চলচ্চিত্রের নিজস্ব ভাষা নির্মাণ করেছিলেন। তার 'অন্তর্যাত্রা' দেখার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের মধ্যে এমন আলাপও হয়েছে, তারেক মাসুদের নাম এখন নিঃসন্দেহে মৃণাল সেন কিংবা বুদ্ধদেব দাসগুপ্তের পাশে সমানভাবে লেখা যায়। যুক্তিটা ছিল এ রকম, মৃণাল সেনের ছবিতে রাজনীতির জটিল অনুষঙ্গগুলো প্রবল হয়ে ওঠে, বুদ্ধদেব দাসগুপ্তের প্রতিটি ছবি যেন সেলুলয়েডে লেখা ধ্রুপদী কবিতা। তারেক মাসুদের 'অন্তর্যাত্রা'য় অন্তরের ভেতরের রাজনীতি কবিতার ছন্দে মূর্ত হয়ে উঠেছে। এই যুক্তি নিছক বন্ধুদের আড্ডার যুক্তি। চলচ্চিত্র বোদ্ধাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে। কিন্তু আমাদের ক্ষুদ্র বিবেচনায় এমনটা মনে হয়েছে। তারেক মাসুদের খুব সামান্য সানি্নধ্য পেয়েছিলাম, বাকিটা সময় তিনি ছিলেন দূর থেকে দেখা কাছের মানুষ। কিন্তু ১৩ আগস্ট দুপুরে তার চলে যাওয়ার নির্মম সংবাদটি শোনার পর থেকে মন কিছুতেই মানছে না। সবসময় তারেক মাসুদের মুখটা চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে। কিসের যেন তীব্র কষ্ট! হয়তো খুব বেশি অসহায় বোধ করার কষ্ট।
শহীদ মুনীর চৌধুরীর পুত্র মিশুক মুনীরের নামটা প্রথম শুনেছিলাম আবু রেজওয়ান ইউরেকার কাছে। ২০০০ সালে একুশে টেলিভিশনের প্রথম যাত্রায় তিনি সেখানে ভিডিও সম্পাদনার কাজ করতেন। সে সময় এক আড্ডায় তিনি উচ্ছ্বসিত গল্প করেছিলেন তাদের 'হেড অব নিউজ অপারেশন' মিশুক মুনীরকে নিয়ে। তার ভাষায় অসাধারণ মেধাবী মানুষ, প্রাণবন্ত মানুষ। আবু রেজওয়ান ইউরেকা এখন এটিএন নিউজে কাজ করছেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মিশুক মুনীর যে প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী এবং প্রধান সম্পাদক ছিলেন। ১৩ আগস্টের সেই ভয়াবহ সংবাদ শোনার পর প্রথম গিয়েছিলাম এটিএন নিউজ কার্যালয়ে। এত তীব্র শোকার্ত পরিবেশ সম্ভবত আগে কখনও কোথাও দেখিনি। প্রতিষ্ঠানের প্রধান নন, হৃদয়ের খুব কাছের মানুষ না হলে সব সহকর্মীর চোখের জল এভাবে অঝোর ধারায় ঝরে না। গণমাধ্যম কর্মীদের কান্না এখনও থামেনি। বরং শোকের মুহূর্তে দায়িত্বশীল কারও কারও বোধহীন হাসিমাখা মুখ কান্নাকে ক্রোধে পরিণত করছে।
সড়ক দুর্ঘটনার কাছে সত্যিই আমরা খুব অসহায়। এই ভয়ঙ্কর মৃত্যুফাঁদের শিকার হয়ে আরও নতুন মৃত্যু সংবাদের জন্য অপেক্ষা কিংবা নিজেই এর শিকার হওয়ার দুশ্চিন্তা ছাড়া সড়ক দুর্ঘটনার বিরুদ্ধে কিছুই করার নেই। কয়েকদিন আগে রাত ৯টার দিকে তিন নম্বর লোকাল বাসে মহাখালী থেকে খিলক্ষেত যাচ্ছি। বিশ্বরোড ক্রসিং পার হওয়ার মুহূর্তে আমাদের বাসচালকের কী খেয়াল হলো, সামনের একটি ট্রাককে অতিক্রম করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠল। মুহূর্তে গতি বাড়িয়ে দিল এবং বিপজ্জনকভাবে ডান লেনে এসে ট্রাককে ওভারটেক করল। একটু পরেই এসে ওই ট্রাক এসে ধাক্কা দিল আমাদের গাড়িকে। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম ট্রাকের ড্রাইভার কুৎসিত একটা হাসি দিয়ে কী যেন বলছিল। কয়েক মুহূর্ত পরে ট্রাকটি চলে গেল। যাত্রীরা তখন হৈচৈ করছে। চালককে কেউ গালি দিচ্ছে। এর মধ্যে চালক এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটাল। একেবারে রাস্তার মাঝখানে গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করে সিটে হেলান দিয়ে বসে পড়ল। তার সে কী আস্ফালন, 'হাউখাউ বন্ধ না হলে গাড়ি যাবে না।' আমাদের গাড়ি রাস্তার মাঝখানে দাঁড়ানোর কারণে ছোটখাটো যানজটেরও সৃষ্টি হয়েছে। চালকের কোনো খেয়াল নেই। ট্রাফিক পুলিশেরও দেখা নেই। শেষ পর্যন্ত মাঝবয়সী একজন যাত্রী দায়িত্ব নিয়ে সবাইকে চুপ করালেন। চালক গাড়ি স্টার্ট নিল। আরও একদিন বেলাল পরিবহনের একটা বাসে ফার্মগেট থেকে খিলক্ষেত যাচ্ছি। মহাখালী ফ্লাইওভারে উঠে আর একটা বাসের সঙ্গে ওভারটেকিং প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত হয়ে উঠল। এক পর্যায়ে আমাদের গাড়ি সামনের গাড়ির গা ঘেঁষে ঘরঘর শব্দ করে ওভারটেক করল ভয়ঙ্কর ঝুঁকি নিয়ে। আমি বিষয়টি সঙ্গে সঙ্গে বেলাল পরিবহনের এক পরিচালককে জানিয়েছিলাম। তিনি পরে আমাকে জানালেন, তার ওই গাড়ির চালক বিষয়টি অস্বীকার করেছে, অতএব কী আর করা!

রাশেদ মেহেদী : সাংবাদিক
 

No comments

Powered by Blogger.