সন্ত্রাসবাদ-তালেবানকে শান্তি আলোচনায় আনতে ব্যর্থ পাকিস্তান by হামিদ মির
আল-কায়েদার নেতা ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যুর পর যুক্তরাষ্ট্র মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তালেবানের সঙ্গে শান্তিচুক্তিতে পৌঁছাতে। বহু পাকিস্তানি প্রশ্ন তুলছেন, ওয়াশিংটন যদি তালেবানের সঙ্গে আলোচনায় যেতে পারে, তাহলে ইসলামাবাদ পিছিয়ে থাকবে কেন? কিন্তু বাস্তব সত্য হলো,
তখনই কেবল পাকিস্তান তালেবানের সঙ্গে আলোচনা শুরু করতে পারে, যখন আফগান তালেবানেরা আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় বসবে। অন্যথায় পাকিস্তান ও তালেবানের মধ্যে আলোচনা যেকোনো সময় ভণ্ডুল করে দিতে পারে ওয়াশিংটন। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় যেতে আফগান তালেবানকে রাজি করাতে পাকিস্তান সাম্প্রতিক সময়ে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত অগ্রগতি হয়নি। গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বদের মধ্যে খুব কমসংখ্যকই জানেন, আফগান ও পাকিস্তানি তালেবানের শীর্ষ নেতৃত্ব এ মুহূর্তে কাবুল বা ইসলামাবাদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে আগ্রহী নন। কেননা তাঁরা মনে করেন, গ্রীষ্মকাল ‘আলোচনার সময়’ নয়। গরম আবহাওয়া তাঁদের কাছে ‘যুদ্ধের সময়’। গত কয়েক দিনে আফগান তালেবান বহু মার্কিন সেনাকে হত্যা করেছে। কিন্তু মার্কিন প্রশাসন এখনো কয়েকজন ব্যক্তির দিকে চেয়ে আছে, যাঁরা তালেবানের সঙ্গে তাদের শান্তি আলোচনার সুযোগ তৈরি করে দেবেন।
তালেবান ও ওয়াশিংটনের মধ্যে গোপনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ যোগাযোগ বহু দিন ধরে আছে—এমন দাবি মার্কিন গণমাধ্যমে করা হচ্ছে। গত বছর খবর বেরোয়, তালেবানের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনে যুক্তরাষ্ট্রকে সহায়তা করছে সৌদি আরব। কিন্তু সৌদি কর্তৃপক্ষ এ খবর নাকচ করে দেয়। ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি লন্ডন সম্মেলনে হিলারি ক্লিনটন আফগানিস্তানে তালেবানের সঙ্গে আলোচনার প্রতি তাঁর সমর্থন ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, ‘বিদ্রোহের অবসান ঘটাতে চাইলে শত্রুর সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার ব্যাপারে আপনাকে ইচ্ছুক হতে হবে।’ কয়েক সপ্তাহ আগে ভয়েস অব আমেরিকা জানায়, ন্যাটোর সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ করার জন্য তুরস্ক তালেবানকে আঙ্কারায় তাদের দপ্তর খুলতে দেবে। তখন জার্মান ম্যাগাজিন দের স্পিগেল দাবি করে, জার্মানরা যুক্তরাষ্ট্রকে সহায়তা দিচ্ছে মোল্লা ওমরের সঙ্গে তাঁর সাবেক মুখপাত্র তাইয়্যেব আগার মাধ্যমে আলোচনার বিষয়ে। কিন্তু জার্মান কর্মকর্তারা এখনো এ খবর নিশ্চিত করেননি।
নিউইয়র্ক টাইমস দাবি করেছে, গত দুই সপ্তাহে মার্কিন কর্মকর্তারা অন্তত তিনবার তাইয়্যেব আগার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। ইসলামাবাদেও এমন খবর চাউর হয়েছে, তাইয়্যেব আগাকে মার্কিন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলতে প্ররোচিত করেছে পাকিস্তানও। কিন্তু বড় অগ্রগতি হয়নি। কেননা, আট বছর ধরে আগা আর মোল্লা ওমরের ঘনিষ্ঠ নন। মোল্লা ওমরের ঘনিষ্ঠ সব নির্ভরযোগ্য তালেবান সূত্র পশ্চিমা গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর নাকচ করে দিচ্ছে। তালেবান মুখপাত্র জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ আফগানিস্তান থেকে টেলিফোনে আমাকে বলেছেন, ‘এটা মার্কিন মিথ্যা প্রচারণা। তারা আমাদের নানা স্তরের কর্মীদের মধ্যে মতবিরোধ সৃষ্টি করতে চায়। একদিকে তারা গত সপ্তাহে মোল্লা ওমরের মৃত্যুর বিষয়ে ভিত্তিহীন গুজব ছড়িয়েছে, অন্যদিকে তারা বলেছে মার্কিন কর্মকর্তাদের সঙ্গে তালেবানের সাক্ষাতের কথা। এটা সত্য নয়। তারা যদি আলোচনা চায়, তাহলে প্রথমে ওবামাকে প্রকাশ্যে সেই ঘোষণা দিতে হবে এবং তাঁকে মেনে নিতে হবে যে আফগানিস্তানে আক্রমণ করে যুক্তরাষ্ট্র ভুল কাজ করেছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘মার্কিনরা আমাদের পদাতিক সেনাদের পরাজিত করতে ৫০ কোটি ডলারের তহবিল গঠন করেছে। এ খবর আমরা রাখি। আমাদের সেনারা কান্দাহারে অস্ত্র সমর্পণ করেছে বলে বহু নাটক তারা সংঘটিত করেছে। কিন্তু নাটকে কাজ হলো না। তাই এখন তারা আমাদের নেতাদের সঙ্গে আলোচনার কৃপা চাইছে।’
৫০ কোটি ডলারে আফগান তালেবানকে কিনতে পারবে যুক্তরাষ্ট্র? এখনই আলোচনার জন্য কেন তালেবান প্রস্তুত নয়? জবাব খুব সোজা। কাবুল, ইসলামাবাদ ও ওয়াশিংটনের কাউকে বিশ্বাস করে না তারা। মজার ব্যাপার, আফগান প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই মনে করেন, পাকিস্তান যদি আফগান তালেবানের ওপর কিছুটা চাপ প্রয়োগ করত, তাহলে তারা নিশ্চয়ই আলোচনা শুরু করতে রাজি হতো।
আইএসআইয়ের প্রতি মোল্লা ওমর ক্ষিপ্ত কেন? প্রথমত, মোল্লা ওমরের নিশ্চিত ধারণা, বেশ কয়েকজন শীর্ষ তালেবান কমান্ডারকে (যেমন: মোল্লা সাদুল্লা) হত্যায় সিআইএকে সহায়তার জন্য আইএসআই দায়ী। দ্বিতীয়ত, আইএসআই মোল্লা ওমরের ডেপুটি মোল্লা আবদুল গনি ব্রাদারকে ২০১০ সালে করাচি থেকে গ্রেপ্তার করে এবং তারপর গুজব ছড়ায়, ব্রাদার সিআইএর যোগাযোগের মধ্যে ছিলেন এবং তালেবান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছিলেন তিনি। বর্তমানে মোল্লা ব্রাদার আইএসআইয়ের হেফাজতে।
তাঁকে ব্যবহার করে আইএসআই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন তালেবান নেতার সঙ্গে যোগাযোগের রাস্তা খুলতে। কিন্তু ব্রাদারের অবস্থান এখন মোল্লা আবদুল সালাম জাইফের মতোই। জাইফ দীর্ঘদিন কাবুলে মার্কিন হেফাজতে থাকার পর এখন খাঁচার ভেতর পাখির মতো বসবাস করছেন কাবুলে। তাঁর চলাফেরার ওপর নিষেধাজ্ঞা আছে। ২০০১ সালে মোল্লা জাইফ পাকিস্তানে তালেবান-নিযুক্ত আফগান রাষ্ট্রদূত ছিলেন।
তালেবান-বৃত্তে মোল্লা জাইফ অত্যন্ত সম্মানিত, কেননা কারজাই সরকারের মন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন। জাইফ সেসব তালেবানের প্রতিনিধি, যারা শুধু ওয়াশিংটন ও কাবুলকে ঘৃণা করে তা-ই নয়, ইসলামাবাদের নীতিনির্ধারকদেরও তারা বড় অপছন্দ করে। মোল্লা জাইফ সম্প্রতি প্রকাশিত তাঁর আত্মজীবনীতে কাবুল, ওয়াশিংটন ও ইসলামাবাদের নীতির কঠোর সমালোচনা করেছেন। ২০০১ সালে মার্কিন বিমানঘাঁটি করতে দিয়ে আফগানদের হত্যা করার পথ করে দেওয়ার জন্য তিনি পাকিস্তানকে অভিযুক্ত করেছেন।
ইসলামাবাদ সম্পর্কে পাকিস্তানি তালেবানের চিন্তাভাবনা আফগান তালেবানের চেয়ে ভিন্ন নয়। তারা জানে, মার্কিন ড্রোন পাকিস্তানি ঘাঁটি থেকেই উড়ছে। সে কারণে পাকিস্তানি ঘাঁটিগুলোতেই তারা আক্রমণ শুরু করেছে। আফগান তালেবানের চেয়ে পাকিস্তানি তালেবান অনেক বেশি বিপজ্জনক। এই পাকিস্তানিরা কোনো বিদেশি দখলদারের বিরুদ্ধে লড়াই করছে না। তারা নিজেদের দেশের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। তারা স্বাধীনতার মহৎ উদ্দেশ্যেও লড়াই করছে না। তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো প্রতিশোধ। কেউ কেউ লড়াই করছে উপজাতীয় এলাকায়, তাদের ঘরবাড়ি বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়ার কারণে। কেউ বা লড়াই করছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দ্বারা প্রতারিত হয়েছে মনে করে। ইলিয়াস কাশ্মীরি তাদের একজন। তিনি কাশ্মীর প্রতিরোধ বাহিনীর অংশ ছিলেন। তিনি ২০০৩ সালে গ্রেপ্তার হন এবং পারভেজ মোশাররফকে হত্যার ষড়যন্ত্রের অভিযোগে তাঁর ওপর নির্মম নির্যাতন চালানো হয়। মুক্তি পাওয়ার পর তিনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে গঠিত আত্মঘাতী স্কোয়াডের সদস্য হন। আফগান তালেবান একক নেতৃত্বের অধীনে ঐক্যবদ্ধ হলেও পাকিস্তান তালেবানের চেইন অব কমান্ড নেই। ইসলামাবাদে লাল মসজিদ অভিযানের পর ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে বায়তুল্লাহ মেহসুদের নেতৃত্বে তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) প্রতিষ্ঠিত হয়। টিটিপি প্রতিষ্ঠার আগে এই জঙ্গিরা সেনাবাহিনীর সঙ্গে বহুবার শান্তি আলোচনায় মিলিত হয়েছে। মার্কিন ড্রোন সব শান্তি আলোচনাই ভণ্ডুল করে দিয়েছে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানের মৌলভি নেক মোহাম্মদের সঙ্গে ২০০৪ সালের ২৭ মার্চ প্রথম শান্তিচুক্তিতে সই করে। কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে ২০০৪ সালের ১৮ জুন মৌলভি নেক মোহাম্মদ মার্কিন ড্রোন হামলায় নিহত হন। সেটাই ছিল পাকিস্তানে নতুন করে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সূচনা। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আবদুল্লাহ মেহসুদের বিরুদ্ধে বায়তুল্লাহ মেহসুদকে মদদ দিয়েছিল। ২০০৫ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি বায়তুল্লাহ মেহসুদের সঙ্গে শান্তিচুক্তি সই হয়। সিদ্ধান্ত হয়, বায়তুল্লাহ মেহসুদ বিদেশি জঙ্গিদের সহায়তা করবেন না। কিন্তু ২০০৫ সালের ১৪ মে আরেকটি ড্রোন হামলা হয়। বাজৌরে আরেকটি শান্তি উদ্যোগ যখন চলছিল, তখন ২০০৬ সালের ৩০ অক্টোবর সেখানকার একটি মাদ্রাসায় আবার মার্কিন ড্রোন হামলা হয়। এতে দক্ষিণ ও উত্তর ওয়াজিরিস্তানের জঙ্গি পরিবারের বহু সদস্যসহ ৮০টি ছেলে নিহত হয়। এ হামলার ফলে আফগান সীমান্তবর্তী উপজাতীয় এলাকায় নতুন নতুন জঙ্গি গ্রুপের জন্ম হয়। চূড়ান্তভাবে ২০০৭ সালের জুলাইয়ে লাল মসজিদ অভিযান জঙ্গিবাদের প্রসার ঘটায় এবং পাকিস্তানকে প্রতিদিন আত্মঘাতী বোমা হামলার মুখে ঠেলে দেয়।
২০০৮ সালের অক্টোবরে পাকিস্তান পার্লামেন্টে প্রস্তাব পাস করে, ‘আমাদের ভূখণ্ড অন্য কোনো দেশের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে দেব না এবং যারা দেশের আইন মেনে চলে, তাদের সবার সঙ্গে সংলাপ শুরু করা হবে।’ দুর্ভাগ্যজনক হলো, এই প্রস্তাব বাস্তবায়িত হয়নি। পাকিস্তান সরকার সোয়াতে তালেবানের সঙ্গে শান্তি প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী ছিল, কিন্তু তা প্রত্যাখ্যাত হয়। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র তালেবানের সঙ্গে শান্তি উদ্যোগের বিরোধিতা করে। চূড়ান্তভাবে তালেবানপন্থী ধর্মীয় নেতা সুফি মোহাম্মদের সঙ্গে চুক্তি সই হয়। কিন্তু পরে প্রমাণিত হয়, তালেবানের ওপর তার কোনো প্রভাবই ছিল না। পাকিস্তান পার্লামেন্ট ২০১১ সালের ১৩ মে আরেকটি প্রস্তাব নেয়। এই প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্মূল্যায়ন ও পুনর্বিবেচনার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানানোর পাশাপাশি বালুচসহ সব বিদ্রোহী গ্রুপের সঙ্গে আলোচনার যে প্রস্তাব ২০০৮ সালে নেওয়া হয়েছিল, তার প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করা হয়।
বালুচদের সঙ্গে আলোচনার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের আপত্তি নেই। কিন্তু আফগান তালেবান তাদের (যুক্তরাষ্ট্র) সঙ্গে আলোচনার ক্ষেত্র প্রস্তুত না করা পর্যন্ত তালেবানের সঙ্গে আলোচনা শুরু করতে দিতে তারা রাজি নয়।
সংখ্যাগরিষ্ঠ পাকিস্তানি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের যে যুদ্ধ, তা থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। গত তিন বছরে ইরাক ও আফগানিস্তানের চেয়েও বেশি বোমা বিস্ফোরণ ও আত্মঘাতী হামলার সম্মুখীন হয়েছে পাকিস্তান। তালেবান ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়ের দিক থেকে আক্রমণের মুখে পাকিস্তান।
গত নয় বছরে পাকিস্তান ওয়াশিংটনের কাছ থেকে ৬৮ বিলিয়ন ডলার ক্ষতির মুখে পড়েছে আর সাহায্য পেয়েছে ১৫ বিলিয়ন ডলার। ক্ষতি ও প্রাপ্তির ব্যবধান বিশাল। অন্যদিকে, মানুষ নিহত হয়েছে অবিশ্বাস্য সংখ্যায়। ৯/১১-এর পর পাকিস্তানে বোমা বিস্ফোরণ ও আত্মঘাতী হামলায় ৩৫ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। অন্যদিকে, আফগানিস্তানে এক হাজার ৫০০ মার্কিন সেনা মারা গেছে। তালেবানের সঙ্গে পাকিস্তানের শান্তি প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন। কিন্তু ইসলামাবাদকে বিশ্বাস করে না তালেবান। আলোচনায় সম্মত না হলে কী উপায়? একমাত্র সমাধান, জাতীয় মতৈক্যের ভিত্তিতে উপজাতীয় এলাকায় তালেবানের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত অভিযানে যাওয়া। মার্কিনের যুদ্ধে তথাকথিত মিত্র হয়ে যত দিন থাকবে পাকিস্তান, তত দিন জাতীয় মতৈক্য আসবে না। পাকিস্তান অন্তত যুক্তরাষ্ট্রকে ড্রোন হামলা চালানোর কাজে তার বিমানঘাঁটি ব্যবহার বন্ধ করতে পারে। এতে যুক্তরাষ্ট্র ক্রুদ্ধ হবে। কিন্তু পাকিস্তানিদের জন্যও অন্য পথ নেই। পাকিস্তানিদের বেছে নিতে হবে যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের মধ্যে কোনো একটিকে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
হামিদ মির: পাকিস্তানের জিয়ো টিভির নির্বাহী সম্পাদক।
তালেবান ও ওয়াশিংটনের মধ্যে গোপনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ যোগাযোগ বহু দিন ধরে আছে—এমন দাবি মার্কিন গণমাধ্যমে করা হচ্ছে। গত বছর খবর বেরোয়, তালেবানের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনে যুক্তরাষ্ট্রকে সহায়তা করছে সৌদি আরব। কিন্তু সৌদি কর্তৃপক্ষ এ খবর নাকচ করে দেয়। ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি লন্ডন সম্মেলনে হিলারি ক্লিনটন আফগানিস্তানে তালেবানের সঙ্গে আলোচনার প্রতি তাঁর সমর্থন ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, ‘বিদ্রোহের অবসান ঘটাতে চাইলে শত্রুর সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার ব্যাপারে আপনাকে ইচ্ছুক হতে হবে।’ কয়েক সপ্তাহ আগে ভয়েস অব আমেরিকা জানায়, ন্যাটোর সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ করার জন্য তুরস্ক তালেবানকে আঙ্কারায় তাদের দপ্তর খুলতে দেবে। তখন জার্মান ম্যাগাজিন দের স্পিগেল দাবি করে, জার্মানরা যুক্তরাষ্ট্রকে সহায়তা দিচ্ছে মোল্লা ওমরের সঙ্গে তাঁর সাবেক মুখপাত্র তাইয়্যেব আগার মাধ্যমে আলোচনার বিষয়ে। কিন্তু জার্মান কর্মকর্তারা এখনো এ খবর নিশ্চিত করেননি।
নিউইয়র্ক টাইমস দাবি করেছে, গত দুই সপ্তাহে মার্কিন কর্মকর্তারা অন্তত তিনবার তাইয়্যেব আগার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। ইসলামাবাদেও এমন খবর চাউর হয়েছে, তাইয়্যেব আগাকে মার্কিন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলতে প্ররোচিত করেছে পাকিস্তানও। কিন্তু বড় অগ্রগতি হয়নি। কেননা, আট বছর ধরে আগা আর মোল্লা ওমরের ঘনিষ্ঠ নন। মোল্লা ওমরের ঘনিষ্ঠ সব নির্ভরযোগ্য তালেবান সূত্র পশ্চিমা গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর নাকচ করে দিচ্ছে। তালেবান মুখপাত্র জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ আফগানিস্তান থেকে টেলিফোনে আমাকে বলেছেন, ‘এটা মার্কিন মিথ্যা প্রচারণা। তারা আমাদের নানা স্তরের কর্মীদের মধ্যে মতবিরোধ সৃষ্টি করতে চায়। একদিকে তারা গত সপ্তাহে মোল্লা ওমরের মৃত্যুর বিষয়ে ভিত্তিহীন গুজব ছড়িয়েছে, অন্যদিকে তারা বলেছে মার্কিন কর্মকর্তাদের সঙ্গে তালেবানের সাক্ষাতের কথা। এটা সত্য নয়। তারা যদি আলোচনা চায়, তাহলে প্রথমে ওবামাকে প্রকাশ্যে সেই ঘোষণা দিতে হবে এবং তাঁকে মেনে নিতে হবে যে আফগানিস্তানে আক্রমণ করে যুক্তরাষ্ট্র ভুল কাজ করেছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘মার্কিনরা আমাদের পদাতিক সেনাদের পরাজিত করতে ৫০ কোটি ডলারের তহবিল গঠন করেছে। এ খবর আমরা রাখি। আমাদের সেনারা কান্দাহারে অস্ত্র সমর্পণ করেছে বলে বহু নাটক তারা সংঘটিত করেছে। কিন্তু নাটকে কাজ হলো না। তাই এখন তারা আমাদের নেতাদের সঙ্গে আলোচনার কৃপা চাইছে।’
৫০ কোটি ডলারে আফগান তালেবানকে কিনতে পারবে যুক্তরাষ্ট্র? এখনই আলোচনার জন্য কেন তালেবান প্রস্তুত নয়? জবাব খুব সোজা। কাবুল, ইসলামাবাদ ও ওয়াশিংটনের কাউকে বিশ্বাস করে না তারা। মজার ব্যাপার, আফগান প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই মনে করেন, পাকিস্তান যদি আফগান তালেবানের ওপর কিছুটা চাপ প্রয়োগ করত, তাহলে তারা নিশ্চয়ই আলোচনা শুরু করতে রাজি হতো।
আইএসআইয়ের প্রতি মোল্লা ওমর ক্ষিপ্ত কেন? প্রথমত, মোল্লা ওমরের নিশ্চিত ধারণা, বেশ কয়েকজন শীর্ষ তালেবান কমান্ডারকে (যেমন: মোল্লা সাদুল্লা) হত্যায় সিআইএকে সহায়তার জন্য আইএসআই দায়ী। দ্বিতীয়ত, আইএসআই মোল্লা ওমরের ডেপুটি মোল্লা আবদুল গনি ব্রাদারকে ২০১০ সালে করাচি থেকে গ্রেপ্তার করে এবং তারপর গুজব ছড়ায়, ব্রাদার সিআইএর যোগাযোগের মধ্যে ছিলেন এবং তালেবান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছিলেন তিনি। বর্তমানে মোল্লা ব্রাদার আইএসআইয়ের হেফাজতে।
তাঁকে ব্যবহার করে আইএসআই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন তালেবান নেতার সঙ্গে যোগাযোগের রাস্তা খুলতে। কিন্তু ব্রাদারের অবস্থান এখন মোল্লা আবদুল সালাম জাইফের মতোই। জাইফ দীর্ঘদিন কাবুলে মার্কিন হেফাজতে থাকার পর এখন খাঁচার ভেতর পাখির মতো বসবাস করছেন কাবুলে। তাঁর চলাফেরার ওপর নিষেধাজ্ঞা আছে। ২০০১ সালে মোল্লা জাইফ পাকিস্তানে তালেবান-নিযুক্ত আফগান রাষ্ট্রদূত ছিলেন।
তালেবান-বৃত্তে মোল্লা জাইফ অত্যন্ত সম্মানিত, কেননা কারজাই সরকারের মন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন। জাইফ সেসব তালেবানের প্রতিনিধি, যারা শুধু ওয়াশিংটন ও কাবুলকে ঘৃণা করে তা-ই নয়, ইসলামাবাদের নীতিনির্ধারকদেরও তারা বড় অপছন্দ করে। মোল্লা জাইফ সম্প্রতি প্রকাশিত তাঁর আত্মজীবনীতে কাবুল, ওয়াশিংটন ও ইসলামাবাদের নীতির কঠোর সমালোচনা করেছেন। ২০০১ সালে মার্কিন বিমানঘাঁটি করতে দিয়ে আফগানদের হত্যা করার পথ করে দেওয়ার জন্য তিনি পাকিস্তানকে অভিযুক্ত করেছেন।
ইসলামাবাদ সম্পর্কে পাকিস্তানি তালেবানের চিন্তাভাবনা আফগান তালেবানের চেয়ে ভিন্ন নয়। তারা জানে, মার্কিন ড্রোন পাকিস্তানি ঘাঁটি থেকেই উড়ছে। সে কারণে পাকিস্তানি ঘাঁটিগুলোতেই তারা আক্রমণ শুরু করেছে। আফগান তালেবানের চেয়ে পাকিস্তানি তালেবান অনেক বেশি বিপজ্জনক। এই পাকিস্তানিরা কোনো বিদেশি দখলদারের বিরুদ্ধে লড়াই করছে না। তারা নিজেদের দেশের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। তারা স্বাধীনতার মহৎ উদ্দেশ্যেও লড়াই করছে না। তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো প্রতিশোধ। কেউ কেউ লড়াই করছে উপজাতীয় এলাকায়, তাদের ঘরবাড়ি বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়ার কারণে। কেউ বা লড়াই করছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দ্বারা প্রতারিত হয়েছে মনে করে। ইলিয়াস কাশ্মীরি তাদের একজন। তিনি কাশ্মীর প্রতিরোধ বাহিনীর অংশ ছিলেন। তিনি ২০০৩ সালে গ্রেপ্তার হন এবং পারভেজ মোশাররফকে হত্যার ষড়যন্ত্রের অভিযোগে তাঁর ওপর নির্মম নির্যাতন চালানো হয়। মুক্তি পাওয়ার পর তিনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে গঠিত আত্মঘাতী স্কোয়াডের সদস্য হন। আফগান তালেবান একক নেতৃত্বের অধীনে ঐক্যবদ্ধ হলেও পাকিস্তান তালেবানের চেইন অব কমান্ড নেই। ইসলামাবাদে লাল মসজিদ অভিযানের পর ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে বায়তুল্লাহ মেহসুদের নেতৃত্বে তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) প্রতিষ্ঠিত হয়। টিটিপি প্রতিষ্ঠার আগে এই জঙ্গিরা সেনাবাহিনীর সঙ্গে বহুবার শান্তি আলোচনায় মিলিত হয়েছে। মার্কিন ড্রোন সব শান্তি আলোচনাই ভণ্ডুল করে দিয়েছে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানের মৌলভি নেক মোহাম্মদের সঙ্গে ২০০৪ সালের ২৭ মার্চ প্রথম শান্তিচুক্তিতে সই করে। কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে ২০০৪ সালের ১৮ জুন মৌলভি নেক মোহাম্মদ মার্কিন ড্রোন হামলায় নিহত হন। সেটাই ছিল পাকিস্তানে নতুন করে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সূচনা। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আবদুল্লাহ মেহসুদের বিরুদ্ধে বায়তুল্লাহ মেহসুদকে মদদ দিয়েছিল। ২০০৫ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি বায়তুল্লাহ মেহসুদের সঙ্গে শান্তিচুক্তি সই হয়। সিদ্ধান্ত হয়, বায়তুল্লাহ মেহসুদ বিদেশি জঙ্গিদের সহায়তা করবেন না। কিন্তু ২০০৫ সালের ১৪ মে আরেকটি ড্রোন হামলা হয়। বাজৌরে আরেকটি শান্তি উদ্যোগ যখন চলছিল, তখন ২০০৬ সালের ৩০ অক্টোবর সেখানকার একটি মাদ্রাসায় আবার মার্কিন ড্রোন হামলা হয়। এতে দক্ষিণ ও উত্তর ওয়াজিরিস্তানের জঙ্গি পরিবারের বহু সদস্যসহ ৮০টি ছেলে নিহত হয়। এ হামলার ফলে আফগান সীমান্তবর্তী উপজাতীয় এলাকায় নতুন নতুন জঙ্গি গ্রুপের জন্ম হয়। চূড়ান্তভাবে ২০০৭ সালের জুলাইয়ে লাল মসজিদ অভিযান জঙ্গিবাদের প্রসার ঘটায় এবং পাকিস্তানকে প্রতিদিন আত্মঘাতী বোমা হামলার মুখে ঠেলে দেয়।
২০০৮ সালের অক্টোবরে পাকিস্তান পার্লামেন্টে প্রস্তাব পাস করে, ‘আমাদের ভূখণ্ড অন্য কোনো দেশের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে দেব না এবং যারা দেশের আইন মেনে চলে, তাদের সবার সঙ্গে সংলাপ শুরু করা হবে।’ দুর্ভাগ্যজনক হলো, এই প্রস্তাব বাস্তবায়িত হয়নি। পাকিস্তান সরকার সোয়াতে তালেবানের সঙ্গে শান্তি প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী ছিল, কিন্তু তা প্রত্যাখ্যাত হয়। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র তালেবানের সঙ্গে শান্তি উদ্যোগের বিরোধিতা করে। চূড়ান্তভাবে তালেবানপন্থী ধর্মীয় নেতা সুফি মোহাম্মদের সঙ্গে চুক্তি সই হয়। কিন্তু পরে প্রমাণিত হয়, তালেবানের ওপর তার কোনো প্রভাবই ছিল না। পাকিস্তান পার্লামেন্ট ২০১১ সালের ১৩ মে আরেকটি প্রস্তাব নেয়। এই প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্মূল্যায়ন ও পুনর্বিবেচনার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানানোর পাশাপাশি বালুচসহ সব বিদ্রোহী গ্রুপের সঙ্গে আলোচনার যে প্রস্তাব ২০০৮ সালে নেওয়া হয়েছিল, তার প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করা হয়।
বালুচদের সঙ্গে আলোচনার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের আপত্তি নেই। কিন্তু আফগান তালেবান তাদের (যুক্তরাষ্ট্র) সঙ্গে আলোচনার ক্ষেত্র প্রস্তুত না করা পর্যন্ত তালেবানের সঙ্গে আলোচনা শুরু করতে দিতে তারা রাজি নয়।
সংখ্যাগরিষ্ঠ পাকিস্তানি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের যে যুদ্ধ, তা থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। গত তিন বছরে ইরাক ও আফগানিস্তানের চেয়েও বেশি বোমা বিস্ফোরণ ও আত্মঘাতী হামলার সম্মুখীন হয়েছে পাকিস্তান। তালেবান ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়ের দিক থেকে আক্রমণের মুখে পাকিস্তান।
গত নয় বছরে পাকিস্তান ওয়াশিংটনের কাছ থেকে ৬৮ বিলিয়ন ডলার ক্ষতির মুখে পড়েছে আর সাহায্য পেয়েছে ১৫ বিলিয়ন ডলার। ক্ষতি ও প্রাপ্তির ব্যবধান বিশাল। অন্যদিকে, মানুষ নিহত হয়েছে অবিশ্বাস্য সংখ্যায়। ৯/১১-এর পর পাকিস্তানে বোমা বিস্ফোরণ ও আত্মঘাতী হামলায় ৩৫ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। অন্যদিকে, আফগানিস্তানে এক হাজার ৫০০ মার্কিন সেনা মারা গেছে। তালেবানের সঙ্গে পাকিস্তানের শান্তি প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন। কিন্তু ইসলামাবাদকে বিশ্বাস করে না তালেবান। আলোচনায় সম্মত না হলে কী উপায়? একমাত্র সমাধান, জাতীয় মতৈক্যের ভিত্তিতে উপজাতীয় এলাকায় তালেবানের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত অভিযানে যাওয়া। মার্কিনের যুদ্ধে তথাকথিত মিত্র হয়ে যত দিন থাকবে পাকিস্তান, তত দিন জাতীয় মতৈক্য আসবে না। পাকিস্তান অন্তত যুক্তরাষ্ট্রকে ড্রোন হামলা চালানোর কাজে তার বিমানঘাঁটি ব্যবহার বন্ধ করতে পারে। এতে যুক্তরাষ্ট্র ক্রুদ্ধ হবে। কিন্তু পাকিস্তানিদের জন্যও অন্য পথ নেই। পাকিস্তানিদের বেছে নিতে হবে যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের মধ্যে কোনো একটিকে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
হামিদ মির: পাকিস্তানের জিয়ো টিভির নির্বাহী সম্পাদক।
No comments